গণপরিষদ, প্রোক্লামেশন ও সেকেন্ড রিপাবলিক
২৬ মার্চ ২০২৫, ০১:৩০ এএম | আপডেট: ২৬ মার্চ ২০২৫, ০১:৩০ এএম

এবার অর্থাৎ ২০২৫ সালের স্বাধীনতা দিবসে এসে নতুন কতগুলো রাজনৈতিক বন্দোবস্তের সম্মুখীন হতে হলো। এগুলো অবশ্যাম্ভাবীরূপে জুলাই বিপ্লবের ফল। গত বছরের ৫ আগস্টের পর আমরা কতগুলো রাজনৈতিক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবির কথা শুনলাম। এগুলো হলো, বর্তমান সংবিধান সংশোধন নয়, নতুন সংবিধান রচনা। সেই নতুন সংবিধান রচনার জন্য সর্বাগ্রে করতে হবে গণপরিষদের নির্বাচন। সেই গণপরিষদ যে নতুন সংবিধান রচনা করবে তার মাধ্যমে সূচিত হবে সেকেন্ড রিপাবলিক বা দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র। আমরা আরো পরিচিত হলাম একটি রাজনৈতিক পরিভাষার সাথে। সেটি হলো, দ্বিতীয় স্বাধীনতার প্রোক্লামেশন। প্রোক্লামেশনের বাংলা করা হচ্ছে ঘোষণাপত্র। আসলে প্রোক্লামেশন কোনো ঘোষণাপত্র নয়। এটিকে বলা হয় ফরমান। দেশে মার্শাল ল’ হলে প্রোক্লামেশন দিয়ে বা অর্ডিন্যান্স জারি করে দেশ শাসন করা হয়। দেশে গণঅভ্যুত্থান বা বিপ্লবের মাধ্যমে সরকার গঠিত হলেও প্রোক্লামেশন বা অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে দেশ শাসন করা হয়।
ওপরে যেসব রাজনৈতিক পরিভাষা ব্যবহার করা হলো সেগুলো কোনো রাজনৈতিক দল এবং তার কোনো কোনো নেতার কাছে নতুন পরিভাষা মনে হয়েছে। এমন কথাও বলা হয়েছে যে, যেসব শব্দ বা পরিভাষা ডিকশনারিতে নাই সেগুলো ব্যবহার করে পরিস্থিতিকে জটিল করবেন না। আরো বলা হচ্ছে যে, ঐসব দাবি তুলে নির্বাচন বিলম্বিত করার ষড়যন্ত্র হচ্ছে। প্রশ্ন করা হয়েছে যে, নতুন সংবিধান কেন? আমাদের কি কোনো সংবিধান নাই?
আমাদের সংবিধান থাকবে না কেন? অবশ্যই আছে। কিন্তু সেটা কোন্ সংবিধান? কেউ কি সঠিক করে কিছু বলতে পারবেন? একজন বড় নেতা তো এমনও বলেছেন যে, রক্ত দিয়ে ৭২ এর সংবিধান লেখা হয়েছে। আফসোস হয়, এসব বড় বড় নেতা সমাজ ও রাজনীতির উঁচু স্তরে পৌঁছেও এমন কথা বলতে পারেন!
সংবিধান থাকবে না কেন? কিন্তু এটা কি মুক্তিযুদ্ধের রক্তে লেখা সংবিধান? মুক্তিযুদ্ধ কি ঐ সংবিধান লেখার জন্য করা হয়েছিল? মুক্তিযুদ্ধ তো করা হয়েছিল ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র বাস্তবায়নের জন্য। এই স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র গৃহীত হয়েছিল ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল মেহেরপুরের আ¤্রকাননে। সেখানে কোনো সংসদ ছিল না। ছিল না কোনো স্পিকার। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে যারা পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় জাতীয় পরিষদে পূর্ব পাকিস্তানের কোটায় নির্বাচিত হয়েছিলেন সেই ১৬৭ জন এমপি (তখন বলা হতো এমএনএ) এবং পূর্ব পাকিস্তান ব্যবস্থাপক পরিষদের ২৮৮ জন এমপিএ-কে নিয়ে মেহেরপুরের আ¤্রকাননে যৌথ সভা হয়। ঐ সভাতেই শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রেসিডেন্ট, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং তাজউদ্দিনকে প্রধানমন্ত্রী করে একটি অস্থায়ী সরকার গঠিত হয়। সেখানে কোনো বিচার বিভাগ না থাকায় কোনো চিফ জাস্টিস ছিলেন না। আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো গণপরিষদ না থাকায় কোনো স্পিকারও ছিলেন না।
আরো লক্ষ্য করার বিষয় হলো এই যে ১৯৭০ সালে তৎকালীন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য একটি এলএফও (লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার বা আইনগত কাঠামো) প্রণয়ন করেন। ঐ এলএফওর অধীনে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র প্রণয়নের জন্য সারা পাকিস্তানব্যাপী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। লক্ষ্য করার বিষয় হলো এই যে, যখন এই ইলেকশনটি অনুষ্ঠিত হয় তখন অর্থাৎ ১৯৭০ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়নি। তাই ঐ নির্বাচনটি ছিল পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র প্রণয়নের জন্য গণপরিষদ নির্বাচন।
যেহেতু পাকিস্তানের গণপরিষদের অধিবেশন বসার আগেই ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানে মিলিটারি ক্র্যাকডাউন হয় তাই ঐ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তান থেকে যারা কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত হয়েছিলেন তাই তাদের না ছিল কোনো গণপরিষদ, না ছিল কানো বিচার বিভাগ বা না ছিল কোনো স্পিকার বা চিফ জাস্টিস। শেখ মুজিব এবং তাজউদ্দিনকে নিয়ে যে মন্ত্রিসভা গঠিত হয় সেটির শপথ বাক্য পাঠ করান অন্যতম নব নির্বাচিত এমএনএ অধ্যাপক ইউসুফ আলী। শপথ বাক্যে ১০ এপ্রিল ১৯৭১ সালে গৃহীত ঘোষণাপত্রটিই ছিল ফার্স্ট প্রোক্লামেশন। এই প্রোক্লামেশনের মাধ্যমেই দেশে ফার্স্ট রিপাবলিক গঠিত হয়। এই ক্যাবিনেটটি না ছিল প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির, না ছিল সংসদীয় বা পার্লামেন্টারি পদ্ধতির।
তাই দেখা যায়, শেখ মুজিব দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১০ জানুয়ারি বাংলাদেশে ফিরে ১২ তারিখেই প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণ করেন এবং তাজউদ্দিনকে নামিয়ে অর্থমন্ত্রী করেন। এরপর শেখ মুজিবের মন্ত্রিসভা একটি হুকুমবলে ঐ ৪৫৫ সদস্যকে (১৬৭ জন এমএনএ + ২৮৮ জন এমপিএ) নিয়ে গণপরিষদ গঠিত হয়েছে বলে ঘোষণা করেন। সুতরাং গণপরিষদ বা ফার্স্ট রিপাবলিক, সেকেন্ড রিপাবলিক ইত্যাদি পরিভাষা ডিকশনারিতে নাই বলে যা বলা হয় সেগুলো রাজনৈতিক অভিজ্ঞানের পরিচয় বহন করে না।
মুক্তিযুদ্ধ তো পরিচালিত হয়েছিল ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল গৃহীত প্রোক্লামেশন বা ঘোষণাপত্র বাস্তবায়ন করার জন্য। আগেই বলেছি যে, ঐ ঘোষণাপত্রে সরকারের কাঠামো, মূলনীতি, প্রস্তাবনা ইত্যাদি কিছুই ছিল না। ১৯৭২ সালের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ইত্যাদি বিষয় নতুন সংবিধানে অন্তর্ভূক্ত করা হয়। ১৯৪৯ সালে আওয়ামী লীগ গঠিত হয়। আর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তান পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণমুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশ হয়।
সেই যে ৭২ এর সংবিধান হলো, সেই সংবিধান কি আর ৩ বছর ৮ মাস পর কি আর আগের অবস্থায় থাকলো? শেখ মুজিবুর রহমান ঐ সংবিধানের খোলনলিচা সম্পূর্ণ পাল্টে দেন। সংসদীয় পদ্ধতির সরকার হয়ে যায় প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির সরকার। বহুদলীয় গণতন্ত্র রূপান্তরিত হয় একদলীয় গণতন্ত্রে। এক দলীয় গণতন্ত্র রূপান্তরিত হয় এক ব্যক্তির গণতন্ত্রে। সোজা কথা, আওয়ামী লীগ তার বিগত ২২ বছরের ইতিহাস সম্পূর্ণ পাল্টে দিয়ে গণতন্ত্রের বদলে ব্যক্তি স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠা করেন।
এই ব্যক্তি স্বৈরাচারও টিকলো না। জেনারেল জিয়াউর রহমান প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর মুজিবের এক ব্যক্তির স্বৈরাচার সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। সংবিধানের ৫ম সংশোধনীর মাধ্যমে দেশ বহুদলীয় গণতন্ত্রে ফিরে যায়। কিন্তু সরকারের পদ্ধতি প্রেসিডেন্সিয়াল থেকে যায়। তারপর মোট ১৬ বার সংবিধানের সংশোধন হয়েছে। সংবিধানের অনেক কাটা ছেঁড়া হয়েছে। তাই এখন আর ৭২ এর সংবিধানের কথা বলে লাভ কি?
এখন আসছে প্রোক্লামেশন বা ফরমান এবং সেকেন্ড রিপাবলিকের কথা। যারা সেকন্ড রিপাবলিককে ডিকশনারি বহির্ভূত বলেন তারা কি জানেন যে, ফরাসি বিপ্লবের পর থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত ফ্রান্স একবার দুইবার নয়, পাঁচ পাঁচ বার রিপাবলিক হয়েছে। এখন চলছে ৫ম রিপাবলিক। আর সেই রিপাবলিকও এসেছে একজন সেনাপ্রধানের হাত ধরে। তার নাম জেনারেল চার্লস দ্যাগল। আর সবচেয়ে অবাক ব্যাপার হলো এই যে, সেনাপ্রধান দ্যাগলের হাত ধরে যে ৫ম রিপাবলিক এলো সেটি এত সাচ্চা গণতান্ত্রিক হলো যে, সেটিকেই এখন ইউরোপে গণতন্ত্রের অন্যতম রোল মডেল হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
৩৬ জুলাইয়ের বিপ্লব নেহায়েত শেখ হাসিনাকে সরিয়ে অন্য কাউকে বসানোর জন্য নয়। দেড় হাজার ছাত্র জনতা প্রাণ দিলেন, ২৬ হাজার ছাত্র জনতা বুলেটের আঘাতে আহত হলেন। সে কি শুধুমাত্র সরকার পরিবর্তনের জন্য? সরকার অবশ্যই পরিবর্তিত হবে। নির্বাচন অবশ্যই হবে। কিন্তু সংবিধান এবং নির্বাচন ব্যবস্থা পরিবর্তন করে এমন নতুন রূপ দিতে হবে যে রূপটি যেন ফ্যাসিবাদি মাফিয়াতন্ত্রের বিরুদ্ধে একটি লৌহ কঠিন প্রাচীর হিসেবে দাঁড়াতে পারে। যাতে করে আগামী দিনে কেউ গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হয়ে স্বৈরাচারি ডিক্টেটর হতে না পারে, কিংবা দুর্বল গণতন্ত্রের সুযোগ নিয়ে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটাতে না পারে।
বিভাগ : বিশেষ সংখ্যা
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন

৮ গোলের অবিশ্বাস্য লড়াই শেষে ফাইনালে রিয়াল মাদ্রিদ

ঈদ মিছিলে মূর্তি ঈদের মূল স্পিরিটের সঙ্গে সাংঘর্ষিক: হেফাজত

ফার্নান্দেসের রিয়ালে যাওয়ার ব্যাপারে যা বললেন তার কোচ

রোনালদোকে ছাড়িয়ে যেতে পারেন এমবাপে: আনচেলত্তি

উইন্ডিজের নেতৃত্ব ছাড়লেন ব্র্যাথওয়েট

ঈদের আনন্দ ৫ আগস্ট শুরু হয়েছে : শিবির সভাপতি

আমাকে যুদ্ধাপরাধের মামলায় ফাঁসানোর ভয় দেখানো হয়েছিল: জামায়াত আমির

বাকিটা জীবন বুড়িচং-ব্রাহ্মণপাড়াবাসীর পাশে থাকতে চাই : ব্যারিস্টার আব্দুল্লাহ আল মামুন

পশ্চিমবঙ্গ-গুজরাটে আতশবাজি কারখানায় বিস্ফোরণ, নিহত ২১

আমাদের চেতনার প্রাণপুরুষ আল্লামা ফুলতলী (র.)

লক্ষ্মীপুরে অস্ত্রধারীদের গুলিতে শিশু গুলিবিদ্ধ

রামুতে গুলিতে নিহতের ঘটনায় ২ টি দেশীয় তৈরি অস্ত্র উদ্ধার আটক ২

সিলেটে ৬ তলা ভবন থেকে লাফ দিয়ে এক গৃহবধুর আত্মহত্যা
ঈদ পরবর্তী শুভেচ্ছা বিনিময়ে মোরেলগঞ্জের পথে প্রান্তরে বিএনপি নেতা কাজী শিপন

ঈদে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত পর্যটকে মুখরিত

কুমিল্লায় বিদ্যুতের খুঁটিতে ধাক্কা বাসের, নিহত ৩

দাউদকান্দিতে এক যুবকের লাশ উদ্ধার

ঈদের পাঞ্জাবি নিয়ে বিপাকে বাবর, ডিজাইনারকে ছাঁটাই করতে বললেন ভক্তরা

লন্ডনে ঈদের জামাতে প্রকাশ্যে হাছান মাহমুদ

সুপ্রিম কোর্টে মুখ পুড়ল যোগী আদিত্যনাথের