একটি জাতির জন্ম

Daily Inqilab জিয়াউর রহমান

২৬ মার্চ ২০২৫, ০১:৩০ এএম | আপডেট: ২৬ মার্চ ২০২৫, ০১:৩০ এএম

পাকিস্তান সৃষ্টির পর পরই ঐতিহাসিক ঢাকা নগরীতে মি. জিন্নাহ যেদিন ঘোষণা করলেন, ‘উর্দু এবং একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা’, সেদিন নিজের অজান্তে পাকিস্তানের স্রষ্টা নিজেই অস্বাভাবিক রাষ্ট্র পাকিস্তানের ধ্বংসের বীজটাও বপন করে গিয়েছিলেন এই ঢাকার ময়দানেই। এই ঐতিহাসিক নগরী ঢাকাতেই মি. জিন্নাহ অত্যন্ত নগ্নভাবে পদদলিত করেছিলেন আমাদের জনগণের জন্মগত অধিকার। আর এই ঐতিহাসিক ঢাকা নগরীতেই চূড়ান্তভাবে খ--বিখ- হয়ে গেলো তাঁর সাধের পাকিস্তান। ঢাকা নগরী প্রতিশোধ নিল জিন্নাহ ও তার অনুসারীদের নষ্টামীর। প্রতিশোধ নিল যোগ্যতমভাবেই। মহান নগরী ঢাকা চিরদিন ছিল মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠা ও মানবিক মুক্তি সাধনের পীঠস্থান। সে এবারও হয়েছে মুক্তির উৎস রূপে সুপ্রতিষ্ঠিত। সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবার বিশ্বের নির্যাতিত জনতার গর্বের শহর, আশার নগরী রূপে। অতিপ্রিয় মাতৃভূমির মুক্তির আশায় ঢাকা নগরীর বীর জনতা সংগ্রাম করেছে হানাদার দখলদার দস্যু বাহিনীর বিরুদ্ধে। দস্যু বাহিনীর নৃশংসতা আর হত্যার বিরুদ্ধে শির উঁচু করে রুখে দাঁড়িয়েছে ঢাকার মানুষ। সংগ্রাম করেছে দৃঢ়তার সাথে। বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়েছে এই ঢাকা নগরীতেই। এই বীর নগরীর পবিত্র ভূমিতে ফিরে এসেছি আমি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের দিন কয়েকের মধ্যেই। বীর নগরীর পবিত্র মাটিতে দাঁড়িয়ে প্রথমেই আমি এই সংগ্রামী ঢাকা ও ঢাকাবাসীর উদ্দেশ্যে শির নত করেছি অকুণ্ঠ শ্রদ্ধায়। পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণের সপ্তাহ খানেক পরে একজন সাংবাদিক আমাকে বলেছিলেন, সেই দুঃস্বপ্নে ভরা দিনগুলো সম্পর্কে কিছু স্মৃতিকথা লিখতে। আমি একজন সৈনিক। আর লেখা একটি ঈশ্বরপ্রদত্ত শিল্প। সৈনিকেরা স্বভাবত সেই বিরল শিল্পক্ষমতার অধিকারী হয় না। কিন্তু সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তটি ছিল এমনই আবেগধর্মী যে আমাকেও তখন কিছু লিখতে হয়েছিল। তখন কলম তুলে নিতে হয়েছিল হাতে।

ভারত ভেঙে দু’ভাগ হয়ে সৃষ্টি হয়েছিল অস্বাভাবিক রাষ্ট্র পাকিস্তানের। আর তার অব্যাবহিত পরেই আমরা চলে গিয়েছিলাম করাচি। সেখানে ১৯৫২ সালে আমি পাস করি ম্যাট্রিক। যোগদান করি পাকিস্তান সামরিক একাডেমিতে। অফিসার ক্যাডেট রূপে। সেই থেকে অধিকাংশ সময়ই বিভিন্ন স্থানে আমি কাজ করেছি পাকিস্তানি বাহিনীতে।

স্কুল জীবন থেকেই পাকিস্তানিদের দৃষ্টিভঙ্গির অসচ্ছলতা আমার মনকে পীড়া দিতো। আমি জানতাম, অন্তর দিয়ে ওরা আমাদের ঘৃণা করে। স্কুল জীবনে বহু দিনই শুনেছি আমার স্কুল-বন্ধুদের আলোচনা। তাদের অভিভাবকরা বাড়িতে যা বলতো তাই তারা রোমন্থন করতো স্কুল প্রাঙ্গণে। আমি শুনতাম মাঝে-মাঝেই, শুনতাম তাদের আলোচনার প্রধান বিষয় হতো বাংলাদেশকে শোষণ করার বিষয়। পাকিস্তানি তরুণ সমাজকেই শেখানো হতো বাঙালিদের ঘৃণা করতে। বাঙালিদের বিরুদ্ধে একটি ঘৃণার বীজ উপ্ত করে দেওয়া হতো স্কুল ছাত্রদের শিশুমনেই। স্কুলে শিক্ষা দেয়া হতো তাদের বাঙালিকে নিকৃষ্টতম জাতি রূপে বিবেচনা করতে। অনেক সময় আমি থাকতাম নীরব শ্রোতা। আবার মাঝে মধ্যে প্রত্যাঘাত হানতাম আমিও। সেই স্কুল জীবন থেকেই মনে মনে আমার একটি আকাক্সক্ষাই লালিত হতো, যদি কখনো দিন আসে, তাহলে এই পাকিস্তানবাদের অস্তিত্বেই আমি আঘাত হানবো। সযতেœ এই ভাবনাটিকে আমি লালন করতাম। আমি বড় হলাম। সময়ের সাথে সাথে আমার সেই কিশোর মনের ভাবনাটাও পরিণত হলো। জোরদার হলো পাকিস্তানের ভিত্তি ভূমিটাকে তছনছ করে দিতে। কিন্তু উপযুক্ত সময় আর স্থানের অপেক্ষায় দমন করতাম সেই আকাক্সক্ষাকে।

১৯৫২ সালে মশাল জ্বললো আন্দোলনের। ভাষা আন্দোলনের। আমি তখন করাচিতে। দশম শ্রেণীর ছাত্র তখন। পাকিস্তানি সংবাদপত্র, প্রচার মাধ্যম, পাকিস্তানি বুদ্ধিজীবী, সরকারি কর্মচারী, সেনাবাহিনী, আর জনগণ সবাই সমানভাবে তখন নিন্দা করেছিল বাংলা ভাষার, নিন্দা করেছিল বাঙালিদের। তাদের রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তারা এটাকে মনে করেছিল এক চক্রান্ত বলে। এক সুরে তাই তারা চেয়েছিল একে ধ্বংস করে দিতে। আহ্বান জানিয়েছিল এর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের। কেউবা বলতো, ‘বাঙালি জাতির মাথা গুঁড়িয়ে দাও।’ কেউ বলতো, ‘ভেঙে দাও এর শিরদাঁড়া।’ এদের থেকেই আমার তখন ধারণা হয়েছিল, পাকিস্তানিরা বাঙালিদের পায়ের তলায় দাবিয়ে রাখতে চায়। জীবনের সর্বক্ষেত্রে তারা চায় বাঙালিদের ওপর ছড়ি ঘুরাতে। কেড়ে নিতে চায় বাঙালিদের সব অধিকার। একটি স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিকরূপে বাঙালিদের মেনে নিতে তারা কুণ্ঠিত।

১৯৫৪ সালে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হলো নির্বাচন। যুক্তফ্রন্টের বিজয় রথের চাকার নিচে পিষ্ট হলো মুসলিম লীগ। বাঙালিদের আশা-আকাক্সক্ষার মূর্ত প্রতীক যুক্তফ্রন্টের বিজয়কেতন উড়লো বাংলায়। আমি তখন দ্বিতীয় পর্যায়ের ক্যাডেট। আমাদের মনেও জাগলো তখন পুলকের শিহরণ। যুক্তফ্রন্টের বিরাট সাফল্যে আনন্দে উদ্বেলিত হলাম আমরা সবাই পর্বতে ঘেরা এ্যাবোটাবাদের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। আমরা বাঙালি ক্যাডেটরা আনন্দে হলাম আত্মহারা। খোলাখুলিভাবে প্রকাশ করলাম সেই বাঁধভাঙ্গা আনন্দের তরঙ্গমালা। একাডেমি ক্যাফেটেরিয়ায় নির্বাচনী বিজয় উৎসব করলাম আমরা। এ ছিল আমাদের বাংলা ভাষার জয়, এ ছিল আমাদের অধিকারের জয়, এ ছিল আমাদের আশা-আকাক্সক্ষার জয়, এ ছিল আমাদের জনগণের, আমাদের দেশের এক বিরাট সাফল্য।

এই সময়েই একদিন কতগুলো পাকিস্তানি ক্যাডেট আমাদের জাতীয় নেতা ও জাতীয় বীরদের গালাগাল করলো। আখ্যায়িত করলো তাদের বিশ্বাসঘাতক বলে। আমরা প্রতিবাদ করলাম। অবতীর্ণ হলাম তাদের সাথে এক উষ্ণতম কথা কাটাকাটিতে। মুখের কথা কাটাকাটিতে এই বিরোধের মীমাংসা হলো না- ঠিক হলো এর ফয়সালা হবে মুষ্টিযুদ্ধের দ্বন্দ্বে। বাঙালিদের জন্মগত অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে বক্সিং গ্লাভস হাতে তুলে নিলাম আমি। পাকিস্তানি গোঁয়ার্তুমির মান বাঁচাতে এগিয়ে এলো এক পাকিস্তানি ক্যাডেট, নাম তার লতিফ (পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অর্ডিন্যান্স কোরে এখন সে লেফটেন্যান্ট কর্নেল)। লতিফ প্রতিজ্ঞা করলো, আমাকে সে একটু শিক্ষা দেবে। পাকিস্তানের সংহতির বিরুদ্ধে যাতে আর কথা না বলতে পারি সেই ব্যবস্থা নাকি সে করবে। এই মুষ্টিযুদ্ধ দেখতে সেদিন জমা হয়েছিল অনেক দর্শক। তুমুল করতালির মাঝে শুরু হলো মুষ্টিযুদ্ধ। বাংলাদেশ বনাম পাকিস্তানের দুই প্রতিনিধির মধ্যে। লতিফ আর তার পারিষদ দল অকথ্য ভাষায় আমাদের গালাগাল করলো। হুমকি দিলো বহুতর। কিন্তু মুষ্টিযুদ্ধ স্থায়ী হলো না ত্রিশ সেকেন্ডের বেশি। পাকিস্তানপন্থী আমার প্রতিপক্ষ ধুলায় লুটিয়ে পড়লো। আবেদন জানালো, সব বিতর্কের শান্তিপূর্ণ মীমাংসার জন্যে।

এই ঘটনাটি আমার মনে এক গভীর রেখাপাত করেছিল। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীতেও বাঙালি অফিসারদের আনুগত্য ছিল না প্রশ্নাতীত। অবশ্য গুটি কয়েক দালাল ছাড়া। আমাদের ওরা দাবিয়ে রাখতো, অবহেলা করতো, অসম্মান করতো। দক্ষ ও যোগ্য বাঙালি অফিসার আর সৈনিকদের ভাগ্যে জুটতো না কোন স্বীকৃতি বা পারিতোষিক। জুটতো শুধু অবহেলা আর অবজ্ঞা। বাঙালি অফিসার ও সৈনিকরা সব সময়ই পরিণত হতো পাকিস্তানি অফিসারদের রাজনৈতিক শিকারে। সব বড় বড় পদগুলো আর লোভনীয় নিয়োগপত্রের শিকাগুলো বরাবরই ছিঁড়তো পাকিস্তানিদের ভাগ্যে। বিদেশে শিক্ষার জন্য পাঠানো হতো না বাঙালি অফিসারদের। আমাদের বলা হতো, ভীরু-কাপুরুষ। আমাদের নাকি ক্ষমতা নেই ভালো সৈনিক হওয়ার। ঐতিহ্য নেই যুদ্ধের, সংগ্রামের।

এর পর এলো আইয়ুবী দশক। আইয়ুব খানের নেতৃত্বে চালিত এক প্রতারণাপূর্ণ, সামরিক শাসনের কালো দশক। এই তথাকথিত উন্নয়ন দশকে সুপরিকল্পিত প্রচেষ্টা চালানো হয়েছিল বাঙালি সংস্কৃতিকে বিকৃত করার। আমাদের জাতীয়তা খাটো করার। বাংলাদেশের বীর জনতা অবশ্য বীরত্বের সাথে প্রতিহত করেছে এই হীন প্রচেষ্টা। এ ছিল এক পালা বদলের কাল। এখান থেকেই আমাদের ভাষা, সাহিত্য ও শিল্প গ্রহণ করেছে এক নতুন পথ। আমাদের বুদ্ধিজীবী মহল, ছাত্র-জনতা আর প্রচার মাধ্যমগুলো সাংস্কৃতিক বন্ধনকে দৃঢ় করার জন্য পালন করেছে এক বিরাট ভূমিকা। আমাদের দেশে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য আসন্ন সশস্ত্র সংগ্রামের ক্ষেত্র প্রস্তুতিতে জনগণ ও সৈনিকদের মনোভাবকে গড়ে তোলা আর আন্দোলনে দ্রুততর গতি সঞ্চারণে এঁদের রয়েছে এক বিরাট অবদান। জাতীয়তাবাদ গড়ে তোলার একমাত্র উপাদান হচ্ছে এর সংস্কৃতি।

১৯৬৩ সালে আমি ছিলাম সামরিক গোয়েন্দা বিভাগে। সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের তদানীন্তন পরিচালক মেজর জেনারেল নওয়াজেশ আলী মালিক এক সময় আমার এলাকা পরিদর্শন করেন। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল একদিন। বাংলাদেশের অর্থনীতিকে কিছুটা উন্নততর করবার অভীক্ষা সম্পর্কে দ্বিমত পোষণ করেছিলেন তিনি।

এক পর্যায়ে এ ব্যাপারে তিনি আমার অভিমত জানতে চাইলে আমি বললাম, ‘বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যদি ব্যাপক অগ্রগতি সাধন না করা হয়, তাহলে দেশে প্রশাসন ব্যবস্থা চালু রাখা সরকারের পক্ষে কঠিন হবে।’ এর জবাবে তিনি বললেন, ‘বাংলাদেশ যদি স্বয়ম্ভর হয় তাহলে সে আলাদা হয়ে যাবে।’ পাকিস্তানের শীর্ষ স্থানীয় সামরিক কর্তাদের বাংলাদেশ সম্পর্কে এটাই ছিল মনোভাব। অথচ, তারাই তখন দেশটা শাসন করছিলেন। তারা চাচ্ছিলেন বাংলাদেশটাকে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে দেউলিয়া করে রাখতে।

১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হচ্ছে আর একটি উল্লেখযোগ্য বিষয়। সে সময়ে আমি ছিলাম পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর এমন এক কোম্পানিতে, যার নামে গর্ববোধ করতো সবাই। আমি ছিলাম তেমনি একটা ব্যাট্যালিয়নের কোম্পানি কমান্ডার। সেই ব্যাটালিয়ন এখন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীরও গর্বের বস্তু। খেমকারান রণাঙ্গনে বেদিয়ানে তখন আমরা যুদ্ধ করেছিলাম। সেখানে আমাদের ব্যাট্যালিয়ন বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেছিল। এই ব্যাট্যালিয়নই লাভ করেছিল পাক বাহিনীর মধ্যে দ্বিতীয় সর্বাধিক বীরত্ব পদক। ব্যাট্যালিয়নের পুরস্কার বিজয়ী কোম্পানি ছিল আমার কোম্পানি, ‘আলফা কোম্পানি’। এই কোম্পানি যুদ্ধ করেছিল ভারতীয় সপ্তদশ রাজপুত, ঊনবিংশ মারাঠা লাইট ইনফ্যান্ট্রি, ষোড়শ পাঞ্জাব ও সপ্তম লাইট ক্যান্ডালবীর (সাঁজোয়া বহর) বিরুদ্ধে। এই কোম্পানির জওয়ানরা এককভাবে এবং সম্মিলিতভাবে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেছে, ঘায়েল করেছে প্রতিপক্ষকে। বহুসংখ্যক প্রতিপক্ষকে হতাহত করে, যুদ্ধবন্দি হিসেবে আটক করে এই কোম্পানি অর্জন করেছিল সৈনিকসুলভ মর্যাদা, প্রশংসা করেছিল তাদেরও প্রীতি। যুদ্ধবিরতির সময় বিভিন্ন সুযোগে আমি দেখা করেছিলাম বেশ কিছুসংখ্যক ভারতীয় অফিসার ও সৈনিকের সাথে। আমি তখন তাদের সাথে কোলাকুলি করেছি, হাত মিলিয়েছি। আমার ভালো লাগতো তাদের সাথে হাত মেলাতে। কেননা আমি তখন দেখেছিলাম, তারাও অত্যন্ত উঁচু মানের সৈনিক। আমরা তখন মতবিনিময় করেছিলাম। সৈনিক হিসেবেই আমাদের মাঝে একটা হৃদ্যতাও গড়ে উঠেছিল, আমরা বন্ধুত্বে পরিণত হয়েছিলাম। এই প্রীতিই দীর্ঘদিন পর বাংলাদেশে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে পাশাপাশি ভাই-এর মত দাঁড়িয়ে সংগ্রাম করতে উদ্বুদ্ধ করেছে আমাদের।
পাকিস্তানিরা ভাবতো বাঙালিরা ভালো সৈনিক নয়। খেমকারানের যুদ্ধে তাদের বদ্ধমূল ধারণা ভেঙে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেছে। পাকিস্তানি বাহিনীর সবার কাছেই আমরা ছিলাম তখন ঈর্ষার পাত্র। সে যুদ্ধে এমন একটা ঘটনাও ঘটেনি যেখানে বাঙালি জওয়ানরা প্রাণের ভয়ে পালিয়ে গেছে। ভারতের সাথে সেই সংঘর্ষে বহুক্ষেত্রে পাকিস্তানিরাই বরং লেজ গুটিয়ে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে বেঁচেছে। সে সময় পাকিস্তানিদের সমন্বয়ে গঠিত পাক বাহিনীর এক প্রথম শ্রেণীর সাঁজোয়া ডিভিশনই নি¤œমানের ট্যাংকের অধিকারী ভারতীয় বাহিনীর হাতে নাস্তানাবুদ হয়েছিল, এসব কিছুতে পাকিস্তানিরা বিচলিত হয়ে পড়েছিল। বাঙালি সৈনিকদের ক্ষমতা উপলব্ধি করে হৃদকম্প জেগে ছিল তাদের।

এই যুদ্ধে পাকিস্তান বিমান বাহিনীর বাঙালি পাইলটরাও অর্জন করেছিল প্রচুর সুনাম। এসব কিছুই চোখ খুলে দিয়েছিল বাঙালি জনগণের, তারাও আস্থাশীল হয়ে উঠেছিল তাদের বাঙালি সৈনিকদের বীরত্বের প্রতি। বাঙালি সৈনিকের বীরত্ব ও দক্ষতার প্রশংসা হয়েছিল তখন বিশ্বের বিভিন্ন সংবাদপত্রে। উল্লেখ করা হয়েছিল ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের নাম। এ নাম আজ বাংলাদেশেরও এক পরমপ্রিয় সম্পদ।

এ সব কিছুর পরিণতিতে পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বাহিনী গ্রহণ করলো এক গোপন পরিকল্পনা। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী তারা ঠিক করলো প্রতিরক্ষা বাহিনীতে বাঙালিদের আনুপাতিক হার কমাতে হবে। তারা তাদের এই গোপন পরিকল্পনা পুরোপুরিভাবে কার্যকর করলো। কিন্তু এই গোপন তথ্য আমাদের কাছে গোপন ছিল না।
ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে আত্মবিশ্বাস জাগিয়েছিল আমাদের মনে, বাঙালি সৈনিকদের মনে, বিমান বাহিনীর বাঙালি, জওয়ানদের মনে। আমরা তখনই বুঝেছিলাম, বিশ্বের যে কোন বাহিনীর মোকাবিলায়ই আমরা সক্ষম।

জানুয়ারিতে আমি নিযুক্ত হয়েছিলাম পাকিস্তান সামরিক একাডেমিতে প্রশিক্ষকের পদে, যুদ্ধক্ষেত্রে সৈনিকাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমি একদিন শিক্ষক হলাম। মনে রইল শুধু যুদ্ধের স্মৃতি। সামরিক একাডেমিতে শুরু হলো আমার শিক্ষক জীবন। পাকিস্তানিদের আমি সমরবিদ্যায় পারদর্শী করে তোলার কাজে আত্মনিয়োগ করলাম। আর সেই বর্বররা এই বিদ্যাকে কাজে লাগালো আমারই দেশের নিরস্ত্র জনতার বিরুদ্ধে এক পাশবিক যুদ্ধ ঘোষণ করে দিয়ে।

সামরিক একাডেমিতে থাকাকালেও আমি সম্মুখীন হয়েছি নিকৃষ্ট অভিজ্ঞতার। সেখানে দেখেছি বাঙালি ক্যাডেটদের প্রতি পাকিস্তানিদের একই অবজ্ঞার ঐতিহ্যবাহী প্রতিচ্ছবি। অবৈধ উপায়ে পাকিস্তানিদের দেখেছি বাঙালি ক্যাডেটদের কোণঠাসা করতে। আমরা যখন ছাত্র ছিলাম তখন যেমন, আমি যখন শিক্ষক তখনো তেমনিভাবেই বাঙালি ক্যাডেটদের ভাগ্যে জুটতো শুধু অবহেলা, অবজ্ঞা আর ঘৃণা। আন্তঃসার্ভিস বোর্ডে গ্রহণ করা হতো নি¤œমানের বাঙালি ছেলেদের, ভালো ছেলেদের নেওয়া হতো না ক্যাডেটরূপে। রাজনৈতিক মতাদর্শ আর দরিদ্র পরিবারের নামে প্রত্যাখান করা হতো তাদের। এর সব কিছুই আমাকে ব্যথিত করতো। এই সামরিক একাডেমিতেই পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে আমার মন বিদ্রোহ করলো। একাডেমির গ্রন্থাগারে সংগৃহীত ছিল সব বিষয়ের ভালো ভালো বই। আমি জ্ঞানার্জনের এই সুযোগ গ্রহণ করলাম। আমি ব্যাপক পড়াশুনা করলাম ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহ সম্পর্কে, (ব্রিটিশ ঐতিহাসিকরা এটাকে আখ্যায়িত করেছিল ‘বিদ্রোহ’ হিসেবে।) কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটা বিদ্রোহ ছিল না এটা ছিল এক মুক্তিযুদ্ধ। ভারতের জন্যে স্বাধীনতার যুদ্ধ।

পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর তথাকথিত সামরিক কর্মকর্তাদের সাথেও মাঝে মাঝে আমার আলোচনা হতো। তাদের পরিকল্পনা ছিল আরো কয়েক দশক কোটি কোটি জাগ্রত বাঙালিকে দাবিয়ে রাখার। কিন্তু আমি বিশ্বাস করতাম, বাংলাদেশের জনগণ আর ঘুমিয়ে নেই। তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিচারের পরিণতিই ছিল এর জ্বলন্ত প্রমাণ। স্বাধীনতার জন্য আমাদের সশস্ত্র সংগ্রামের দিকে এটাও ছিল একটা সুস্পষ্ট অঙ্গুলি সংকেত। এই মামলার পরিণতি এক করে দিল বাঙালি সৈনিক, নাবিক ও বৈমানিকদের। বাংলাদেশের জনগণের সাথে একাত্ম হয়ে গেল তারা। তাদের ওপর পাকিস্তান সরকারের চাপিয়ে দেওয়া সব বিধি-নিষেধ ঝেড়ে ফেলা হলো। এক কণ্ঠে সোচ্চার হলো তারা মাতৃভূমির স্বাধীনতার দাবিতে। ইসলামাবাদের যুদ্ধবাজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা এবং অস্ত্র তুলে নেওয়ার মধ্যেই যে আমাদের দেশের— বাংলাদেশের কল্যাণ নিহিত তাতে আর কোন সন্দেহই ছিল না আমাদের মনে। এটাও আমাদের সশস্ত্র সংগ্রামের আরেক দিকদর্শন। এ সময় থেকেই এ ব্যাপারে আমরা মোটামুটিভাবে খোলাখুলি আলোচনাও শুরু করেছিলাম।

১৯৬৯ সালের এপ্রিল মাসে আমাকে নিয়োগ করা হলো জয়দেবপুরে। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের দ্বিতীয় ব্যাট্যালিয়নে আমি ছিলাম সেকেন্ড-ইন-কমান্ড। আমাদের কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল আবদুল কাউয়ুম ছিল একজন পাকিস্তানি। একদিন ময়মনসিংহের এক ভোজসভায় ধমকের সুরে সে ঘোষণা করল- ‘বাংলাদেশের জনগণ যদি সদাচারণ না করে তাহলে সামরিক আইনের সত্যিকার ও নির্মম বিকাশ এখানে ঘটানো হবে। আর তাতে হবে প্রচুর রক্তপাত।’ এই ভোজসভায় কয়েকজন বেসামরিক ভদ্রলোকও উপস্থিত ছিলেন। তাদের মাঝে ছিলেন ময়মনসিংহের তদানীন্তন ডেপুটি কমিশনার জনাব মোকাম্মেল। লেফটেন্যান্ট কর্নেল কাউয়ুমের এই দম্ভোক্তি আমাদের বিস্মিত করলো। এর আগে কাইয়ুম এক গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ছিল। ইসলামাবাদে পাকিস্তানি নীতি-নির্ধারকদের সাথে সংযোগ ছিল তার। তার মুখে তার পুরনো প্রভুদের মনের কথাই ভাষা পেয়েছে কিন্তু তাই আমি ভাবছিলাম। পরবর্তী সময়ে এ ব্যাপারে আমি তাকে অনেকগুলো প্রশ্ন করি এবং ওর কথা থেকে আমার কাছে এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, সে যা বলেছে তা জেনেশুনেই বলেছে। উপযুক্ত সময়ে কার্যকরী করার জন্য সামরিক ব্যবস্থার এক পরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছে। আর কাউয়ুম সে সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। আমি এতে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ি। এই সময়ে আমি একদিন চতুর্দশ ডিভিশনের সদর দফতরে যাই জিএসও-১ (গোয়েন্দা) লে. কর্নেল তাজ আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের কয়েকজন সম্পর্কে আমার কাছে অনেক কিছু জানতে চায়। আমি তার এসব তথ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্য কি জিজ্ঞেস করি। সে আমাকে জানায় যে তারা বাঙালি নেতাদের জীবনী সংক্রান্ত তথ্যাদি সংগ্রহ করছে। আমি বার বার তাকে জিজ্ঞেস করি- ‘এসব খুঁটিনাটির প্রয়োজন কি?’ এই প্রশ্নের জবাবে সে জানায়- ‘ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক গতিধারায় এগুলো কাজে লাগবে।’

গতিক যে বেশি সুবিধার নয়, তার সাথে আলোচনা করেই আমি তা বুঝতে পারি। সেই বছরেরই সেপ্টেম্বর মাসে চার মাসের জন্য আমি পশ্চিম জার্মানি যাই। এই সময়ে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে এক রাজনৈতিক ঝড় বয়ে যায়।
পশ্চিম জার্মানিতে অবস্থানকালে আমি একদিন দেখি সামরিক এ্যাটাচি কর্নেল জুলফিকার সে সময়ের পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে কারিগরি এ্যাটাচির সাথে কথা বলছিল। এই ব্যক্তিটি ছিল সরলমনা পাঠান অফিসার। তাদের সামনে ছিল করাচির দৈনিক পত্রিকা ‘ডনে’র একটা সংখ্যা। এতে প্রকাশিত হয়েছিল ইয়াহিয়ার ঘোষণা ১৯৭০ সালেই নির্বাচন হবে। সরলমনা পাঠান অফিসারটি বলছিল- ‘নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ ব্যাপকভাবে নির্বাচনে জয়ী হবে, আর সেখানেই হবে পাকিস্তানের সমাপ্তি।’

এর জবাবে কর্নেল জুলফিকার বললো- ‘আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করতে পারে। কিন্তু কেন্দ্রে সে ক্ষমতা পাবে না। কেননা, অন্যান্য দল মিলে কেন্দ্রে আওয়ামী লীগকে ছাড়িয়ে যাবে। আমি এটা জেনে বলছি, এ সম্পর্কে আমার কাছে বিশেষ খবর আছে।’

এরপর আমি বাংলাদেশে ফিরে এলাম। ১৯৭০ সালের সেপ্টেম্বরে আমাকে নিয়োগ করা হলো চট্টগ্রামে। এবার ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অষ্টম ব্যাট্যালিয়নের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড। এর কয়েকদিন পর আমাকে ঢাকা যেতে হয়। নির্বাচনের সময়টায় আমি ঢাকায় ছিলাম ক্যান্টনমেন্টে। প্রথম থেকেই পাকিস্তানি অফিসাররা মনে করতো চূড়ান্ত বিজয় তাদেরই হবে। কিন্তু নির্বাচনের দ্বিতীয় দিনেই তাদের মুখে দেখলাম হতাশার সুস্পষ্ট ছাপ। ঢাকায় অবস্থানকারী পাকিস্তানি সিনিয়র অফিসারদের মুখে দেখলাম আমি আতঙ্কের ছবি। শীঘ্রই জনগণ গণতন্ত্র ফিরে পাবে, এই আশায় আমরা বাঙালি অফিসাররা তখন আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠেছিলাম। চট্টগ্রামে আমরা ব্যস্ত ছিলাম অষ্টম ব্যাট্যালিয়নকে গড়ে তোলার কাজে। এটা ছিল রেজিমেন্টের তরুণতম ব্যাট্যালিয়ন। এটার ঘাঁটি ছিল ষোলশহর বাজারে। ‘৭১-এর এপ্রিল মাসে এই ব্যাট্যালিয়নকে পাকিস্তানের খারিয়ানে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। তাই অগ্রগামী দল হিসেবে আমাদের দু’শ জন জোয়ান আগেই পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিলো। বাকিরা ছিলো একেবারেই প্রাথমিক পর্যায়ের সৈনিক। আমাদের তখন যেসব অস্ত্রশস্ত্র দেওয়া হয়েছিল তার মধ্যে ছিল তিনশ’ পুরনো ৩০৩-রাইফেল, চারটা এল, এম, জি ও দু’টি তিন ইঞ্চি মর্টার। গোলাবারুদের পরিমাণও ছিল নগণ্য। আমাদের এন্টিট্যাংক বা ভারি মেশিনগান ছিল না।

ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে বাংলাদেশে যখন রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিস্ফোরণোন্মুখ হয়ে উঠছিল, তখন আমি একদিন খবর পেলাম তৃতীয় কমান্ডো ব্যাটালিয়নের সৈনিকরা চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন এলাকায় ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে বিহারিদের বাড়িতে বাস করতে শুরু করেছে। খবর নিয়ে আমি আরো জানলাম, কমান্ডোরা বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র আর গোলাবারুদ নিয়ে বিহারিদের বাড়িগুলোতে জমা করেছে এবং রাতের অন্ধকারে বিপুল সংখ্যায় তরুণ বিহারিদের সামরিক ট্রেনিং দিচ্ছে। এসব কিছু থেকে এরা যে ভয়াবহ রকমের অশুভ একটা কিছু করবে তার সুস্পষ্ট আভাস আমরা পেলাম।

এরপর এলো ১লা মার্চ। সারাদেশে শুরু হলো ব্যাপক অসহযোগ আন্দোলন। এর পরদিন দাঙ্গা হলো। বিহারিরা হামলা করেছিল এক শান্তিপূর্ণ মিছিলে। এর থেকেই ব্যাপক গোলযোগের সূচনা হলো। এই সময়ে আমার ব্যাট্যালিয়নের এনসিও-রা আমাকে জানালো, প্রতিদিন সন্ধ্যায় বিংশতিতম বালুচ রেজিমেন্টের জওয়ানরা বেসামরিক পোশাক পরে বেসামরিক ট্রাকে করে কোথায় যেন যায়। তারা ফিরে আসে আবার শেষ রাতের দিকে। আমি উৎসুক হলাম। লোক লাগালাম খবর নিতে। খবর নিয়ে জানলাম প্রতি রাতেই তারা যায় কতগুলো নির্দিষ্ট বাঙালি পাড়ায়। নির্বিচারে হত্যা করে সেখানে বাঙালিদের। এই সময় প্রতিদিনই ছুরিকাহত বাঙালিদের হাসপাতালে ভর্তি হতেও শোনা যায়।

এই সময়ে আমাদের কমান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল জানজুয়া আমার গতিবিধির ওপর লক্ষ রাখার জন্যেও লোক লাগায়। মাঝে মাঝেই তার লোকেরা গিয়ে আমার সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে শুরু করে। আমরা তখন আশংকা করছিলাম, আমাদের হয়তো নিরস্ত্র করা হবে। আমি আমার মনোভাব দমন করে কাজ করে যাই এবং তাদের উদ্যোগ ব্যর্থ করে দেয়ার সম্ভাব্য সব ব্যবস্থা গ্রহণ করি। এ সময় বাঙালি হত্যা ও বাঙালি দোকানপাটে অগ্নিসংযোগের ঘটনাক্রমে বাড়তেই থাকে।

আমাদের নিরস্ত্র করার চেষ্টা করা হলে আমি কি ব্যবস্থা গ্রহণ করবো কর্নেল (তখন মেজর) শওকতও আমার কাছে জানতে চান। ক্যাপ্টেন শমসের মবিন এবং মেজর খালেকুজ্জামান আমাকে জানান যে, স্বাধীনতার জন্য আমি যদি অস্ত্র তুলে নেই তাহলে তারাও দেশের মুক্তির জন্য প্রাণ দিতে কুণ্ঠাবোধ করবেন না। ক্যাপ্টেন ওলি আহমদ আমাদের মাঝে এসব খবর আদান-প্রদান করতেন। জেসিও এবং এনসিওরাও দলে দলে বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন স্থানে জমা হয়ে আমার কাছে আসতে থাকে। তারাও আমাকে জানায় যে কিছু একটা না করলে বাঙালি জাতি চিরদিনের জন্যে দাসে পরিণত হবে। আমি নীরবে তাদের কথা শুনতাম। কিন্তু আমি ঠিক করেছিলাম উপযুক্ত সময় এলেই আমি মুখ খুলবো। সম্ভবত ৪ঠা মার্চে আমি ক্যাপ্টেন ওলি আহমদকে ডেকে নেই। আমাদের ছিল সেটা প্রথম বৈঠক। আমি তাকে সোজাসুজি বললাম- ‘সশস্ত্র সংগ্রাম করার সময় দ্রুত এগিয়ে আসছে। আমাদের সব সময় সতর্ক থাকতে হবে।’ ক্যাপ্টেন আহমদও আমার সাথে একমত হন। আমরা পরিকল্পনা তৈরি করি এবং প্রতিদিনই আলোচনা বৈঠকে মিলিত হতে শুরু করি।

৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ঘোষণা আমাদের কাছে এক গ্রিন সিগন্যাল বলে মনে হলো। আমরা আমাদের পরিকল্পনাকে চূড়ান্ত রূপ দিলাম। কিন্তু তৃতীয় কোন ব্যক্তিকে তা জানালাম না। বাঙালি ও পাকিস্তানি সৈনিকদের মাঝেও উত্তেজনা ক্রমেই চরমে উঠছিল।

১৩ই মার্চ শুরু হলো মুজিব-ইয়াহিয়ার আলোচনা। আমরা সবাই ক্ষণিকের জন্য স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। আমরা আশা করলাম, পাকিস্তানি নেতারা যুক্তি মানবে এবং পরিস্থিতির উন্নতি হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে পাকিস্তানিদের সামরিক প্রস্তুতি হ্রাস না পেয়ে দিন দিনই বৃদ্ধি পেতে শুরু করলো। প্রতিদিনই পাকিস্তান থেকে সৈন্য আমদানি করা হলো। বিভিন্ন স্থানে জমা হতে থাকলো অস্ত্রশস্ত্র আর গোলাবারুদ। সিনিয়র পাকিস্তানি সামরিক অফিসাররা সন্দেহজনকভাবে বিভিন্ন গ্যারিসনে আসা-যাওয়া শুরু করলো। চট্টগ্রামে নৌ বাহিনীরও শক্তি বৃদ্ধি করা হলো। ১৭ই মার্চ স্টেডিয়ামে ইবিআরসি’র লেফটেন্যান্ট কর্নেল এম আর চৌধুরী, আমি, কাপ্টেন ওলি আহমদ ও মেজর আমিন চৌধুরী এক গোপন বৈঠকে মিলিত হলাম। এক চূড়ান্ত যুক্ত পরিকল্পনা গ্রহণ করলাম। লে. কর্নেল চৌধুরীকে অনুরোধ করলাম নেতৃত্ব দিতে।

দু’দিন পর ইপিআর-এর ক্যাপ্টেন (এখন মেজর) রফিক আমার বাসায় গেলেন এবং ইপিআর বাহিনীকে সঙ্গে নেয়ার প্রস্তাব দিলেন। আমরা ইপিআর বাহিনীকে আমাদের পরিকল্পনাভুক্ত করলাম। এর মধ্যে পাকিস্তানি বাহিনীও সামরিক তৎপরতা শুরু করার চূড়ান্ত প্রস্তুতি গ্রহণ করলা। ২১ মার্চ জেনারেল আবদুল হামিদ খান গেল চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে। চট্টগ্রামে সামরিক ব্যবস্তা গ্রহণের চূড়ান্ত পরিকল্পনা প্রণয়নই তার এই সফরের উদ্দেশ্য। সেদিন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট সেন্টারের ভোজসভায় জেনারেল হামিদ ২০তম বালুচ রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফাতমীকে বললো- ‘ফাতমী, সংক্ষেপে, ক্ষিপ্রগতিতে আর যত কম সম্ভব লোক ক্ষয় করে কাজ সারতে হবে।’ আমি এই কথাগুলো শুনেছিলাম।

২৪শে মার্চ ব্রিগেডিয়ার মজুমদার ঢাকা চলে এলেন। সন্ধ্যায় পাকিস্তানি বাহিনী শক্তি প্রয়োগে চট্টগ্রাম বন্দরে যাওয়ার পথ করে নিল। জাহাজ ‘সোয়াত’ থেকে অস্ত্র নামানোর জন্যেই ছিল তাদের এই অভিযান।
পথে জনতার সাথে ঘটলো ওদের কয়েক দফা সংঘর্ষ। এতে আহত হলো বিপুলসংখ্যক বাঙালি। সশস্ত্র সংগ্রাম যে কোন মুহূর্তে শুরু হতে পারে, এ আমরা ধরেই নিয়েছিলাম মানসিক দিক দিয়ে আমরা ছিলাম প্রস্তুত। পরদিন আমরা পথের ব্যারিকেড অপসারণের কাজে ব্যস্ত ছিলাম।

তারপর এলো সেই কালো রাত। ২৫শে ও ২৬শে মার্চের মধ্যবর্তী কালো রাত। রাত ১টায় আমার কমান্ডিং অফিসার আমাকে নির্দেশ দিলো নৌবাহিনীর ট্রাকে করে চট্টগ্রাম বন্দরে যেয়ে জেনারেল আনসারীর কাছে রিপোর্ট করতে। আমার সাথে নৌবাহিনীর (পাকিস্তানি) প্রহরী থাকবে তাও জানানো হলো। আমি ইচ্ছা করলে আমার সাথে তিনজন লোক নিয়ে যেতে পারি। তবে আমার সাথে আমারই ব্যাট্যালিয়নের একজন পাকিস্তানি অফিসারও থাকবে। অবশ্য কমান্ডিং অফিসারের মতে সে যাবে আমাকে গার্ড দিতে।
এ আদেশ পালন করা আমার পক্ষে ছিল অসম্ভব। আমি বন্দরে যাচ্ছি কিনা তা দেখার জন্যে একজন লোক ছিল। আর বন্দরে শবরীর মত প্রতীক্ষায় ছিল জেনারেল আনসারী। হয়তোবা আমাকে চিরদিনের মতোই স্বাগত জানাতে।

আমরা বন্দরের পথে বেরুলাম। আগ্রাবাদে আমাদের থামতে হলো। পথে ছিল ব্যারিকেড। এই সময়ে সেখানে এলো মেজর খালেকুজ্জামান চৌধুরী। ক্যাপ্টেন ওলি আহমদের কাছে থেকে এক বার্তা এসেছে। আমি রাস্তায় হাঁটছিলাম। খালেক আমাকে একটু দূরে নিয়ে গেল। কানে কানে বললো- ‘তারা ক্যান্টনমেন্ট ও শহরে সামরিক তৎপরতা শুরু করেছে। বহু বাঙালিকে ওরা হত্যা করেছে।
এটা ছিল একটা সিদ্ধান্ত গ্রহণের চূড়ান্ত সময়। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই আমি বললাম- ‘আমরা বিদ্রোহ করলাম। তুমি ষোলশহর বাজারে যাও। পাকিস্তানি অফিসারদের গ্রেফতার করো। ওলি আহমদকে বলো ব্যাট্যালিয়ন তৈরি রাখতে, আমি আসছি।’

আমি নৌবাহিনীর ট্রাকের কাছে ফিরে এলাম। পাকিস্তানি অফিসার, নৌবাহিনীর চিফ পেটি অফিসার ও ড্রাইভারকে জানালাম যে আমাদের আর বন্দরে যাওয়ার দারকার নেই। এতে তাদের মনে কোন প্রতিক্রিয়া হলো না দেখে আমি পাঞ্জাবি ড্রাইভারকে ট্রাক ঘুরাতে বললাম। ভাগ্য ভালো, সে আমার আদেশ মানলো। আমরা আবার ফিরে চললাম। ষোলশহর বাজারে পৌঁছেই আমি গাড়ি থেকে লাফিয়ে নেমে একটা রাইফেল তুলে নিলাম। পাকিস্তানি অফিসারটির দিকে তাক করে তাকেই বললাম, ‘হাত তুলো। আমি তোমাকে গ্রেফতার করলাম।’ সে আমার কথা মানলো। নৌবাহিনীর লোকেরা এতে বিভ্রান্ত হয়ে পড়লো। পর মুহূর্তেই আমি নৌবাহিনীর অফিসারের দিকে রাইফেল তাক করলাম। তারা ছিল আটজন। সবাই আমার নির্দেশ মানলো এবং অস্ত্র ফেলে দিল।
আমি কমান্ডিং অফিসারের জিপ নিয়ে তার বাসার দিকে রওয়ানা দিলাম। তার বাসায় পৌঁছে হাত রাখলাম কলিং বেলে। কমান্ডিং অফিসার পাজামা পরেই বেরিয়ে এলো। খুলে দিল দরজা। ক্ষিপ্রগতিতে আমি ঘরে ঢুকে পড়লাম এবং গলা শুদ্ধ তার কলার টেনে ধরলাম।

দ্রুতগতিতে আবার দরজা খুলে কর্নেলকে আমি বাইরে টেনে আনলাম। বললাম- ‘বন্দরে পাঠিয়ে আমাকে মারতে চেয়েছিলে? এই আমি তোমাকে গ্রেফতার করলাম। এখন লক্ষ্মী সোনার মতো আমার সঙ্গে এসো।’
সে আমার কথা মানলো। আমি তাকে ব্যাট্যালিয়নে নিয়ে এলাম। অফিসারদের মেসে যাওয়ার পথে আমি কর্নেল শওকতকে (তখন মেজর) ডাকলাম। জানালাম- ‘আমরা বিদ্রোহ করেছি।’ শওকত আমার হাতে হাত মিলালো।

ব্যাট্যালিয়নে ফিরে দেখলাম, সমস্ত পাকিস্তানি অফিসারকে বন্দি করে একটা ঘরে রাখা হয়েছে। আমি অফিসে গেলাম। চেষ্টা করলাম লেফটেন্যান্ট কর্নেল এম আর চৌধুরীর সাথে আর মেজর রফিকের সাথে যোগাযোগ করতে। কিন্তু পারলাম না। সব চেষ্টা ব্যর্থ হলো। তারপর রিং করলাম বেসামরিক বিভাগের টেলিফোন অপারেটরকে। তাকে অনুরোধ জানালাম- ডেপুটি কমিশনার, পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট, কমিশনার, ডিআইজি ও আওয়ামী লীগ নেতাদের জানাতে যে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অষ্টম ব্যাট্যালিয়ন বিদ্রোহ করেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করবে তারা।
এঁদের সবার সাথেই আমি টেলিফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু কাউকে পাইনি। তাই টেলিফোন অপারেটরের মাধ্যমেই আমি তাদের খবর দিতে চেয়েছিলাম। অপারেটর সানন্দে আমার অনুরোধ রক্ষা করতে রাজি হলো।

সময় ছিল অতি মূল্যবান। আমি ব্যাট্যালিয়ানের অফিসার, জেসিও আর জোয়ানদের ডাকলাম। তাদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলাম। তারা সবই জানতো। আমি সংক্ষেপে সব বললাম এবং তাদের নির্দেশ দিলাম সশস্ত্র সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে। তারা সর্বসম্মতিক্রমে হৃষ্টচিত্তে এ আদেশ মেনে নিলো। আমি তাদের একটা সামরিক পরিকল্পনা দিলাম।
তখন রাত ২টা বেজে ১৫ মিনিট। ২৬শে মার্চ। ১৯৭১ সাল। রক্তের আখরে বাঙালির হৃদয়ে লেখা একটি দিন। বাংলাদেশের জনগণ চিরদিন স্মরণ রাখবে এই দিনটিকে। স্মরণ রাখতে ভালোবাসবে। এই দিনটিকে তারা কোনো দিন ভুলবে না। কো-ন-দি-ন না।


বিভাগ : বিশেষ সংখ্যা


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

জাগ্রত ভয় মনের মাঝে
আর কেউ বেঁচে নেই
সময়
মার্চের পদাবলি
অপসৃয়মাণ রেলগাড়ি
আরও
X

আরও পড়ুন

ঈদ মিছিলে মূর্তি ঈদের মূল স্পিরিটের সঙ্গে সাংঘর্ষিক: হেফাজত

ঈদ মিছিলে মূর্তি ঈদের মূল স্পিরিটের সঙ্গে সাংঘর্ষিক: হেফাজত

ফার্নান্দেসের রিয়ালে যাওয়ার ব্যাপারে যা বললেন তার কোচ

ফার্নান্দেসের রিয়ালে যাওয়ার ব্যাপারে যা বললেন তার কোচ

রোনালদোকে ছাড়িয়ে যেতে পারেন এমবাপে: আনচেলত্তি

রোনালদোকে ছাড়িয়ে যেতে পারেন এমবাপে: আনচেলত্তি

উইন্ডিজের নেতৃত্ব ছাড়লেন ব্র্যাথওয়েট

উইন্ডিজের নেতৃত্ব ছাড়লেন ব্র্যাথওয়েট

ঈদের আনন্দ ৫ আগস্ট শুরু হয়েছে : শিবির সভাপতি

ঈদের আনন্দ ৫ আগস্ট শুরু হয়েছে : শিবির সভাপতি

আমাকে যুদ্ধাপরাধের মামলায় ফাঁসানোর ভয় দেখানো হয়েছিল: জামায়াত আমির

আমাকে যুদ্ধাপরাধের মামলায় ফাঁসানোর ভয় দেখানো হয়েছিল: জামায়াত আমির

বাকিটা জীবন বুড়িচং-ব্রাহ্মণপাড়াবাসীর পাশে থাকতে চাই : ব্যারিস্টার আব্দুল্লাহ আল মামুন

বাকিটা জীবন বুড়িচং-ব্রাহ্মণপাড়াবাসীর পাশে থাকতে চাই : ব্যারিস্টার আব্দুল্লাহ আল মামুন

পশ্চিমবঙ্গ-গুজরাটে আতশবাজি কারখানায় বিস্ফোরণ, নিহত ২১

পশ্চিমবঙ্গ-গুজরাটে আতশবাজি কারখানায় বিস্ফোরণ, নিহত ২১

আমাদের চেতনার প্রাণপুরুষ আল্লামা ফুলতলী (র.)

আমাদের চেতনার প্রাণপুরুষ আল্লামা ফুলতলী (র.)

লক্ষ্মীপুরে অস্ত্রধারীদের গুলিতে শিশু গুলিবিদ্ধ

লক্ষ্মীপুরে অস্ত্রধারীদের গুলিতে শিশু গুলিবিদ্ধ

রামুতে গুলিতে নিহতের ঘটনায় ২ টি দেশীয় তৈরি অস্ত্র উদ্ধার আটক ২

রামুতে গুলিতে নিহতের ঘটনায় ২ টি দেশীয় তৈরি অস্ত্র উদ্ধার আটক ২

সিলেটে ৬ তলা ভবন থেকে লাফ দিয়ে এক গৃহবধুর আত্মহত্যা

সিলেটে ৬ তলা ভবন থেকে লাফ দিয়ে এক গৃহবধুর আত্মহত্যা

ঈদ পরবর্তী শুভেচ্ছা বিনিময়ে মোরেলগঞ্জের পথে প্রান্তরে বিএনপি নেতা কাজী শিপন

ঈদ পরবর্তী শুভেচ্ছা বিনিময়ে মোরেলগঞ্জের পথে প্রান্তরে বিএনপি নেতা কাজী শিপন

ঈদে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত পর্যটকে মুখরিত

ঈদে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত পর্যটকে মুখরিত

কুমিল্লায় বিদ্যুতের খুঁটিতে ধাক্কা বাসের, নিহত ৩

কুমিল্লায় বিদ্যুতের খুঁটিতে ধাক্কা বাসের, নিহত ৩

দাউদকান্দিতে এক যুবকের লাশ উদ্ধার

দাউদকান্দিতে এক যুবকের লাশ উদ্ধার

ঈদের পাঞ্জাবি নিয়ে বিপাকে বাবর, ডিজাইনারকে ছাঁটাই করতে বললেন ভক্তরা

ঈদের পাঞ্জাবি নিয়ে বিপাকে বাবর, ডিজাইনারকে ছাঁটাই করতে বললেন ভক্তরা

লন্ডনে ঈদের জামাতে প্রকাশ্যে হাছান মাহমুদ

লন্ডনে ঈদের জামাতে প্রকাশ্যে হাছান মাহমুদ

সুপ্রিম কোর্টে মুখ পুড়ল যোগী আদিত্যনাথের

সুপ্রিম কোর্টে মুখ পুড়ল যোগী আদিত্যনাথের

মির্জাপুরে প্রশাসনের হস্তক্ষেপে বিরোধপূর্ণ দুই ঈদগাহসহ আড়াই শতাধিক মাঠে উৎসবমুখর পরিবেশে ঈদের জামাত

মির্জাপুরে প্রশাসনের হস্তক্ষেপে বিরোধপূর্ণ দুই ঈদগাহসহ আড়াই শতাধিক মাঠে উৎসবমুখর পরিবেশে ঈদের জামাত