ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরাচারিণী শেখ হাসিনার পতনের পর দেশে ১৫ আগস্টকে কেন্দ্র করে গত কয়েকদিন ধরে রাজনৈতিক অঙ্গনে উদ্বেগ, উত্তেজনা ও শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এতদিন জাতীয় শোক দিবস ১৫ আগস্টের যে সরকারি ছুটি ছিল মঙ্গলবার সেটি বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।

জনরোষের মুখে হাসিনা দেশ ছেড়ে পলায়নের পর গা ঢাকা দিয়ে আছে দেড় দশকেরও বেশি সময় ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। এমন অবস্থায় ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকী কেন্দ্র করে ঢাকায় শোক ও শ্রদ্ধা জানানোর কর্মসূচি নিয়েছে আওয়ামী লীগ। মূলত দিবসটি ঘিরে আওয়ামী লীগ নেতাদের নাশকতা পরিকল্পনার নানা তথ্য ভাসছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।

সেদিন ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের কর্মসূচিতে নিরাপত্তা দিতে নতুন সরকারকে চিঠি দেয়া হয়েছে বলে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। এদিন শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকীতে ঢাকার ধানমণ্ডিতে একত্রিত হয়ে শ্রদ্ধা জানাতে চায় আওয়ামী লীগ।

বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানানোর কথা বলা হলেও মূলত ১৫ আগস্ট ঘিরে প্রতিবিপ্লবের দুঃস্বপ্ন দেখছে দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে গুম-খুনের সংস্কৃতি গড়ে তোলো দলটি। এদিন সারাদেশ থেকে অস্ত্রধারী, দলীয় সন্ত্রাসী ও পুলিশ-বিজিবি-র‌্যাব থেকে পালিয়ে যাওয়া আওয়ামী লীগের দোসরা ব্যাপক নাশকতা চালানোর ষড়যন্ত্র করছে। ভারতের সহায়তায় তারা এদিন মরণ কামড় দিবে বলে আশঙ্কা করছে সংশ্লিষ্টরা। ইতিমধ্যেই ভারতে পলাতক শেখ হাসিনা দলীয় নেতাকর্মীদেরকে টেলিফোন করে সবাইকে ঢাকায় আসার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। এ সংক্রান্ত একাধিক অডিও ও ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ফাঁস হয়েছে।

এদিকে, আওয়মী লীগ ১৫ আগস্ট ঘিরে আওয়মী লীগের নাশকতা রুখে দিতে মাঠ দখলে রাখার ঘোষণা দিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা। এছাড়া আওয়মী বিরোধী সকল রাজনৈতিক দলও ষড়যন্ত্র রুখে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। অনেকের মতে, সরকারকে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে ব্যস্ত রেখে সংখ্যালঘুদের উপর হামলা চালিয়ে ভারতকে সুযোগ করে দেয়ার ষড়যন্ত্র থাকতে পারে এই নীল নকশায়।

দু’পক্ষের এমন পাল্টাপাল্টি অবস্থানের কারণে দেশে আবারো সহিংস পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। যা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যেও এক ধরনের উদ্বেগ লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাবা শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে এ দিনকে জাতীয় শোক দিবস হিসেবে পালন করা হয়। পরে ২০০২ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর এ সিদ্ধান্ত বাতিল করা হয়।

অন্যদিকে, ৫০ বছর আগের এক ব্যক্তির জন্য শোক পালন করা গুরুত্বপূর্ণ নাকি জুলাই জুড়ে যে শত শত ছাত্র-জনতাকে গণহত্যা করা হয়েছে তার জন্য শোক পালন করা জরুরি তা নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে সবাই প্রশ্ন তুলেছেন।

আওয়ামী লীগ সরকারের শাসন আমলে পিলখানা গণহত্যা, শাপলা চত্বর গণহত্যা এবং বিগত ছাত্র আন্দোলনে যে সহস্রাধিক গণহত্যা চালানো হয়েছে তার তুলনায় ১৫ আগস্ট এর গণহত্যা অত্যন্ত গৌণ হয়ে গেছে। বিগত ১৬ বছরে হাজার হাজার মানুষকে গুম করে হত্যা করা হয়েছে, আয়না ঘরে বন্দি রেখে বছরের পর বছর নির্যাতন করা হয়েছে। তাদেরও পরিবার রয়েছে, তাদেরও স্বজন রয়েছে। তাদেরও স্বজন হারানোর শোক রয়েছে। কাজেই সবকিছুকে অস্বীকার করে কেবল ১৫ আগস্টকে জাতীয় শোক দিবস পালন করা হলে সেটি জুলাই বিপ্লবের সাথে প্রতারণার নামান্তর।

জাতীয় শোক দিবস কেন্দ্র করে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে সতর্ক দৃষ্টি রাখছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। ১৫ আগস্টের এ দিনটিকে ঘিরে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আশঙ্কা করছেন সংগঠনটির সমন্বয়করা। দেশকে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিয়ে ক্ষমতা দখলের দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র রুখতে ওইদিন রাজপথে থাকার ঘোষণা দিয়েছেন তারা।

৫ আগস্টের বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের আস্তানা ও কার্যালয় ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের ঘটনাকে ভারত সরকার সম্পূর্ণরূপে হিন্দুদের ওপর আক্রমণ বা সাম্প্রদায়িক রূপে দেখিয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় কতিপয় আওয়ামীপন্থি হিন্দুদের নেতৃত্বে রাজধানীর শাহবাগসহ সারা দেশে বিক্ষোভ লক্ষ্য করা গেছে। উপরন্তু শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ায় আওয়ামী লীগের অস্তিত্ব এখন হুমকির সম্মুখীন।

অনেকেই বলছেন, ১৫ আগস্ট কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ সারা দেশে শোডাউন ও জমায়েতের মধ্য দিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করবে। হিন্দুদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে আওয়ামী লীগকে মাঠে নামিয়ে ছাত্র-জনতার বিপ্লবকে প্রশ্নবিদ্ধ করার ষড়যন্ত্র চলছে। এর মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করার এমনকি সম্ভব হলে প্রশাসন ও সেনাবাহিনীর একটি অংশের সহযোগিতায় পুনরায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের যৌথ প্রচেষ্টা চালাবে ভারত সরকার ও আওয়ামী লীগ।

বিগত ১৬ বছরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে শেখ হাসিনা টুকরো টুকরো করে এক এক করে ভারতের হাতে তুলে দিয়েছে। লক্ষ কোটি টাকা লুটপাট করেছে এবং দেশের বাইরে পাচার করেছে। এসবের বিচারের আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় পুনর্বাসনের উদ্যোগ দেশবাসী গ্রহণ করবে না।

প্রকৃতপক্ষে আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের নামে সরকারের উপরে চাপ সৃষ্টি করে ভারত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার থেকে ফায়দা হাসিল করতে চায়। তাদের মূল লক্ষ্য শেখ হাসিনার আমলে যে সমস্ত সুযোগ-সুবিধা ও চুক্তি তারা করেছে সেগুলো বহাল রাখা। শেখ হাসিনার আমলে দেশের প্রশাসনে যে পঞ্চম বাহিনীর প্রবেশ ও নেটওয়ার্ক তৈরি করা হয়েছে সেগুলো বহাল রাখা। এবং শেখ হাসিনাকে ব্যবহার করে বাংলাদেশে ভারতীয় শাসকগোষ্ঠী যে লুটপাট চালিয়েছে সেগুলোর বিচার ও আলোচনা বন্ধ রাখা।

তাদের এই কাজে সহযোগিতা করেছে দেশের অভ্যন্তরের মিডিয়া ও কিছু চাটুকার বুদ্ধিজীবী। এই মিডিয়াগুলো কখনোই শেখ হাসিনাকে বাস্তব অবস্থা বুঝতে দেয়নি। শেখ হাসিনার সব ধরনের অন্যায় কর্মকান্ড তারা চাটুকারিতা দিয়ে বৈধতা দিয়েছে নিজেদের স্বার্থে। এতে শেখ হাসিনার ও দল হিসেবে আওয়ামী লীগের ক্ষতি হলেও এইসব চাটুকারদের বড় অংশই এখন রং বদল করে ভোল পাল্টে নতুন স্রোতে গা ভাসাতে শুরু করেছে। নতুন সরকারের শুভাকাঙ্ক্ষী হয়ে তারা মূলত আত্মরক্ষার চেষ্টা করছে। খুব অল্পদিনেই তারা তাদের আসল চেহারা দেখাতে শুরু করবে। কাজেই এদের ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে এ ব্যাপারে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন তাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ক্রমাগত পোস্ট দিয়ে যাচ্ছে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা বলেন, পরাজিত শক্তি আওয়ামী লীগ নানা কূটকৌশল আঁকছে। আমরা ছাত্র-জনতা কোনোভাবেই তাদের ১৫ আগস্টের ক্যু করার পরিকল্পনা সফল হতে দেব না। সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসুদ বলেন, আওয়ামী সরকারের প্রেতাত্মারা এখনো সক্রিয়। ভারতীয় দালালদের সব ষড়যন্ত্র ও প্রতিবিপ্লব রুখে দিতে হবে। বিপ্লবকে সুসংহত ও রাষ্ট্রের পুনর্গঠন নিশ্চিত করার আগে ছাত্র-জনতা রাজপথ ছাড়ছে না।

১৫ আগস্টের এ ষড়যন্ত্র রুখতে সারা দেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে বিএনপি, জামায়াত ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে সর্বদলীয় প্রতিরোধ গড়ে তুলে আগামী কয়েকদিন ঢাকাসহ সারা বাংলার রাজপথ দখলে রাখার আহ্বান জানান তারা।