ভাষা আন্দোলনের পরম্পরা

Daily Inqilab মো. শহীদুল্লাহ শিকদার

২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:১৫ এএম | আপডেট: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:১৫ এএম

ভাষা সৈনিক অধ্যাপক আবদুল গফুর যথার্থই বলেছেন, পৃথিবীর কোন বড় ঘটনাই হঠাৎ করে ঘটে না। ভাষা আন্দোলনও নয়। ভাষা আন্দোলন বলতে আমরা সাধারণত: বায়ান্নের আন্দোলনের কথা স্মরণ করতে অভ্যস্ত। কিন্তু বায়ান্নের আন্দোলনও হঠাৎ করে সৃষ্টি হয়নি। বায়ান্নের পিছনে ছিল আটচল্লিশের অবদান, আর আটচল্লিশের পেছনে ছিল সাতচল্লিশের বিভাগ পূর্ববর্তী আন্দোলন। অবশ্য প্রকৃত প্রস্তাবে ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে বিভাগ পূর্ব যুগেই। আর, এর সাথে নিবিড়ভাবে জড়িত ছিল পাকিস্তান আন্দোলন। ভাষা আন্দোলনের তাই সুদীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। ভাষা আন্দোলনের সুদীর্ঘ ইতিহাসের এ ধারাবাহিকতাকে গবেষকরা তাঁদের সাম্প্রতিক গবেষণায় ৪টি পর্যায়ে বিভক্ত করেছেন। যথা-(১) মানসিক পর্ব (২) সাংগঠনিক পর্ব (৩) সংগ্রাম পর্ব (৪) বিজয় পর্ব। প্রথম পর্যায়ে মানসিক কালকে গবেষকরা ১৯১১ সালকে চিহ্নিত করেছেন এবং এ প্রসঙ্গে টাঙ্গাইলের ধনবাড়ীর নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী, বহু ভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এবং মুসলিম বাংলার সাংবাদিকতার জনক মাওলানা আকরাম খাঁ’র নাম সর্বাগ্রে উল্লেখ করা যায়।

এসব গবেষণায় নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরীকে রাষ্ট্রভাষা বাংলার ‘প্রথম প্রস্তাবক’-এর মর্যাদায় অভিষিক্ত করা হয়েছে। ১৯১১ সালে রংপুরে অনুষ্ঠিত মুসলিম প্রাদেশিক শিক্ষা সম্মেলনে প্রমত্ত এক ভাষণে তিনি বাংলা ভাষা সম্পর্কে সর্ব প্রথম দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বক্তব্য উপস্থাপন করে ফারসি ও উর্দুভাষা সম্পর্কে বলেন, ‘বাঙ্গালী মুসলমানদের পক্ষে এই দুইটি ভাষার কোন আবশ্যকতা নাই’। যে মুসলমান উর্দু বলিতে পারিবে না সে সত্যিকার মুসলিম হইতে পারিবেন না, এইরূপ ভুল ধারণা আমি অতি ঘৃণা পূর্বক উপেক্ষা করিতে চাই। ১৯২০ সালে বিশ্ব ভারতীতে অনুষ্ঠিত এক সভায় ভারতের সাধারণ ভাষা হিসেবে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হিন্দি সম্পর্কিত প্রস্তাবের বিরোধিতা করে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এক প্রবন্ধের মাধ্যমে বাংলা ভাষার দাবি উত্থাপন করেন। ১৯২১ সালে নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী তৎকালীন ইংরেজ সরকারের কাছে রাষ্ট্র ভাষা বাংলার সপক্ষে সর্বপ্রথম লিখিত প্রস্তাব উত্থাপন করে বলেন, ভারতের রাষ্ট্রভাষা যাই হোক, বাংলার রাষ্ট্রভাষা করতে হবে বাংলা ভাষাকে।’

১৯৩৭ সালের ২৩ এপ্রিল মুসলিম বাংলার অন্যতম প্রধান মুখপত্র দৈনিক আজাদে ভারতের রাষ্ট্রভাষা শিরোনামে এক ঐতিহাসিক সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়। এ সম্পাদকীয় নেহেরু রিপোর্টের সময় মহাত্মা গান্ধী কর্তৃক হিন্দি ও উর্দুর পরস্পর মীমাংসা হিসেবে অন্যান্য ভাষাভাষীর চেয়ে বাংলা ভাষাভাষীর সংখ্যা যে বেশি তার প্রমাণ যুক্তি সহকারে উপস্থাপনের মাধ্যমে বাংলার ভাষাগত ও সাহিত্যিক শ্রেষ্ঠত্ব এবং বিবিধ ভাব প্রকাশোপযোগী শব্দের সংখ্যাধিক্যতা প্রমাণ করে বাংলা যে ভারতের রাষ্ট্রভাষা হওয়ার দাবি রাখে, তা প্রতিপন্ন করা হয়।

এই প্রেক্ষাপটে ১৯৪০ সালে গৃহীত হয় ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব, লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে ভারতের মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলসমূহ নিয়ে একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পর ভারতের কংগ্রেস নেতাদের হিন্দিকে একক রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেওযার প্রচেষ্টা থেকে মুসলিম অধ্যুষিত ভাবী রাষ্টসমূহের উর্দু সমর্থক বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে উর্দুকে তাঁদের রাষ্ট্রভাষা করার মানসিকতা আরও জোরদার হয়ে উঠে। এই প্রেক্ষিতে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের দ্বিজাতি তত্ত্বের ফর্মুলায় বিশ্বাসী বুদ্ধিজীবী মহলে বাংলা-উর্দু প্রশ্নে একটি দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। এই দ্বান্দ্বিক পট-ভূমিকায় বাংলা ভাষী বুদ্ধিজীবীদের একটি ব্যাপক অংশ হিন্দি-উর্দুর রাষ্ট্রভাষার আসন দখলের তুমুল লড়াইয়ে বৈরী পরিবেশেও বাংলার স্বপক্ষে কথা বলতে এগিয়ে আসেন।

ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার দু’বছরের মধ্যেই কলকাতা ও ঢাকায় যথাক্রমে ‘পূর্ব-পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটি’ ও ‘পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ’ নামে দুটি সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়। বিশেষত: রেনেসাঁ সোসাইটিতে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা প্রশ্নটি খুবই গুরুত্ব পায় এবং এর অনেক সদস্য রাষ্ট্রভাষা বাংলার স্বপক্ষে কবিতা এবং প্রবন্ধ লেখেন। রেনেসাঁ সোসাইটির সদস্য কবি ফররুখ আহমদ পাকিস্তান সৃষ্টির দু’বছর পূর্বে ‘উর্দু বনাম বাংলা’ শীর্ষক কবিতায় বাংলার স্বপক্ষে তাঁর দৃঢ় চিত্ত মতামত ব্যক্ত করেন। ১৩৫২ সালে রচিত এবং একই সালের জ্যৈষ্ঠ মাসে মাসিক মোহাম্মদীতে প্রকাশিত তাঁর এই ব্যঙ্গ কবিতাটি ঐ সময় সুধীমহলে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করে। এ কবিতা ছাড়াও ‘পাকিস্তান’ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাত্র এক মাসের ব্যবধানে তিনি রচনা করেন। ‘পাকিস্তান রাষ্ট্রভাষা ও সাহিত্য’ শীর্ষক প্রবন্ধ। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয় ১৩৫৪ সালের ভাদ্র মাসে আর তার প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় ১৩৫৪ সালের আশ্বিন মাসের মাসিক সওগাত পত্রিকায়। তাঁর এ প্রবেন্ধেও তিনি উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা করার যৌক্তিকতা খন্ডন করেন। বাংলার স্বপক্ষে অভিমত ব্যক্ত করে বলেন যে, ‘বাংলা ভাষার পরিবর্তে অন্য ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসাবে গ্রহণ করলে এই দেশে ইসলামী সংস্কৃতিকে হত্যা করা হবে।’

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পূর্বে রেনেসাঁ সোসাইটির অন্যতম স্থপতি মুজিবুর রহমান খাঁ তাঁর বিখ্যাত ‘পাকিস্তান’ গ্রন্থে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা যে বাংলাই হওয়া উচিত এ সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করেন। বিভাগ পূর্ব সময়ে ‘পূর্ব পাকিস্তানের জবান’ শিরোনামে আরেকটি মূল্যবান প্রবন্ধ লেখেন আবুল মনসুর আহমদ। তাঁর প্রবন্ধটি ১৩৫০ সালের কার্তিক মাসে মাসিক মোহাম্মদীতে প্রকাশিত হয়। তিনিও তাঁর প্রবন্ধে বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করার স্বপক্ষে যুক্তি পেশ করেন এবং এর অন্যথা হলে কী সংকটের সৃষ্টি হতে পারে তার ইংগিত দেন। এতদসত্বেও ১৯৪৭ সালের মে মাসে আলীগড় বিশ্ব বিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ড. জিয়াউদ্দিন আহমদ উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা করার প্রস্তাব করেন, তার এ প্রস্তাবের বিপক্ষে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ লিখিতভাবে এর প্রতিবাদ করে বাংলার স্বপক্ষে তার মতামত ব্যক্ত করেন। ১৯৪৭সালের ২ জুলাই দৈনিক আজাদে তিনি লেখেন ‘পাকিস্তানের ভাষা সমস্যা’ শীর্ষক প্রবন্ধ। অথচ, এখানে উল্লেখ্য যে, ড. সুনীতি কুমার চট্টোপ্যাধ্যায় অন্যান্য হিন্দু বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিকের অনুরূপ ১৩৫১ সালে লিখিত ‘ভারতের ভাষা ও ভাষা সমস্যা’ শীর্ষক গ্রন্থে অখন্ড ভারতের সংহতির অজুহাতে হিন্দিকে ভারতের রাষ্ট্র ভাষা করার পক্ষে তাঁর মতামত ব্যক্ত করেছিলেন। এভাবে রাষ্ট্র ভাষার প্রশ্নটিকে সামনে নিয়েই ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দুই সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘পাকিস্তান তমদ্দুন মজলিস’।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ অধ্যাপক আবুল কাসেমের উদ্যোগে ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর প্রতিষ্ঠিত এই সাংস্কৃতিক সংগঠনটিই প্রথমবারের মতো রাষ্ট্র ভাষার প্রশ্নটিকে সাংগঠনিক প্রক্রিয়ায় নিয়ে আসে এবং রাষ্ট্রভাষা বাংলার স্বপক্ষে সংগঠন প্রতিষ্ঠার মাত্র ১৫ দিনের মধ্যে ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৪৭-এ প্রকাশ করে ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা বাংলাÑ না উর্দু’ নামক ভাষা আন্দোলনের সুবিখ্যাত সুচক পুস্তিকা। অধ্যাপক আবুল কাসেম, আবুল মনসুর আহমদ, ড. কাজী মোতাহার হোসেনের তিনটি প্রবন্ধ নিয়ে প্রকাশিত এ পুস্তিকা ভাষা আন্দোলনের স্বপক্ষে এক ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে। পুস্তিকায় প্রকাশিত অধ্যাপক আবুল কাসেমের প্রবন্ধে (ক) বাংলাই হবে পূর্ব পাকিস্তানের অফিস আদালতের ভাষা (খ) বাংলাই হবে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার বাহন এবং (গ) পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে দু’টি বাংলা ও উর্দু। এই তিনটি মূলনীতি আলোচিত হয়।

আবুল মনসুর আহমদ তাঁর ‘বাংলা ভাষাই হইবে আমাদের রাষ্ট্র ভাষা’ শীর্ষক প্রবন্ধে আশংকা ব্যক্ত করেন যে, বাংলাকে উপেক্ষা করে উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা করা হলে বৃটিশ আমলের মতো এদেশের জনসমাজও উপেক্ষিত থেকে যাবে। ড. কাজী মোতাহার হোসেন তাঁর প্রবন্ধে বাংলা ভাষার বিকাশে মুসলিম শাসকদের অবদান উল্লেখ করে ‘নূতন পাকিস্তান রাষ্ট্রের স্বপ্ন বাস্তবায়নে বাংলার ভূমিকা ও গুরুত্ব ব্যাখ্যা করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মাতৃভাষা বাংলা সম্পর্কে প্রথম বিরোধিতা করলেও পরবর্তীতে জোর সাফাই গেয়েছেন, তিনি বলেন, দেশের অধিকাংশ লোকের শিক্ষার উপর যদি দেশের উন্নতি নির্ভর করে, সে শিক্ষার গুরুত্ব ও স্থায়ীত্বের উপর যদি উন্নতির স্থায়ীত্ব নির্ভর করে তবে মাতৃভাষা ছাড়া আর কোন গতি নেই’। মাতৃভাষার প্রতি অনিহা প্রকাশ করা কোন ব্যক্তি বা কোন জাতির পক্ষে শুভ লক্ষণ নয়। তার জ্বলন্ত প্রমাণ মাইকেল মধুসুদন দত্ত। বাংলা ভাষা রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদার দাবিতে ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঢাকসুর জি,এস ভাষা সৈনিক অধ্যাপক গোলাম আজম পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ঢাকায় আগমনে তাঁকে রাষ্ট্রভাষা বাংলাকরণের দাবিনামা সংবলিত স্মারকলিপি প্রদান করেন। বিশেষ উল্লেখ্য যে, ভাষা আন্দোলনের ক্ষেত্রে ১৯৪৭ সালের ১ অক্টোবর তমদ্দুন মজলিস তদানীন্তন সুরুজ্জামাল মেসে অনুষ্ঠিত এক সমাবেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের তরুণ অধ্যাপক নুরুল হক ভূঁইয়াকে আহ্বায়ক করে গঠন করে প্রথম ‘রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ এবং একই মাসে ফজলুল হক হলে হাবিবুল্লাহ বাহারের সভাপতিত্বে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে প্রথম প্রকাশ্য সেমিনারের আয়োজন করা হয়। এভাবে সভা-সমিতি, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম অনুষ্ঠান ও পত্রপত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রেরণের মাধ্যমে তমদ্দুন মজলিস ভাষা সংগ্রামকে এগিয়ে নিতে থাকে। পক্ষান্তরে শাসক গোষ্ঠী ও উর্দুকে লিংগুয়াফ্রাংকা করা, উচ্চতম সিভিল সার্ভিসে বাংলাকে বাদ দেওয়াসহ বিভিন্ন সরকারি ফরমে বাংলাকে উপেক্ষা করতে থাকে।

১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশন চলাকালীন গণ পরিষদের সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলায় বক্তৃতা দিতে চাইলে তা প্রত্যাখাত হয়। এর প্রতিবাদে ১৯৪৮ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের এক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে বাংলার স্বপক্ষে আন্দোলন জোরদার করার আহব্বান জানানো হয়। এই আহব্বানের পরিপ্রেক্ষিতে পরদিন ২৭ ফেব্রুয়ারি রশিদ বিল্ডিংয়ে তমুদ্দুন মজলিসের অফিসে অধ্যাপক আবুল কাসেমের সভাপতিত্বে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদকে পুনর্গঠিত করে এম শামসুল আলমকে আহব্বায়ক করা হয় এবং রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ১১ মার্চ হরতাল ও ছাত্র ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ঐদিনের কর্মসূচি সাফল্য অর্জন করে। ১১ মার্চের সাফল্যের পরিপ্রেক্ষিতে ১৫ মার্চ প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশন চলাকালে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন সংগ্রাম পরিষদের এক প্রতিনিধি দলের সাথে মিলিত হন এবং সংগ্রাম পরিষদের সাথে ৮ দফা চুক্তি স্বাক্ষর করেন। চুক্তিতে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি মেনে নেওয়া হয় এবং এর ধারাবাহিকতায় এপ্রিল মাসে পূর্ব পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলার পক্ষে সর্ব সম্মতিক্রমে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। এভাবে তমদ্দুন মজলিসসহ অন্যান্য ছাত্র, যুব ও রাজনৈতিক সংগঠনের নিরলস প্রচেষ্টায় ভাষা আন্দোলনের প্রথম বিজয় সূচিত হয়। কিন্তু ১৯৪৮ সালে ১৯ মার্চ গর্ভনর জেনারেল কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় রেসকোর্স ময়দানে ঘোষণা দেন ‘উর্দু, উর্দু এন্ড উর্দু শ্যাল বি দি স্টেট ল্যাংগুয়েজ অব পাকিস্তান’ এতে ছাত্র ও বুদ্ধিজীবী সমাজ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে।

ভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ের সূচনা হয় ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি। ঐদিন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন তার পূর্ব প্রতিশ্রুতি ভংগ করে পুনর্বার উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করলে এর প্রতিবাদে ৩০ জানুয়ারি ঢাকা বার লাইব্রেরি হলে আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সমাবেশে কাজী গোলাম মাহবুবকে আহবায়ক করে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয় এবং ২১ ফেব্রুয়ারি সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানব্যাপী প্রতিবাদ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ২০ ফেব্রুয়ারি প্রাদেশিক সরকার ১৪৪ ধারা জারি করলে সংগ্রাম পরিষদ এক জরুরি সভায় মিলিত হয়ে ১৪৪ ধারা অমান্য না করার পক্ষে সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু সংগ্রাম পরিষদের এই সিদ্ধান্ত অলি আহাদ, গাজীউল হক প্রমুখ ছাত্র-যুব নেতাদের নেতৃত্বে অমান্য করা হয়। পুলিশ ছাত্র-জনতার উপর গুলিবর্ষণ করে। পুলিশের গুলিতে সালাম, বরকত, রফিক, শফিক, জব্বার শাহাদত বরণ করেন। শাহাদতের এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ২২ ও ২৩ ফেব্রুয়ারি বিক্ষোভ মিছিল ও ধর্মঘট পালনের কর্মসূচি নেওয়া হয় এবং জনমনে তা বিপুল প্রভাব বিস্তার করে। আর এভাবেই রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিটি গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠে এবং ১৯৫৬ সালের সংবিধানেও পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা সাংবিধানিক মর্যাদা লাভ করে। ভাষা আন্দোলনের ধারাবাহিকতা বা প্রেক্ষাপট খুব কম ইতিহাস গ্রন্থে স্থান পেয়েছে। অথচ, ভাষা আন্দোলন জাতির একটি বড় আন্দোলন। ভাষা নিয়ে এমন আন্দোলন বিশ্বে আর কোথাও হয়নি। তাই ঐতিহাসিক প্রয়োজনেই ভাষা আন্দোলনের প্রকৃত ইতিহাস প্রণয়নের জন্য সরকারের তরফে অবিলম্বে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস প্রণয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা উচিত।

লেখক: সাবেক সম্পাদক, নরসিংদী জেলা আইনজীবী সমিতি


বিভাগ : বিশেষ সংখ্যা


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

জাগ্রত ভয় মনের মাঝে
আর কেউ বেঁচে নেই
সময়
মার্চের পদাবলি
অপসৃয়মাণ রেলগাড়ি
আরও
X

আরও পড়ুন

ঈদ মিছিলে মূর্তি ঈদের মূল স্পিরিটের সঙ্গে সাংঘর্ষিক: হেফাজত

ঈদ মিছিলে মূর্তি ঈদের মূল স্পিরিটের সঙ্গে সাংঘর্ষিক: হেফাজত

ফার্নান্দেসের রিয়ালে যাওয়ার ব্যাপারে যা বললেন তার কোচ

ফার্নান্দেসের রিয়ালে যাওয়ার ব্যাপারে যা বললেন তার কোচ

রোনালদোকে ছাড়িয়ে যেতে পারেন এমবাপে: আনচেলত্তি

রোনালদোকে ছাড়িয়ে যেতে পারেন এমবাপে: আনচেলত্তি

উইন্ডিজের নেতৃত্ব ছাড়লেন ব্র্যাথওয়েট

উইন্ডিজের নেতৃত্ব ছাড়লেন ব্র্যাথওয়েট

ঈদের আনন্দ ৫ আগস্ট শুরু হয়েছে : শিবির সভাপতি

ঈদের আনন্দ ৫ আগস্ট শুরু হয়েছে : শিবির সভাপতি

আমাকে যুদ্ধাপরাধের মামলায় ফাঁসানোর ভয় দেখানো হয়েছিল: জামায়াত আমির

আমাকে যুদ্ধাপরাধের মামলায় ফাঁসানোর ভয় দেখানো হয়েছিল: জামায়াত আমির

বাকিটা জীবন বুড়িচং-ব্রাহ্মণপাড়াবাসীর পাশে থাকতে চাই : ব্যারিস্টার আব্দুল্লাহ আল মামুন

বাকিটা জীবন বুড়িচং-ব্রাহ্মণপাড়াবাসীর পাশে থাকতে চাই : ব্যারিস্টার আব্দুল্লাহ আল মামুন

পশ্চিমবঙ্গ-গুজরাটে আতশবাজি কারখানায় বিস্ফোরণ, নিহত ২১

পশ্চিমবঙ্গ-গুজরাটে আতশবাজি কারখানায় বিস্ফোরণ, নিহত ২১

আমাদের চেতনার প্রাণপুরুষ আল্লামা ফুলতলী (র.)

আমাদের চেতনার প্রাণপুরুষ আল্লামা ফুলতলী (র.)

লক্ষ্মীপুরে অস্ত্রধারীদের গুলিতে শিশু গুলিবিদ্ধ

লক্ষ্মীপুরে অস্ত্রধারীদের গুলিতে শিশু গুলিবিদ্ধ

রামুতে গুলিতে নিহতের ঘটনায় ২ টি দেশীয় তৈরি অস্ত্র উদ্ধার আটক ২

রামুতে গুলিতে নিহতের ঘটনায় ২ টি দেশীয় তৈরি অস্ত্র উদ্ধার আটক ২

সিলেটে ৬ তলা ভবন থেকে লাফ দিয়ে এক গৃহবধুর আত্মহত্যা

সিলেটে ৬ তলা ভবন থেকে লাফ দিয়ে এক গৃহবধুর আত্মহত্যা

ঈদ পরবর্তী শুভেচ্ছা বিনিময়ে মোরেলগঞ্জের পথে প্রান্তরে বিএনপি নেতা কাজী শিপন

ঈদ পরবর্তী শুভেচ্ছা বিনিময়ে মোরেলগঞ্জের পথে প্রান্তরে বিএনপি নেতা কাজী শিপন

ঈদে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত পর্যটকে মুখরিত

ঈদে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত পর্যটকে মুখরিত

কুমিল্লায় বিদ্যুতের খুঁটিতে ধাক্কা বাসের, নিহত ৩

কুমিল্লায় বিদ্যুতের খুঁটিতে ধাক্কা বাসের, নিহত ৩

দাউদকান্দিতে এক যুবকের লাশ উদ্ধার

দাউদকান্দিতে এক যুবকের লাশ উদ্ধার

ঈদের পাঞ্জাবি নিয়ে বিপাকে বাবর, ডিজাইনারকে ছাঁটাই করতে বললেন ভক্তরা

ঈদের পাঞ্জাবি নিয়ে বিপাকে বাবর, ডিজাইনারকে ছাঁটাই করতে বললেন ভক্তরা

লন্ডনে ঈদের জামাতে প্রকাশ্যে হাছান মাহমুদ

লন্ডনে ঈদের জামাতে প্রকাশ্যে হাছান মাহমুদ

সুপ্রিম কোর্টে মুখ পুড়ল যোগী আদিত্যনাথের

সুপ্রিম কোর্টে মুখ পুড়ল যোগী আদিত্যনাথের

মির্জাপুরে প্রশাসনের হস্তক্ষেপে বিরোধপূর্ণ দুই ঈদগাহসহ আড়াই শতাধিক মাঠে উৎসবমুখর পরিবেশে ঈদের জামাত

মির্জাপুরে প্রশাসনের হস্তক্ষেপে বিরোধপূর্ণ দুই ঈদগাহসহ আড়াই শতাধিক মাঠে উৎসবমুখর পরিবেশে ঈদের জামাত