সংস্কারের সফলতায় শঙ্কা
২৮ মার্চ ২০২৫, ১২:০৪ এএম | আপডেট: ২৮ মার্চ ২০২৫, ১২:০৪ এএম

রাষ্ট্র পুনর্গঠন ও বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে একটি শক্তিশালী ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে সংস্কারের উদ্যোগ নেয় জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। কিন্তু এই উদ্যোগের মাঝপথে এসে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে মতবিরোধ দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী পদে একই ব্যক্তির দুই বারের বেশি না আসা, প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধানের পদে একইসঙ্গে না থাকা, সরকারের মেয়াদ পাঁচ বছর থেকে চার বছরে কমিয়ে আনার মতো প্রধান কয়েকটি সংস্কার প্রস্তাবনার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছে বিএনপি। এ ছাড়া জরুরি অবস্থা ঘোষণার সুপারিশ বিষয়ে দ্বিমত বিএনপির। অন্যদিকে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) চাইছে সংসদ ও গণপরিষদের ভোট একত্রে করতে। এ ছাড়া তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠারও পক্ষে নয়। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে হলেও তারা চাইছে সংখ্যানপাতিক পদ্ধতির নির্বাচনের পক্ষে তাদের মতামত দিয়েছে। শুধু রাজনৈতিক দলই নয়, নির্বাচন কমিশন সংস্কারের বিষয়ে যে সুপারিশ করা হয়েছে তার কয়েকটি নিয়ে খোদ নির্বাচন কমিশনই আপত্তি জানিয়েছে। এত ভিন্নমতের সমাহারের মধ্যে সংস্কারের সফলতা নিয়ে এক ধরনের শঙ্কা দেখা দিয়েছে। কেননা, দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার জন্য যে সব বিষয় সংস্কার করা প্রয়োজন বলে মানুষ মনে করে সেগুলো নিয়েই দলগুলোর মধ্যে দ্বিমত দেখা দিয়েছে। আর এসব বিষয় যদি সংস্কার করা না যায় তাহলে এ সংস্কার অর্থবহ হবে না বলেই রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন।
গত ২৩ মার্চ বিএনপি ও এনসিপি তাদের মতামত জমা দিয়েছে। এসব মতামতে বিভিন্ন বিষয়ে একমতের সঙ্গে এসেছে নানা বিষয়ে ভিন্নমত। এ ছাড়া বিভিন্ন বিষয়ে দলগুলোর পক্ষ থেকে বিপরীতধর্মী মতামতও এসেছে। দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট সংসদ এবং সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনের বিষয়ে দলগুলো ভিন্ন ভিন্ন মতামত দিয়েছে। জামায়াতে ইসলামী সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনের বিষয়ে একমত হলেও বিএনপি এ বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করেছে। অন্যদিকে বিএনপি দুইবারের বেশি কেউ প্রধানমন্ত্রী হতে পারবে না এবং সরকারের মেয়াদ চার বছর করার বিষয়েও দ্বিমত পোষণ করেছে। মূলত বিএনপির ওই প্রস্তাব ঘিরেই রাজনীতির মাঠে চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা।
ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশে ১৯৭১ সাল এবং ২০২৪ সালকে এক কাতারে আনার বিষয়ে বিএনপি ভিন্নমত পোষণ করেছে। এ ছাড়া রাষ্ট্রীয় নাম পরিবর্তনের প্রস্তাবেও সায় দেয়নি দলটি। বিচার বিভাগের ক্ষেত্রে প্রায় সব প্রস্তাবে বিএনপি একমত। ৩১ দফা সুপারিশের মধ্যে চার-পাঁচটি বিষয়ে মতামত দেয়া হয়েছে। বিএনপি বলছে, অধ্যাদেশের মাধ্যমে সংশোধনী দিয়ে নির্বাচন কমিশনের হাতে ডিলিমিটেশনের এখতিয়ার রাখা হোক। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সংস্কার নিয়ে ২০টি সুপারিশের ১১টিতে একমত দলটি। একটি প্রস্তাবে মন্তব্যসহ ভিন্নমত পোষণ করেছে দলটি। প্রশাসন সংস্কারে প্রায় অর্ধেক প্রস্তাবে একমত বিএনপি। ২৬টি প্রস্তাবনার মধ্যে অর্ধেকে নিজস্ব মতামত দিয়েছে দলটি। এদিকে পাঁচটি বিষয়ের ওপর সংস্কার প্রস্তাব জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে জমা দিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। সংবিধানের মূলনীতিতে আল্লাহর প্রতি অবিচল ঈমান-আস্থা ফিরিয়ে আনতে মত দিয়েছে জামায়াত। দলটির সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পারওয়ারের নেতৃত্বে জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে সংস্কার প্রস্তাব জমা দেয়া হয়। দলটি সংবিধান, জনপ্রশাসন, বিচার বিভাগ, নির্বাচন প্রক্রিয়া ও দুর্নীতি দমন কমিশনের বিষয়ে কিছু পয়েন্টে দ্বিমত করেছে। দলটি বলছে, নির্বাচন কমিশনের যারা কর্মকর্তা, রিটার্নিং ও প্রিজাইডিং অফিসার যারা রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ থাকতে পারেন না তাদের এড়াতে বলা হয়েছে। দলটি পিআর বা সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচন চায়। সংবিধানে সাম্য, গণতন্ত্র, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার বহাল রাখার পক্ষে মত দিয়েছে জামায়াত। ন্যাশনাল কনস্টিটিউশনাল কাউন্সিলের সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত নয় দলটি। দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্টের সঙ্গে একমত হলেও পুরাপুরি একমত নয় দলটি। তারা এ বিষয়ে বিস্তারিত মতামত দিয়েছে। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে জামায়াত আস্থাভোট, বাজেট সম্পর্কে ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কীভাবে দায়িত্ব পালন করবে সে ব্যাপারে মতামত দিয়েছে। জামায়াত জাতীয় নির্বাচনের আগে গণপরিষদ নির্বাচন চায় না।
ওদিকে রাষ্ট্রসংস্কার প্রশ্নে নিজেদের মতামত জানানোর পাশাপাশি ঐকমত্য কমিশনের কাছে তিনটি বিষয় জানতে চেয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। ২৩ মার্চ জাতীয় সংসদের এলডি হলে ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি আলী রীয়াজের কাছে দলটি নিজেদের লিখিত মতামত হস্তান্তর করে। কমিশনের ১৬৬টি সুপারিশের মধ্যে ১১৩টির পক্ষে মত দিয়েছে দলটি। ২৯টি প্রস্তাবে আংশিকভাবে একমত এবং ২২টি প্রস্তাবের বিষয়ে দ্বিমত প্রকাশ করে দলটি। পুলিশ সংস্কার কমিশন ও স্থানীয় সরকার কমিশনের সুপারিশ রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে না পাঠানোর কারণও জানতে চেয়েছে এনসিপি। এনসিপি দুই কক্ষবিশিষ্ট সংসদদের বিষয়ে একমত পোষণ করেছে। তবে তারা বলেছে, নির্বাচনের আগেই উচ্চকক্ষের প্রার্থী কারা, তা দলগুলোকে ঘোষণা করতে হবে। এনসিপি বলেছে, অন্তর্বর্তী সরকার হতে হবে নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকার। তাদের মেয়াদ ৭০ থেকে ৭৫ দিন হতে পারে।
কমিশনে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরেছেন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি)। কমিশনের ১৬৬টি প্রস্তাবের মধ্যে ৪২টি প্রস্তাবের সঙ্গে এলডিপি একমত নয় বলে জানিয়েছে। দুটো প্রস্তাবের সঙ্গে আংশিকভাবে একমত। দুটি প্রস্তাবের বিষয়ে তারা এখনো স্পষ্ট নয়। গত বৃহস্পতিবার এলডিপি নিজেদের মতামত জমা দিয়েছে। এদিকে খেলাফত মজলিশ গণপরিষদের পক্ষে নয়। তারা ৪০০ আসনে নারীদের সরাসরি ভোটে নির্বাচনের প্রস্তাব দেয়। সংসদের মেয়াদ তারা পাঁচ বছর চায়। এ ছাড়া উচ্চকক্ষে (সিনেটে) সংখ্যালঘুদের ১ শতাংশ ভোটের ভিত্তিতে আসন বণ্টনের মতামত দিয়েছে। সংবিধানে মহান আল্লাহর প্রতি আস্থা বিশ্বাস রাখতে মতামত দিয়েছে দলটি। ২২ মার্চ জমা দেয়া মতামতে লেবার পার্টি ১৪৭টি সুপারিশে একমত হয়েছে, সাতটিতে মতপার্থক্য আছে বলে জানিয়েছে। ১২টিতে আংশিকভাবে সম্মত হয়েছে। দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্টের পক্ষে মত দিলেও দেশকে চারটি প্রদেশে ভাগ করার বিপক্ষে মত দেয়া হয়েছে। ২১ মার্চ মতামত জমা দিয়েছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)। জরুরিভিত্তিতে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের প্রস্তাব দিয়েছে দলটি। ব্যাপক আলোচনার মাধ্যমে জনগণের মতামতের ভিত্তিতে ব্যাপক সংস্কার চালানোর পক্ষে মত দিয়েছে দলটি। গত ১৭ মার্চ ঐকমত্য কমিশনের ৩২ প্রস্তাবনায় দ্বিমত জানিয়ে এবি পার্টি তাদের মতামত দিয়েছে। সংস্কার কমিশনে প্রস্তাব জমা দিয়েছে জমিয়তে ওলামা ইসলাম বাংলাদেশ, জাকের পার্টি, ভাসানী অনুসারী পরিষদ, এনডিএম ও আমজনতার দলসহ আরো কয়েকটি দল। এসব দলও নিজস্ব মতামত তুলে দিয়েছে কমিশনের হাতে। তাদের মতামতেও অনেক ভিন্নমত রয়েছে। এত ভিন্নমতের মধ্যে কিভাবে এখন ঐকমত্য হবে সেটা নিয়ে বড় প্রশ্নে দেখা দিয়েছে।
বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী বলেন, সংস্কার বিষয়ে যে সব ভিন্নমত বা দ্বিমতের সৃষ্টি হয়েছে সেগুলো নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে ঐকমত্যে পৌঁছাতে হবে। তবে সব বিষয় যে ঐকমত্য হবে এমনটি আমি মনে করি না। বেসিক বিষয়গুলোতে রাজনৈতিক দলগুলো একমত পোষণ করবে বলে আমি আশা করি। আর যে সব বিষয়ে ঐকমত্য হবে সেগুলো দ্রুত সংস্কার করে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজনের মাধ্যমে দেশ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় যাত্রা শুরু করবে এমনটিই প্রত্যাশা।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ, সংস্কারের কিছু বেসিক বিষয়ে আমরা একমত পোষণ করেছি। আবার কিছু বিষয় আছে যেগুলোতে আমাদের দ্বিমত বা ভিন্নমত রয়েছে। যেমন একাত্তর আর ’২৪-এর গণ-অভ্যুত্থান এক হতে পারে না বলে আমরা মনে করি। একাত্তর সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সঙ্গে একই কাতারে ২০২৪ সালে গণ-অভ্যুত্থানকে নিয়ে আসা আমরা মনে করি সমীচীন নয়। ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানের অংশটি সংবিধানের অন্য জায়গায় কীভাবে চতুর্থ তফসিল যুক্ত করা যায় সেটা পরে আলোচনা করা যায়। আমরা মনে করি সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। এটা সব সময় চলতে থাকবে। এখন সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যা প্রয়োজন সেটা করে দ্রুত নির্বাচন জাতির প্রত্যাশা।
গণ সহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, দেশকে একটি প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রূপ দিতে হলে সংস্কারের কোনো বিকল্প নেই। জুলাই বিপ্লবের মধ্যদিয়ে আমরা একটি নতুন রাষ্ট্র বির্নিমাণের যে সুযোগ পেয়েছি তা কিছুতেই নষ্ট হতে দেয়া যাবে না। তাই আমি মনে করি দ্বিমত-ভিন্নমত এগুলো গণতন্ত্রেরই অংশ। গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠনিক রূপদানের লক্ষ্যে যে সব সংস্কার প্রয়োজন সে সবের বিষয় সব রাজনৈতিক দল ঐকমত্য পোষণ করবেন এটা আমি মনে করি। এছাড়া আমাদের সামনে আর কোনো বিকল্প নাই।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন

ড. ইউনূসকে শেহবাজের ফোন, পাকিস্তান সফরের আমন্ত্রণ

ফাঁস হয়ে গেছে সালমানের 'সিকান্দার', আর্থিক ঝুঁকির শঙ্কা

যমুনা সেতু দিয়ে এক সপ্তাহে ২ লাখ ৪৭ লাখ যানবাহন পারাপার, ১৭ কোটি টাকার টোল আদায়

দেশে দেশে ঈদ উদযাপিত

ফ্যাসিস্ট সরকারের সময় বাড়িতে আসতে পারেনি চৌদ্দগ্রামে স্বাচ্ছন্দে ঈদ উদযাপন সাবেক এমপি ও শিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতির

টেকেরহাট বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে অতিরিক্ত দামে

মিথ্যাচার করছেন নেহা কক্কর,দাবি আয়োজকদের

সম্প্রীতির নজির, ঈদের দিন নামাজিদের উপর পুষ্পবর্ষণ হিন্দুদের

কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় দেশের বৃহত্তম ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত

ফ্যাসিস্ট সরকার আমাদেরকে ঈদের আনন্দ উপভোগ করতে দেয়নি: এ্যানি

রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার বারুইপাড়া ঈদগাহ মাঠ বিভিন্ন স্থানে ঈদুল ফিতরের জামাত অনুষ্ঠিত

চৌদ্দগ্রামে মদের কারখানা গুঁড়িয়ে দিল প্রশাসন, আটক ৪

ঈদের পরে কোন পথে রাজনীতি? কী পরিকল্পনা বিএনপি, জামায়াত আর এনসিপির?

তারাকান্দায় বিদ্যুৎপৃষ্টে যুবকের মৃত্যু

ঈদের মাংশ নিয়ে বাড়ী ফেরা হলো না রুহুল আমিনের

সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় ঈদ জামাত অনুষ্ঠিত

ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়ে যা বললেন সারজিস আলম

কমলনগরে প্রশাসনের উদ্যোগে প্রস্তুতকৃত ঈদগাহে প্রথম' আনুষ্ঠানিকভাবে ঈদের নামাজ আদায়

ঈদের দিনেও তাপপ্রবাহ অব্যাহত

আগামীতে আরও বড় পরিসরে ঈদ উৎসব হবে: আসিফ মাহমুদ