কথার ফুলঝুরিতেই সীমাবদ্ধ
০৮ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০১ এএম | আপডেট: ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০১ এএম
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ উপদেষ্টার তিন মাস
তিস্তাসহ অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন বিষয়ে এখনো কোনো বৈঠক হয়নি
নদী রক্ষায় দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেই
কোনো খাল এখনো উদ্ধার হয়নি
বনভ‚মির ৭ হাজার ৪৫০ একর জমি বেদখল
উদ্ধারে কোনো তৎপরতা নেই
নোবেল জয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তিন মাস দেখতে দেখতেই পূর্ণ হয়ে গেল। যেকোনো সরকারের ১০০ দিনে যে হানিমুন সময় ধরা হয় সেটা প্রায় শেষের পথে। তাই এ সরকারের কাছে মানুষের যে প্রত্যাশা তার প্রাপ্তি কতটুকু হলো তার হিসাব-নিকাশ শুরু হয়ে গেছে। ছাত্র-জনতার এক অকল্পনীয় অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এর মাধ্যমে দীর্ঘ ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসান ঘটে। দেশের মানুষ এক নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্নে বিভোর হয়ে ওঠে। আর মানুষের সেই স্বপ্ন পূরণের অঙ্গীকার নিয়ে গত ৮ আগস্ট দেশ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন সারাবিশ্বে সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব শান্তিতে নোবেল জয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। আর তার এই যাত্রাপথে সহযোদ্ধা হিসেবে নিয়েছেন আরও ২০ জনকে। সব মিলিয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে ২১ সদস্যের অন্তর্বর্তী সরকার নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে অর্থাৎ দেশের মানুষের স্বপ্ন ও আশা পূরণে কাজ করে যাচ্ছেন। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সক্ষমতা, দক্ষতা, বিশ্বব্যাপী তার গ্রহণযোগ্যতা ইতোমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে। জাতিসংঘের অধিবেশনে অংশগ্রহণ করে তিনি তার বিশ্বজনীনতাকে প্রমাণ করেছেন। বাংলাদেশকে নিয়ে গেছেন এক অনন্য উচ্চতায়। তবে তার সহযোদ্ধা অনেকের সক্ষমতা ও কর্মদক্ষতা নিয়ে ইতোমধ্যে নানা মহলে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস নিজেও অনেকের কার্যক্রমে সন্তুষ্ট হতে পারেননি। তাইতো তিনি তার উপদেষ্টা পরিষদের সবার তিন মাসের কার্যক্রম ও সম্পদের হিসাব জানতে চেয়েছেন।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের যাত্রাপথের সহযোদ্ধাদের অন্যতম একজন হলেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) নির্বাহী পরিচালক হিসেবে তিনি বেশ আলোচিত। তিনি দেশের পরিবেশ উন্নয়নে বেশ সাহসী ভূমিকা রেখেছেন। তার মতো এমন পরিবেশবাদীকে এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়ায় দেশের মানুষ খুবই আশান্বিত হয়েছিল। প্রথম দিকে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান মানুষের সে আশার প্রদীপে আলোও জ্বালিয়েছেন।
দায়িত্ব গ্রহণের পর পর তিনি ভারতের সংবাদ সংস্থা পিটিআইকে দেওয়া এক সক্ষাৎকারে বলেন, বাংলাদেশ ভারতের অভিন্ন নদী তিস্তা ও গঙ্গার পানি বণ্টন ইস্যুতে একটি বন্ধুত্বপূর্ণ সমাধান খুঁজতে চায় বাংলাদেশ। তবে একই সঙ্গে এই ইস্যুতে ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সমাধান সম্ভব না হলে আন্তর্জাতিক আইনের দ্বারস্থ হতে পারে বাংলাদেশ। সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, আমি তিস্তার পানি বণ্টনের বিষয়টি নিয়ে (বাংলাদেশে) সংশ্লিষ্ট সব অংশীদারের সঙ্গে আলোচনা করেছি। আমরা আলোচনা করেছি যে, তিস্তা চুক্তি নিয়ে প্রক্রিয়া ও সংলাপ পুনরায় শুরু করতে হবে। ৪১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ তিস্তা নদী ভারতের সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এই নদীর ওপর ভারত গজলডোবায় একটি বাঁধ দিয়ে পানি প্রত্যাহার করছে কিন্তু এই বিষয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে পানি বণ্টন নিয়ে ভারতের কোনো চুক্তি নেই। ১৯৯৬ সালের গঙ্গা পানি বণ্টন চুক্তির আলোকে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি করার চেষ্টা করা হলেও তা এখনো বাস্তবায়িত হয়নি।
গত ২৫ সেপ্টেম্বর রাজধানীর পানি ভবনের সম্মেলন কক্ষে ‘অভিন্ন নদীতে বাংলাদেশের ন্যায্য অধিকার’ বিষয়ক বিশেষ সেমিনারে দেওয়া বক্তব্যে তিনি বলেন, আন্তঃসীমান্ত নদ-নদীতে বাঁধ নির্মাণের জন্য আন্তর্জাতিক আইন থাকলেও ভারত অধিকাংশ সময় এসব আইনের তোয়াক্কা করছে না। এরই মধ্যে তারা (ভারত) স্বীকৃত আন্তঃসীমান্ত ৫৪ নদীর মধ্যে ৩৬টি নদীর ওপর মোট ৫৪টি বাঁধ (ব্যারাজ) এবং ড্যাম তৈরি করেছে। ফলে এসব বাঁধ ভাটি অঞ্চলে (বাংলাদেশ) পানির স্বাভাবিক ও যথাযথ প্রবাহে বিঘœ ঘটাচ্ছে। তিনি বলেন, আন্তঃসীমান্ত নদীর পানির অধিকার ও হিস্যা আদায়ে ভারতের সাথে শিগগির আলোচনার উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। জনগণের মতামতের ভিত্তিতে এই আলোচনা করা হবে এবং আলোচনার ফলাফলও জনগণকে জানানো হবে।
তিস্তার ন্যায্য পানির দাবি এ দেশের মানুষের দীর্ঘদিনের। মানুষের এই প্রাণের দাবি নিয়ে কথা বলায় রিজওয়ানার প্রতি সবার শ্রদ্ধাবোধ আরও বেড়ে যায়। তার স্ট্যাটম্যানশিপ এই বক্তব্য সবার হৃদয় ছুঁয়ে যায়। রাতারাতি তিনি দেশের মানুষের কাছে আইকন হয়ে ওঠেন। কিন্তু সময় যত যাচ্ছে তার প্রতি মানুষের প্রত্যাশা ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে আসছে। দায়িত্ব গ্রহণের তিন মাস পূর্ণ হলেও এখনও ভারতের সাথে পানি বণ্টনের বিষয় নিয়ে কোনো আলোচনাই শুরু করতে পারেনি।
এত গেল কূটনৈতিক ব্যর্থতার কথা। দেশের মধ্যে যে নদী দখল ও দূষণ নিয়ে এতদিন তিনি কথা বলেছেন, এর বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন সে বিষয়েও এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি। শুধুমাত্র বিভিন্ন এনজিও আয়োজিত সেমিনারে সুন্দর সুন্দর কথামালার ফুলঝুরি ছড়িয়ে বেড়াচ্ছেন।
বনভ‚মিতে দখলদারদের আগ্রাসন এখনো অব্যাহত রয়েছে। বন বিভাগের হিসবি মতে, গত ৫ আগস্টের আগে শুধুমাত্র গাজীপুরের প্রায় ৫৩ হাজার একর বনভ‚মির মধ্যে ৭ হাজার ৪৫০ একর জমি বেদখলের কথা বলা হলেও বাস্তবে পরিমাণটা আরও অনেক বেশি। কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গাজীপুরের বনভ‚মিতে চলছে ব্যাপক আগ্রাসন। বিট অফিসে হামলা, অস্ত্র লুট ছাড়াও বন বিভাগের কোনো কর্মী সরেজমিন জবরদখলে বাধা দিতে গেলে মুহূর্তেই শত শত মানুষ একত্রিত হয়ে দলবেঁধে তাদের ওপর আক্রমণ করছেন। বন বিভাগ এসব জমি অবৈধ দখলদারদের কাছ থেকে দখলমুক্ত করতে পারছে না। বছরের পর বছর ধরে অবৈধ দখলদাররা বনের জমি দখল করে মিল কারখানা, বহুতল ভবন, হোটেল, রিসোর্ট গড়ে তুললেও তাদের উচ্ছেদ তৎপরতা তেমন নেই। মাঝে মধ্যে অভিযানের মাধ্যমে কিছু জমি উদ্ধার করা গেলেও কিছুদিন পর সেই জমি ফের দখল হয়ে যাচ্ছে। বন বিভাগ আর অবৈধ দখলদারদের চোর-পুলিশ খেলায় হারিয়ে যাচ্ছে বনের জমি।
ঢাকার বিভিন্ন খাল উদ্ধারের ব্যাপারেও অনেক গালভরা বুলি শোনা গেলেও এখন পর্যন্ত একটি খালও উদ্ধার সম্ভব হয়নি। গত ২৮ সেপ্টেম্বর রাজধানীর বন ভবনে সিইজিআইএস আয়োজিত ‘বিগত ১০০ বছরে ঢাকা শহরের নগর প্রতিবেশ, ভ‚মি ব্যবহার এবং জীববৈচিত্র্যে স্থানিক ও সময়ানুক্রমিক পরিবর্তন ও কৌশলগত কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন’ শীর্ষক মতবিনিময় কর্মশালায় পরিবেশ উপদেষ্টা বলেন, অবৈধভাবে দখল হওয়া ঢাকার খাল উদ্ধারে রাজউককে প্রতি সপ্তাহে অভিযান পরিচালনা করতে হবে। কোনো অন্যায়কে বৈধতা দেওয়া যাবে না। অবৈধ খাল উদ্ধারে প্রয়োজনে অভিযান বাড়াতে হবে। ঢাকার খালগুলো দিয়ে ‘বøæ নেটওয়ার্ক’ করার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। যে খালগুলো এখনো উদ্ধার করা সম্ভব, সেগুলো দিয়ে এ নেটওয়ার্ক করা হবে। কিন্তু তার সে কথা শুধু কথার কথাই রয়ে গেছে। রাজউকের আজ পর্যন্ত খাল উদ্ধারে কোনো অভিযান পরিচালনা করতে দেখা যায়নি। বিশ্ব যুবদিবস উপলক্ষে সারাদেশে যে ৬৪টি খাল পরিষ্কার করা হয়েছে সেটিও যুব মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে হয়েছে। এ আইডিয়াও দিয়েছেন যুব মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজিব ভূঁইয়া।
উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান পরিবেশ রক্ষায় পলিথিন বন্ধে বেশ তৎপর রয়েছেন। ইতোমধ্যে রাজধানীর সুপার শপগুলোতে গত ১ অক্টোবর থেকে পলিথিন ব্যবহার বন্ধ রয়েছে। গত ১ নভেম্বর থেকে রাজধানীর বিভিন্ন মার্কেটে পলিথিন বন্ধের কথা বলা হলেও এখনো দেদারসে পলিথিন বিক্রি হচ্ছে। পলিথিন কারখানায়ও অভিযান চলছে। তারপরও উৎপাদন বন্ধ হচ্ছে না। প্রায় দুই দশক আগে বাংলাদেশ সরকার ১ জানুয়ারি ২০০২ ঢাকা শহরে এবং ১ মার্চ ২০০২ থেকে সারা দেশে পলিথিনের উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এরপর তৎকালীন বিএনপি সরকারের পরিবেশ মন্ত্রী শাহজাহান সিরাজ সারাদেশে পলিথিন বন্ধ করতে পেরেছিলেন। তিনি এ কাজে সফল হয়েছেন। এবার সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানও যদি এ কাজে সফল হন তাহলে দেশের মানুষ অবশ্যই তাকে সাধুবাদ দেবে। তবে তার কাছে মানুষের প্রত্যাশা অনেক বেশি। এসব এনজিও ধ্যান-ধারণার বাইরে এসে তাকে স্ট্যাটম্যান সুলভ কাজকর্ম করতে হবে। দেশের নদীগুলো বাঁচাতে হবে। তিস্তাসহ অভিন্ন নদীর পানি হিস্যা আদায়ে কাজ করতে হবে। আর এসব করতে হলে এনজিওর বৃত্ত থেকে বেরিয়ে এসে বৃহত্তর পরিধিতে কাজ করতে হবে।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
কুরস্কে ইউক্রেনের সৈন্যদের কঠিন সংগ্রাম এবং ট্রাম্পের জন্য অপেক্ষা!
আগরতলায় বাংলাদেশ উপ-দূতাবাসে হামলার প্রতিবাদে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ
ত্রিপুরায় বাংলাদেশিদের জন্য হোটেল ও খাবার মিলবে না
কক্সবাজারে গোয়েন্দা অভিযানে ২ অস্ত্রধারী আটক
খোশরোজ কিতাব মহলের মালিক মহীউদ্দীন আহমদ আর নেই
চীনের ‘ঝুহাই এয়ারশো ২০২৪’,ভবিষ্যৎ বিমান শক্তির এক ঝলক
ভারত নিজেকে মনে করে সে বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, নেপালের বড়-দাদা : কবীর সুমন
‘ভারত বয়কট হোক’
ইসরায়েলকে ‘গণহত্যায় দায়ী বর্ণবাদী রাষ্ট্র’ ঘোষণা করলো মর্যাদাপূর্ণ অক্সফোর্ড ইউনিয়ন
সকালে ঝলমলে রোদ,সন্ধ্যা নামতেই শীতে কাঁপছে পঞ্চগড়
বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ভারতকে ব্যান্ডউইথ নেওয়ার অনুমতি দেয়নি বিটিআরসি
আজ ২৬তম জাতীয় প্রতিবন্ধী দিবস
সময় এসেছে নতুন এক দৃষ্টিভঙ্গির, ভারতকে নিয়ে বার্তা হাসনাতের
আসছে নতুন টাকা, থাকছে জুলাই বিপ্লবের গ্রাফিতি
রায়গঞ্জে ৮ ইউনিয়ন পরিষদে প্রশাসকে বরণ করে নিলেন সাধারণ মানুষ
চাঁদপুরে দুই কোটি টাকার ব্রিজে উঠতে লাগে মই দিয়ে
ইমরান খান ও বুশরা বিবির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি
খুনি হাসিনা সরকারের অর্থপাচারের তথ্য পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত হবে’
শীতের শুরু থেকেই সীমান্তবর্তী অঞ্চলে লেপ-তোষকের দোকানে কারিগরদের ব্যস্ততা বেড়েছে
আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে হামলার প্রতিবাদে পর্তুগালে প্রতিবাদ সভা