সাদী মহম্মদের মৃত্যু ও কিছু প্রশ্ন
১৯ মার্চ ২০২৪, ০৭:২৮ পিএম | আপডেট: ১৯ মার্চ ২০২৪, ০৭:২৮ পিএম
সাদি মহম্মদের 'স্বেচ্ছামৃত্যু'(আত্মহত্যা) নিয়ে আমি খুব বেশি কিছু লিখিনি। কিন্তু এখন লিখতে বাধ্য হচ্ছি। কেননা তিনি আমার খুব প্রিয় শিল্পী ছিলেন। তার অনেক গান আমি শুনেছি এবং শুনতাম।(যদিও রবীন্দ্র সংগীত বাংলাদেশের শিল্পীর চেয়ে ভারতীয় শিল্পীদের কন্ঠে আমার ভালো লাগতো বেশি। তবে নজরুল গীতি আবার বাংলাদেশের শিল্পীদের কন্ঠের বেশি ভালো লাগে)। তাই প্রিয় শিল্পীর এমন অসম্মানে আমি না লিখে পারছি না।
গণমাধ্যম এবং সংস্কৃতি কর্মীদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে সাদি মহম্মদ স্বেচ্ছা মৃত্যু বা আত্মহত্যাকে বেছে নিয়েছেন। বাংলাদেশে এখন যারা রাষ্ট্রীয় পদক পাচ্ছেন তাদের বিবেচনায় সাদি মহম্মদের অনেক আগেই একুশে পদক বা স্বাধীনতা পদক পাওয়া উচিত ছিল তিনি আমার কোন সন্দেহ নেই। এবং তাকে অবহেলা করার তীব্র নিন্দা আমিও করছি। কিন্তু তাই বলে তিনি পুরস্কার না পেয়ে আত্মহত্যা করেছেন বা স্বেচ্ছামৃত্যু বেছে নিয়েছেন এই বয়ান যারা দিচ্ছেন তারা সাদি মোহাম্মদকে কতটা সম্মানিত করছেন? তাকে জীবনে একুশে পদক দেয়া হয়নি বলে তার লাশ শহীদ মিনারে নেয়া হলো না- এই ধরনের বয়ান তাকে কি আদৌ সম্মানিত করে? আমি মনে করি, কোন পুরস্কার কখনোই না পেলেও, এমনকি মরণোত্তর পুরস্কার না পেলেও সাদি মহম্মদ বাংলাদেশে সংগীতের জগতে যে স্থান করে নিয়েছেন তাতে অনেক পুরস্কারপ্রাপ্ত শিল্পীর চেয়ে তিনি শতাব্দীর পর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণীয় থাকবেন। এটাই তার সবচেয়ে বড় পুরস্কার। একজন শিল্পীর সবচেয়ে বড় পুরস্কার থাকে তার শ্রোতা ও ভক্তদের স্বীকৃতি। রাষ্ট্রীয় বা আন্তর্জাতিক পুরস্কার কেবল গুণের বিচারে দেয়া হয় না। এর পেছনে রাজনৈতিক, কূটনৈতিক, বাণিজ্যিক তথা বিভিন্ন স্বার্থ জড়িত থাকে। তাই শিল্পীরা সব সময় ভক্ত শ্রোতাদের অন্তরে যুগ যুগ বা কালান্তরিত হয়ে বেঁচে থাকতে চান। তারা সর্বোচ্চ পুরস্কার হিসেবে গ্রহণ করেন। সে কারণেই অনেক বিখ্যাত সৃজনশীল মানুষকে নামি নামি সব পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করতে দেখা যায়। সেখানে সাদি মহম্মদের মতো একজন শিল্পী পুরস্কার না পেয়ে অভিমানে আত্মহত্যা করবেন এ ধরনের বয়ান কখনোই তাকে সম্মানিত করে না।
আরো একটি বিষয় নিয়ে বলতে চাই, টেলিভিশনের নিউজ দেখলাম সাদি মহম্মদের লাশ বিদায় জানাতে উপস্থিত রবীন্দ্র শিল্পীরা তার লাশ সামনে রেখে রবীন্দ্র সংগীত গেয়ে তাকে বিদায় জানিয়েছেন। কোন মুসলিম যখন মারা যান তখন আত্মীয়-স্বজন ও শুভানুধ্যায়ী যারা তাকে চির বিদায় জানাতে বা তার লাশের জানাজা করতে হাজির হন তারা সবাই কুরআন তেলাওয়াত করেন সূরা পাঠ করেন বিভিন্ন দোয়া দরুদ করে লাশের রুহের মাগফেরাত ও জান্নাত কামনা করে থাকেন। এটাই স্বাভাবিক রীতি। কিন্তু সাদি মোহাম্মদের বিদায় উপস্থিত শিল্পীরা তার লাশের সামনে গাইলেন, 'তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে যত দূরে আমি ধাই, কোথাও দুঃখ, কোথাও মৃত্যু, কোথা বিচ্ছেদ নাই, তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে, যত দূরে আমি ধাই।’ রবীন্দ্রনাথ এই গানটি রচনা করেছিলেন ১৯০১ সালে। এটি রবীন্দ্রনাথের পূজা পর্বের গান। পুরো গানটি এরকম:
'তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে
যত দূরে আমি ধাই
কোথাও দুঃখ, কোথাও মৃত্যু
কোথা বিচ্ছেদ নাই
তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে
যত দূরে আমি ধাই
কোথাও দুঃখ, কোথাও মৃত্যু
কোথা বিচ্ছেদ নাই
তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে
যত দূরে আমি ধাই।
মৃত্যু সে ধরে মৃত্যুর রূপ
দুঃখ হয় হে দুঃখের কূপ
মৃত্যু সে ধরে মৃত্যুর রূপ
দুঃখ হয় হে দুঃখের কূপ
তোমা হতে যবে হইয়ে বিমুখ
আপনার পানে চাই
তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে
যত দূরে আমি ধাই।
হে পূর্ণ, তব চরণের কাছে
যাহা-কিছু সব আছে আছে আছে
নাই নাই ভয়, সে শুধু আমারই
নিশিদিন কাঁদি তাই
হে পূর্ণ, তব চরণের কাছে
যাহা-কিছু সব আছে আছে আছে
নাই নাই ভয়, সে শুধু আমারই
নিশিদিন কাঁদি তাই
অন্তরগ্লানি সংসারভার
পলক ফেলিতে কোথা একাকার
জীবনের মাঝে স্বরূপ তোমার
রাখিবারে যদি পাই।
তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে
যত দূরে আমি ধাই
কোথাও দুঃখ, কোথাও মৃত্যু
কোথা বিচ্ছেদ নাই
তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে
যত দূরে আমি ধাই।'
সন্দেহ নেই এটি নির্ভেজাল পূজার গান। এই গানের মাধ্যমে মূলত দেবদেবীর প্রশস্তি গাওয়া হয়েছে। তাদের প্রতি নিবেদন তুলে ধরা হয়েছে। গানের দুটি চরণের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে,
" হে পূর্ণ, তব চরণের কাছে যাহা-কিছু সব
আছে আছে আছে--
নাই নাই ভয়, সে শুধু আমারই, নিশিদিন
কাঁদি তাই।
অর্থাৎ যে সুমহান প্রভু আমাদের সৃষ্টি করেছেন তাঁর পদতলে সবই আছে। সেখানে ভয়ের কোন চিহ্ন নেই। যত ভয় আছে সবই আমাদের অন্তরের ভেতরকার ভয়। সেই ভয় আমাদের তাড়িয়ে বেড়ায়। আমাদের কাঁদায় প্রতিটি মুহুর্তে, প্রতিটি ক্ষণে।
অন্তরগ্লানি সংসারভার পলক
ফেলিতে কোথা একাকার
জীবনের মাঝে স্বরূপ তোমার
রাখিবারে যদি পাই॥
মানে হল, আমাদের জীবনের কেন্দ্রে (হৃদয়াসনে) যদি আমাদের সুমহান প্রভুকে স্থান দেই তাহলে আমাদের অন্তরের যত কষ্ট ও ভয়, সংসারের যত ভার সবই পলক ফেলতে না ফেলতেই এক নিমেষেই কোথায় যেন মিলিয়ে যায়। তখন আমাদের পাহাড়তুল্য বিষাদে ভরা মনেও আপনা আপনি একটা প্রেরণাদায়ক ভাবনা সৃষ্টি হয় যে, ছোট খাটো দুঃখ ও কষ্টে জীবন ভেঙে পড়ার না, কখনোই ভেঙে পড়ার ন। এইভাবে আমাদের শোক রূপান্তরিত হয় শক্তিতে।"
সন্দেহ নেই রবীন্দ্রনাথ যে প্রভুর কথা বলেছেন, যে প্রভুর চরণ তলে নিবেদন করেছেন এই গানে, তা রবীন্দ্রনাথের পূজা পর্বের সকল গানে উল্লেখিত বিভিন্ন হিন্দু দেব দেবী ছাড়া অন্য কেউ নয়। মুসলিম শিল্পী সাদি মোহাম্মদের লাশের সামনে পূজার গান, হিন্দু দেব দেবীর স্তুতি কীর্তন কতটা সঙ্গত এই বিচার পাঠকরাই ভালো করতে পারবেন। তবে রবীন্দ্রনাথের রচনায় ধর্মীয় চেতনার মূল উৎস উপনিষদ ও পুরাণ। ধর্মীয়ভাবে তিনি ব্রাহ্ম ধর্মের অনুসারী হলেও চেতনাগতভাবে তিনি ব্রাহ্মণ্যবাদের অনুসারী। জাতীয়ভাবে তিনি মহাভারতীয় চেতনায় উদ্ভাসিত যা এসেছে ব্রাহ্মণ্য সুপ্রিমিস্ট চেতনা থেকে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর কবিতায় দেশ, প্রেম এবং পূজাকে এমনভাবে মোল্ডিং করেছেন যা বুঝতে হলে বা এগুলোর পার্থক্য করতে হলে বিশেষ অভিনিবেশ প্রয়োজন। কিন্তু যথেষ্ট সচেতনতার অভাবে আমরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এগুলো গুলিয়ে ফেলি। আর প্রগতিশীল বিতর্কের মীমাংসা করতে হলে আগে বুঝতে হবে এই প্রগতিশীলতার মানদণ্ড কে নির্ধারণ করেছে, এর মাপকাঠি কার হাতে? আপনি মন্দিরে যান, গির্জায় যান, প্যাগডায় যান ও আপনার প্রগতিশীলতা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলবে না বরং এটি আরো শক্তিশালী যোগ্যতা হিসেবে বিবেচিত হবে। কিন্তু আপনি মসজিদে যান- আপনি প্রতিক্রিয়াশীল। আপনি নমস্কার বলেন, আদাব বলেন, আপনি প্রগতিশীল। কিন্তু আপনি সালাম দিলে, আলহামদুলিল্লাহ, সুবহানআল্লাহ বললে আপনি প্রতিক্রিয়াশীল।
এর আগেই একজন রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পীকে তার লাশের পাশে দাড়িয়ে রবীন্দ্র সঙ্গীত গেয়ে বিদায় দিতে দেখেছি। বছরখানেক পূর্বে বিখ্যাত গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার মারা গিয়েছেন। তার লাশের পাশে তো এরকম আয়োজন দেখিনি। অনেকেই হয়তো বলবেন সাদি মহম্মদ যেহেতু সঙ্গীত শিল্পী ছিলেন সে কারণেই তার লাশের পাশে গান গাওয়া দূষণীয় ব্যাপার নয়। তাহলে প্রশ্ন জাগে, নৃত্যশিল্পী মারা গেলে কি তার লাশের সামনে নাচতে হবে? চলচ্চিত্র শিল্পী মারা গেলে কি তার লাশের সামনে মুভি চালাতে হবে? যন্ত্র শিল্পী মারা গেলে কি তার লাশের পাশে বাদ্যযন্ত্র বাজাতে হবে?
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
যে আইন বাংলাদেশে চলে, সেই আইনে পার্বত্য অঞ্চলেও চলবে -কুমিল্লার সমাবেশে ফয়জুল করিম চরমোনাই
সীতাকু-ের বিতর্কিত সাবেক সহকারী কমিশনার চট্টগামের এডিসি হলেন
ফরাজীকান্দি নেদায়ে ইসলাম ওয়েসীয়ান ছাত্রদের উদ্যোগে ঈদে মিলাদুন্নাবী (সা.) উপলক্ষে আনন্দ র্যালি
ব্রুনাইয়ে ভবন থেকে পড়ে গফরগাঁওয়ের প্রবাসী নিহত
গুলিবিদ্ধ ইলহামের জন্য তারেক রহমানের অনন্য উদ্যোগ
মব জাস্টিসের প্রতিবাদে চবিতে মানববন্ধন
মতলবে ছেলের ইটের আঘাতে মায়ের মৃত্যু : আটক ছেলে
ছাত্ররাজনীতিতে গুণগত সংস্কার প্রয়োজন : শিবির সেক্রেটারী
ভোলায় ঝড়ের কবলে পড়ে ১০ ট্রলারডুবি, নিখোঁজ ১
যে কোনো ষড়যন্ত্রের দাঁতভাঙা জবাব দিতে প্রস্তুত: বিএনপির স্থানীয় কমিটির সদস্য ডা. জাহিদ
‘শুধু সংস্কারে থেমে থাকলেই চলবে না, অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন করতে হবে’ : তারেক রহমান
সাজেক ভ্রমণে আটকা পড়েছেন ৮০০ পর্যটক
কুষ্টিয়ায় বিদ্যুৎস্পৃষ্টে সুগার মিলের নিরাপত্তা প্রহরীর মৃত্যু
একদিনে ৮৪৩ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত, মৃত্যু ১
বিচার বিভাগে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা প্রধান বিচারপতির
মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করতে ঐক্যবদ্ধ থাকার কোনো বিকল্প নেই: তারেক রহমান
জিয়ার ভূমিকাকে অবহেলা করায় পাহাড়ে সমস্যা হচ্ছে : জামায়াত নেতা শাহজাহান চৌধুরী
দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হোক আওয়ামী লীগ তা কখনও চায়নি : শিমুল বিশ্বাস
এনপি জনগণকে নিয়ে যে কোনো ষড়যন্ত্রের দাঁতভাঙ্গা জবাব দিবে- বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এজেডএম ডাঃ জাহিদ হোসেন,
আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির অভিযোগে আওয়ামীলীগের পাঁচ নেতা গ্রেপ্তার