ডিএসসিসির টাকা ফেরত দিতে মধুমতি ব্যাংকের গড়িমসি, পুরো সংস্থায় সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দুর্নীতির রাজত্ব ষ নিয়োগে মেয়রের পছন্দের লোক, ছাত্রলীগ ও গোপালগঞ্জের প্রার্থীদের প্রাধান্য

ডিএসসিসি এখনো তাপসের নিয়ন্ত্রণে

Daily Inqilab স্টাফ রিপোর্টার

১৮ জানুয়ারি ২০২৫, ০২:২০ এএম | আপডেট: ১৮ জানুয়ারি ২০২৫, ০২:২০ এএম

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র পদে ২০২০ সালের ১৬ মে দায়িত্ব নেন ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস। দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের ঘোষণা দেন। কিন্তু নিজে দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থানের কথা বললেও আসলে আধিপত্য বিস্তার করতে থাকেন। পুরো সংস্থায় সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দুর্নীতির রাজত্ব কায়েম করেন। গত চার বছরে বিভিন্ন বিভাগে জনবল নিয়োগ দেন অনেক। নিয়োগ পাওয়া বেশির ভাগ কর্মকর্তা-কর্মচারী মেয়রের পছন্দের লোক ও রাজনৈতিক পদবিধারী। চাকরি দেয়ার বিষয়ে তিনি ছাত্রলীগ ও গোপালগঞ্জের প্রার্থীদের প্রধান্য দিতেন। এ ছাড়া পার্কিং, মাঠ ও পার্ক, ফুডকোর্টসহ একই সিস্টেমে বিভিন্ন উন্নয়ন কাজের টেন্ডার কার্যক্রম করতেন তিনি। এখনো তার নিয়ন্ত্রণেই রয়েছে অনেককিছু। এক কথায় তাপস ছিলেন ডিএসসিসি আতঙ্ক। তার কথাই ছিলো শেষ কথা।

বনানীর বাসা থেকে শেখ ফজলে নূর তাপসের জন্য প্রতিদিন দুপুরে খাবার আনতে যেত ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের একটি গাড়ি। শুধু এ কাজের জন্য করপোরেশনের পরিবহন বিভাগের একজন চালক নিয়োজিত ছিলেন। বনানী থেকে ফুলবাড়িয়ায় দক্ষিণ সিটির প্রধান কার্যালয় নগর ভবনে টিফিন বক্সে করে খাবার আনতে ওই গাড়ির জন্য দিনে ২০ লিটার জ্বালানি তেল বরাদ্দ ছিল। সে হিসাবে তাপসের বাসা থেকে দুপুরের খাবার আনার পেছনে দিনে ব্যয় হতো ২ হাজার ৫০০ টাকা। তাপসের খাবার আনার কাজে ব্যবহৃত ওই গাড়ির জন্য বরাদ্দ ছিল ৪৪০ লিটার অকটেন। সব মিলিয়ে গাড়ির পেছনে জ্বালানি বাবদ মাসে খরচ হতো ৫৫ হাজার টাকা, যা বছরে ৬ লাখ ৬০ হাজার টাকা। তাপস ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়রের দায়িত্বে ছিলেন ৫১ মাস। সে হিসাবে শুধু দুপুরের খাবার আনার জন্য গাড়ির জ্বালানি বাবদ সিটি করপোরেশনের ব্যয় ২৮ লাখ ৫ হাজার টাকা।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস ও তার স্ত্রী আফরিন তাপসের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। মামলা দুটি দায়ের করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন দুদকের মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) মো. আক্তার হোসেন। তিনি বলেন, শেখ ফজলে নূর তাপস ২৭টি ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে ৫৩৯ কোটি ১৬ লাখ ২০ হাজার ২৭৮ টাকার সন্দেহজনক লেনদেন করেছেন। দুদক মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) আক্তার হোসেন বলেন, শেখ ফজলে নূর তাপস ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে নিজের ক্ষমতার অপব্যবহার করেন। বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে আয়ের উৎসের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ ৭৩ কোটি ১৯ লাখ ৬৭ হাজার ৩৭ টাকা মূল্যের সম্পদের মালিকানা অসাধু উপায়ে অর্জন করে ভোগদখলে রাখেন। তার নামের ২৭টি ব্যাংক হিসাবে ২০১৩ সালের ২২ সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৪ সালের ১৯ আগস্ট পর্যন্ত জ্ঞাত আয়ের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ ৩০৪ কোটি ৩৩ লাখ ৫৮ হাজার ৫২৮ টাকা জমা এবং ২৩৪ কোটি ৮২ লাখ ৬৬ হাজার ৭৫০ টাকা উত্তোলন করেন। এছাড়াও ৫ লাখ ১৭ হাজার ৫২৭ মার্কিন ডলারের অস্বাভাবিক লেনদেন করেন। এ কারণে তার বিরুদ্ধে দুদক ও মানিলন্ডারিং আইনে মামলা দায়ের করা হয়েছে। স্ত্রী আফরিন তাপস স্বামী শেখ ফজলে নূর তাপসের সহায়তায় নিজের ৯টি ব্যাংক ব্যাংক হিসাবে ৭০ কোটি ৮৯ লাখ ৯৩ হাজার ৬৬৯ টাকা এবং দুই লাখ দুই হাজার ২৫৯ মার্কিন ডলারের অস্বাভাবিক লেনদেন করেছেন। এছাড়াও জ্ঞাত আয়বহির্ভূত ৬ কোটি ৪০ লাখ ৮৯ হাজার ৯৮ টাকা মূল্যের সম্পদের মালিকানা অর্জন করেন। যে কারণে তার বিরুদ্ধেও দুদক আইন ও মানিলন্ডারিং আইনে মামলা দায়ের করা হয়েছে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের এফডিআর হিসেবে জমা রাখা টাকা ফেরত দিতে গড়িমসি করছে মধুমতি ব্যাংক। লিখিত ও মৌখিকভাবে বারবার তাগাদা দেওয়ার পরও ব্যাংকটি চাহিদার সব অর্থ ফেরত দিচ্ছে না বলে অভিযোগ করপোরেশনের কর্মকর্তাদের। কর্মকর্তারা বলছেন, ব্যাংকের এমন গড়িমসির কারণে উন্নয়নকাজের ঠিকাদারদের জামানতের টাকা যথাসময়ে ফেরত দিতে পারছে না ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। পাশাপাশি উন্নয়নকাজ বাস্তবায়নেও সমস্যার মুখে পড়ছে সংস্থাটি।

জানা যায়, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের আমলে শেখ ফজলে নূর তাপস মেয়র হওয়ার পর এ করপোরেশনের বার্ষিক রাজস্বের প্রায় অর্ধেক মধুমতি ব্যাংকে রাখা হতো। সবশেষ অর্থবছরে (২০২৪-২৫) করপোরেশনের মোট জমা অর্থের প্রায় ৪৬ শতাংশ অর্থাৎ ৫৪৩ কোটি টাকা এ ব্যাংকে স্থায়ী আমানত হিসেবে রাখা ছিল। এর বাইরে বিভিন্ন প্রকল্পের আরও ৪২৩ কোটি টাকা ব্যাংকটিতে রেখে আত্মগোপনে যান তাপস। বর্তমানে বিভিন্ন ব্যাংকে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের স্থায়ী আমানতের পরিমাণ ১ হাজার ১৫৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে চলতি জানুয়ারি পর্যন্ত মধুমতি ব্যাংকে স্থায়ী আমানত হিসেবে রয়েছে ৩২৩ কোটি টাকা। এর ১৪৫ কোটি ঠিকাদারদের জামানতের। বাকি ১৭৮ কোটি বাজার সালামী, সাধারণ তহবিলসহ অন্যান্য খাতের স্থায়ী আমানত। ৫ আগস্টের আগপর্যন্ত স্থায়ী আমানত ও প্রকল্পের জমা অর্থ মিলিয়ে মধুমতি ব্যাংকে দক্ষিণ সিটির ৯৬৬ কোটি টাকা ছিল। মূলত উন্নয়নকাজ ধীরগতিতে চালিয়ে ও ঠিকাদারদের জামানতের টাকা যথাসময়ে না দিয়ে এসব টাকা ব্যাংকটিতে জমা রাখা হতো। এ নিয়ে আগে ভয়ে কেউ কিছু বলার সাহস পাননি।

২০১৩ সালে অনুমোদন পাওয়া মধুমতি ব্যাংকের উদ্যোক্তা মূলত শেখ ফজলে নূর তাপস। এখনো তিনি ব্যাংকটির পরিচালক। রাজধানী ও কেরানীগঞ্জে ব্যাংকটির ১০টি শাখায় করপোরেশনের টাকা স্থায়ী আমানত হিসেবে রাখা হয়েছিল। শাখাগুলো হচ্ছে মিটফোর্ড, মতিঝিল, বংশাল, ধানমন্ডির শেখ কামাল সরণি, উত্তরা, আগানগর, গুলশান, ভিআইপি রোড, বাংলামোটর ও প্রগতি সরণি। এ ছাড়া নগরবাসীর কাছ থেকে নেওয়া গৃহকর ও ট্রেড লাইসেন্সের বেশির ভাগ টাকাও এ ব্যাংকের মাধ্যমে নেওয়া হতো। গ্রাহকেরা যাতে ব্যাংকটির মাধ্যমে লেনদেন করতে পারেন, সে জন্য মেয়র থাকাকালে করপোরেশনের প্রধান কার্যালয় নগর ভবন ও দক্ষিণ সিটির আঞ্চলিক কার্যালয়ে মধুমতির ছয়টি বুথ স্থাপন করে গেছেন তাপস।

সিটি করপোরেশনের হিসাব বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত স্থায়ী আমানত ও প্রকল্পের জমা অর্থ মিলিয়ে মধুমতি ব্যাংকে দক্ষিণ সিটির ৯৬৬ কোটি টাকা ছিল। মূলত উন্নয়নকাজ ধীরগতিতে চালিয়ে ও ঠিকাদারদের জামানতের টাকা যথাসময়ে না দিয়ে এসব টাকা ব্যাংকটিতে জমা রাখা হতো। এ নিয়ে আগে ভয়ে কেউ কিছু বলার সাহস পাননি।

ঢাকা দক্ষিণ সিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকা করপোরেশনের সচিব মোহাম্মদ বশিরুল হক ভূঁঞা বলেন, মধুমতি ব্যাংক টাকা দিতে গড়িমসি করছে। নানা অজুহাত দেখিয়ে তারা সময়ক্ষেপণ করছে। কেন টাকা দিচ্ছে না, জানতে ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে তলব করা হলেও তিনি আসেননি। তারা আশ্বাস দিচ্ছে, কিন্তু যথাসময়ে টাকা দিচ্ছে না। টাকা ফেরত দিতে আরও গড়িমসি করলে আইনের আশ্রয় নেবেন তারা।
মধুমতি ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক কামরুল হাসান খান বলেন, দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অভিযোগ সত্য নয়। পর্যায়ক্রমে সিটি করপোরেশনকে টাকা দেওয়া হচ্ছে। আগস্টের পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ২০০ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে।


বিভাগ : জাতীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

গাজার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা পুনর্গঠনে ১০ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন
অন্তর্বর্তী সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর দিকে তাকিয়ে ইইউ
ভারতের উদ্বেগের মধ্যে হাসিনা পরবর্তী বাংলাদেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হচ্ছে পাকিস্তান
সান্ত¡না খুঁজে পাচ্ছেন না, দুই দেশে কলঙ্কিত টিউলিপ
দুর্নীতির মামলায় ইমরান খান ও বুশরা বিবির কারাদণ্ড
আরও

আরও পড়ুন

খুশদীলের অলরাউন্ড নৈপুণ্যে রংপুরের আটে আট

খুশদীলের অলরাউন্ড নৈপুণ্যে রংপুরের আটে আট

বন্ধ হয়ে যাচ্ছে অনেক দেশের ভিসা

বন্ধ হয়ে যাচ্ছে অনেক দেশের ভিসা

মেডিকেল কলেজে শিক্ষক বাড়ানোর কথা ভাবছে সরকার

মেডিকেল কলেজে শিক্ষক বাড়ানোর কথা ভাবছে সরকার

ছাত্রদলের ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচি আজ

ছাত্রদলের ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচি আজ

গাজার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা পুনর্গঠনে ১০ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন

গাজার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা পুনর্গঠনে ১০ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন

অন্তর্বর্তী সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর দিকে তাকিয়ে ইইউ

অন্তর্বর্তী সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর দিকে তাকিয়ে ইইউ

ভারতের উদ্বেগের মধ্যে হাসিনা পরবর্তী বাংলাদেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হচ্ছে পাকিস্তান

ভারতের উদ্বেগের মধ্যে হাসিনা পরবর্তী বাংলাদেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হচ্ছে পাকিস্তান

সান্ত¡না খুঁজে পাচ্ছেন না, দুই দেশে কলঙ্কিত টিউলিপ

সান্ত¡না খুঁজে পাচ্ছেন না, দুই দেশে কলঙ্কিত টিউলিপ

দুর্নীতির মামলায় ইমরান খান ও বুশরা বিবির কারাদণ্ড

দুর্নীতির মামলায় ইমরান খান ও বুশরা বিবির কারাদণ্ড

বিদেশে টাকা পাচারের রাজনীতি মানুষ চায় না : পীর সাহেব চরমোনাই

বিদেশে টাকা পাচারের রাজনীতি মানুষ চায় না : পীর সাহেব চরমোনাই

শেখ পরিবারের রক্তের জন্যই দুর্নীতিতে জড়িয়েছেন টিউলিপ -রিজভী

শেখ পরিবারের রক্তের জন্যই দুর্নীতিতে জড়িয়েছেন টিউলিপ -রিজভী

নামাজ মু’মিনের জন্য মেরাজস্বরূপ

নামাজ মু’মিনের জন্য মেরাজস্বরূপ

ক্রেডিট কার্ডে বিদেশে বাংলাদেশিদের লেনদেন কমেছে

ক্রেডিট কার্ডে বিদেশে বাংলাদেশিদের লেনদেন কমেছে

স্বনির্ভর অর্থনীতির পথে দেশ

স্বনির্ভর অর্থনীতির পথে দেশ

বগুড়ার বিমানবন্দর দ্রুত চালুর দাবি

বগুড়ার বিমানবন্দর দ্রুত চালুর দাবি

আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে বাংলাদেশকে মানবাধিকার লংঘন বন্ধ করতে হবে : হিউম্যান রাইটস ওয়াচ

আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে বাংলাদেশকে মানবাধিকার লংঘন বন্ধ করতে হবে : হিউম্যান রাইটস ওয়াচ

হাজারীবাগের ট্যানারির গোডাউনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড

হাজারীবাগের ট্যানারির গোডাউনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড

জুলাই বিপ্লব ঘোষণাপত্র দেওয়া জরুরি : নুরুল হক নুর

জুলাই বিপ্লব ঘোষণাপত্র দেওয়া জরুরি : নুরুল হক নুর

গণঅভ্যুত্থানের ইশতেহারে বিএনপির ভূমিকা লিখতে হবে : জয়নুল আবদিন

গণঅভ্যুত্থানের ইশতেহারে বিএনপির ভূমিকা লিখতে হবে : জয়নুল আবদিন

নির্বাচনে রাজনৈতিক নেতাদের পরিবেশ রক্ষায় প্রতিশ্রুতি দিতে হবে

নির্বাচনে রাজনৈতিক নেতাদের পরিবেশ রক্ষায় প্রতিশ্রুতি দিতে হবে