গরুর গোশত প্রত্যেক মুসলমানের জন্য লোভনীয় খাবার। কিন্তু গোশতের দাম বেড়ে যাওয়া এবং আয় কমে যাওয়ায় গরুর গোশত বেশির ভাগ মানুষের খাবারের তালিকা থেকে বিদায় নিয়েছে। রমজান মাসে হাটবাজারগুলোতে গত রমজানের চেয়ে অনেক কম গরু জবেহ হচ্ছে। গোশত বিক্রি হচ্ছে আগের চেয়ে কম।

পহেলা রমজানে উপলক্ষে ‘সুলভ’ মূল্যে দুধ, ডিম, গোশত বিক্রি কার্যক্রম শুরু করে প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। চলবে পুরে মাসজুড়ে। ফ্রিজিং ভ্যানে করে রাজধানীর ২০টি স্থানে এসব পণ্য বিক্রি করা হচ্ছে। তবে যাদের জন্য এমন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সেই নিম্ন আয়ের মানুষদেরই খুব একটা আগ্রহ নেই এসব ভ্যানের পণ্যে। তারা বলছেন, ‘সুলভ’ মূল্যের পণ্যের যে দাম নির্ধারণ করা হয়েছে তাও তাদের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে। তাছাড়াও একটি পণ্য কিনতে গেলে সঙ্গে অন্য একটি পণ্য কিনতে বাধ্য করা হচ্ছে। আবার ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। এ কারণেই ইচ্ছা থাকলেও কেনা সম্ভব হচ্ছে না।

এছাড়া ছাড়াও খোলাবাজারে (ওএমএস) ‘ট্রাক সেল’-এর মাধ্যমে চাল ও আটা বিক্রি করছে খাদ্য মন্ত্রণালয় এবং ডিলারদের মাধ্যমে তেল, চিনি, ডাল, ছোলাসহ নিত্য পণ্য বিক্রি করছে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)। এরই মধ্যে টিসিবি থেকে বরাদ্দ পাওয়া পণ্যের স্টক ফুরিয়ে গেছে অনেক ডিলারের, তাই বন্ধ রাখা হয়েছে পণ্য বিক্রি। আর ওএমএস-এর ট্রাক সেল চালু রয়েছে, সেগুলোতে সেহরির পর থেকেই অপেক্ষা করছেন নিম্ন আয়ের মানুষ।

গত রোববার ও সোমবার রাজধানীর কয়েকটি পয়েন্টে ঘুরে দেখা গেছে, ফ্রিজিং ভ্যানগুলোর সামনে গোশত কেনার জন্য যারা আসছেন তাদের বেশিরভাগই মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত। আর স্বল্প আয়ের মানুষ যারা আসছেন, তারা দাম শুনে চলে যাচ্ছেন। প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ‘সুলভ’ মূল্যকেও ‘বেশি দাম’ মনে করছেন নিম্ন আয়ের মানুষ। এছাড়া যেকোনও একটি পণ্য কেনার সুযোগ না থাকায় ইচ্ছে থাকলেও গোশত, দুধ কিংবা ডিম কোনোটাই কেনা হচ্ছে না তাদের। কারণ তাদের পক্ষে এতো বেশি দামে গোশত কেনা যেমন সম্ভব নয়; তেমনি এতোগুলো পণ্য কেনাও সম্ভব নয়।

যাত্রাবাড়ী মোড়ে গোশত কিনতে আসা হোসনে আরা জানান, তিনি গরুর গোশত কিনতে এসেছে; তাকে গোশতের সঙ্গে দুধ ক্রয়ের জন্য বলা হচ্ছে। আমরা গরীব মানুষ, সবজি কিনতে পারি না। দুধ খাওয়ার জন্য টাকা খরচ করতে পারবো না। সরকার গরুর গোশতের দাম আরেকটু কমালে এবং একটি করে পণ্য ক্রয়ের নিয়ম করলে আমরা আধাকেজি গোশত কিনতে পারতাম।

কালশীতে একটি ফ্রিজিং ভ্যানের সামনে এসেছিলেন মো. হোসেইন। কিছু না কিনেই ফিরে যাওয়ার সময় ‘কিছু নিলেন না কেন’ জানতে চাইলে বলেন, ‘গোশত কেনার সামর্থ্য তো নাই। একটু কম দামে ডিম বেচতেছে দেখে আসছিলাম। কিন্তু জানলাম যে শুধু ডিম বেচবে না। অন্য আরেকটা জিনিস (দুধ কিংবা গোশত) সঙ্গে কিনতে হবে। লগে এত টাকা নাই। এগুলা শুধু শুধুই, আমাদের পক্ষে মাংস কেনা সম্ভব না।

গরুর গোশত কিনতে এসেছেন গৃহিণী নাজনীন জুঁই বেগম। আগের দিনও গোশত নিয়ে গেছেন তিনি। বলেন, গতকাল আধা কেজি গোশত নিয়েছি। ভেবেছিলাম কেমন না কেমন হবে; কিন্তু রান্নার পর বাসার সবাই পছন্দ করেছে। তাই আজ আবার নিতে এসেছি। আজ গরুর গোশতের সঙ্গে দুধ ও মুরগির গোশতও কিনবো।

প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের এই উদ্যোগ ‘প্রশংসনীয়’ মন্তব্য করে আরেক ক্রেতা ইয়াসিন আলম বলেন, বাজারের থেকে এখানে গরুর গোশত কেজিতে ১১০ টাকা কম। দুধও এখানে ৮০ টাকা, যা বাইরে ৯০ থেকে ১০০ টাকা। এগুলো তো সারা রমজানে ধরে কিনতেই হবে। একটু কমে পেলে ভালো না!

প্রাণিসম্পদের উদ্যোগে গরুর গোশত প্রতি কেজি ৬৪০ টাকা, খাসির গোশত প্রতি কেজি ৯৪০ টাকা, ড্রেসিং করা (চামড়া ছাড়া) ব্রয়লা মুরগির প্রতি কেজি ৩৪০ টাকা, দুধ প্রতি লিটার ৮০ টাকা ও ডিম প্রতি পিস ১০ টাকা মূল্যে বিক্রয় করা হচ্ছে। গরু, খাসি ও মুরগির গোশত সর্বনিম্ন আধা কেজি করে কেনা যাচ্ছে। রাজধানীর সচিবালয় সংলগ্ন আবদুল গণি রোড, খামারবাড়ি, মোহাম্মদপুরের জাপান গার্ডেন সিটি, মিরপুর ৬০ ফুট রাস্তা, আজিমপুর মাতৃসদনের সামনে, পুরান ঢাকার নয়াবাজার, আরামবাগ, নতুনবাজার, মিরপুরের কালশী, খিলগাঁও রেলগেট, নাখালপাড়ার লুকাস মোড়, সেগুনবাগিচা কাঁচাবাজার, মোহাম্মদপুরের বছিলা, উত্তরার দিয়াবাড়ি, যাত্রাবাড়ী, গাবতলী, হাজারীবাগ, বনানীর কড়াইল বস্তি, কামরাঙ্গীরচর ও রামপুরায় এসব পণ্য বিক্রি করা হচ্ছে।

আরামবাগে ‘সুলভ’ মূল্যে গোশত, দুধ ও ডিম বিক্রির দায়িত্বে থাকা মো. মামুন হাসান জানান, এখান থেকে সর্বনিম্ন আধা কেজি গোশত কেনা যাবে। তবে সঙ্গে দুধ বা ডিম বা যেকোনও দুটি পণ্য একসঙ্গে কিনতে হবে। ধীরে ধীরে লোক বাড়ছে। গরুর গোশতের প্রতিই সবার আগ্রহ বেশি, এর জন্য সঙ্গে আরেকটা পণ্য কেনা বাধ্যতামূলক করে দেওয়া হয়েছে।
অল্প কয়েকজন ছাড়া পণ্যের দাম নিয়ে কেউ আপত্তি জানায়নি মন্তব্য করে তিনি বলেন, যারা নিতে আসেন তাদের বেশিরভাগ জেনেই আসছেন। তবে কেউ কেউ শুধু দাম শুনে চলে যাচ্ছেন।

রোজা উপলক্ষে সারা দেশে ফ্যামিলি কার্ডধারী নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে কম দামে পণ্য বিক্রি করছে টিসিবি। তবে ভোর থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পণ্য না পাওয়ার অভিযোগ রয়েছে কার্ডধারীদের। আবার অনেক ডিলারের বরাদ্দ পাওয়া পণ্য ইতোমধ্যে শেষ হয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন। ফলে বন্ধ রেখেছেন পণ্য বিক্রি। গতকাল সোমবার কয়েকটি পয়েন্টে গিয়ে দেখা গেছে, পণ্য বিক্রি শেষ হয়ে যাওয়ায় দোকানগুলো বন্ধ রাখা হয়েছে। ডিলাররা বলছেন, পরে পণ্য এলে আবারও চালু করা হবে।

এই প্রসঙ্গে মিরপুর বাউনিয়াবাদ এলাকার বিক্রেতা ও টিসিবি ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি শেখ সিরাজুল ইসলাম বলেন, গত ১৯ তারিখে টিসিবির পণ্য বিক্রি শুরু হয়, এর চার-পাঁচ দিনের মধ্যেই অনেক ডিলার তাদের পণ্য বিক্রি শেষ করেছে। এর আগে প্রায় আড়াই মাস পণ্য বিক্রি বন্ধ এবং রমজান মাস হওয়ায় এবার পণ্যের চাহিদা বেশি। অনেক আগে আগেই পণ্য কেনার জন্য ক্রেতাদের ভিড় ছিল। এছাড়া ফ্যামিলি কার্ড হওয়ায় পণ্য বিক্রিও সহজ হয়েছে বলে দাবি এই ডিলারের। ডিলাররা কার্ডধারীদের পণ্য বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন দাবি করে তিনি বলেন, একজন ডিলার ২ হাজার লোকের পণ্য বরাদ্দ পান। কিন্তু চাহিদা আরো বেশি। সবাইকে দেওয়ার চেষ্টা করি আমরা। এটাও সত্য যে অনেকেই টিসিবির পণ্য নিতে পারে নাই। ভিড় ঠেলে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হবে বলে হয়তো অনেকে ফিরেও গেছেন।

রমজান উপলক্ষে টিসিবি থেকে ৫৭০ টাকা প্যাকেজে তেল, চিনি, খেজুর, ছোলা ও ডাল বিক্রি হচ্ছে। রুটিন করে এখনও প্রতিনিয়ত ওএমএস ট্রাক সেলে মানুষ আসে জানিয়ে কাজীপাড়ায় ট্রাক সেলের দায়িত্বে থাকা উপ-খাদ্য পরিচালক আবুল হোসেন বাদল বলেন, রমজান মাসে সকালে ভিড় কম থাকলেও বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে লোকও বেড়েছে। যারা এখানে আসেন তারা এখন নিয়মিতই কেনেন পরিচিত মুখ। এর বাইরে মাঝে মাঝে লোক সংখ্যা বাড়ে। এখন আর কাগজ দেখা হয় না, যে কেউ লাইনে দাঁড়ালেই রেশন পাবে। ##