অন্তর্বর্তী সরকারের সিদ্ধান্তে সিলেটজুড়ে স্বস্তি
২৩ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০৭ এএম | আপডেট: ২৩ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০৭ এএম
সিলেটসহ সারাদশের পাথর কোয়ারি নিয়ে ভাবনার অবসান ঘটেছে আপাতত। পাথর কোয়ারি উন্মুক্তের দাবিতে দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামেও টনক নড়াতে পারেনি পতিত স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারকে। বরং ভারতীয় গুটিকয়েক শিল্পগোষ্ঠির স্বার্থে দেশের পাথর কোয়ারি বন্ধ রেখে আমদানীতে ব্যস্ত ছিল পতিত সরকার। সেই বন্ধের কারণ হিসেবে দাঁড় করিয়েছিল কথিত পরিবেশ দূষণের তকমা।
সরকার যন্ত্র তাদের অনুগত হওয়ায় জনস্বার্থ উপেক্ষা করে ২০২০ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারির জারিকৃত একটি প্রজ্ঞাপনে বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল দেশের সবকটি পাথর কোয়ারি। এর মধ্যে দিয়ে ধ্বংস হয়ে পড়ে পাথর শিল্প ঘিরে বিনিয়োগকারীদের তাবৎ আয়োজন। এতে নিরব দুর্ভিক্ষ ছড়িয়ে পড়ে এখানে জড়িত প্রায় অর্ধকোটি শ্রমিক পরিবারে। পাথরখাত ঘিরে গড়ে উঠা পরিবহন, ক্রাশার মেশিন জোনগুলোতে জং ধরে। ব্যাংকের ঋণ শোধ করতে না পেরে সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েন ছোট-বড় ব্যবসায়ী। এরপর শুরু হয় পাথর কোয়ারি খুলে দেয়ার দাবিতে যুগপৎ আন্দোলন। হরতাল, অবরোধ, সভা, সমাবেশ স্মারকলিপি প্রদান কিছু বাদ রাখেননি আন্দোলনকারীরা। স্থানীয় অর্থনীতির পাশাপাশি জনস্বার্থ বিবেচনার পরিবর্তে শিল্পগোষ্ঠির স্বার্থ রক্ষায় পাথর কোয়ারি বন্ধে অটল থাকে প্রশাসনযন্ত্র। আমলে নেয়নি আদালদের নির্দেশনাও। সেই সাথে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতিও (বেলা) তাল মেলায় তাদের পক্ষে। পাথর বন্ধে পরিবেশের কথিত জুজু প্রচারে সক্রিয় হয়ে থাকে শিল্পিগোষ্ঠির মিডিয়াও। এতে বাস্তবিক চিত্র চরম অবহেলায় চাপা পড়ে যায়। অবশেষে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর পাথর কোয়ারি উন্মুক্তের আশায় বুক বাঁধতে থাকেন পাথর সংশ্লিষ্টরা। এরমধ্যে পাথর শ্রমিক বাঁচাও আন্দোলনের ব্যানারে নতুন করে শুরু হয়ে আন্দোলন সংগ্রাম। সংগঠনের আহ্বায়ক, আবুল হোসেনের নেতৃত্বে কোয়ারি উন্মুক্তের দাবিতে স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে শুরু হয় নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন। সনাতনী পদ্ধতিতে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় পাথর উত্তোলনের দাবি সরব হয়ে উঠে সর্বত্র।
২০২০ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারির জারিকৃত প্রজ্ঞাপনটি গত ১৩ জানুয়ারি বিদ্যুৎ, জ্বালানী ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব সাবরিনা আফরিন মোস্তফা স্বাক্ষরিত পত্রে পূর্বের আদেশটি বাতিল করায় সারাদেশসহ সিলেটের বন্ধ থাকা সকল পাথর ও বালু মহাল থেকে পাথর, বালু, সাদামাটি উত্তোলনে বাধা রহিত হয়ে যায়। এ খবরে আনন্দ-উচ্ছ্বাস ছড়িয়ে পড়ে সিলেটজুড়ে। মিষ্টি বিতরণসহ শোকরানা মিছিল সমাবেশ করে ধন্যবাদ জানানো হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে। একই সাথে প্রস্তাব করা হয় দ্রুত সময়ের মধ্যে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের ২০১৪ সালের পাথর উত্তোলন গাইডলাইন অনুযায়ী সেনাবাহিনী অথবা প্রশাসনের মাধ্যমে খাস কালেকশন শুরু করে পাথর, বালু উত্তোলনের কার্যক্রম চালুর। এ সময় পাথর কোয়ারি সংশ্লিষ্টরা বলেন, এ আদেশ বাতিলের মধ্যে দিয়ে দীর্ঘ ৮ বছর শ্রমজীবী মানুষের দুঃখ দুদর্শার অবসান হতে যাচ্ছে।
সিলেটের সীমান্তবর্তী কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর ও কানাইঘাট উপজেলার বিভিন্ন পাথর ও বালু মহাল দীর্ঘ ৭ বছর ধরে বন্ধ ছিল। দীর্ঘদিন থেকে পাথর ও বালু উত্তোলন বন্ধ থাকায় এ অঞ্চলের প্রধানতম বারকী পেশায় সম্পৃক্ত ১০ লক্ষাধিক মানুষ ও ২০ হাজারের অধিক ব্যবসায়ী আয়-রোজগার হারিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে। ইতোমধ্যে শত শত ব্যবসায়ী ব্যাংক ঋণে জর্জরিত হয়ে দেউলিয়া হয়ে পড়েছে। বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী ঋণের বোঝা সইতে না পেরে ইতিমধ্যে আত্মহত্যা করেছে এবং অনেকে প্যারালাইজড হয়ে বিছানায় ছটপট করছে। অনেক প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী দেশ ছেড়ে বিদেশে পালিয়েছেন।
বৈশ্বিক মহামারী কোভিট-১৯ এবং সাম্প্রতিক প্রলয়ঙ্কারী বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত বৃহত্তর সিলেটের মানুষের জীবন ও জীবিকা মারাত্মক সঙ্কটাপন্ন হয়ে পড়েছে। আয়-রোজগার না থাকায় সাধারণ মানুষসহ পাথর ও বালু উত্তোলনে জড়িত কয়েক লক্ষ পাথর শ্রমিক, হাজার হাজার ট্রাক মালিক-শ্রমিক, স্টোন ক্রাশার মিল মালিক, ব্যবসায়ী, বেলচা শ্রমিক, হেমার শ্রমিক ও লোড আনলোড শ্রমিক পরিবার পরিজন নিয়ে সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় দিন যাপন করছে। কিছু শ্রমিক পেটের দায়ে বালু উত্তোলন করতে গেলে প্রশাসন তাদের উপর অমানবিক অত্যাচার ও নিষ্ঠুর নির্যাতন চালিয়েছে।
অপরদিকে, দেশের পাথর মহালগুলো বন্ধ রেখে ভারতসহ বিভিন্ন দেশ থেকে রিজার্ভের ডলার খরচ করে পাথর আমদানি করা হয়েছে। লাখ লাখ মানুষের জীবন রক্ষা এবং রিজার্ভে সাশ্রয়ের জন্য সিলেটের সকল পাথর মহাল জরুরি ভিত্তিতে খুলে দেয়ার দাবি ছিল শ্রমজীবী মানুষের। দীর্ঘদিন পর এ দাবি বাস্তবায়ন হওয়ায় শ্রমজীবী ও পাথর ব্যবসায়ীদের মধ্যে স্বস্তি ফিরে এসেছে।
এব্যাপারে পাথর শ্রমিক বাঁচাও আন্দোলনের আহ্বায়ক আবুল হোসেন লাখ লাখ শ্রমিকের কর্মসংস্থান ফিরিয়ে দিতে প্রশাসনিক জটিলতা দূর করে অতি দ্রুত কোয়ারি সচলের দাবি জানান তিনি। ব্যবসায়ী মো. সুরুজ আলীর জানান, আমরা বিভিন্ন ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে ক্রাশার করে লসে আছি। অনেকে আবার ঋণ খেলাপি হয়ে গেছে। আওয়ামী সরকার ইন্ডিয়ার স্বার্থে বিগত দিন পরিবেশের কথা বলে পাথর কোয়ারি বন্ধ রেখে ইন্ডিয়া থেকে নিম্ন মানের পাথর আমদানি করে আসছে। সরকার পাথর কোয়ারি চালু করার সিদ্ধান্তে আমরা অনেক অনেক খুশি। যত দ্রুত সম্ভব ইজারা বা খাস কালেকশনের মাধ্যমে চালু করে দেওয়া হোক কোয়ারি।
অপরদিকে, বৈধভাবে পাথর কোয়ারি সচল না থাকায় লুকিয়ে লুটপাঠ বন্ধ করতে পারেনি প্রশাসন সংশ্লিষ্টরা। প্রশাসনের হিসাবে, গত ৫ আগস্টের পর দুই সপ্তাহে জাফলং ও ভোলাগঞ্জ থেকে প্রায় ১৪০ কোটি টাকার পাথর লুট হয়েছে। নজরদারির কারণে এখন তা কমেছে বলে দাবি জেলা প্রশাসকের। এছাড়া অবৈধভাবে বালু পাথর উত্তোলন বন্ধে অভিযান চলমান রয়েছে বলে জানিয়েছে প্রশাসন সংশ্লিষ্টরা। প্রশাসনের একটি সূত্র বলছে, ৫ আগস্টের প্রশাসনযন্ত্রেও দূর্বলতার সুযোগে লুটপাট অতিমাত্রায় বেড়ে যায়। এছাড়া অভিযান দেয়ার মতো লোকবলের রয়েছে সঙ্কট। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি রক্ষার স্বাভাবিক কার্যক্রমের বাইরে বালু পাথর রক্ষার বিষয়টি প্রশাসনের জন্য বাড়তি চাপ।
পাথর সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র বলছে, গত ১৩ জানুয়ারি পাথর কোয়ারি নিয়ে সরকারি সিদ্ধান্তের পর স্বৈরাচারের একাধিক দোসর চক্র ঢাকায় অবস্থান করছে। তারা পাথর কোয়ারিগুলো কুক্ষিগত করতে চালিয়ে যাচ্ছে দৌড়ঝাঁপ। বিগত সরকারকালীন লুটপাটের অর্র্থ ছিটিয়ে সেই সাথে প্রশাসনের সর্বোচ্চ মহলে এখনো আসীন বিগত সরকারের দোসরদের সহযোগীতায় কোয়ারিগুলো বরাদ্দ নিতে তৎপরতা চালাচ্ছে তারা। এতে শঙ্কা বিরাজ করছে সাধারণ পাথর শ্রমিকসহ সংশ্লিষ্টদের মধ্যে। তারা মনে করছেন সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ব্যতিত পাথর কোয়ারিগুলো লুটেরাদের হাতে পড়লে তারা অবৈধ কার্যক্রম পরিচালনা করে বর্তমান সরকারকে বির্তকিত করবে, সেই সাথে সৃষ্টি করবে অরাজক পরিস্থিতি।
সিলেট জেলা প্রশাসক শের মাহবুব মুরাদ জানান, অবৈধভাবে বালু ও পাথর উত্তোলন বন্ধে অভিযান চলমান। পাথর বা বালু উত্তোলন বিষয়টি নিয়ে কিছু প্রস্তাবনা সরকার সংশ্লিষ্টদের কাছে পাঠিয়েছেন তিনি। তিনি আরো বলেন, বালু-পাথর উত্তোলনে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার বিকল্প নেই। এখাত বেসরকারিভাবে ছেড়ে দিলে অরাজকতাসহ নির্বিচারে উত্তোলন শুরু হবে। এতে পরিবেশের ক্ষতিসহ সরকারের রাজস্ব ফাঁকিরও সুযোগ থাকে। সরকারিভাবে উত্তোলন করে পাথর ও বালু নিলাম বা যথার্থ স্বচ্ছ পন্থায় বিক্রি করলে, রাজস্ব সুরক্ষা সাথে সাথে পরিবেশের বিষয়টিও নজরে রাখা যাবে। এছাড়া তিনি জানান, সরকারে নীতিনির্ধারকদের নির্দেশনার উপর নির্ভর করছে পাথর কোয়ারি দ্রুত খুলে দেয়ার ব্যবস্থা।
****************
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
ভারতকে ছেড়ে কেন চীনের ঘনিষ্ঠ হচ্ছে শ্রীলঙ্কা?
রাজনৈতিক উত্তরণে অন্তর্বর্তী সরকারকে সমর্থন করবে জাপান
প্রবাসী উপদেষ্টার আশ্বাসে মালয়েশিয়া গমনেচ্ছুদের আন্দোলন স্থগিত
মহার্ঘভাতার সঙ্গে ভ্যাট বাড়ানোর কোনো সম্পর্ক নেই: অর্থ উপদেষ্টা
পুরো বইমেলা মনিটরিং হবে ড্রোনে-ডিএমপি কমিশনার
যানবাহন চালক-পথচারীদের জন্য ডিএমপির বিশেষ নির্দেশনা
মাস্ক বা অন্য কেউ টিকটক কিনলে বিনিয়োগ করবে প্রিন্স তালালের কোম্পানি
মৃত বাবার রেখে যাওয়া ঋণ পাওনাদার নিতে না চাওয়া প্রসঙ্গে?
খেলাধুলার মাধ্যমে তরুণদের শারীরিক ও মানসিক বিকশিত হয় -ডিসি তৌফিকুর রহমান
চাঁপাইনবাবগঞ্জে বিজিবি বিএসএফ বৈঠক
জিয়াউল হক মাইজভা-ারী ট্রাস্টের শিক্ষাবৃত্তি প্রদান
৪ দিনের রিমান্ডে সাবেক এমপি আবু রেজা নদভী
মাদারীপুরে জলবায়ু পরিবর্তন ও মানবপাচারের আন্তঃসম্পর্কবিষয়ক কর্মশালা
রাজশাহীতে ছাত্রাবাসে ঢুকে সমন্বয়ককে মারধর
মাদারীপুরে হত্যার দায়ে ৫ জনের যাবজ্জীবন
এক বছরে উখিয়া-টেকনাফে ১৯২ জন অপহরণ
‘সমন্বয়ক মরার জন্য প্রস্তুত হ’ দেয়ালে লিখে হত্যার হুমকি
বিমানের এই কর্মকা- সহ্য করার মতো নয় -সিলেট সুধীজন
বাণিজ্যমেলায় শেষ মুহূর্তে নিত্যপণ্য কেনাকাটার ধুম
পঞ্চগড়ে চার বিচারক অপসারণে ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম