ঢাকা   বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৪ আশ্বিন ১৪৩১
পূর্বকথন

ভারতের সভ্যতায় মুসলমানদের অবদান

Daily Inqilab মুনশী আবদুল মাননান

২৪ মার্চ ২০২৩, ১১:৫৫ পিএম | আপডেট: ২৫ জুন ২০২৩, ০৮:১২ পিএম

মুসলিম শাসকদের যারা ভারত জয় করেছেন, ঐক্যবদ্ধ করেছেন, গঠন করেছেন, সমৃদ্ধ করেছেন তাদের চরিত্রহনন করা হচ্ছে পরিকল্পিত ও সংঘবদ্ধভাবে। বিন কাসিম, সুলতান মাহমুদ, সুলতান মুহম্মদ ঘোরী, সুলতান কুতুবদ্দীন আইবাক, স¤্রাট বাবর, স¤্রাট শাহজাহান, স¤্রাট আওরঙ্গজেব এমনকি ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতাসংগ্রামী টিপু সুলতান পর্যন্ত উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয়েছেন। ভারতের সভ্যতা-সংস্কৃতির উন্নয়ন ও সমৃদ্ধিতে মুসলমানদের অবিস্মরণীয় অবদানের কথা বিশ্ব ইতিহাসে স্বীকৃত ও কীর্তিত হলেও তা এখন গায়ের জোরে অস্বীকার করা হচ্ছে। রামরাজত্ব প্রতিষ্ঠার সবচেয়ে বড় বাধা মনে করা হচ্ছে মুসলমানদের। তাদের অতীত ও বর্তমানকে। অতীতকে মুছে ফেলা হচ্ছে, বর্তমানকে অস্বীকার ও উপেক্ষা করা হচ্ছে। তাদের নিরালম্ব, অসহায় করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে।

যে মুসলমানরা ভারতে আধুনিকতার সূচনা করেছে, এক উন্নত সভ্যতা ও সংস্কৃতি উপহার দিয়েছে, শত শত বছরে ভারতকে মাতৃভূমি মেনে গড়ে তুলেছে, তাদের এভাবে উৎখাত ও নির্মূল করা কখনোই সম্ভব নয়। কী দেয়নি ভারতকে মুসলমানরা? মুসলিম আগমনের পূর্বে ভারতের সার্বিক অবস্থা ছিল অত্যন্ত নাজুক ও শোচনীয়। ভারত ছিল বহির্বিশ্ব থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। জনসাধারণের একটি অংশের মধ্যে প্রাচীন বিদ্যা ও দর্শনের চর্চা থাকলেও বহির্বিশ্বের সঙ্গে পরিচয় বিশেষ করে বাইরের সভ্যতা, জ্ঞান-বিজ্ঞান, দর্শন, শিক্ষা-সংস্কৃতি ইত্যাদির সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা ছিল না। ঐতিহাসিকদের মতে, আলেকজান্ডারই ছিলেন সর্বশেষ স¤্রাট, যিনি বাইরের দেশ থেকে ভারতে অভিযান চালিয়েছিলেন। তারপর থেকে ভারত ছিল আবদ্ধ, মলিন জলাশয়ের শামিল। সেই সময় মুসলমানরা ছিল বিশ্বের সবচেয়ে সভ্য, আলোকিত ও সংস্কৃতবান জাতি। ভারতে মোগল সা¤্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা জহির উদ্দিন মুহাম্মদ বাবর ইসলাম ও মুসলিমপূর্ব ভারতের একটি খন্ডচিত্র তার আত্মজীবনী ‘তুযুক-ই বাবরী’তে তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন: ভারতে উন্নত ঘোড়া নেই, ভালো গোশত নেই, আঙ্গুর নেই, তরমুজ নেই, বরফ নেই, শীতল পানি নেই, শৌচাগার নেই, মোমবাতি নেই, বাতি রাখার পাত্র নেই, মশাল নেই। মোমবাতির পরিবর্তে সেবকেরা কাদামাটি, কাঠ বা লোহার তৈরি পিদিম ব্যবহার করতো। সরিষার তেল এর জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এই পিদিম তিন পা বিশিষ্ট। এক পা-তে বাতিদানের মুখের আকৃতিতে একটি লোহা বা কাঠ স্থাপন করা হতো। রাতের বেলা রাজা-মহারাজাদের যদি আলোর দরকার হতো তখন পরিচারিকাগণ এ স্থূল পিদিম নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো।

বাগান বা প্রাসাদে পানি প্রবাহের কোনো সুব্যবস্থা নেই। প্রাসাদগুলোতে সৌন্দর্য, সামঞ্জস্য, পরিচ্ছন্নতার অভাব রয়েছে এবং এতে বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা নেই। মহিলারা পরতো ধূতি, এর একাংশ দিয়ে পা পর্যন্ত ঢেকে রাখতো, অপরাংশ ছড়িয়ে দিতো মাথার ওপরে।

স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহর লাল নেহেরু তাঁর ‘ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া’ বইতে বাবরের লিখিত বিবরণ স্বীকার করে ভারতের পশ্চাৎপদতার কারণ নির্ণয়ের চেষ্টা করেছেন। বলেছেন: বাবরের লিখিত উতিহাস থেকে উত্তর ভারতের সাংস্কৃতিক দরিদ্রতার বিবরণ আমরা পাই। এর পেছনে কারণ ছিল অংশত তৈমুর লঙ্গের ধ্বংসাত্মক তৎপরতা এবং অংশত শিল্পী, কারিগর ও বিজ্ঞ ব্যক্তিদের দলবদ্ধভাবে দক্ষিণ ভারতে গমন। এ অধঃপতনের পেছনে আরেকটি কারণ হচ্ছে, ভারতের জনগণের সৃষ্টিধর্মী প্রতিভা শুকিয়ে গিয়েছিল। বাবরের মতে, এদেশে দক্ষ কারিগর ও শিল্পীর অভাব নেই কিন্তু তাদের উদ্ভাবনী ক্ষমতা ও যান্ত্রিক আবিষ্কারের দক্ষতার অভাব রয়েছে।

তখন ভারতীয় সমাজ ছিল বিভক্ত, পারস্পরবিরোধী, স্বার্থতাড়িত, অবনত ও বিষম। সুস্থ ও মানবিক সংস্কৃতির কোনো চর্চা ছিল না। মুসলমানদের আগমনের ফলে সেই সমাজে একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন সূচিত হয়। এ সম্পর্কে জওহরলাল নেহেরু বলেছেন: ‘উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে আগত আক্রমণকারী ও ইসলামের আগমন ভারতের ইতিহাসে বিশেষ গুরুত্বের দাবি রাখে। তারা হিন্দু সমাজে সৃষ্ট কুসংস্কারসমূহ বিশেষত বর্ণপ্রথা, শ্রেণিবৈষম্য, অস্পৃশ্যতা এবং অন্তহীন একাকিত্বের স্বরূপ উন্মোচন করেন। ইসলামের ভ্রাতৃবোধের আদর্শ ও মুসলমানদের বাস্তব সাম্য হিন্দু মানসিকতায় সুগভীর প্রভাব বিস্তার করে। বিশেষত, যেসব মানুষ হিন্দু সমাজে সর্বদা সমানাধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল তাদের ব্যাপকভাবে আলোকিত করে।’

ভারতকে বিচ্ছিন্নতা থেকে মুক্ত করে বহির্বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন, বাইরের সভ্যতা, শিক্ষা-সংস্কৃতি, দর্শন ও চিন্তাধারা ইত্যাদির সঙ্গে পরিচয় করানো, ¯্রষ্টা বা আল্লাহর একত্ববাদের ধারণা প্রদান, তাঁর ইবাদতের প্রক্রিয়া-পদ্ধতি শিক্ষাদান মুসলমানদেরই একক অবদান। এ সম্পর্কে ঐতিহাসক ড. কে এন পানিকরের অভিমত প্রণিধানযোগ্য। তিনি তাঁর ‘এ সার্ভে অব ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি’তে বলেছেন: এ কথা স্পষ্ট যে, এ যুগে হিন্দু ধর্মের ওপর ইসলামের সুগভীর প্রভাব পড়েছে। হিন্দুদের মধ্যে ¯্রষ্টার উপাসনার ধারণা ইসলামের বদৌলতে সৃষ্টি হয়েছেÑ এ যুগের সব হিন্দু পুরোহিত তাদের দেবতার নাম যাই রাখুন না কেন, ¯্রষ্টা এক, তিনিই উপাসনার একমাত্র উপযুক্ত, তার মাধ্যমেই আমরা পারলৌকিক মুক্তি পেতে পারি।

আল্লাহর একত্ববাদ ইসলামের মূল কথা। ‘আল্লাহ ছাড়া উপাস্য নেই।’ এর পরে আছে মুহম্মদ সা. এর কথা। ‘মুহম্মদ সা. আল্লাহর রাসূল।’ এই বিশুদ্ধ ও দ্ব্যার্থহীন একত্ববাদ এক অনিঃশেষ প্রেরণা ও শক্তির নাম। অতি দ্রুত বিশ্বের সর্বত্র ইসলাম বিস্তার ও প্রতিষ্ঠার পেছনে এই প্রেরণা ও শক্তির ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। তারপরে আছে ইসলামের সাম্য ও ভাতৃচেতনা। মানুষের মধ্যে কোনো ভেদ-বিভেদ নেই, সব মানুষ সমান। সব আল্লাহ বিশ্বাসী পরস্পরের ভাই। ভারতে ইসলামের প্রসারে এবং মুসলমানদের আত্মপ্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে একত্ববাদ, সমতা ও ভাতৃবোধ ছাড়াও আরো অনেক কিছু ভূমিকা রেখেছে। তাদের সঙ্গে নিয়ে আসা উন্নত মূল্যবোধ, রুচিবোধ, সংস্কৃতি এখানে প্রতিষ্ঠা করে মুসলমানরা যে অবদান রাখে তা এখনো বহাল আছে। কৃষি, শিল্প, শিক্ষা, নগর পরিকল্পনা, নগরায়ন, চিকিৎসা, ইতিহাস রচনা, শিল্পকলা, সাহিত্য ইত্যাদি প্রতিটি ক্ষেত্রে মুসলমানদের অমোচনীয় ভূমিকা-অবদান রয়েছে। এ সম্পর্কে সংক্ষেপে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা উপস্থাপন করেছেন সুখ্যাত চিন্তাবিদ ঐতিহাসিক সাইয়িদ আবুল হাসান আলী নদভী তার ‘ভারতবর্ষে মুসলমানদের অবদান’ গ্রন্থে। ‘ইসলাম ইন ইন্ডিয়া’ গ্রন্থের লেখক স্যার যদুনাথ সরকার ভারতে মুসলমানদের বিশেষ ১১টি অবদানের কথা বর্ণনা করেছেন। সেগুলো হলো: ১. বহিঃবিশ্বের সাথে সংস্পর্শের প্রত্যার্পণ, ভারতীয় নৌ-শক্তির পুনরুজ্জীবন। ২. ভারতের ব্যাপক অংশের ওপর অভ্যন্তরীণ শান্তি। ৩. প্রসাশনিক সামঞ্জস্য। ৪. উচ্চতর শ্রেণীর লোকদের মধ্যে সামাজিক রীতিনীতি ও পোশাকের সমতা। ৫. ভারত ও আরবের শিল্পকলার সম্মিলন। ৬. একটি সাধারণ ভাষা, যা সরকারি ভাষা হিসেবে গঠিত। ৭. দিল্লি-আগ্রার রাজদরবারের কাছে স্বদেশি সাহিত্যের উত্থান। ৮. একেশ্বরবাদী ধর্মীয় ভাবধারার পুনরুজ্জীবন ও সুফিবাদ। ৯. অত্যন্ত মূল্যবান ঐতিহাসিক সাহিত্যকর্ম, যা মধ্যযুগের ইতিহাস পুনরায় গঠন করতে সাহায্য করেছে। ১০. যুদ্ধের কলাকৌশলের উৎকর্ষ সাধন। ১১. অভ্যাস ও স্বভাবের সূক্ষ্মতা।

ভারতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে মুসলমানদের এত অবদান, যা বলে শেষ করা যাবে না। ভারতের যা কিছু গৌরবের, অহংকারের, খ্যাতির, তাদের অধিকাংশের পেছনে মুসলমানদের সুনির্দিষ্ট, ব্যাপক ও উদ্দীপক ভূমিকা ও অবদান রয়েছে। চাইলেই বিজেপি, উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা তা মুছে ফেলতে পারবে না। আমরা অতঃপর ভারতের সভ্যতায় মুসলমানদের অবদান সম্পর্কে আলোচনা প্রকাশ করতে থাকবো। একদিকে বিখ্যাত ও গুরুত্বপূর্ণ মুসলিম বিজেতা ও শাসকদের অবদান বর্ণনা করা হবে, অন্যদিকে ইসলাম প্রচারক, আওলিয়া-দরবেশ ও পীর-ফকিরদের অবদান তুলে ধরা হবে। (সমাপ্ত)


বিভাগ : বিশেষ প্রতিবেদন


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

ইত্তিহাদেই সিটিকে রুখে দিল ইন্টার

ইত্তিহাদেই সিটিকে রুখে দিল ইন্টার

রোনালদোদের নতুন কোচ পিওলি

রোনালদোদের নতুন কোচ পিওলি

দক্ষিণ আফ্রিকাকে গুড়িয়ে আফগানদের ঐতিহাসিক জয়

দক্ষিণ আফ্রিকাকে গুড়িয়ে আফগানদের ঐতিহাসিক জয়

যেই গৌরব কেবল শারজাহ ক্রিকেট স্টেডিয়ামের

যেই গৌরব কেবল শারজাহ ক্রিকেট স্টেডিয়ামের

রিট করে ‘খেলাপি ঋণ স্থগিত’ বন্ধ চান ব্যাংক-মালিকরা

রিট করে ‘খেলাপি ঋণ স্থগিত’ বন্ধ চান ব্যাংক-মালিকরা

বিদেশি ঋণ ফের ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে

বিদেশি ঋণ ফের ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে

টাকা উদ্ধারের নামে ‘ঘুষ’ চাওয়ার অভিযোগ জিএম শাহজাহান চৌধুরীর’র বিরুদ্ধে

টাকা উদ্ধারের নামে ‘ঘুষ’ চাওয়ার অভিযোগ জিএম শাহজাহান চৌধুরীর’র বিরুদ্ধে

জাতীয় ঐক্য বিনষ্টকারী কর্মকান্ড থেকে বিরত থাকতে হবে

জাতীয় ঐক্য বিনষ্টকারী কর্মকান্ড থেকে বিরত থাকতে হবে

৬০ হাজার টন ইউরিয়া সার কিনবে সরকার, ব্যয় ২৩৬ কোটি টাকা

৬০ হাজার টন ইউরিয়া সার কিনবে সরকার, ব্যয় ২৩৬ কোটি টাকা

আইকনিক লিডার তারেক রহমান ও বাংলাদেশের রাজনীতি

আইকনিক লিডার তারেক রহমান ও বাংলাদেশের রাজনীতি

পতিত স্বৈরাচার ও ভারতের চক্রান্ত চলছেই

পতিত স্বৈরাচার ও ভারতের চক্রান্ত চলছেই

তারেক রহমানের রাষ্ট্রনায়কোচিত বক্তব্য ও দিকনির্দেশনা

তারেক রহমানের রাষ্ট্রনায়কোচিত বক্তব্য ও দিকনির্দেশনা

ইসরাইলের দখলদারিত্ব বন্ধের প্রস্তাব বিবেচনা জাতিসংঘের

ইসরাইলের দখলদারিত্ব বন্ধের প্রস্তাব বিবেচনা জাতিসংঘের

উত্তপ্ত মণিপুরে অত্যাধুনিক অস্ত্র দিয়ে নতুন করে গোলাগুলি

উত্তপ্ত মণিপুরে অত্যাধুনিক অস্ত্র দিয়ে নতুন করে গোলাগুলি

২৭ দেশে ছড়িয়ে পড়েছে করোনার নতুন ভ্যারিয়্যান্ট

২৭ দেশে ছড়িয়ে পড়েছে করোনার নতুন ভ্যারিয়্যান্ট

২০০ হাতি নিধনের সিদ্ধান্ত জিম্বাবুয়ের

২০০ হাতি নিধনের সিদ্ধান্ত জিম্বাবুয়ের

কলেরাসহ মারাত্মক রোগের ঝুঁকিতে সুদানের ৩৪ লাখ শিশু

কলেরাসহ মারাত্মক রোগের ঝুঁকিতে সুদানের ৩৪ লাখ শিশু

১১ হাজার ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থীর প্রাণ গেছে

১১ হাজার ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থীর প্রাণ গেছে

বেলারুশে হামলা হলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবে : লুকাশেঙ্কো

বেলারুশে হামলা হলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবে : লুকাশেঙ্কো

তাইওয়ান প্রণালীতে চীনের যুদ্ধবিমান

তাইওয়ান প্রণালীতে চীনের যুদ্ধবিমান