নিশিতে পাওয়া সায়লা

Daily Inqilab ইউসুফ শরীফ

৩০ মার্চ ২০২৫, ১২:৪৭ এএম | আপডেট: ৩০ মার্চ ২০২৫, ১২:৪৭ এএম

রাতের ডিউটি থাকলে একটু গোছগাছ করতেই হয়। গোছগাছ মানে এক বোতল পানি-হালকা নাশতা-শীতকালে ক্রীম আর সবসময় অলিভ ওয়েলÑ চমৎকার ছোট কৌটায় আর একটা পাতলা চাদর।

অনেকদিন ধরে রাত জেগে তার কাজ করা। ডিউটিতে কলিগরা বারোটার পর কেউ জেগে থাকে নাÑ সে থাকে। জেগে থাকতে তার ভাল লাগেÑ রাতের এই সময়টুকু নৈঃশব্দের মখমলে ঢাকাÑ তার উপর দিয়ে নিমিষে সে নিজের পরাজিত যৌবনের কাছে ফিরে যেতে পারে এবং ফিরে যায়ও সেই বর্ষণমুখর নির্জন নির্মল ভোরেÑ সেই জটলাগা চারটি আম গাছÑ তার মাঝখানে বেঞ্চির মত জায়গাÑ মধুসিক্ত ফিসফিস গুঞ্জণÑ যার চেয়ে সুন্দর আর কোন শব্দ কোনদিন শুনেনিÑ এরকম শব্দ হতেও পারে নাÑ আর সেই অসম্ভব পুলকানন্দ...

তখন এই পাতলা সাদা চাদরটা সারা গায়ে নিবিড় করে জড়িয়ে রাখে যাতে এক চিমটি সুখস্মৃতিও গড়িয়ে পড়তে না পারে। কখনও চোখ লেগে এলে চকিতে চেতন হয়ে সে দেখেÑ কাফন পড়ে উবু হয়ে মজুমদার বাড়ির গোল মুখের অসম্ভব লাবণ্যবতী মেয়েটি পুরান দিঘীর পানিতে মুখ দেখছে। তবু গত কিছুদিন ধরে যন্ত্রণাদায়ক সেই ভাললাগা তাকে গ্রাস করে আছে। আসঙ্গলিপ্সার সেই তৃপ্তি তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করে।
প্রতি নাইট ডিউটিতে সায়লা চাদরটা নেয় এবং মধ্যরাত পার হবার পর গায়ে জড়ায়। সারা শহর তখন ঘুমের অতলেÑ বড় রাস্তায়-গলিতে-ফাঁকা জায়গায় হু হু করে বাতাস বয়। সারাদিনের বাতাসের মত নয়Ñ অন্য রকম। বহুÑ বহুকাল আগের এই বাতাস দিনভর কোথায় কার আঁচলে গিঁট দেয়া থাকেÑ কে জানে! সেই বাতাস তার বুকের ভেতর সরাসরি ঢুকে পড়ে। কোন কোন রাতে হঠাৎ কোন সিরিয়াস রোগী কঁকিয়ে ওঠে। তখন সেই আর্ত ধ্বনিপুঞ্জ ক্রনিক ব্যথার মত তার মগজে প্রবাহিত হতে থাকে।

ধীরে ধীরে আরেক নিশীথ উন্মোচিত হয়Ñ সেই নির্জন নিশীথে সায়লা বেদনাভারে আক্রান্ত নিজেকেই অবিকল দেখে ফেলেছিল। নিজে নিজেকে দেখে ফেলার দুর্লভ অভিজ্ঞতার বেদনা সে বহন করছে। সায়লা কি হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে? কোন কোন বেদনা কি মানুষের জন্য হয়ে ওঠে উপভোগ্যও?
নাইট ডিউটির দিন সন্ধ্যার পর বেশ সময় নিয়ে চলে সায়লার এই গোছগাছ। দেখে কলিগরা ঠাট্টা করেÑ তাই বলে এই একান্ত গোপন তো সে কারও কাছে উন্মোচিত করতে পারে না।
আজকেও ললিতা বলল, কি দিদিÑ বাসর রাতের সাজ নিচ্ছ?
সায়লা হাসে প্রাণ খুলেÑ তার মনের ছোট কুঠুরিতে ধামাচাপা দেয়া এই একটি শব্দ এরা কেউ না কেউ জোরে নাড়িয়ে দেয় প্রতি নাইট ডিউটির আগে। আর সায়লা হাসে প্রাণভরেÑ তার দমবন্ধ ভেতরটাও হাসে। হাসতে হাসতে ভেঙেচুরে যায় আজকের সায়লার ভেতর সেদিনের সায়লা।

সায়লা হাসতে হাসতেই বলল, সেবিকাদের বাসর রাত তো হসপিটাল ওয়ার্ডের রাত। জানিস মেয়ে মধ্যযুগে ইউরোপে কোথাও কোথাও সেবিকাদের বিয়ে- ঘরসংসার পর্যন্ত হত নাÑ হলে সে আর সেবিকা থাকতে পারত নাÑ
ললিতা বলল, দিদি সেবিকাবৃত্তি তোমার হল সাধনা আর আমাদের হল চাকরিÑ আমরা এত কিছু জানব ক্যামনে ?
সায়লা বলল, জানে নাওÑ জানা ভাল। আর জানলেই হবে না বুঝতেও হবে। তাহলে মনে শান্তি পাবেÑ মানসিক শান্তি অনেক বড় কথা।
তাহেরা আগের কথায় ফিরে যায়, সায়লা আপার বাসর রাত বলে কথাÑ ওটা হবে একটা ইতিহাসÑ
সায়লা হাসি থামিয়ে বলল, ঠিক বলেছিস তাহিÑ সে এক ইতিহাসÑ
ললিতা তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে, দিদি ইতিহাসটা বল না কেনÑ কতদিন তো বললে শোনাবেÑ একটু চেপেচুপে সংক্ষিপ্ত করেই শোনাও নাÑ
সায়লা হেসে ওঠল, ললিতা দেবী চেপেচুপে কাটছাঁট করে ইতিহাস বলা যায় না। ইতিহাস হল ধারাবাহিকতার বিষয়Ñ বাবরের ছেলে হুমায়ূনÑ হুমায়ূনের ছেলে আকবরÑ আকবরের ছেলে জাহাঙ্গীর...
ললিতা কথা শেষ করতে দিল না, কথায় তোমার সাথে পারবে কে!
তাহেরা বলল, সায়লা আপা একটা কথা বলিÑ
সায়লা বলল, বাহ এতক্ষণ কি অনুমতি নিয়ে বলছিলি?
তাহেরা আমতা আমতা করে, না মানে তোমার মত মানুষেরও বেদনা আছেÑ বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় আপাÑ
সায়লা হেসে ওঠে, বলে কি পাগল মেয়েÑ কার না বেদনা আছেÑ
হঠাৎ থেমে টেবিলের উপর থেকে ব্যাগটা তুলে নিয়ে বলল, যাইরেÑ ডিউটির সময় হয়ে এসেছে।
ললিতা বলল, আচ্ছা দিদিÑ এই যে আমাদের নতুন হসপিটাল ডিরেক্টর নিউরো সার্জারির প্রফেসরÑ শুনেছি সরাসরি আমেরিকা থেকে এসেছেন। বরাবর দেখছিÑ রাউন্ডে আসেন রাতে। আমেরিকায় কি প্রফেসররা রাতেই রাউন্ডে আসেন?
তাহেরা বলল, তুই এ নিয়ে মোটেই ভাববি নাÑ সায়লা আপার নার্ভ খুব শক্ত। তা না হলে এত বছর নিউরো সার্জারি ওয়ার্ডেÑ
ওদের হাসি থামার আগেই সায়লা পথে নামে।
দুই.
সায়লা ধীরে-সুস্থে ডিউটি বুঝে নিয়ে পেশেন্টদের চার্ট দেখে-টেখে মাত্র টুলটায় বসেছে। আজ ছিল নিউরো সার্জারির ওপারেশন ডেটÑ সায়লা মর্নিং ডিউটি করেছে। ওটিতে সার্জনদের অপরিহার্য হেল্পিংহ্যান্ড সায়লা। একজন জটিল পেশেন্ট আসবে এজন্য তাকে আবার রাতের ডিউটিতে আসতে হয়েছে। এরকম হয় মাঝেমধ্যেই। জটিল পেশেন্ট এটেন্ড করায় তার জুড়ি নেই। ডিউটির চাপে ভেতরে টেনশন থাকলেও তার অস্থিরতা থাকে না।
বাইরে তাকিয়ে ভদ্রলোককে দেখল সিস্টার্স রুমের সামনে এলোমেলা হাঁটছে। চোখে উদাস দৃষ্টিÑ ভেতরে আসন্ন শূন্যতার ছায়াপাত।
তার মাÑ বয়স ছিয়াত্তর। ব্রেন টিউমারÑ মাথার সামনের দিকে দু’টা টিউমার। অপারেশনটা হয়েই গেল শেষ পর্যন্ত। আট ঘন্টার অপারেশনÑ বিশাল আয়োজনÑ নিউরো সার্জারির ফাইনাল ইয়ারের ছাত্রছাত্রীদের সতর্ক মনোনিবেশÑ প্রফেসরের লেকচারÑ অসহ্য লেগেছে সায়লার।
কালই পোস্ট-অপারেটিভ ওয়ার্ড থেকে তিন নম্বর বেডে দেয়া হয়েছে। ওটি-তে যাবার আগেও এই বেডেই ছিলেন। সাতদিন পোস্ট-অপারেটিভ ওয়ার্ডে টানা ঘুম। এখনও ঘুমের মধ্যেই আছেন। গভীর নৈঃশব্দময় ঘুমÑ যেখানে মখমলের মত অন্ধকার আবেশ চৈতন্যকে নিঃশব্দে ধীরে-ধীরে নিঃশেষ করে দিতে থাকে। বলা হয় কোমাÑ আরেকটু এগোলেই ক্লিনিক্যালি ডেড।
ভদ্রলোক গলা খাকারি দিল। সায়লা বুঝল কিছু বলতে চান।
সে ডাকল, আসুন।
ভদ্রলোক ঢুকে করুণ কণ্ঠে বলল, সিস্টারÑ
সায়লা তার মুখে তাকাতে পারল নাÑ কিছুতেই পারল না। গত ক’দিন ধরেই পারছে নাÑ মনে হয় আর কোনদিন পারবেও না। মানুষ কখন মানুষের মুখের দিকে তাকাতে পারে না? এটা চট করে বোঝার মত অভিজ্ঞতা সায়লার আছে। শুধু পড়াশোনাটাই করেনিÑ করতে পারেনি। এসএসসি-তে স্টার-মার্ক পেয়েছিলÑ এইচএসসি- তে চার বিষয়ে লেটার। এই রেজাল্ট নিয়েও তাকে নার্সিং ইন্সটিটিউটে ভর্তি হতে হয়েছিল। কোন উপায় ছিল না। এটাই মনে করেছে এত বছর। সত্যিই কী কোনই উপায় ছিল না?
তার মুখও কী বেদনায় নীল হয়ে ওঠল? এবার সে মুখ তুলে তাকাল। ভদ্রলোকের চোখে নিঃশব্দ কান্না থর বেধে আছে।
ভদ্রলোক আবারও বলল, সিস্টারÑ
আর কিছু বলতে পারল না। আর কিইবা বলার আছে জীবন্মৃত মাকে নিয়ে অসহায় এক পুত্রের। অপারেশনের দু’দিন পর সায়লার সঙ্গে ঠিক কথা বলা নয়Ñ হাঁটছিল। ডিউটি শেষে ভোরে সায়লা হোস্টেলে ফিরছিলÑ প্রথম সায়লা বুঝতে পারেনি যে আসছে।
সায়লা ঘাড় ফিরিয়ে বলল, কিছু বলবেন?
ভদ্রলোক বলল, সিস্টার আমি কি ভুল করলাম?
সায়লা বলল, না আপনি ভুল করেননি। তবে হয়ত ভুল করা হয়েছে।
অপারেশনের আগের দিনও ওয়ার্ডের বরান্দায় ভদ্রলোক কথা বলছিল তার সঙ্গে।
বলেছিল, সিস্টার আপনার কি মনে হয় অপারেশন করাটা ঠিক হবে ?
সায়লা বলেছিল, আমি একজন নার্সÑ পেশেন্টের সেবিকাÑ ডক্টরের ব্যক্তিগত সাহায্যকারিণী মাত্র। পেশেন্টের ট্রিটমেন্টের ব্যাপারে আমার-আপনার মধ্যে বিশেষ কোন তফাৎ নেই। তবে আপনার মা’র ব্রেনে দু’টা টিউমারÑ এরকম বেশি দেখা যায় না। এটা নিউরো সার্জারির ছাত্রছাত্রীদের জন্য যথেষ্ট শিক্ষণীয়Ñ
ভদ্রলোক বলেছিল, কিন্তু আমার মাÑ
সায়লা বলেছিল, আপনার মা’র বয়স ছিয়াত্তরÑ এই বয়সে ব্রেন অপারেশন কী খুব সহজ বিষয় হওয়ার কথাÑ
ভদ্রলোক অসহায় ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে নাড়তে এলোমেলো পা ফেলে এগিয়ে গিয়েছিল। দু’দিন পর ওই হোস্টেলের পথেই কথা। গত ক’রাত আসেনিÑ তার স্ত্রী এসেছে। নেত্রকোণার আমলাপাড়ায় বাসাÑ ওখানেই বড় হয়েছে মহিলা। সায়লা কখনও মনে করতে চায় না নেত্রকোণাকেÑ আমলাপাড়াকে...। প্রথমদিকে এক রাতে তার শাশুড়ি খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। এরকম ক্ষেত্রে সায়লাকে অভিজ্ঞতা এবং সাধারণ বুদ্ধি খাটাতে হয়Ñ সেদিনও করেছিল। সাড়ে বারোটার দিকে রুমে ফিরে মাত্র বসেছে।
মহিলা এসে বলল, আপনার কাছে আমরা কৃতজ্ঞÑ আপনি না থাকলে কী যে হত!
সায়লা হাসল, কিছুই হত নাÑ কেউ না কেউ এটেন্ড করতÑ হসপিটালে পেশেন্টকে এটেন্ড করা ডাক্তার-সিস্টারদের স্বাভাবিক দায়িত্বÑ
মহিলা মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, সিস্টার আপনার মত করে কেউ কী বলে! আপনাকে খুব ভাল লাগছেÑ আপন মনে হচ্ছেÑ আমি একটু বসি আপনার এখানেÑ
সায়লা হাসল, অবশ্যইÑ বসুন।
মহিলা বলল, জানেন গত একটা মাসে মনে হচ্ছে বহু সময় পার হয়ে এসেছি। মানুষের জীবনে কখনও কখনও অতি অল্প সময়ে অনেক ঘটনা ঘটে যায়Ñ তাই না।

সায়লা কি বলবেÑ কতজনকে সান্তনা দিতে হয়Ñ সেই একই কথা আর বলতে ইচ্ছা করে নাÑ অনেকটা পরিহাসের মত শোনায়। চুপ করে থাকাটাই এখন ভাল মনে হয়Ñ অন্তত নিজের কাছে সৎ থাকা যায়। মহিলাও স্তব্ধ হয়ে আছে।
অনেকক্ষণ পর অস্পষ্ট জড়ানো কণ্ঠে বলল, জানেন খুবই অসহায় লাগছেÑ মনে হচ্ছে আমাদের পৃথিবীর চারপাশটা মুছে গিয়ে সাদা দেয়ালের মত হয়ে যাচ্ছেÑ যেখানে কিছু নেইÑ কিচ্ছুই নেইÑ
সায়লা বলল, আপনি খুব চমৎকার করে বললেন।
মহিলা বলন, জানেন এরকম সময়ে অনেক কথা মনে পড়েÑ অগোছালো-মাথাম-ুহীন কথাÑ আমার শাশুড়ি সুন্দর করে গল্প বলতেন। পড়াশোনার অভ্যাস ছিলÑ বললে ঠিক বুঝানো যাবে নাÑ খুব সিরিয়াস পাঠক ছিলেন যা সাহিত্যের ছাত্রদের কাছেই আশা করা হয়Ñ অনেকের থাকে না। সাহিত্যের ছাত্র হিসেবে তার কাছে নিজেকে সর্ষের মত মনে হতÑ বাংলা সাহিত্যে অনার্স শেষ করার পর আমার বিয়ে হয়। কয়েক মাসের মধ্যেই বুঝলামÑ আরও আগে এই মানুষটির সাহচর্য পেলে সাহিত্য-পাঠ অনেক সহজ হত। তিনি বলতেন, মানুষের জীবনে সব ঘটনা কেন মনে থাকে নাÑ বলতে পারÑ জবাবও তিনিই দিতেন। বলতেন, সব ঘটনা মানুষের জীবনে বিচলন সৃষ্টি করতে পারে নাÑ এজন্য মনে থাকে না। তিনি বলতেন, বোধের জাগরণ না ঘটলে পড়াশোনা-পান্ডিত্ব কোনটাই জীবনে বা জগৎ-সংসারে কাজে লাগে নাÑ
সায়লা জানে এরকম প্রান্তিক সময়ে স্মৃতিকাতরতায় নিমজ্জিত হয় মানুষ। তখন এমন কারও কাছে তার মহার্ঘ কথাগুলো বলতে চায়Ñ যে ধৈর্য ও সহানুভূতির সঙ্গে শুনবে। মধ্যরাতে এই হাসপাতালে রোগির এটেডেন্ট যারা আছেÑ তারা কেউ কারও কথায় সঙ্গত কারণেই পূর্ণ মনোযোগ দিতে পারে না।

মহিলা আপন মনেই বলছে, আমি তখন খুব ছোটÑ একটা ঘটনা ঘটেছিলÑ আমলাপাড়ায় যে বাসাটায় আমরা ভাড়া থাকতাম তার ডানপাশে ছিল মজুমদারদের বাড়ি। আমার সবচে’ বড় বোনের বান্ধবী ছিল শিউলিদিÑ আবছা আবছা মনে আছেÑ শিউলিদির ছিল গোল মুখ অসম্ভব লাবণ্যময়ীÑ ঠিক প্রতিমার মতÑ আমাদের বামপাশে ছিল খাঁ’দের বাড়িÑ ও বাড়ির বড় ছেলে কী যেন নাম ছিল ভুলে গেছিÑ ময়মনসিংহ মেডিক্যালে পড়তÑ তখন না জেনেশুনেই ভারী অপছন্দ করতামÑ পরে জেনেছি ওই ছেলেটা শিউলিদিকে ঠকিয়েছিলÑ একদিন সকালবেলা উঠে শুনলাম শিউলিদি নেইÑ ওই একদিনেই মজুমদার বাড়িটা রক্তশূন্য হয়ে পড়লÑ ক’মাস পর ওরা এক এক করে সবাই চলে গেল। এই চলে যাওয়াটা এখনও আমাকে কষ্ট দেয়Ñ শিউলিদির অস্পষ্ট মুখটা আজও আমি খুঁজে ফিরিÑ হঠাৎ হঠাৎ কাউকে দেখে মনে হয়, এই বুঝিÑ পরক্ষণেই আর মিলাতে পারি নাÑ কি করে পারব শিউলিদির অবয়বটা আমার কাছে অনেকটা যে ঘষা কাঁচের মত। টের পাই শিউলিদি হারিয়েই গেছেÑ তাকে আরÑ

সায়লা শুরুতে মহিলাকে থামিয়ে দিতে চেয়েছিলÑ পারেনি। কি বলে থামাবেÑ কেন থামাবে? যুক্তিগ্রাহ্য কোন কারণ তো নেই।
মহিলা উঠে যাবার পর সায়লা টয়লেটে গেল। বেসিনের উপর আয়নায় সে তার মুখটাকে লম্বা হয়ে ঝুলে পড়তে দেখল। ছোটবেলায় অনেকে বলত তার মুখ বাটার মত গোল। গোল মুখের মেয়েরা শুধু লাবণ্যবতী নয় সৌভাগ্যবতীও বটেÑ কে বলেছিল আজ আর মনে নেই। কেউ একজন বলেছিলেন আর সে ছোটবেলায় আরও অনেক কিছুর মত এ কথাটাও বিশ্বাস করতে শুরু করে। সহজে বিশ্বাস করাটা তাকে তখন পেয়ে বসে। রূপে-মেধায় ধারাল খাঁ বাড়ির মিজানকেও বিশ্বাস করেÑ এই বিশ্বাস তার জীবনের শিকড় কেটে দিল।

তিন.
জুনিয়র সিস্টার রেহানা এসে বলল, সায়লা আপা ওই পেশেন্ট এসে গেছে। জলদি চলÑ সবাই ওটিতে দৌঁড়াচ্ছেÑ
ঘড়িতে রাত দু’টাÑ এতে তার কিছু আসে যায় না। সে মনে করে রাতেই মাথা বেশি ঠান্ডা রেখে কাজ করা যায়। আগেই ওটি রেডি করা ছিল। জটিল অপারেশন চলল দু’ঘন্টার ওপর। এধরনের অপারেশনের শুরুতেই এখন সায়লা বুঝতে পারে কি হতে যাচ্ছে। এ কেসটাও সে বুঝে ফেলেছেÑ কোন আশা নেই। নতুন আসা সার্জারির প্রফেসর নিজে ছুরি-কাঁচি ধরল নাÑ ওটি টেবিলে অস্থির দৃষ্টি নিবদ্ধ করে এক কোণে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকল। সার্জনদের কারও চোখেই সাফল্যের ইঙ্গিতময় কোন স্বস্তি ফুটে ওঠেনি।

পেশেন্ট আইসিইউ-তে নিয়ে যাওয়ার পরই সায়লা জানতে পারল পেশেন্ট প্রফেসরেরই স্ত্রী। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রোডে এক্সিডেন্ট হয়েছেÑ গাড়ি চালাচ্ছিল নিজে। সায়লা মন খারাপ অবস্থায় ওটি থেকে বেরিয়েছে। সব সময় যা হয়Ñ তাই হলÑ কোন হেরফের হল না মন খারাপের। রোগি তার কাছে রোগিইÑ আর কোন পরিচয় নেই। কষ্ট তার প্রফেসর নয়Ñ রোগিণীর জন্য। প্রফেসরের মধ্যে মেধাবী মুখচোরা নেত্রকোণার সেই ছেলেটি এখন আর কোথাও নেই। সে অনেক বড় ডাক্তার এখন আর সায়লা নিছক এক সিনিয়র নার্স।
কয়েক বছর আগে বিখ্যাত এক ব্যক্তি পেশেন্ট হয়ে এসেছিলেন। ছোট একটা সার্জারির পর এক নম্বর কেবিনে ছিলেন দিন পনের। সায়লা তখন কেবিন ব্লকে। নিজে থেকে সায়লার প্রমোশনের ব্যবস্থা করে গিয়েছিলেন। হাসপাতালে সবাই তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছে। সায়লা একদম নিশ্চুপ থেকেছে। এমনকি চাকরিটাও ছেড়ে দিতে চেয়েছিল। চাকরির ক্ষেত্রে তার কোন উচ্চাশা কখনই ছিল না। তবু প্রমোশন হল আজকাল যেভাবে হচ্ছে অনেকটা সেভাবেই। এই প্রমোশনের ব্যাপারে সে কিছু না জানলেও সে যা জানে তা আর কেউ জানে না। ওই বিখ্যাত ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের সঙ্গে মোটেই মানানসই নয়Ñ এমন টুকটাক আচরণও হজম করতে হয়েছিল সায়লাকে।

একেবারে ভোর রাতের দিকে প্রফেসর তাকে ডাকল নিজে কক্ষ থেকে বেরিয়ে এসে। গত এক মাসে সায়লাকে দেখেছে বেশ কয়েকবারÑ কিন্তু কোন কথা বলেনি। প্রথম ক’দিন সায়লা ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি, এই সেই লোক কি না। তারপর একদিন শার্টের দুই ভাঁজকরা হাতায় চোখ পড়েÑ আর কোন সন্দেহ থাকল নাÑ
কক্ষে ঢুকে চুপচাপ বসে সায়লাকে বলল, বসÑ
সায়লা দাঁড়িয়ে থাকল। বেদনাহত মুষড়েপড়া মানুষজনকে সামলানোর অভিজ্ঞতা তার ভালই আছে। কিন্তু সামনে বসে থাকা এই বিখ্যাত লোকটি নিজেই তো বড় ডাক্তারÑ তাকে তার কিছুই বলার নেই।
প্রফেসর আবার বলল, বসÑ

সায়লা শুনতেই পেল না। এই জনমে কখনও আবার তার সঙ্গে দেখা হবেÑ সে তাকে ডেকে আনবেÑ বসতে বলবেÑ এসব দৃশ্য কখনও স্বপ্নেও দেখেনি। সেই বর্ষণসিক্ত নির্মল ভোরÑ সেই জটলাগা আমগাছÑ সেই মধুসিক্ত কণ্ঠ ছাপিয়ে বারবার নিষিদ্ধ মাতৃত্বের স্বাদ জেগে ওঠলেও কখনও ভাবেনি আবার তারা মুখোমুখি হবে। কয়েকটি মাস অপেক্ষার পর কারও প্রতি তার কোন অভিযোগ থাকল নাÑ নিজের কাছেÑ যৌবনের কাছে পরাজিত এক নারীর জীবন যে তারÑ তার মেয়েটি জানে নাÑ কে তার মাÑ কে তার বাবাÑ সায়লার পরিচিতজনেরা জানেÑ এক অরফানেজ চাইল্ড তার সহায়তায় বেড়ে ওঠছেÑ প্রতি মাসে সাত তারিখে নিজে যায়Ñ টাকাটা দিয়ে অনেক দূর থেকে দেখে আসেÑ তার কলজেটা ফালি ফালি করে চিরে রেখে সবাই চলে গেছেÑ চুপি চুপি দেখে সায়লা নিজের কলজের এই দৃশ্যÑ সমাজের ভয়ে এখনও তার ভেতরটা কী রকম যে কুঁজো হয়ে আছেÑ হাসপাতালে ডিউটিতে অসহায় মাতৃত্বের নিঃশব্দ অঝোর কান্নায় কাটে সায়লার বিনিন্দ্র সব রাতÑ যে জীবনের কোন মানে হয় নাÑ সে জীবনই টেনে নিয়ে যেতে হচ্ছেÑ

আজ সতের বছরÑ নিশিতে পাওয়া এক জীবন তার। দিনের ডিউটিতে তার লজ্জা-সংকোচ নাকি ভয়Ñ জানে না। নামবদলÑ এফিডেভিটÑ নিজেকে লুকিয়ে রাখা কোনকিছুই তার ভেতরে জেঁকেবসা রাতের আধার ডিঙাতে পারেনি। সায়লা আজও স্পষ্ট দেখলÑ ওই খোলা জানালা দাপিয়ে প্রচন্ড ঝড়ো বাতাস তাকে শুইয়ে ফেলছেÑ সে দলামোচড়া হয়ে মেঝেতে রক্তের মত চিকন ধারায় গড়িয়ে যাচ্ছে বাইরেÑ সে কত সময় গড়াবেÑ কতদূরই বা যাবে গড়িয়ে গড়িয়েÑ

প্রফেসর উঠে এসে সায়লার হাত ধরল, সিলুÑ আমি তোমাকে বলতে পারছি নাÑ আমাকে মাফ করÑ তুমি জান মাফ চাওয়ার জন্য যে নৈতিক শক্তি দরকারÑ তা আমার নেই। আমি তোমার সাথে এমন দু’টি কঠিন অন্যায় করেছি যার কোন মাফ হয় নাÑ তুমি আমাকে মাফ করবে নাÑ কখনও করবে নাÑ তারপরও এটা আমার জন্য যথেষ্ট হবে নাÑ কোনভাবেই হবে নাÑ
প্রফেসরের কণ্ঠ কী কান্নাভেজাÑ সে কী তার স্ত্রীর অন্তিমদশা নাকি সায়লার কাছে অনুতাপ প্রকাশজনিত! তার হাতে কী শীতলতা নাকি অদ্ভুত রকমের উষ্ণতা! সায়লার বোধ-চেতনা ঘঁষা কাঁচের মত হয়ে গেছে। তার ওপর ঝলসে ওঠল যে দৃশ্যÑ তাতে সে পরিস্কার দেখতে পেলÑ মৃত্যু ছাড়া সায়লার বাঁচার কোনই পথ নেই...


বিভাগ : বিশেষ সংখ্যা


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

জাগ্রত ভয় মনের মাঝে
আর কেউ বেঁচে নেই
সময়
মার্চের পদাবলি
অপসৃয়মাণ রেলগাড়ি
আরও
X

আরও পড়ুন

ঈদ মিছিলে মূর্তি ঈদের মূল স্পিরিটের সঙ্গে সাংঘর্ষিক: হেফাজত

ঈদ মিছিলে মূর্তি ঈদের মূল স্পিরিটের সঙ্গে সাংঘর্ষিক: হেফাজত

ফার্নান্দেসের রিয়ালে যাওয়ার ব্যাপারে যা বললেন তার কোচ

ফার্নান্দেসের রিয়ালে যাওয়ার ব্যাপারে যা বললেন তার কোচ

রোনালদোকে ছাড়িয়ে যেতে পারেন এমবাপে: আনচেলত্তি

রোনালদোকে ছাড়িয়ে যেতে পারেন এমবাপে: আনচেলত্তি

উইন্ডিজের নেতৃত্ব ছাড়লেন ব্র্যাথওয়েট

উইন্ডিজের নেতৃত্ব ছাড়লেন ব্র্যাথওয়েট

ঈদের আনন্দ ৫ আগস্ট শুরু হয়েছে : শিবির সভাপতি

ঈদের আনন্দ ৫ আগস্ট শুরু হয়েছে : শিবির সভাপতি

আমাকে যুদ্ধাপরাধের মামলায় ফাঁসানোর ভয় দেখানো হয়েছিল: জামায়াত আমির

আমাকে যুদ্ধাপরাধের মামলায় ফাঁসানোর ভয় দেখানো হয়েছিল: জামায়াত আমির

বাকিটা জীবন বুড়িচং-ব্রাহ্মণপাড়াবাসীর পাশে থাকতে চাই : ব্যারিস্টার আব্দুল্লাহ আল মামুন

বাকিটা জীবন বুড়িচং-ব্রাহ্মণপাড়াবাসীর পাশে থাকতে চাই : ব্যারিস্টার আব্দুল্লাহ আল মামুন

পশ্চিমবঙ্গ-গুজরাটে আতশবাজি কারখানায় বিস্ফোরণ, নিহত ২১

পশ্চিমবঙ্গ-গুজরাটে আতশবাজি কারখানায় বিস্ফোরণ, নিহত ২১

আমাদের চেতনার প্রাণপুরুষ আল্লামা ফুলতলী (র.)

আমাদের চেতনার প্রাণপুরুষ আল্লামা ফুলতলী (র.)

লক্ষ্মীপুরে অস্ত্রধারীদের গুলিতে শিশু গুলিবিদ্ধ

লক্ষ্মীপুরে অস্ত্রধারীদের গুলিতে শিশু গুলিবিদ্ধ

রামুতে গুলিতে নিহতের ঘটনায় ২ টি দেশীয় তৈরি অস্ত্র উদ্ধার আটক ২

রামুতে গুলিতে নিহতের ঘটনায় ২ টি দেশীয় তৈরি অস্ত্র উদ্ধার আটক ২

সিলেটে ৬ তলা ভবন থেকে লাফ দিয়ে এক গৃহবধুর আত্মহত্যা

সিলেটে ৬ তলা ভবন থেকে লাফ দিয়ে এক গৃহবধুর আত্মহত্যা

ঈদ পরবর্তী শুভেচ্ছা বিনিময়ে মোরেলগঞ্জের পথে প্রান্তরে বিএনপি নেতা কাজী শিপন

ঈদ পরবর্তী শুভেচ্ছা বিনিময়ে মোরেলগঞ্জের পথে প্রান্তরে বিএনপি নেতা কাজী শিপন

ঈদে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত পর্যটকে মুখরিত

ঈদে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত পর্যটকে মুখরিত

কুমিল্লায় বিদ্যুতের খুঁটিতে ধাক্কা বাসের, নিহত ৩

কুমিল্লায় বিদ্যুতের খুঁটিতে ধাক্কা বাসের, নিহত ৩

দাউদকান্দিতে এক যুবকের লাশ উদ্ধার

দাউদকান্দিতে এক যুবকের লাশ উদ্ধার

ঈদের পাঞ্জাবি নিয়ে বিপাকে বাবর, ডিজাইনারকে ছাঁটাই করতে বললেন ভক্তরা

ঈদের পাঞ্জাবি নিয়ে বিপাকে বাবর, ডিজাইনারকে ছাঁটাই করতে বললেন ভক্তরা

লন্ডনে ঈদের জামাতে প্রকাশ্যে হাছান মাহমুদ

লন্ডনে ঈদের জামাতে প্রকাশ্যে হাছান মাহমুদ

সুপ্রিম কোর্টে মুখ পুড়ল যোগী আদিত্যনাথের

সুপ্রিম কোর্টে মুখ পুড়ল যোগী আদিত্যনাথের

মির্জাপুরে প্রশাসনের হস্তক্ষেপে বিরোধপূর্ণ দুই ঈদগাহসহ আড়াই শতাধিক মাঠে উৎসবমুখর পরিবেশে ঈদের জামাত

মির্জাপুরে প্রশাসনের হস্তক্ষেপে বিরোধপূর্ণ দুই ঈদগাহসহ আড়াই শতাধিক মাঠে উৎসবমুখর পরিবেশে ঈদের জামাত