ধূসর রাত আর উজ্জ্বল দিন
০৩ জুন ২০২৩, ০৭:৫৮ পিএম | আপডেট: ০৪ জুন ২০২৩, ০১:০২ এএম
![](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/content/images/2023June/9-20230603195836.jpg)
টেবিলে নয় পাশে আলাদা সাইড কেবিনেটে থাকবে টেলিফোনÑ একটা নয় অন্তত তিনটা। টেলিফোন নিয়ে এই ছেলেমানুষি ভাবনা এক সময় পেয়ে বসেছিল তাকে। টেবিলের পাশে ছোট কেবিনেটে তিনটা টেলিফোনÑ একটা ইন্টারকম-দু’টা ল্যান্ডফোনÑ এছাড়া আরও দু’টা সেলফোন এখন শাহেদের যন্ত্রণা। কমার্শিয়াল অফিস হলে অংকের নিয়মে কথা বলা যায়। তা তো আর হবার নয়Ñ সকাল থেকেই অনিবার্য এক যন্ত্রণার শুরু। যন্ত্রণায় যখন অতিষ্ঠপ্রায় তখন এল সেই কল যার অপেক্ষায় গত দু’টা বছর গোপন অস্থিরতায় বার বার এলোমেলো হয়ে উঠেছে।
হ্যালো যাচ্ছেন তো কাল
বুকের গোপন কুঠুরিতে সযতেœ রক্ষিত কণ্ঠ প্রশ্নটা ঠাহর করতে যা একটু সময় লাগল। যাবার বিষয়টা সবার জানার কথা নয়Ñ যারা জানে ইতোমধ্যে তারা অনেকেই কথা বলেছে। টেলিফোনের ওপারে যে আছে তার পক্ষেও জানা সম্ভবÑ খুবই সম্ভব।
ফোনের ওপাশ থেকে হালকা রহস্য-মাখা হাসি, কী অসুবিধা আছে বলতেÑ
শাহেদ সচকিত হয়ে ওঠে, তা কেন! তবে এতদিন পর শার্মিন নার্গিস খানÑ বিষয়টা হজম করতেÑ
শার্মিন এবার তার সেই বিশেষ হাসি বিকশিত করল, বাহ এমন করে বলছেনÑ যেন এই সাতশ’ তিরিশটা দিনে আস্ত জীবন পার করে দিয়েছি আমরা।
কণ্ঠে শাহেদও একটু রহস্য মাখাল, একদিন কিংবা তার চেয়েও কম সময়ের জীবনও তো আছে। সন্ধ্যারাতে জীবন শুরু করে রাত পোহাবার আগেই শেষÑ
হাসল শার্মিন, রাতের রাণী বলে কথাÑ হবে না কেন! তার তো আর দিবসরজনী নেইÑ
শাহেদ বলল, দূরের রাণী বলেও একটা কথা হতে পারেÑ নাকি?
শার্মিন প্রগলভ, ওহ সিওরÑ সুদূরিকা নীহারিকা...
ত্বরিৎ জবাব শাহেদের, ওসবও মানুষের চোখ ফাঁকি দিতে পারছে নাÑ
হেসে ফেলল শার্মিন, তাতো পারবেই না। তবে চোখ আর মনÑ ফারাক অনেক দূরেরÑ পরশে নয়ন তৃপ্ত হলেও হতে পারেÑ মন কি তাতেÑ
শাহেদ বলল, আমিও তো বলিÑ দূরের পরশÑ কবিতায় কাজে লাগেÑ জীবনে কি লাগেÑ
আবারও হেসে উঠল শার্মিন, ওরে বাব্বা! সেই সাহিত্য আর দর্শন এক সঙ্গেÑ পারব নাÑ পারবই নাÑ
শাহেদ সিরিয়াস, সাহিত্য আর দর্শনকেই যদি ভয়Ñ তাহলে চোখের বৃত্তে মনকে টেনে আনা কেন?
গম্ভীর শার্মিন, ভয় আর অভয়ের মধ্যে তফাৎ মাত্র একটা অÑ
ব্যাখ্যামুখর শাহেদ, অ-টা কিন্তু শুরু। আমরা পার হয়ে এসেছি অনেক আগেইÑ
শার্মিন হাসি ছড়াতে ছড়াতে, মগজটা ম্যানেজমেন্টেরÑ হৃদয়টা সাহিত্যের। এ-ও বুঝেছি অনেক আগেই। কাজেই মাফ চাইÑ বুঝলেন মাফ চাইছিÑ দয়া করে আরও একবার মাফ করে দিলে হয় নাÑ
শাহেদ বলল, সবাই মাফ করবেই বা কেন?
কথা খাটো করতে চায় শার্মিন, আগামী এক পক্ষকাল কি মাফ কিংবা শাস্তির জন্য কম সময়? কাল ভোরে তাহলে এয়ারপোর্টেÑ
তবু শাহেদ জিজ্ঞেস করল, যাচ্ছেন তো আপনি?
শার্মিনের কণ্ঠে সেই রিনরিনে হাসি, লেট আস হোপÑ
ছেড়ে দিয়েছে শার্মিন। শাহেদের কানে অনুরণিত হচ্ছে : লেট-আস-হোপ-হোপ-হো-পÑ হোপ মানে কি নিছক শাব্দিক আশা নাকি তার চেয়ে বেশি বস্তুগত কিছু! শার্মিন কি এতদিন পর সত্যিই কোন বার্তা দিলÑ নাকি রঙিন পাখার সেই বায়বীয় ওড়াওড়িÑ
দুই.
কোপেনহেগেনে পনের দিনের প্রোগ্রাম : স্বল্পোন্নত দেশগুলোর সফল সমবায় উপদেষ্টাদের অভিজ্ঞতা বিনিময়। দেশওয়ারি পেপার প্রেজেন্টেশনে অংশ নেবে শাহেদÑ তার সোসাইটির একটা বড় স্বীকৃতিও। পেপারটায় আবার একটু চোখ বুলাবে। কো-অর্ডিনেটর তাহমিদা সকালেই দিয়ে গেছে প্রিন্ট। মার্চ মাসের সিডিউলটা দেখেও ও-কে করতে হবে। ফেব্রুয়ারিতে সবগুলো প্রকল্প এলাকায় বয়স্কশিক্ষার ক্লাস চালু করেছিলÑ ফলাফল ভাল। আরও দু’মাস চালু রাখতে হবে। শার্মিনের ফোনের আগে এই ফাইলটাই মাত্র সই করতে পেরেছিলÑ বাকি কাজ পড়ে আছে।
তাগিদ দিতে এল তাহমিদা, শাহেদ ভাই আজ চারটার মধ্যে অফিস ছাড়তে হবে আপনাকেÑ মনে আছে তো?
শাহেদ হাসল, হবেÑ হবে। চারটার মধ্যেই শেষ করে ফেলব।
তাহমিদা যেতে যেতে বলল, আপনি কিন্তু কোনদিনই বললেন না ছবিটা কার? অদ্ভুত ছবিÑ চিত্রকর্ম না ফটোগ্রাফÑ বোঝা মুশকিল। কখনও মনে হয় চিনে ফেলেছিÑ পরক্ষণেই আবার মনে হয়, না মোটেই চিনতে পারিনিÑ শুধু চমৎকার নয়Ñ আকর্ষণীয় এক রহস্যওÑ
হেসে ফেলল শাহেদ, তোমার এখন রহস্য ভেদ করতে হবে না। যাওÑ আগামী মাসের সিডিউলটা শেষ করে আমাকে দেখিয়ে নাও।
শাহেদ ঘুরে বসল। পেছনে কেবিনেটের উপর সেই ছবি : যমুনার বালুচরে মেটে জোছনায় ধূসর শাড়ির আঁচল উড়ছে বাতাসেÑ তার ভেতরে ঢাকা পড়েছে দীর্ঘাঙ্গিণী শার্মিনÑ মুখটা দেখা গেলেও ঘোলাটে ছায়া পড়ায় ঠিক ঠিক চেনা যায় না। ছ’ বছর আগে তুলেছিল এই ছবি। যার ছবি তাকে দেয়া হয়নি। ছবির কথা বলেছিলÑ শুধু হাসি ছাড়া শার্মিন বলেনি আর কিছুÑ
ছবিটা আস্তে আস্তে প্রসারিত হচ্ছেÑ ধরা পড়ছে : যমুনার চর নিশিরাতে আকাশ-বালুকা-পানি মেটে জোছনায় একাকার-ধূসর। তাঁবুর পাশে সেই ধূসরতা সামনে নিয়ে তারা দু’জন। ডগায়-পাতায়-গোছায় ভেজা বালিতে পা যেন গ্রিক প্রতœসম্পদ। তারপর যমুনার পানি খেয়ালি মেয়ের আঁচলÑ এলোমেলো ছুঁয়েছেনে যাচ্ছে চরের বালি। শার্মিনের আঙুল সেই পানিতে-বালিতে লিখছেÑ কি লিখছে জানে শুধু শার্মিন একা আর কেউ নয়Ñ শাহেদও নয়। কারণ তার লেখায় কোন অক্ষর স্পষ্ট হচ্ছে নাÑ মনোচিন্তার অস্পষ্টতাই ধরা পড়ছে মাত্র।
শাহেদ একটু দূরে সরে গিয়ে বালির বিস্তীর্ণ শ্লেটে এক দুই করে লিখল তাদের মিলগুলো :
টাকি ভর্তা, ডিম ভাজি, নিরামিষ, ঝরঝরে খিচুড়ি আর সরিষার তেলে-ধনেপাতায় মাখা মুড়ি সবশেষে চা-চা মানে শুধু চাÑ দুধ-চিনি ছাড়া কড়া লিকারে। হালকা নীল-বেগুনি আর ধূসর রঙ। মিথ্যার প্রতিবাদ-তৎক্ষণাৎ সত্য উচ্চারণ-ক্ষোভ না পুষে সরাসরি ফয়সালা। কাজের সময় লো ভলিউমে গোলাম আলির কণ্ঠে হসরত মোহানীর গজলÑ চুপকে চুপকে আঁসু...দিনের বেলা গাড়িতে ঢাকার বাইরে যাবার সময় নজরুল সঙ্গীতÑ আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ঐ... আর রাতে শোবার আগে রবীন্দ্র সঙ্গীতÑ লেগেছে অমল ধবল পালে মন্দ মধুর হাওয়া...। সিরিয়াস উপন্যাস- উন্নয়ন সংক্রান্ত ও ইতিহাসের নানা জটিল বাঁক নিয়ে রচিত গ্রন্থ। কারও দুঃখে খুশি ও উন্নতিতে নাখোশ কখনও নয়। দরিদ্র অসহায় মানুষই আপন। সমাজতন্ত্র নয়-ব্যর্থ হয়েছে মানুষ। উন্নয়নের উৎস ঋণ নয়-একে অন্যের হাত ধরে এগিয়ে যাওয়াÑ সমবায়।
লেখা অসম্পূর্ণ রেখেই শাহেদ ডাকল, শার্মিন আমরা কি এখানে একটা স্বাক্ষর করতে পারি না?
উঠে এল শার্মিন। তার দীঘল আঙুলের ডগায় লেগে রয়েছে পানি আর বালির আর্দ্র মমতা। সে আঙুল তুলে তুলে শব্দ করে পড়ল। তারপর চোখ বড় করে তাকাল শাহেদের চোখেÑ
শাহেদ বলল, এগুলো আমাদের যৌথক্ষেত্রও বলতে পারেনÑ
চোখ সরিয়ে তাকাল শার্মিন লেখার শুরুর দিকটায়Ñ যমুনার পানি বালি চুঁইয়ে চুঁইয়ে অনেক দূর স্পর্শ করে আছে। ভেজা বালিতে লেখা যায় কিন্তু সে লেখা থাকে না বেশিক্ষণ।
শার্মিন কণ্ঠে রহস্য মাখিয়ে হাসল, যৌথক্ষেত্র এখনই চুকেবুকে যাবে বালিতে-পানিতেÑ
শাহেদ বলল, লেখা ঠিকই চুকেবুকে যাবেÑ যৌথক্ষেত্র নয়। ভাললাগার ক্ষেত্র কখনও ফুরায় নাÑ জানেন তো!
কথা ঘুরাল শার্মিন, জানেন শাহেদ কণিকার একটা নতুন ক্যাসেট এনেছিলামÑ এখন আর ব্যাগে খুঁজে পাচ্ছি না।
তাঁবু থেকে বেরিয়ে এসে লায়লা বলল, ব্যাগে নয় খোঁজ হৃদয়েÑ কিছুই হারায় নাÑ সব জমা থাকে হৃদয় নামের যাদুর ব্যাগেÑ অগণিত পরত-ধারণক্ষমতা অসংখ্য-ওখানে কিছুই নাই আবার সবই আছেÑ এরই নাম হৃদয়। এবার হৃদয় নামের ব্যাগটায় চোখ রাখ লক্ষ্মী মেয়েÑ
শাহেদ একটু চমকায়Ñ ধূসর শাড়িপরা গমরঙ শার্মিন নদী আর জ্যোৎস্নার ধূসরতায় মিলেমিশে স্থির।
লায়লার চোখ পড়ে বালির লেখায়। উপরের দিক মিলিয়ে এসেছে। এখনও ঠিকঠাক আছে : ‘উন্নয়নের উৎস ঋণ নয়, একে অন্যের হাত ধরে এগিয়ে যাওয়াÑ সমবায়।’
লায়লা বলল, শার্মিন তোমরা ভুলে যাও কেনÑ আমাদের সঙ্গে ছায়ার মত মিশে আছে আহসান চৌধুরীর লোক? যমুনা চরাঞ্চলের মানুষদের জন্য এই প্রোজেক্ট কত কোটি টাকার আর খরচ হচ্ছে কতÑ জান? জান না। টাকার অংকের ঘর শূন্য রেখে কেন স্বাক্ষর-টিপছাপ নিচ্ছি আমরা? আমাদের কাছে কোন জবাব নেইÑ কারও কাছে আছে কী?
শার্মিন কোন কথা না বলে তাকাল লায়লার দিকে। ধূসর আলোয় চোখে তার বিদ্যুৎ চমকাল।
যা বিশ্বাস করিÑ তা গোপন করবÑ কার ভয়েÑ শার্মিনের কোমল অথচ দৃঢ় কণ্ঠ বিস্তীর্ণ চরের বাতাসে প্রবাহিত হতে থাকলÑ ধূসর ছায়ার দু’বাহুর মাঝ বরাবর বিদ্যুৎলতা ঝলসে ওঠল।
মাগুরা থেকে সাতক্ষীরা ধবল জোছনাপ্লাবিত ভাঙা রাস্তায় তাদের মাইক্রো যেন খেয়াযানÑ ক্যাসেটে বাজছেÑ আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ঐ... তন্দ্রায় ঢুলু ঢুলু শার্মিনের টিকালো নাক শাহেদের বুকে কি কথা লিখেছেÑ দীঘল চুলের অদ্ভুত ভেজা ভেজা ঘ্রাণ কোন ধুপছায়া পথ দেখিয়েছেÑ সকালের ঝাঁঝালো রোদে সেসব আর মনে করতে পারেনি শাহেদ। তারপরও এ সবই তো বাস্তবতা। পিরোজপুরে সাঁকো পার হতে গিয়ে পা হড়কে শার্মিন অবলীলায় শাহেদকে জাপটে ধরে সাঁকোর বাঁশে ঝুলে স্বচ্ছ পানিতে যুগল ছায়ার ভেঙেপড়াÑ সটান হয়েওঠার শিহরণ লুকিয়ে ফেলে উদ্বিগ্ন হয়েছেÑ কখন পৌঁছবে ফেরিঘাটে! উষ্ণ কোমল শার্মিনের ভার বহনের আকস্মিকতা হৃদয়ে ধারণ করার চেয়ে শাহেদ অধিক সতর্ক পা টিপে টিপে বাঁশের সাঁকো পার হওয়ায়। শার্মিন কতটা কোমলÑ কতটা পেলবÑ কখনও ভাবেনি শাহেদ। ভাবলেও সেই ভাবনা কোনভাবেই প্রবহমান থাকত না। শার্মিনকে আস্তে করে মাটিতে নামিয়ে দেয়ার পর তার বুক জুড়ে ঢেউ উঠল শূন্যতার। স্তিমিত-অস্তিমিতের মাঝখানের হাসি ঝুলিয়ে শার্মিন দাঁড়ালÑ অনেকক্ষণ চোখ খুলল নাÑ খুলতে পারলই নাÑ সঘন শ্বাস-প্রশ্বাস গোপন করা যে কী কঠিন টের পেল মর্মে মর্মে।
শাহেদ বলল, ওকি শার্মিন চোখ খুলুনÑ ভয় নেইÑ বিপদ উতরে গেছেÑ সাঁকো পার হয়ে এসেছি আমরাÑ
টুকরো টুকরো অসংখ্য স্মৃতি তো নয়Ñ যেন বার্থডে পার্টির নানা রঙের বেলুনÑ আর সে বেলুন হেসেখেলে কত যে ফুটো করেছে শার্মিনÑ সে হিসাব রেখেছে শুধু শাহেদ!
সাত বছরÑ হ্যা সাত বছরই ছিল তারা এক কর্মক্ষেত্রে পাশাপাশি। শার্মিনের প্রান্তর যাকে বলে খোলামেলাÑ তেমন দেখেনি কখনও। রহস্য আর কৌতূহলে সারাক্ষণ জমকালো শার্মিন। ব্যতিক্রম শুধু ফিল্ড ওয়ার্কেÑ একদম খোলামেলা-সাদামাটা অথচ আন্তরিক আচরণে মুহূর্তে টার্গেট গ্রুপের সাথে মিশে যাওয়াÑ তাদের আপন হয়ে ওঠাÑ নারী শুধু নয় পুরুষরাও তার সাথে খোলামেলাÑ সে তাদের আস্থা রক্ষায় প্রাণপাত করতে এক পায়ে খাড়া।
নারী-পুরুষ সবাই মেম’পা বলতে অজ্ঞান। গাঁয়ের কোন কোন পুরুষ অনেক সময় গোপন কথাও মেম’পাকে অবলীলায় বলেছে। শাহেদ বা অন্য কোন পুরুষের সামনে যা বলতে পারেনি তাই বলেছে তাকে দারুণ আস্থায়-নির্ভরতায়। শহরে নিয়ে কাউকে কাউকে দেহজ-দুর্বলতার চিকিৎসাও করিয়েছে। অনেকের পারিবারিকÑ এমনকি দাম্পত্য ঝগড়া-বিবাদও তার জন্যই মিটেছে। শার্মিনের কথাÑ সার্বিক সমাধান! এই লক্ষ্যে কাজ করতে কর্মসূচি শেষ করতে ওর সময় একটু বেশি লাগলেও প্রোগ্রাম প্রায় শতভাগ সফল হত।
মাঝেমধ্যে সহকর্মীরা প্রশ্ন করেছে, অত কী কথা বলেন? একটা করতে এসে আরেকটা না করলেই কী নয়?
সাফ জবাব শার্মিনেরÑ না। আঙুলের ডগা দিয়ে পানি ছিটিয়ে ঘর ধোয়া যায় না। আমরা ক্ষুদ্র ঋণ দিচ্ছিÑ ও দিয়ে ওরা কি করবে? ঋণের ব্যবহারটা কি ওরা জানেÑ ঋণ সুষ্ঠুভাবে ব্যবহারের জন্য মাথা ঠান্ডা রাখতে হয় আর সেজন্য প্রয়োজন পারিবারিক শান্তি। আর পারিবারিক শান্তির জন্য চারটা ডাল-ভাতের পাশাপাশি তৃপ্ত দাম্পত্য জীবন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কী ঠিক বলিনি?
এ প্রশ্নের জবাব দেবার জন্য সহকর্মীদের কাউকে পাওয়া যায়নি কখনও। একজন সুন্দরী তরুণী যতই সংস্কারমুক্ত হোক তার সাথে এই বিষয়ে আরও অগ্রসর আলোচনা! না লজ্জার বাধ সহকর্মীরা কেউ কখনও ভাঙতে পারেনি।
আড়ালে তারা শাহেদকে বলত, আমরা না হয় সাহস পাই নাÑ তুমি চুপ মেরে থাক কেনÑ চালিয়ে যেতে পার না!
শাহেদ বলত, শার্মিন নার্গিস খান কি পছন্দ করে আর না করেÑ ওটা বোঝার বুদ্ধি তোমাদের এখনও পাকেনি। ওর পছন্দ টার্গেট গ্রুপ আর বেটার-বেটার পারফরমেন্স এবং সাকসেসের পর সাকসেসÑ
পছন্দের দৃঢ়তার কারণেই প্রথম মোকাবিলাটা শার্মিন করে। শাহেদের ছিল নীরব সমর্থন শুধু। ফাইনাল মোকাবিলাটাও শার্মিনই করে। এক বছর ধরে এই মোকাবিলা চলে আহসান চৌধুরীর সঙ্গে। এই সময়টাতে শাহেদের প্রস্তুতিও শেষ হয়। শার্মিন তার আহ্বানে সাড়া দেয়নিÑ যোগ দেয়নি শাহেদের প্রস্তুতিতেÑ তার নিজের মত করে করেছে। দু’জনেরই লক্ষ্য এক আত্ম-উন্নয়নের চাকাটা ঠেলে নেয়ার স্পৃহা মানুষের মধ্যে জাগিয়ে দেয়া এবং বাধাগুলো গোষ্ঠিবদ্ধভাবে মোকাবিলায় উদ্দীপ্ত করাÑ সেই দশে মিলে করি কাজ-আর কী!
শার্মিন আর শাহেদ এগিয়েছে সমান্তরাল গতিতেÑ বলা যায় অনেকটাই এগিয়েছে। সেই শার্মিন আজ নিজে ফোন করল। সে কি তার অভ্যাস বদলেছে? শাহেদ জানে বাংলাদেশ থেকে সে একাই যাচ্ছে। এখন জানল তার জানাটা ঠিক নয়Ñ সে একা নয়Ñ শার্মিনও যাচ্ছে। শুধু তাই নয়Ñ শাহেদের যাবার খবরটাও তার জানা। শার্মিনের মাত্রাটা অস্পষ্ট হলেও সে বুঝতে পারছে। ডেনিস কো-অপারেটিভ সোসাইটির প্রোগ্রামটা ছোট নয়Ñ বলা যায় বেশ বড়ই। এ রকম একটা প্রোগ্রামে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করবেÑ শাহেদ কিছুটা গর্ব অনুভব করেছিল। দু’বছর আগেও ঘটনা তো এরকমই ঘটেছিল। আহসান চৌধুরীকে নাজেহাল করবে সেÑ এই সেক্টরে সবাই বাহবা দেবে তাকে। ঘটনা ঘটল অন্য রকম। আচমকা শার্মিন নাজেহাল নয়Ñ একেবারে ধ্বসিয়ে দিল আহসান চৌধুরীকে। তার জারিজুরি সব ফাঁস হয়ে গেলÑ বাগাড়ম্বরে-কাগজপত্রে কল্যাণব্রত-প্রকল্পের অর্থ লোপাট-দেশের মানুষের দারিদ্রকে পণ্য হিসেবে চড়া দামে বিক্রি এই সবই কমলাপুর রেলস্টেশনের ওয়েটিং রুমের মত খোলামেলা করে দিয়ে শার্মিন বিজয়ী ভঙ্গিতে হাত নাড়াল এই সেক্টরে সবাইকে লক্ষ্য করে। রাতারাতি দুর্দান্ত ইমেজে আর্বিভূত হল শার্মিন নার্গিস খানÑ বাহবাটা নিয়ে নিল। সংবাদপত্রগুলো মুখিয়ে ছিল। লিখে দিলÑ কল্যাণকর্মে নারীরাই হতে পারে অগ্রগামীÑ জনকল্যাণে নারীদের ক্ষমতায়ন অপরিহার্য...
তিন.
স্ক্রিনে ভেসে ওঠলÑ কল ফেল।
সহজে বিরক্ত হয় না শাহেদ। সে জানে বিরক্ত হওয়া মানে পিছিয়ে পড়া। কোন কাজে কখনও বিরক্ত হওয়ার আগে অনেকবার ভাবে। আজকে বিরক্ত হল। দু’দুটা মোবাইলে চেষ্টা করেও পারছে না। তারপরও মোবাইল রেখে দিতে পারল না।
আবার কল করল। স্ত্রিনে এবার ভেসে ওঠলÑ নেটওয়ার্ক ফেল। রাত বাড়ছেÑ ভোরে উঠতে হবে। আটটায় ফ্লাইটÑ সাতটায় পৌঁছতে হলে রওনা দিতে হবে ছ’টায় মধ্যে। শাহেদের মন চাইছিল শার্মিনকে একটা হ্যালোÑ বলে শুতে যাবেÑ হল না। মন খারাপ বাতাস চারপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে। মোবাইল বেজে উঠল তখনই।
ওপাশে সেই পরিচ্ছন্ন রিনরিনে হাসি, ব্যাপার কী কাহার সনে এত কথাÑ কী কথা তাহার সনেÑ বারবার শুধু স্ক্রিনে কল ফেলÑ নেটওয়ার্ক ফেল ঘটনা কি?
হেসে উঠল শাহেদ, আমারও তো একই কথাÑ বারবার শুধু স্ক্রিনে কল ফেলÑ নেটওয়ার্ক ফেলÑ কাহার সনে এত কথা, কী কথা তাহার সনেÑ
শার্মিন বলল, তুমি জানতে আমি ফোন করব?
শাহেদ বলল, জানতামÑ জানতাম বলেই আগে ফোন করার চেষ্টা করেছি।
শার্মিন বলল, এখন জানলে তো দু’জনে দু’জনকে ট্রাই করলেই কল ফেল করেÑ নেটওয়ার্কও ফেল করেÑ একজন আরেকজনকে সময় দিতে হয়Ñ
শাহেদ হেসে উঠল, তাহলে বোঝ সাত-সাতটি বছর একজনকেই এগিয়ে আসতে হয়Ñ
শার্মিনও হাসল, আরেকজনকেও এটা বুঝতে হয়। এখন ঘুমাওÑ প্রাণশক্তি সঞ্চয় করে নাও। সাত সাতটি বছর খুব জ্বালিয়েছÑ মনে আছে হে দুষ্টু বালকÑ
মোবাইল ছেড়ে দিল দু’জনই। তারপরই যমুনার চরে হৃদয় নামক যাদুর ব্যাগের গোপন পরতে তুলে রাখা কামনা জীবনের পলিতে ডালপালা মেললÑ শব্দহীন দৃশ্যহীন শূন্যতা এক পলকে ডিঙিয়ে কত সহজ-স্বচ্ছন্দে একে অন্যকে স্পর্শ করলÑ
এটা আদতেই কোন গল্প নয়Ñ শার্মিন-শাহেদের গল্পের শুরুটা এখান থেকে হতে পারে। আমরা সবাই জানিÑ এরপর তাদের কী কঠিন সময়Ñ কী তীব্র বিরোধিতা মোকাবিলা করতে হবে। তবে দু’জনের হাত গভীর আস্থায় শক্ত করে ধরা থাকবেÑ এইটুকু ভরসা তারা করতে পারেÑ পারা উচিত।
বিভাগ : বিশেষ সংখ্যা
বিষয় : year
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
![বাংলাদেশে সহিংসতা প্রসঙ্গে মমতা, ‘আমাকে শেখাবেন না, বরং আপনারা শিখুন’](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/content/images/2024July/SM/500-321-inqilab-white-20240727093432.jpg)
বাংলাদেশে সহিংসতা প্রসঙ্গে মমতা, ‘আমাকে শেখাবেন না, বরং আপনারা শিখুন’
চোটজর্জর বার্সাকে নিয়ে চিন্তিত ফ্লিক
![বছরের প্রথমার্ধে বিদেশি বিনিয়োগে দারুণ প্রবৃদ্ধি চীনে](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/content/images/2024July/SM/500-321-inqilab-white-20240727091817.jpg)
বছরের প্রথমার্ধে বিদেশি বিনিয়োগে দারুণ প্রবৃদ্ধি চীনে
![জাপানে রেকর্ড বৃষ্টিপাত, সরিয়ে নেওয়া হলো হাজারো মানুষকে](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/content/images/2024July/SM/500-321-inqilab-white-20240727085854.jpg)
জাপানে রেকর্ড বৃষ্টিপাত, সরিয়ে নেওয়া হলো হাজারো মানুষকে
জন্মভূমির বিপক্ষে মুরের ফিফটি, মাডান্ডের অনাকাঙ্ক্ষিত রেকর্ড
![ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ২৮২ রানে থামিয়েও দিনশেষে অস্বস্তিতে ইংল্যান্ড](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/content/images/2024July/SM/4634-20240727032845.jpg)
ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ২৮২ রানে থামিয়েও দিনশেষে অস্বস্তিতে ইংল্যান্ড
![পদ্মায় নিখোঁজ নৌপুলিশের সন্ধান মেলেনি ৭ দিনেও](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/common/-default.jpg)
পদ্মায় নিখোঁজ নৌপুলিশের সন্ধান মেলেনি ৭ দিনেও
![বেতাগী দরবারে ওরশ আজ](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/common/-default.jpg)
বেতাগী দরবারে ওরশ আজ
![সন্ধ্যা হলেই দ্বিগুণ ভাড়া ভোগান্তিতে যাত্রীরা](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/common/-default.jpg)
সন্ধ্যা হলেই দ্বিগুণ ভাড়া ভোগান্তিতে যাত্রীরা
![কারফিউ শিথিল করায় টাঙ্গাইলে জনজীবনে কর্মচাঞ্চল্য ফিরেছে](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/common/-default.jpg)
কারফিউ শিথিল করায় টাঙ্গাইলে জনজীবনে কর্মচাঞ্চল্য ফিরেছে
![নদী ভাঙনে ৪৫৮ পরিবারের আহাজারি](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/content/images/2024July/SM/5-20240726212443.jpg)
নদী ভাঙনে ৪৫৮ পরিবারের আহাজারি
![বিটিভি ভবনে অগ্নিসংযোগের অভিযোগে টুকুসহ বিএনপি জামায়াতের ৬ নেতা কারাগারে প্রেরণ](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/content/images/2024July/SM/500-321-inqilab-white-20240726212448.jpg)
বিটিভি ভবনে অগ্নিসংযোগের অভিযোগে টুকুসহ বিএনপি জামায়াতের ৬ নেতা কারাগারে প্রেরণ
![শনিবার সজীব ওয়াজেদ জয়ের ৫৩তম জন্মবার্ষিকী](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/content/images/2024July/SM/500-321-inqilab-white-20240726212737.jpg)
শনিবার সজীব ওয়াজেদ জয়ের ৫৩তম জন্মবার্ষিকী
![মেট্রোরেল স্টেশনে হামলার ঘটনায় আসামিদের ৫ দিনের রিমান্ড](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/content/images/2024July/SM/500-321-inqilab-white-20240726213356.jpg)
মেট্রোরেল স্টেশনে হামলার ঘটনায় আসামিদের ৫ দিনের রিমান্ড
![গণবিরোধী কারফিউ দিয়ে মানুষের কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দিতে চাইছে : ডা. মনীষা](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/content/images/2024July/SM/500-321-inqilab-white-20240726213707.jpg)
গণবিরোধী কারফিউ দিয়ে মানুষের কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দিতে চাইছে : ডা. মনীষা
![নিহত রুদ্রের নামে শাবির প্রধান ফটকের নামকরণ](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/content/images/2024July/SM/500-321-inqilab-white-20240726213859.jpg)
নিহত রুদ্রের নামে শাবির প্রধান ফটকের নামকরণ
![তিনটি গুলি খেয়ে বিনা চিকিৎসায় আমার ছেলেটা মরে গেছে’](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/content/images/2024July/SM/500-321-inqilab-white-20240726222840.jpg)
তিনটি গুলি খেয়ে বিনা চিকিৎসায় আমার ছেলেটা মরে গেছে’
![মালয়েশিয়া ও প্রবাসী আর্ট মেলায় প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের অংশগ্রহণ](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/content/images/2024July/SM/500-321-inqilab-white-20240726214708.jpg)
মালয়েশিয়া ও প্রবাসী আর্ট মেলায় প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের অংশগ্রহণ
![সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে থাকুন- ইঞ্জিনিয়ার আব্দুস সবুর এমপি](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/common/-default.jpg)
সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে থাকুন- ইঞ্জিনিয়ার আব্দুস সবুর এমপি
![কুড়িগ্রামে তিন লাশ দাফন, পরিবারের আহাজারি](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/common/-default.jpg)
কুড়িগ্রামে তিন লাশ দাফন, পরিবারের আহাজারি