‘নিরাপদ’ নয় রেল
১৫ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০৭ এএম | আপডেট: ১৫ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০৭ এএম
রেলে প্রতিনিয়ত লাইনচ্যুতিসহ নানা দুর্ঘটনা ঘটেছে। নিরাপদ বাহন রেলে এখন দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছে সাধারণ যাত্রীরা। আহত হচ্ছেন অনেকে। সর্বশেষ নীলফামারীর ডোমারে রেললাইনের ফিসপ্লেট ক্লিপ খুলে ফেলেছে দুর্বৃত্তরা। এর আগে গাজীপুরের বনখড়িয়া এলাকায় রেললাইন কেটে ফেলেছে দুর্বৃত্তরা। এসময় রাজেন্দ্রপুর স্টেশন থেকে ছেড়ে আসে ঢাকা অভিমুখী মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনের ইঞ্জিনসহ সাতটি বগি লাইনচ্যুত হয়েছে। এ ঘটনায় নিহত হয়েছে একজন এবং আহত হয়েছেন কমপক্ষে ১০ জন।
সারাদেশে গত ৫ বছরে দুই হাজারের বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে নিহত হয়েছেন দেড় শতাধিক মানুষ। কর্তৃপক্ষের যথাযথ নজরদারি না থাকায় এ সব দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। দুর্ঘটনা রোধে রেলের অনেক বিধিবিধান রয়েছে, সেগুলো মানা হয় না বলেই বাড়ছে দুর্ঘটনা। যন্ত্রাংশের সঙ্কট, রেলপথের যন্ত্রপাতি চুরি ও রেলপথে পাথর না থাকা। পাশাপাশি রেলওয়ের অবহেলা, নাশকতার মনোভাব, লোকবল ঘাটতি, নিয়মিত তদারকি ও মেরামতের অভাব, রেলপথে মানসম্মত পর্যাপ্ত পাথরের স্বল্পতা ও ঝুঁকিপূর্ণ সেতুর কারণেও এসব দুর্ঘটনা ঘটছে বলে বলছে সংশ্লিষ্টরা।
সর্বশেষ নীলফামারীর ডোমারে রেললাইনের ফিসপ্লেট ক্লিপ খুলে ফেলেছে দুর্বৃত্তরা। এলাকাবাসীর প্রতিরোধে বড় দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পেয়েছে চিলাহাটি থেকে খুলনাগামী সীমান্ত এক্সপ্রেস ট্রেন। গত বুধবার রাত ১০টার দিকে উপজেলার বোড়াগাড়ী ইউনিয়নের বাগডোকরা প্রধানপাড়া দোলা এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ডোমার-চিলাহাটি রেলপথে প্রায় দেড় ঘণ্টা ট্রেন চলাচল বন্ধ ছিল। এর আগে গাজীপুরের বনখড়িয়া এলাকায় রেললাইন কেটে ফেলেছে দুর্বৃত্তরা। এসময় রাজেন্দ্রপুর স্টেশন থেকে ছেড়ে আসে ঢাকা অভিমুখী মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনের ইঞ্জিনসহ সাতটি বগি লাইনচ্যুত হয়েছে। এ ঘটনায় নিহত হয়েছে একজন এবং আহত হয়েছেন কমপক্ষে ১০ জন। গত বুধবার ভোরে জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ রেল লাইনে এ ঘটনাটি ঘটেছে। নিহত আসলাম হোসেন ময়মনসিংহের গফরগাঁও থানার রওহা গ্রামের বাসিন্দা।
পুলিশ ও এলাকাবাসী জানায়, রাতের কোনো এক সময় বনখড়িয়া এলাকায় গ্যাসকাটার দিয়ে রেললাইন কেটে ফেলে দুর্বৃত্তরা। এ সময় মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনটি ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসে। কিছুদূর যাওয়ার পরপরই ট্রেনটি বনখড়িয়া এলাকায় পৌঁছলে ইঞ্জিনসহ সাতটি বগি লাইনচ্যুত হয়। এ ঘটনায় ট্রেনের এক যাত্রী মারা যান। ঘটনার পর উত্তরবঙ্গের সঙ্গে ঢাকার ট্রেন যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে।
গাজীপুরে ট্রেন দুর্ঘটনায় রেলপথ মন্ত্রণালয় তিন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। গতকাল বুধবার রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব (অতিরিক্ত দায়িত্ব) তৌফিক ইমাম স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে এই তথ্য জানানো হয়। অফিস আদেশে বলা হয়, বুধবার ভোর সোয়া ৪ টার দিকে গাজীপুর জেলাধীন শ্রীপুর উপজেলার প্রহল্লাদপুর ইউনিয়নের বনখড়িয়ার চিলাই ব্রিজ সংলগ্ন এলাকায় ঢাকাগামী মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনের ইঞ্জিনসহ ৭টি কোচ লাইনচ্যুত হয়। এ দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধান এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনারোধকল্পে করণীয় নির্ধারণ করার জন্য ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে রেলপথ মন্ত্রণালয়।
অফিস আদেশে আরও বলা হয়, ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব শাহ ইমাম আলী রেজা। আর সদস্য হিসেবে রযেছেন বাংলাদেশ রেলওয়ের পরিচালক(ইঞ্জিনিয়ারিং) মো. মহিউদ্দিন আরিফ, পরিচালক (মেকানিক্যাল) এ. বি. এম. কামরুজ্জামান।
কমিটি সরেজমিন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধান এবং দুর্ঘটনা প্রতিরোধে করণীয় নির্ধারণ করে প্রতিবেদন প্রস্তুত করা, অফিস আদেশ জারির ৩ কার্যদিবসের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল ও কমিটি প্রয়োজনে যে কোনো কর্মকর্তাকে সদস্য হিসেবে কো-অপরেটে করতে পারবে বলেও উল্লেখ করা হয়।
এর আগে পাবনার ঢালারচর থেকে ছেড়ে আসা রাজশাহী হয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জগামী ঢালারচর এক্সপ্রেস ট্রেনের ২টি বগির ৮টি চাকা লাইনচ্যুত হয়েছে। এতে পাবনার সঙ্গে রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। তবে এই ঘটনায় হতাহত হয়নি। সোমবার সকাল সাড়ে ৭টার দিকে পাবনার কাশিনাথপুর-বাঁধেরহাট রেল স্টেশনের মাঝে এ দুর্ঘটনা ঘটে। এর আগে রাজধানীর তেজগাঁও রেলস্টেশনের কাছে নির্মাণাধীন ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের ক্রেনের আঘাতে ইঞ্জিনসহ তিনটি বগি লাইনচ্যুত হয় তিতাস কমিউটার ট্রেনের।
দুর্ঘটনার পরেই ঢাকার সঙ্গের সারাদেশের ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। চলতি বছরের এপ্রিল-সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গত ছয় মাসে সারাদেশের প্রায় অর্ধশতাধিক দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে রেলওয়ের কর্মকর্তারা জানান। এর মধ্যে গত এপ্রিল-১২টি, মে-৭টি, জুনে-৬টি, জুলাই-৬টি, আগস্টে-১৪টি ও সেপ্টেম্বরে-৭টি দুর্ঘটনা ঘটে। মেইন লাইনে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলেই সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও অঞ্চল থেকে তদন্ত কমিটি গঠন করে প্রতিবেদন দেওয়া হয় কিন্তু প্রতিকার হয় না বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।
বেসরকারি সংগঠন ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্টের এক গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে, রেলপথের দুর্ঘটনার মধ্যে মুখোমুখি সংঘর্ষ, ট্রেন বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া, লেভেল ক্রসিং, সিগন্যালিং ত্রুটি, লাইনচ্যুতিসহ নানা কারণে ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটছে। দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে লাইনচ্যুতির ৭৫ শতাংশই ঘটছে রেললাইনের কারণে। এর অন্যতম কারণ যন্ত্রাংশের সঙ্কট, রেলপথের যন্ত্রপাতি চুরি ও রেলপথে পাথর না থাকা। পাশাপাশি রেলওয়ের সংশ্লিষ্টদের অবহেলা, লোকবল ঘাটতি, নিয়মিত তদারকি ও মেরামতের অভাব, রেলপথে মানসম্মত পর্যাপ্ত পাথরের স্বল্পতা ও ঝুঁকিপূর্ণ সেতুর কারণেও ঘটছে দুর্ঘটনা।
তথ্যমতে, বর্তমানে সারাদেশে তিন হাজার কিলোমিটারের বেশি রেললাইন রয়েছে। এর মধ্যে মানসম্পন্ন রেললাইন মাত্র এক হাজার কিলোমিটার। আর আট কারণে বাড়ছে রেল দুর্ঘটনা। রেল দুর্ঘটনায় পড়ার অন্যতম কারণ সিগন্যাল অমান্য করা বা সিগন্যালিং ত্রুটি। কোনো কারণে যদি সিগন্যালে ত্রুটি দেখা দেয় কিংবা চালক অমান্য করেন তাহলে অনেক ক্ষেত্রে দুর্ঘটনা ঘটে। রেলপথের ওপরে ক্রসিং থাকা ঝুঁকিপূর্ণ হলেও যোগাযোগের প্রয়োজনেই অনেক সময় তা করতে হয়। তবে কোনো স্থানে নতুন রেললাইন নির্মাণ করলে প্রয়োজনে লেভেল ক্রসিং নির্মাণ করে সেখানে গেটকিপার নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু দেশে এখনো ২ হাজার ৩১টি ঝুঁকিপূর্ণ রেলক্রসিং রয়েছে। সেসব স্থানে কোনো গেটকিপার নেই। রেল দুর্ঘটনার অন্যতম আরও একটি কারণ হচ্ছে ক্ষমতার অতিরিক্ত বগি স্থাপন করা। নিরাপদ ট্রেন পরিচালনায় অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রেলপথে পাথরের অপর্যাপ্ততা। পর্যাপ্ত পাথর থাকলে গতিবেগ বাড়লেও ট্রেনের দুর্ঘটনার ঝুঁকি কমে যায়। দেশে বর্তমানে রেলপথে ছোট-বড় তিন হাজার ১৪৩টি কালভার্ট ব্রিজ রয়েছে। এর মধ্যে ৩২৬টি বড় সেতু ও দুই হাজার ৮১৭টি ছোট সেতু রয়েছে। এর অধিকাংশই ব্রিটিশ আমলের। সেতুগুলো সংস্কার না করায় এরই মধ্যে ৪০২টি সেতু ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। ফলে মাঝে মধ্যে ব্রিজ ভেঙে, কিংবা সিøপার না থাকায় লাইনচ্যুৎ হয়ে রেল দুর্ঘটনা হচ্ছে। রেল দুর্ঘটনা রোধে নানা প্রযুক্তি আবিষ্কার হলেও দেশে এখনো তার ব্যবহার হচ্ছে না।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. শামসুল হক ইনকিলাবকে বলেন, সড়কের সঙ্গে রেলের কোনো সমন্বয় নেই। রেল লাইনের আশেপাশের এলাকাও ঝুঁকিপূর্ণ। শুধু যে লেভেল ক্রসিং ঝুঁকিপূর্ণ তা নয়। প্রতিবন্ধক বা পাহারাদার ছাড়া কোনো লেভেল ক্রসিং রাখার কোন অর্থ নেই। রেল লাইনের পাশে ৩ ফুট করে খুঁটির ব্যবস্থা করা যেতে পারে। মানুষ বাঁচানোর উন্নয়ন করতে হবে।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
ভাঙ্গায় এক্সপ্রেসওয়েতে পড়েছিল মোটরসাইকেল আরোহীর চূর্ণ-বিচূর্ণ লাশ
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের শহীদরাই আজকের বাংলাদেশ- কক্সবাজারে শিল্প উপদেষ্টা
অতিরিক্ত সময়ে এন্দ্রিকের জোড়া গোলে জিতে শেষ আটে রিয়াল
গ্রিক সাইপ্রিয়ট প্রশাসনকে অস্ত্র বিক্রয়ের মার্কিন সিদ্ধান্তে টিআরএনসি-এর ক্ষোভ ও উদ্বেগ
নরসিংদীতে বাস-ট্রাকের ত্রিমুখী সংঘর্ষ, আহত ৮
পাবনায় জনজীবনে ভয়াবহ হচ্ছে ভার্চুয়াল আসক্তি
মাঝ আকাশে ভেঙে টুকরো ইলন মাস্কের ‘স্টারশিপ’
বাংলাদেশ-ভারতকে অতীত কবর দিয়ে নতুন করে শুরু করতে হবে: সুনন্দা কে দত্ত রায়
সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগ অধ্যাদেশের খসড়া অনুমোদন
সাইফ ইস্যুতে কেজরিওয়ালের বিস্ফোরক মন্তব্য, পাল্টা প্রতিক্রিয়া বিজেপি নেতার
ট্রাম্পের শুল্ক ছাড়াও চীনের অর্থনৈতিক সংকটে তিনটি বড় চ্যালেঞ্জ !
খেজুরের রস খেতে গিয়ে গাড়িচাপায় মোটরসাইকেলের ৩ আরোহী নিহত
দিয়ালোর দুর্দান্ত হ্যাটট্রিকে ইউনাইটেডের নাটকীয় জয়
আজারবাইজান-জর্জিয়া সম্পর্ক শক্তিশালীকরণে উচ্চপর্যায়ের বৈঠক
আসাদগেটে সিএনজি-ট্রাক সংঘর্ষ, একজনের মৃত্যু
মরক্কোতে নৌকা ডুবে ৪৪ পাকিস্তানির মৃত্যু
'বন্ধী মুক্তির চুক্তি' চূড়ান্ত জানিয়েছে নেতানিয়াহুর দপ্তর
সুদানের সেনাপ্রধানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ যুক্তরাষ্ট্রের
উ. কোরিয়ার ইউক্রেনে সামরিক অংশগ্রহণ একটি কৌশলগত ভুল : রব বাউয়ার
সাইফ তো লিস্টে ছিল না,হঠাৎ হামলা হয়ে গেছেঃ মমতা