বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল : টার্গেটের চেয়ে গাড়ি চলাচল কম
০১ মার্চ ২০২৪, ১২:০৮ এএম | আপডেট: ০১ মার্চ ২০২৪, ১২:০৮ এএম
দুই প্রান্তে অপ্রতুল সড়ক অবকাঠামো ট্রাফিক ব্যবস্থায় গলদ উন্নয়ন শিল্পায়নে ধীরগতি :: বিদেশি ঋণ নির্ভর এই মেগা প্রকল্প শ্বেত হস্তিতে পরিণত হওয়ার শঙ্কা
চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলে প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কম যানবাহন চলাচল করছে। সমীক্ষায় বলা হয়েছিল, দেশের এই প্রথম সড়ক টানেল চালুর বছরে প্রতিদিন গড়ে ১৭ হাজারের বেশি গাড়ি চলতে পারে। কিন্তু বাস্তবে গাড়ি চলাচল করছে গড়ে প্রতিদিন পাঁচ হাজারেরও কম। যা টার্গেটের এক তৃতীয়াংশেরও কম। এমনকি টানেল খুলে দেওয়ার পর পর যত সংখ্যক গাড়ি চলেছে এখন তার চেয়েও কম গাড়ি টানেল পাড়ি দিচ্ছে। তাতে ১০ হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্পের সুফল নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।
চট্টগ্রামের সাথে দক্ষিণ চট্টগ্রাম, বান্দরবান ও কক্সবাজারের মধ্যে সমন্বিত কার্যকর সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকায় টানলে যানবাহন চলাচল কম বলে মনে করছেন এই খাতের বিশেষজ্ঞরা। তাছাড়া কর্ণফুলীর ওপারে আনোয়ায় প্রস্তাবিত একাধিক বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ শিল্প কারখানা চালু না হওয়ার কারণেও টানেলে গাড়ি চলাচল বাড়ছে না। দক্ষিণ চট্টগ্রামে ব্যাপক উন্নয়ন এবং শিল্পায়নের পাশাপাশি টানেলকে ঘিরে স্মার্ট সড়ক নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা না হলে দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম এই সড়ক টানেলের পুরোপুরি সুফল মিলবে না বলেও জানান বিশেষজ্ঞরা। তাদের আশঙ্কা টানেলে প্রত্যাশিত যানবাহন চলাচল নিশ্চিত করে এর সক্ষমতার পুরোটা কাজে লাগাতে না পারলে বিদেশি ঋণ নির্ভর ব্যয়বহুল এই মেগা প্রকল্পটি অদূর ভবিষ্যতে শ্বেত হস্তিতে পরিণত হতে পারে।
এই অঞ্চলের কোটি মানুষের স্বপ্নের টানেলে যান চলাচল শুরু হয়েছে গত ২৯ অক্টোবর। সেতু কর্তৃপক্ষের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, চালুর পর হরতাল-অবরোধের মতো রাজনৈতিক কর্মসূচির দিনগুলো বাদে প্রতিদিন গড়ে ৯ হাজার ৪৮টি যানবাহন টানেল পারাপার হয়েছে। আর চালুর পর ১৮ দিনের হিসাবে প্রতিদিন গড়ে টানেলটি ব্যবহার করেছে ছয় হাজার ৩১৮টি যানবাহন। শুরুতে টানেল দেখতে মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ে। বৃহত্তর চট্টগ্রাম ছাড়াও দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে অনেকে টানেল পাড়ি দিয়ে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার ঘুরতে আসেন। এই কারণে টানেলে যানবাহনের চাপ কিছুটা বেশি ছিল। তবে ধীরে ধীরে কমছে যানবাহন চলাচল। বর্তমানে গড়ে প্রতিদিন পাঁচ হাজারের মতো গাড়ি টানেল পাড়ি দিচ্ছে বলে জানান, টানেলের সহকারী ম্যানেজার (টুলস অ্যান্ড ট্রাফিক) তানভীর রিফাত।
তিনি গতকাল বৃহস্পতিবার ইনকিলাবকে বলেন, এখন প্রতিদিন পাঁচ হাজার গাড়ি চলেছে। তাতে টোল আদায় হচ্ছে ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা। তবে আয়ের চেয়ে টানেল পরিচালনা ব্যয় অনেক বেশি।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের উপ-কমিশনার (অতিরিক্ত ডিআইজি পদে পদোন্নতি প্রাপ্ত) তারেক আহম্মদ বলেন, টানেল যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হলেও যানবাহন চলাচল কম। এখন যে সব যানবাহন চলাচল করছে তার বেশির ভাগ পর্যটকদের। সরকারি ছুটির দিন ছাড়া অন্য সময় নানামুখী যানবাহনের চাপ কম। তবে এরমধ্যেও বন্ধের দিনে টানেলের পতেঙ্গা প্রান্তে যানজটের সৃষ্টি হয়। পতেঙ্গা সৈকতে আসা যানবাহনের জন্য কোনো পার্কিংয়ের ব্যবস্থা রাখা হয়নি। রাস্তায় গাড়ি রাখতে হচ্ছে। রাস্তায় গণপরিবহনে যাত্রী ওঠানামা করছে। আমরা বিষয়টি চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নজরে এনেছি।
আনোয়ারা প্রান্তে সংযোগ সড়কের অপ্রতুলতা এবং চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক চার লেন না হওয়ার কারণে অনেক যানবাহন টানেল এড়িয়ে চলাচল করছে বলে জানিয়েছেন জেলা পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের একজন কর্মকর্তা। তিনি বলেন, পতেঙ্গা প্রান্তে একাধিক সংযোগ সড়ক থাকলেও আনোয়ারা প্রান্তে সড়ক অবকাঠামো এখনও টানেলের উপযোগী হয়ে উঠেনি। ফলে সহজ যোগাযোগ নিশ্চিত না হওয়ায় টানেলে কম যানবাহন চলছে।
যদিও টানেলটি নির্মাণের জন্য করা বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের সম্ভাব্যতা সমীক্ষায় ২০২৫ সালে প্রতিদিন প্রায় ২৮ হাজার যান চলাচল করবে বলে পূর্বাভাস দেয়া হয়েছিল। ২০১৭ সালকে টানেল চালুর বছর ধরে এ পূর্বাভাস করা হয়েছিল। টানেলটি নির্মাণের জন্য সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করা হয় ২০১৩ সালে। এতে পূর্বাভাস দেয়া হয়েছিল, ২০১৭ সালে চালুর প্রথম বছরে টানেল দিয়ে প্রতিদিন গড়ে ১৭ হাজারের বেশি যান চলাচল করবে। ২০২০ সালে তা প্রায় ২১ হাজার ও ২০২৫ সালে প্রতিদিন চলাচল করা যানবাহনের সংখ্যা ২৮ হাজার ছাড়িয়ে যাবে। তবে ২০১৭ সালে টানেলটি চালু হওয়ার কথা থাকলেও এটি উদ্বোধন হয়েছে অর্ধ যুগ পর গতবছরের ২৮ অক্টোবর। তার পরদিন থেকে শুরু হয়েছে যানবাহন চলাচল। চালুর পরের ১৮ দিনে টানেলটি পারাপার হয়েছে এক লাখ ১৩ হাজার ৭২১টি যানবাহন। ২৯ অক্টোবর চালু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি যানবাহন চলাচল করেছে ৩ নভেম্বর। ওইদিন পারাপার হওয়া যানবাহনের সংখ্যা ছিল ১৪ হাজার ৭৯৮টি। পরের দিন ৪ নভেম্বর চলাচল করে ১০ হাজার ৫৩৩টি যানবাহন। দুইদিনই ছিল শুক্র ও শনিবার অর্থাৎ সাপ্তাহিক ছুটির দিন। তবে এখন যানবাহন চলাচল কমে এসেছে।
টানেল দিয়ে চলাচল করা যানবাহনের সংখ্যা পূর্বাভাসের চেয়ে কম হওয়ার পেছনে অনেক কারণ রয়েছে বলে জানিয়েছেন পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সহ-সভাপতি প্রকৌশলী সুভাস বড়–য়া। কর্ণফুলী টানেলসহ চট্টগ্রামের পরিবহণ ব্যবস্থা নিয়ে গবেষণাধর্মী কাজ করা এ প্রকৌশলী বলেন, টানেলের সঙ্গে পরিকল্পিত সড়ক নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা হয়নি। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক এখনো চার লেন করা হয়নি। ট্রাফিক ব্যবস্থাপনাও অত্যন্ত দুর্বল। আবার টানেলকে কেন্দ্র করে শিল্পায়নও হয়নি। আনোয়ায় চীনা অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার কথা থাকলে তা এখনো হয়নি।
এদিকে মীরসরাইতে দেশের সর্ববৃহৎ শিল্প নগরের কার্যক্রমও ধীরে চলছে, একই চট্টগ্রাম বন্দরের বে টার্মিনালের। চট্টগ্রাম বন্দরের পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল খুব শিগগিরই চালু হচ্ছে, তবে এই টার্মিনালের চার লাখ একক কনটেইনারের কয়টি টানেল পাড়ি দিয়ে দক্ষিণ চট্টগ্রাম বা কক্সবাজার যাবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। মাতারবাড়িতে গভীর সমুদ্র বন্দর চালু হলে টানেলে গাড়ি চলাচল বাড়তে পারে। তবে বন্দরের কাজ কখন শেষ হবে তা এখনো জানা যায়নি। যতদিন এ কাজগুলো হচ্ছে না, ততদিন বৃহৎ এ প্রকল্পটির কার্যকর সুফল পাওয়া যাবে না। তাছাড়া অতিরিক্ত হারে টোল আদায়ের কারণে কম যানবাহন চলাচল করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ব্যক্তিগত গাড়ির চেয়ে বাস, মিনি বাসসহ গণপরিবহন থেকে বেশি টোল আদায় হচ্ছে। এতে ভাড়া বেড়ে যাওয়ায় গণপরিবহন টানেল এড়িয়ে যাচ্ছে। টানেলকে ঘিরে সড়ক অবকাঠামো এবং পতেঙ্গা প্রান্তে পার্কিং না থাকায় যানজট সৃষ্টি হয়। সব মিলিয়ে টানেলে প্রত্যাশা অনুযায়ী গাড়ি চলাচল করছে না।
তিনি বলেন, পতেঙ্গা টার্মিনাল দিয়ে বছরে সাড়ে চার লাখ একক কনটেইনার আসবে। এ টার্মিনালটি চালুর পর সেখানকার গাড়িগুলো কীভাবে যাতায়াত করবে, তার পরিকল্পনাও কিন্তু এখনো হয়নি। কারণ এসব যানবাহন টানেলের পতেঙ্গা প্রান্ত হয়ে সিটি আউটার রিং রোড ধরে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে চলাচল করবে।
সক্ষমতা বাড়াতে বন্দরের গাড়ির ফার্স্ট প্রায়োরিটি হবে গতিশীলতা বাড়ানো। শুধু সাড়ে তিন কিলোমিটার টানেল দিয়ে তো গতিশীলতা বাড়ানো যাবে না। টানেলের পুরো সক্ষমতা কাজে লাগাতে হলে ব্যাপক উন্নয়ন এবং শিল্পায়নের পাশাপাশি সড়ক অবকাঠামো আধুনিকায়ন করতে হবে। তা না হলে এই টানেল শ্বেত হস্তিতে পরিণত হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। কারণ খুব শিগগিরই টানেল নির্মাণের জন্য নেওয়া বিদেশি ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল নির্মাণ করা হয়েছে চীন সরকারের ঋণে। ১০ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা নির্মাণ ব্যয়ের মধ্যে চীনের ঋণের পরিমাণ ছয় হাজার ৭০ কোটি টাকা। ২০ বছর মেয়াদি এ ঋণের পাঁচ বছরের গ্রেস পিরিয়ড এরই মধ্যে শেষ হয়ে যাচ্ছে বলে জানা গেছে।
সেতু বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, টানেলের এ ঋণ পরিশোধ করা হবে আদায় হওয়া টোলের টাকা দিয়ে। যদিও বর্তমানে আদায় হওয়া টোলের টাকায় টানেল পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় নির্বাহ করাই কঠিন হয়ে পড়েছে। কর্ণফুলী টানেল নির্মাণের জন্য করা সম্ভাব্যতা সমীক্ষায় টানেলটি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য দুই ধরনের ব্যয়ের কথা বলা হয়েছে। এরমধ্যে একটি হলো ‘ডেইলি মেইনটেন্যান্স’। টানেলের ভেতরে বিদ্যুৎ সরবরাহ, কার্বন ডাই-অক্সাইড অপসারণ করে অক্সিজেন সরবরাহসহ বিভিন্ন দৈনন্দিন কাজের পেছনে বছরে ১৮ লাখ ডলার (২০১২ সালের হিসাবে) খরচ হবে। অন্যদিকে প্রতি পাঁচ বছরে একবার করা হবে ‘রেগুলার মেইনটেন্যান্স’। এজন্য প্রতি পাঁচ বছর পরপর আরো ১৯ লাখ ডলার খরচ করতে হবে। রক্ষণাবেক্ষণ ছাড়াও কর্মীদের বেতন, বিদ্যুৎ-জ্বালানিসহ আনুষঙ্গিক পরিচালন কাজে বছরে ব্যয় হবে ১৭ কোটি ১৬ লাখ টাকা। মূল্যস্ফীতির বিবেচনায় নিয়ে এ পরিচালন ব্যয় প্রতি বছর ৮ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাওয়ার কথা বলা হয়েছে সমীক্ষা প্রতিবেদনে।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারে অনুমতি পাচ্ছে না ইউক্রেন
গাজা-লেবাননে নিহত আরো ২২২
আসাদের সঙ্গে বৈঠকের জন্য প্রস্তুত এরদোগান
জাবির সাবেক ছাত্রলীগ নেতাকে পিটিয়ে হত্যা মামলায় রায়হানের দোষ স্বীকার
গণহত্যাকারী কোন রাজনৈতিক দলের রাজনীতি করার অধিকার থাকে না: আসাদুজ্জামান রিপন
ভোটের অধিকার ফিরিয়ে আনা জন্য আমাদের লড়াই চলছে : গয়েশ্বর চন্দ্র রায়
ইনসি ইকো প্লাস সিমেন্ট নিয়ে এলো বাংলাদেশের সমূদ্র তীরবর্তী অঞ্চলের উপযোগী করে দীর্ঘস্থায়ী স্থাপনা নির্মাণের সমাধান
হাত-পা ও চোখ বেঁধে ঝুলিয়ে পেটানো হয় --- আবু বাকের
দৈনিক রাজবাড়ী কন্ঠে" প্রকাশকের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে ফরিদপুর সাংবাদিক জোটের প্রতিবাদ সভা
ডাটা সেন্টারের সক্ষমতা বৃদ্ধির তাগিদ তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টার
শ্রীলঙ্কার চীনপন্থি প্রেসিডেন্ট দিশানায়েকে কি ভারতের জন্য চ্যালেঞ্জ?
ফুটবলের মাঠে চমক দেখাতে চান তাবিথ আউয়াল
এবার ফাঁস হলো রাবি শিবির সভাপতির পরিচয়
নদী দখলকারীদের উচ্ছেদে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে - পানি সম্পদ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান
সাবেক পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক শামিম কারাগারে
স্বৈরাচারের পতন হলেও দোসররা এখনো রয়ে গেছে : তারেক রহমান
মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি রিক্রুটিং এজেন্সি মালিক গ্রেফতার
‘অধ্যাপক’ হিসেবে পদোন্নতি পেলেন শিক্ষা ক্যাডারের ৯২২ জন
ঢাবিতে মতবিনিময় সভায় যৌন নিপীড়ক শিক্ষক, শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ
সেনাবাহিনীর নারী সদস্যরা হিজাব পরতে পারবেন