‘শিক্ষার্থীদের ওপর নৃশংস দমনপীড়নের মধ্য দিয়ে সরকারের সর্বগ্রাসী উদ্দেশ্য প্রকাশ পেয়েছে’

Daily Inqilab অনলাইন ডেস্ক

০২ আগস্ট ২০২৪, ১২:১৪ পিএম | আপডেট: ০২ আগস্ট ২০২৪, ১২:১৪ পিএম

শিক্ষার্থীদের ওপর নৃশংস দমনপীড়নের মধ্য দিয়ে সরকারের সর্বগ্রাসী উদ্দেশ্য প্রকাশ পেয়েছে। প্রকাশ পেয়েছে গণতান্ত্রিক স্বাধীনতায় স্থিতিস্থাপকতার (রিসাইলেন্স) বিষয়ও। এই সঙ্কটকে বাংলাদেশের ভবিষ্যত রাজনীতির ‘আত্মার লড়াই’ (ব্যাটল ফর সাউল) হিসেবে দেখা যেতে পারে।

একদিকে আছেন ৭৬ বছর বয়সী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত ১৫ বছর ধরে তিনি খাঁটি, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করেননি। তিনি বাংলাদেশকে স্বৈরতন্ত্র থেকে একটি সর্বগ্রাসী রাষ্ট্রে পরিণত করতে চাইছেন বলেই মনে হচ্ছে। বাংলাদেশে তার এই সর্বগ্রাসী দৃষ্টিভঙ্গিতে কেউ তার বা তার সরকারের কোনো জবাবদিহিতা চাইতে পারবেন না। যদি কেউ প্রতিবাদ করেন তাহলে সহিংস দমনপীড়নের মুখে পড়তে হয় তাকে বা তাদেরকে। এর মধ্যে আছে মৃত্যু, নির্যাতন, জোরপূর্বক গুম ও বন্দি করে রাখা।

প্রতিবাদকারীদের বিরুদ্ধে যেকোনো রকম সহিংসতাকে ‘রাষ্ট্রবিরোধী’ ‘স্বাধীনতাবিরোধী’ এবং ‘ষড়যন্ত্রকারী’দের কাজ বলে অভিহিত করা হয়। বলা হয়, তারা প্রধানমন্ত্রীর প্রয়াত পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের ‘সোনার বাংলা’র স্বপ্নকে পথচ্যুত করতে চায়।

এই লড়াইয়ের অন্যদিকে আছেন হাজার হাজার বাংলাদেশি শিক্ষার্থী এবং রাজনৈতিক বিরোধীপক্ষ।

তারা সরকারের জবাবদিহি চায়। সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় বৃহত্তর অংশগ্রহণ চায়। সরকারি চাকরিতে সুষ্ঠু অধিকারের দাবিতে তারা তাদের গণতান্ত্রিক উচ্চাকাক্সক্ষাকে চর্চা করতে চান, বিশেষ করে সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থার সংস্কারের মাধ্যমে।

১৫ বছর ধরে সব স্তরের বাংলাদেশি স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের মুখে তাদের সহনশীলতা প্রদর্শন করেছেন। এবং একে চ্যালেঞ্জ করার জন্য নতুন কৌশল অবলম্বন করেছেন। শেখ হাসিনার সর্বগ্রাসী উচ্চাকাঙ্খার বিরুদ্ধে বর্তমানে ছাত্রদের চাপ হলো ‘ডেমোক্রেটিক ব্রিকোলেজ’-এর একটি উদাহরণ। ডেমোক্রেটিক ব্রিকোলেজ হলো এমন একটি সৃষ্টিশীল উপায় যেখানে প্রতিক্রিয়াশীল সরকার এবং জনগণের অংশগ্রহণের আদর্শকে সমুন্নত করা হয়। স্বৈরাচারের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা হয়।

এর আগে ২০১৮ সালের বিক্ষোভের সময়ে মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের উত্তরসুরিদের জন্য সরকারি চাকরিতে শতকরা ৩০ ভাগ কোটা বাতিল দাবি করেছিলেন শিক্ষার্থীরা। তারা যুক্তি দিয়েছিলেন যে, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ওই কোটা ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর প্রযোজ্য ছিল। কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছর পরে এসে তা অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে। তারা আরও অভিযোগ করেন যে, শেখ হাসিনার সরকার তার দলীয় ক্যাডারদেরকে নিয়োগ দেয়ার জন্য এই কোটা ব্যবহার করছিলেন। ২০১৮ সালের বিক্ষোভে কোটা ব্যবস্থা বাতিল হয়।

তবে তা এ বছর আবার ফেরানো হয়। এতে বহু শিক্ষার্থী ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তারা সারাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ বিক্ষোভ শুরু করেন। তারা সরকারি সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করার পাশাপাশি র‌্যালি করতে থাকেন। এ সময়ে তারা তাদের গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা এবং প্রতিবাদ করার অধিকার প্রদর্শন করেছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতিবাদী শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্য মন্তব্য করেন। রাজাকার একটি অবমাননাকর শব্দ। এটা দিয়ে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বাংলাদেশিদের বিরুদ্ধে যারা নৃশংসতা চালিয়েছিল বা চালাতে সহায়তা করেছিল তাদেরকে বোঝানো হয়। তার এই অভিযোগ বিক্ষোভকারীদের ক্ষুব্ধ করে তোলে। তারা উল্টো স্লোগান দিয়ে প্রধানমন্ত্রী হাসিনাকে একজন স্বৈরাচার বলে আখ্যায়িত করতে থাকে।

এই প্রতিবাদ থামাতে শেখ হাসিনার সরকার প্রথমে তার দল আওয়ামী লীগের ছাত্র বিষয়ক সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে নামায়। তারা লাঠি, পিস্তল ও অন্যান্য অস্ত্র হাতে বৈষম্যমূলকভাবে হামলা করে। এমনকি তারা নারী শিক্ষার্থীদেরও ছাড় দেয়নি। অনেক ক্ষেত্রে ছাত্রলীগকে সমর্থন দিতে দেখা গেছে পুলিশকে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শারীরিক শক্তি প্রয়োগ করে।

এমন অবস্থায় ছাত্রদের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ বিক্ষোভ সহিংসতায় রূপ নেয়। অভিযোগ করা হয়েছে যে, তারা ঢাকায় রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন স্টেশনে আগুন দিয়েছে। এই টেলিভিশন স্টেশনকে সরকারের মুখপত্র হিসেবে দেখা হয়।

প্রতিবাদকারীদের সরিয়ে দিতে পুলিশ, সেনবাহিনী, বিজিবি, ডিটেক্টিভ ব্রাঞ্চ ও গোয়েন্দা এজেন্সিসহ সব নিরাপত্তা রক্ষাকারীদের মোতায়েন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ইন্টারনেট ব্লাকআউট করে দেয়া হয়। জারি করা হয় কঠোর কারফিউ। হামলাকারী বা উত্তেজিত জনতার ভিড় দেখলে তাদের বিরুদ্ধে দেখামাত্র গুলির নির্দেশ দেয়া হয়।

এর ফলাফল ভয়াবহ। হিসাব অনুযায়ী, এতে নিহত হয়েছেন প্রায় ২০০ মানুষ। এর বেশির ভাগই ছাত্র। নিহতদের মধ্যে বেশ কিছু শিশু আছে। শিক্ষার্থীরা এবং কিছু মিডিয়ার সূত্র দাবি করেছে, নিহতের প্রকৃত এই সংখ্যা অনেক বেশি। মিডিয়ার রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে, বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি করতে ব্যবহার করা হয়েছে হেলিকপ্টার। জাতিসংঘের কর্মকর্তারা উদ্বেগ জানিয়ে দিয়েছেন যে, বিক্ষোভকারীদের দমন করতে ব্যবহার করা হয়েছে ইউএন লেখা সংবলিত ভেহিক্যালস। দেশটির নিজস্ব সশস্ত্র বাহিনী ও বিজিবির দায়িত্ব হলো দেশের সীমান্ত রক্ষা করা। তাদেরকে দেখা গেছে নিজেদের নাগরিকদের বিরুদ্ধে গুলি করতে।

এর মধ্যে সরকার কোটা কমিয়ে ৭ ভাগ করেছে। এর মধ্যে শতকরা ৫ ভাগ রাখা হয়েছে মুক্তিযোদ্ধার উত্তরসূরিদের জন্য। দুই ভাগ রাখা হয়েছে নৃগোষ্ঠী এবং বিকলাঙ্গ বা ট্রান্সজেন্ডারদের জন্য।

এর মধ্য দিয়ে দমনপীড়নের নৃশংসতা মুছে দেয়া যায় না। এমন দমনপীড়নের কথা বাংলাদেশের ইতিহাসে আর কখনো শোনা যায়নি।

সীমিত পরিসরে ইন্টারনেট ফিরে আসার পর ভয়াবহতা ফুটে উঠছে ভিডিও ও ছবিতে। নিরস্ত্র সাধারণ মানুষকে রাস্তায় গুলি করতে দেখা যাচ্ছে। তাদেরকে রাস্তার ওপর ফেলে রেখেছিল তারা। অনেকের অঙ্গহানী হয়েছে। এমনকি চোখ হারিয়েছেন। ছাত্র আন্দোলনের বেশ কিছু নেতাকে জোরপূর্বক অদৃশ্য করে ফেলা হয়। তাদেরকে নির্যাতন চালানো হয় এবং সরকার জোর করে তাদের সম্মতি আদায় করে। যাহোক শেখ হাসিনা দৃশ্যত রাস্তায় নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছেন। কিন্তু তিনি বহু মানুষের হৃদয় ও মন জয় করতে পারবেন না।

যেসব ছাত্রনেতাকে জোরপূর্বক তুলে নেয়া হয়েছিল, নির্যাতন করা হয়েছিল এবং পরে মুক্তি দেয়া হয়েছে- তারা আশা ছেড়ে দিচ্ছেন না। কান্নাজড়িত কণ্ঠে, অশ্রুসজল চোখে এবং স্পষ্ট ব্যথা নিয়ে তারা সংবাদ সম্মেলন করেছেন এবং শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে গণহত্যার দায় শেখ হাসিনাকে মেনে নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। একই সঙ্গে তাকে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তারা। সূত্র : অনলাইন ৩৬০ ইনফো, টাইমস অব ইন্ডিয়া থেকে


বিভাগ : জাতীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

ডিসেম্বরে সর্বাধিক রেমিট্যান্স এসেছে যুক্তরাষ্ট্র, সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাজ্য ও সউদী আরব থেকে

ডিসেম্বরে সর্বাধিক রেমিট্যান্স এসেছে যুক্তরাষ্ট্র, সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাজ্য ও সউদী আরব থেকে

যশোরে চাকুরিচ্যুত বিডিআর সদস্যদের চাকুরি পুনর্বহালের দাবিতে মানববন্ধন

যশোরে চাকুরিচ্যুত বিডিআর সদস্যদের চাকুরি পুনর্বহালের দাবিতে মানববন্ধন

অপরাধী যদি আমার ভাই হয় তাকেও ছাড় দিবেন না সিরাজদিখানে- কৃষি ও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

অপরাধী যদি আমার ভাই হয় তাকেও ছাড় দিবেন না সিরাজদিখানে- কৃষি ও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

আবারও সিলেটের নায়ক জাকির, খুলনার টানা দ্বিতীয় হার

আবারও সিলেটের নায়ক জাকির, খুলনার টানা দ্বিতীয় হার

মাগুরায় সড়ক দুর্ঘটনায় দুই মোটর সাইকেল চালক নিহত

মাগুরায় সড়ক দুর্ঘটনায় দুই মোটর সাইকেল চালক নিহত

কুষ্টিয়ায় র‌্যাবের অভিযানে ইয়াবা সহ মাদক ব্যবসায়ী গ্রেফতার

কুষ্টিয়ায় র‌্যাবের অভিযানে ইয়াবা সহ মাদক ব্যবসায়ী গ্রেফতার

কুষ্টিয়ার আলফা মোড়ে সিএনজি স্ট্যান্ড’ নাম দিয়ে চাঁদাবাজি

কুষ্টিয়ার আলফা মোড়ে সিএনজি স্ট্যান্ড’ নাম দিয়ে চাঁদাবাজি

জুলাই আগস্টে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে হামলা : বহিস্কার হলেন শাবির ২৯ শিক্ষার্থী

জুলাই আগস্টে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে হামলা : বহিস্কার হলেন শাবির ২৯ শিক্ষার্থী

জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের মেয়াদ বাড়লো ১৬ দিন

জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের মেয়াদ বাড়লো ১৬ দিন

সাতক্ষীরা সীমান্তে ধান চাষে বিএসএফের বাধা, পতাকা বৈঠক অনুষ্ঠিত

সাতক্ষীরা সীমান্তে ধান চাষে বিএসএফের বাধা, পতাকা বৈঠক অনুষ্ঠিত

পিলখানা হত্যাকাণ্ডের নায়কদের শাস্তি ও ৩ দফা দাবিতে পটুয়াখালীতে মানববন্ধন

পিলখানা হত্যাকাণ্ডের নায়কদের শাস্তি ও ৩ দফা দাবিতে পটুয়াখালীতে মানববন্ধন

ইরানের নতুন আত্মঘাতী ড্রোনে আতঙ্কে ইসরাইল!

ইরানের নতুন আত্মঘাতী ড্রোনে আতঙ্কে ইসরাইল!

চাকুরিচ্যুত বিডিআরদের চাকুরিতে পুনর্বহালের দাবি ডিসিকে স্মারক লিপি

চাকুরিচ্যুত বিডিআরদের চাকুরিতে পুনর্বহালের দাবি ডিসিকে স্মারক লিপি

গোপালগঞ্জে জেলা বিএনপি’র সংবাদ সম্মেলন

গোপালগঞ্জে জেলা বিএনপি’র সংবাদ সম্মেলন

পটুয়াখালী প্রেসক্লাবের আহবায়ক কমিটিকে “আমরা -৮৪”-বন্ধুদের পক্ষ থেকে ফুলের শুভেচ্ছা

পটুয়াখালী প্রেসক্লাবের আহবায়ক কমিটিকে “আমরা -৮৪”-বন্ধুদের পক্ষ থেকে ফুলের শুভেচ্ছা

বিএনপির প্রতিনিধি দলের সঙ্গে ইইউ রাষ্ট্রদূতের সৌজন্যে সাক্ষাৎ

বিএনপির প্রতিনিধি দলের সঙ্গে ইইউ রাষ্ট্রদূতের সৌজন্যে সাক্ষাৎ

কেরানীগঞ্জে স্বেচ্ছাসেবকদল সভাপতির বিরুদ্ধে মার্কেট দখলের অভিযোগ

কেরানীগঞ্জে স্বেচ্ছাসেবকদল সভাপতির বিরুদ্ধে মার্কেট দখলের অভিযোগ

সরকারী ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয়ের সুবিধা নিচ্ছে বেসরকারি ট্রেন কোম্পানি

সরকারী ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয়ের সুবিধা নিচ্ছে বেসরকারি ট্রেন কোম্পানি

একযুগ পর জাপান প্রবাসী দূলাল চৌধুরীকে ফুলেল শুভেচ্ছায় বরণ করলো এলাকাবাসী

একযুগ পর জাপান প্রবাসী দূলাল চৌধুরীকে ফুলেল শুভেচ্ছায় বরণ করলো এলাকাবাসী

কি‌শোরগ‌ঞ্জে দুই গ্রু‌পের সংঘ‌র্ষে ইউ‌নিয়ন বিএন‌পির সভাপ‌তি নিহত আহত ৫

কি‌শোরগ‌ঞ্জে দুই গ্রু‌পের সংঘ‌র্ষে ইউ‌নিয়ন বিএন‌পির সভাপ‌তি নিহত আহত ৫