ঢাকা   বৃহস্পতিবার, ০৭ নভেম্বর ২০২৪ | ২৩ কার্তিক ১৪৩১

যশোরের খেজুর গুড়

Daily Inqilab শাহেদ রহমান

০৩ জুন ২০২৩, ০৯:২১ পিএম | আপডেট: ০৪ জুন ২০২৩, ০১:০২ এএম

মধুবৃক্ষ বলা হয় খেজুর গাছকে। প্রবাদ, যশোরের যশ খেজুরের রস। শীতের আগমনী বার্তায় শুরু হয় মধুবৃক্ষ পরিষ্কার করা। ডালপালা কেটে পরিষ্কার করার পরই দফায় দফায় চাচ দেয়া হয়। বসানো হয় কঞ্চির নলি, যা দিয়ে খেজুর গাছ থেকে বেয়ে আসে সুমিষ্ট রস।

মাটির ভাড় বসিয়ে খেজুরের গাছ থেকে সংগ্রহ করা হয় রস। পুরো শীতে গ্রামীণ জীবনের প্রাত্যহিক এই উৎসব চলে আসছে আবহমান কাল ধরে। এর পেছনে লুকিয়ে আছে বিরাট অর্থনৈতিক সম্ভাবনা। সরকারিভাবে কখনোই তা কাজে লাগানো হয়নি। সরকারি পৃষ্টপোষকতা ও উদ্যোগ নেয়া হলে দেশের চাহিদা পূরণ করেও প্রতিবছর বিদেশে গুড় ও পাটালি রফতানি করে কাড়ি কাড়ি টাকা আয় করা সম্ভব।

যশোরের ডাকাতিয়া গ্রামের গাছি সোহাগ মিয়া বলেন, আমরা শীতের শুরুতে গাছ পরিষ্কার করি। এরপরই কাটা শুরু হয়। খেজুরের রস জ্বালিয়ে তৈরি হয় গুড় ও পাটালি। রসে ভিজানো পিঠা ও পায়েস খাওয়ার ধুম পড়ে যায় প্রায় প্রতিটি বাড়িতে। দানা, ঝোলা ও নলেন গুড়ের স্বাদ এবং ঘ্রাণই আলাদা। রসনা তৃপ্তিতে এর জুড়ি নেই। খেজুরের রস, গুড় ও পাটালির কদর প্রতিবছরই বাড়ছে। রীতিমতো কাড়াকাড়ি পড়ে যায় গুড় ও পাটালি নিয়ে। বিশেষত্ব হচ্ছে যত শীত তত মিষ্টি ও সুস্বাদু হয় খেজুরের রস। অধিক শীতের গুড় ও পাটালির চাহিদা সবচেয়ে বেশি। অসময়ে হাজার চেষ্টা করেও শীত মৌসুমের আসল গুড় পাওয়া যাবে না। পাওয়া গেলেও তা হবে ভেজাল কিংবা চিনি মিশানো। তাই শীত মৌসুমে সবাই খেজুরের রস, গুড় ও পাটালি সংগ্রহ করে।

গ্রামাঞ্চলে বাড়ির আঙ্গিনায় ও মাঠে জমির আইলে কিংবা বাগানে অযতœ অবহেলায় ও সম্পূর্ণ বিনা খরচে বেড়ে ওঠা ‘মধুবৃক্ষ’ খেজুর গাছ প্রতিবছর শীত মৌসুমে মানুষের রসনা তৃপ্তির যোগান দিয়ে আসছে। এর জন্য বাড়তি খরচ কিংবা আবাদী জমি নষ্ট করার প্রয়োজন হয় না। সড়ক পথ, রেল পথ, জমির আইল, পতিত জমি ও বাড়ির আঙ্গিনায় কোটি কোটি খেজুর গাছ লাগানো সম্ভব। তাতে উন্মোচিত হবে দেশের অর্থনীতির এক নতুন দ্বার।

উদ্বেগের বিষয়, ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে খেজুর গাছ। কমেছে রসের উৎপাদনও। এক সময় যশোরের খেজুরের গুড়ের চিনির খুব নামডাক ছিল। পরে আখের চিনিতে বাজার সয়লাব হওয়ায় চিনি উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়।

জানা যায়, ১৮৬১ সালে চৌগাছার তাহেরপুরে কপোতাক্ষ নদের পাড়ে ইংল্যান্ডের মি. নিউ হাউস কারখানা স্থাপন করে যান্ত্রিক পদ্ধতিতে ব্রাউন সুগার উৎপাদন শুরু করেন। তাহেরপুর স্থানটি মি. নিউ হাউসের পছন্দ হবার কারণ ছিল নৌপথে যাতায়াত সুবিধার জন্য। কপোতাক্ষ আর ভৈরবের সংযোগস্থল হওয়ায় উত্তর ও দক্ষিণে সহজে যাতাযাত করা যেত। তখন কপোতাক্ষ নদ ছিল প্রমত্তা। ভৈরবও ছিল নাব্য নদ। তাহেরপুর চিনি কারখানা স্থাপনের পর সেখানে বড় বাজারও বসে। স্থাপিত হয় চিনি কারখানার ইংরেজ কর্মীদের আবাসস্থল। তাহেরপুরে কপোতাক্ষ নদের ঘাটে এসে ভিড় করত দেশি-বিদেশি জাহাজ। মূলত একটি বাণিজ্যিক নগর হিসেবে গড়ে ওঠে তাহেরপুর। ১৮৮০ সাল পর্যন্ত মি. নিউ হাউসের ব্রাউন সুগার কারখানাটি চলে। পরে তিনি কারখানাটি বিক্রি করে স্বদেশে ফিরে যান। কারখানাটি ক্রয় করে ইংল্যান্ডের ‘এমেট অ্যান্ড চেম্বার্স কোম্পানি’। তারাও নানা কারণে ১৮৮৪ সালে বিক্রি করে দেয় বালুচরের জমিদার রায় বাহাদুর ধনপতি সিংহের কাছে। ১৯০৬ সালে তাঁর মৃত্যু হলে তাঁর বংশধররা এটি চালাতে ব্যর্থ হন। এরপর ১৯০৯ সালে কাশিমবাজারের মহারাজ মনীন্দ্র চন্দ্র, নাড়াজোলের রাজ্যবাহাদুর ও কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি সারদাচারণ মিত্রসহ কয়েকজন মিলে কারখানাটি ক্রয় করে নাম দেন ‘তাহেরপুর চিনি কারখানা’। নতুন ব্যবস্থাপনায় বৃটেন, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিশেষজ্ঞ আনা হয় কারখানাটিতে। ১৯১৫ সালের দিকে এটি বন্ধ ঘোষণা করা হয়।

সেভ দ্য ট্র্যাডিশন এন্ড ইনভায়রনমেন্ট (এসটিই) সভাপতি মোহাম্মদ আবু বকর বলেন, ‘কয়েক বছর আগেও মাঠে অনেক খেজুর গাছ ছিল। এলাকায় অনেক গাছি খেজুর গাছ কাটতেন। কিন্তু এখন আর এসব দেখা যায় না। শীতকালে আমাদের গ্রামে পিঠা-পুলির উৎসবমুখর আমেজ থাকতো। খেজুর গাছ ও গাছির অভাবে বর্তমান তরুণ প্রজন্ম সেই আমেজ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যশোরের এই ঐতিহ্য আজ যাদুঘরে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে।’ সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মো. সাহেব আলী বলেন, ‘দুবাই, কাতার, সৌদি আরবের সরকার রাস্তার সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য খেজুর গাছ রোপণ করে। তাদের মতো আমরাও রাস্তার সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য খেজুরের চারা রোপণ করতে পারি। এতে একদিকে যেমন অর্থনীতি সমৃদ্ধ হবে, অন্যদিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিয়ন্ত্রণে থাকবে।’

কৃষিবিদ ইবাদ আলী বলেন, ‘একসময় যশোরের সর্বত্রই চোখে পড়ত খেজুর গাছ। কালের বিবর্তনে হারিয়ে যেতে বসেছে এই গাছ। খেজুর গাছের মূল্য কম এবং তা সহজলভ্য হওয়ায় ইটভাটা ও টালি ভাটার মালিকদের টার্গেটে পরিণত হয়েছে। এতে হুমকির মুখে খেজুর গাছ।’

লেখক: যশোর ব্যুরো চিফ, দৈনিক ইনকিলাব।


বিভাগ : বিশেষ সংখ্যা

বিষয় : year


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে জেড ফোর্স
যুগস্রষ্টা জিয়াউর রহমান
সৈনিক-জনতার একতার অঙ্গীকার
তরুণ প্রজন্ম এবং ৭ নভেম্বরের বিপ্লব
৭ নভেম্বর স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় গৌরবের প্রতীক
আরও

আরও পড়ুন

ফ্যাসিস্ট সরকারে সুবিধাভোগীদের জায়গা বিএনপিতে হবে না: সেলিমুজ্জামান সেলিম

ফ্যাসিস্ট সরকারে সুবিধাভোগীদের জায়গা বিএনপিতে হবে না: সেলিমুজ্জামান সেলিম

সমাবেশ শেষে ক্যাম্পাস পরিষ্কার করে প্রশংসায় ভাসছেন মহাসম্মেলনে আসা যুবকরা

সমাবেশ শেষে ক্যাম্পাস পরিষ্কার করে প্রশংসায় ভাসছেন মহাসম্মেলনে আসা যুবকরা

জুলাই-আগষ্ট গনঅভ্যুত্থানের আকাঙ্খা ছিল পরিবর্তন ও সংস্কার -ব্যারিষ্টার ফুয়াদ

জুলাই-আগষ্ট গনঅভ্যুত্থানের আকাঙ্খা ছিল পরিবর্তন ও সংস্কার -ব্যারিষ্টার ফুয়াদ

পলিথিন বিরোধী অভিযানে জরিমানাসহ ৪৮৪৫ কেজি পলিথিন জব্দ, কারখানা সিলগালা

পলিথিন বিরোধী অভিযানে জরিমানাসহ ৪৮৪৫ কেজি পলিথিন জব্দ, কারখানা সিলগালা

মোংলায় প্যারাডাইস হোটেলের গ্রিল খেয়ে ৪০ জন অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি

মোংলায় প্যারাডাইস হোটেলের গ্রিল খেয়ে ৪০ জন অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি

উপদেষ্টা পরিষদে ১০% প্রবাসী বাংলাদেশী নেয়ার জোর দাবী

উপদেষ্টা পরিষদে ১০% প্রবাসী বাংলাদেশী নেয়ার জোর দাবী

হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় মাঠে ছাত্র জমায়েতে সমন্বয়ক হাসনাত-সারজিস

হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় মাঠে ছাত্র জমায়েতে সমন্বয়ক হাসনাত-সারজিস

বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কারে জবি ছাত্রদলের ২১ প্রস্তাবনা

বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কারে জবি ছাত্রদলের ২১ প্রস্তাবনা

ট্রাম্প আমলে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে বড় পরিবর্তন হবে বলে মনে করি না : পররাষ্ট্র উপদেষ্টা

ট্রাম্প আমলে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে বড় পরিবর্তন হবে বলে মনে করি না : পররাষ্ট্র উপদেষ্টা

ঐতিহাসিক জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস; চব্বিশের প্রেরণা

ঐতিহাসিক জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস; চব্বিশের প্রেরণা

একুশে বইমেলায় বিকাশ পেমেন্ট নেয়া সেরা প্রকাশনীগুলোকে এবারও পুরস্কৃত করলো বিকাশ

একুশে বইমেলায় বিকাশ পেমেন্ট নেয়া সেরা প্রকাশনীগুলোকে এবারও পুরস্কৃত করলো বিকাশ

সোনালী ব্যাংকের নতুন এমডিকে সিবিএÕর শুভেচ্ছা

সোনালী ব্যাংকের নতুন এমডিকে সিবিএÕর শুভেচ্ছা

ফ্যাসিষ্ট সরকারের সুবিধাবাদীদের বিএনপিতে জায়গা নেই- মুকসুদপুরে বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক সেলিমুজ্জামান সেলিম

ফ্যাসিষ্ট সরকারের সুবিধাবাদীদের বিএনপিতে জায়গা নেই- মুকসুদপুরে বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক সেলিমুজ্জামান সেলিম

বিমক্স ২০২৪ -এ অংশ নিয়ে অত্যাধুনিক সব পণ্য প্রদর্শন করছে এনার্জিপ্যাক

বিমক্স ২০২৪ -এ অংশ নিয়ে অত্যাধুনিক সব পণ্য প্রদর্শন করছে এনার্জিপ্যাক

প্রাইম ব্যাংক’র সাথে পেরোল চুক্তি করলো বিএস গ্রুপ

প্রাইম ব্যাংক’র সাথে পেরোল চুক্তি করলো বিএস গ্রুপ

আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক এর ৪০৮তম পরিষদ সভা অনুষ্ঠিত

আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক এর ৪০৮তম পরিষদ সভা অনুষ্ঠিত

ইউটিলিটি বিল কালেকশন সহজ করতে তিতাস গ্যাসের সাথে ব্র্যাক ব্যাংকের চুক্তি

ইউটিলিটি বিল কালেকশন সহজ করতে তিতাস গ্যাসের সাথে ব্র্যাক ব্যাংকের চুক্তি

জাইকার সহযোগিতায় রাজউকের তৃতীয় ট্রানজিট ওরিয়েন্টেড ডেভেলপমেন্ট সেমিনার অনুষ্ঠিত

জাইকার সহযোগিতায় রাজউকের তৃতীয় ট্রানজিট ওরিয়েন্টেড ডেভেলপমেন্ট সেমিনার অনুষ্ঠিত

ময়নামতি ও বসুরহাটে ইউসিবির দুই নতুন শাখা উদ্বোধন

ময়নামতি ও বসুরহাটে ইউসিবির দুই নতুন শাখা উদ্বোধন

রমজানের নিত্যপণ্য আমদানিতে ব্যাংকে লাগবে না নগদ অর্থ: গভর্নর

রমজানের নিত্যপণ্য আমদানিতে ব্যাংকে লাগবে না নগদ অর্থ: গভর্নর