বিশে^র সর্ববৃহৎ ক্রীড়া আসর অলিম্পিক গেমস। এবার যার আয়োজক ফ্রান্স। ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের বিখ্যাত সিন নদীতে এবারের অলিম্পিকের ঐতিহাসিক উদ্বোধন হবে আজ। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানকে সামনে রেখে মনরোম সাজে সাজানো হয়েছে সিন নদীর দুই পাড়। নিছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থায় আজ স্থানীয় সময় সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা (বাংলাদেশ সময় রাত সাড়ে ১১টায়) সিন নদীতে শুরু হবে প্যারিস অলিম্পিকের বর্ণাঢ্য উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। চার ঘন্টার এই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানকে ঘিরে ইতোমধ্যে সব প্রস্তুতি শেষ করেছে আয়োজকরা। যদিও উদ্বোধনী অনুষ্ঠান নিয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো সংবাদ সম্মেলন করেনি তারা।

উদ্বোধনের দুই দিন আগেই শুরু হয়েছে এবারের অলিম্পিকের মাঠের লড়াই। পুরুষ ফুটবল ও রাগবি ডিসিপ্লিনের খেলা দিয়ে বুধবার শুরু হয় প্যারিস অলিম্পিকের পদকের লড়াই। তবে সবার আগ্রহ উদ্বোধনী অনুৃষ্ঠানকে ঘিরে। এই অনুষ্ঠানকে জম্পেশ করার লক্ষ্যেই কোনো স্টেডিয়াম নয়, বেছে নেওয়া হয়েছে নদীকে। অলিম্পিকের ইতিহাসে এই প্রথমবার স্টেডিয়ামের বাইরে হচ্ছে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। এবারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভিন্নতা রয়েছে ব্যাপক। সিন নদীর দুই ধারে গ্যালারীও করা হয়েছে। যেখানে বসে ২ লাখ ২২ হাজার সাধারণ দর্শক গেমসের অনুষ্ঠান সরাসরি উপভোগ করতে পারবেন। এছাড়া বিশেষভাবে তৈরি স্ট্যান্ড থেকে এই আয়োজন উপভোগ করবেন টিকিটধারী ১ লাখ ৪ হাজার দর্শক। চড়া দামে বিক্রি হয়েছে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের টিকিট। প্রতিটি টিকিটের মূল্য আড়াই হাজার ইউরো (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৩ লাখ ২০ টাকা)। সব মিলিয়ে ৩ লাখেরও বেশি দর্শক উপভোগ করবেন অলিম্পিকের উদ্ধোধনী অনুষ্ঠান। তবে সিনের তীর ও আশপাশের ভবনের বারান্দা থেকেও বিনামূল্যে উপভোগ করা যাবে বর্ণাঢ্য এই অনুষ্ঠান।

শুধু অলিম্পিকেরই নয়, যেকোন ক্রীড়া আসরের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মার্চ পাস্টের জন্য সাধারণত ব্যবহার করা হয় প্রধান অ্যাথলেটিক্স স্টেডিয়াম। কিন্তু প্যারিস অলিম্পিকের আয়োজকেরা এবার সেটিকে রাজধানীর কেন্দ্র থেকে সরিয়ে নিয়েছেন। মূলত অলিম্পিকের মূল থিম ‘গেমস ওয়াইড ওপেন’কে সামনে রেখেই এই সিদ্ধান্ত। সব সময়ই গেমসের উদ্বোধনী ও সমাপনী অনুষ্ঠানের মূল আকর্ষণ থাকে মার্চ পাস্ট। সেই মার্চ পাস্টেও থাকছে ভিন্নতা। সাড়ে ১০ হাজার অ্যাথলেট দুইশ’র কাছাকাছি নৌকা ও বার্জে মার্চ পাস্টে অংশ নেবেন। তারা আইফেল টাওয়ারের পূর্ব কোণের উস্তালিজ সেতু থেকে নৌকা ও বার্জে করে সিন নদীর ৬ কিলোমিটার পাড়ি দেবেন। আইফেল টাওয়ারের পাদদেশে গিয়ে শেষ হবে এই অভিনব মার্চ পাস্ট। এ রকমভাবে কখনো গেমসের উদ্বোধন আগে কখনো হয়নি। নদীতে আয়োজনের পাশাপাশি এই গেমসের উদ্বোধনে আরেকটি বড় বৈশিষ্ট্য ‘জিরো কার্বন’। গেমসে আতশবাজি ও আরো অনেক দ্রব্য পোড়ানো হয় যা পরিবেশ উপযোগী নয়। এবার প্যারিস অলিম্পিক গেমসে পরিবেশকে অনেক প্রাধান্য দিয়েছেন আয়োজকরা। তাই পরিবেশের প্রতি হুমকি হতে পারে এমন কোনো কর্মকান্ডই রাখা হয়নি উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। চার ঘণ্টার মধ্যেই শেষ হবে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের বর্ণাঢ্য আয়োজন। সূর্যাস্তের সময় আর এই আয়োজনের শেষ অংশটা মিলে যাবে।

ঐতিহ্য মেনে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সবার আগে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হবে অলিম্পিকের জন্মভ‚মি গ্রিসকে। তাদের পর দেখা যাবে শরণার্থী অলিম্পিক দলকে। আর সবার শেষে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হবে আয়োজক দেশ ফ্রান্সকে। অন্যদিকে রাশিয়া ও বেলারুশের অ্যাথলেটরা এই আয়োজনে অংশ নেবেন ব্যক্তিগত পরিচয়ে। ইউক্রেন যুদ্ধে নিজেদের ভ‚মিকার কারণে দল হিসেবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে রাশিয়া ও বেলারুশকে। পুরো উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটিকে ১২টি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যেখানে মোট তিন হাজার নৃত্যশিল্পী, সংগীতশিল্পী ও বিনোদনকর্মী অংশ নেবেন। অংশগ্রহণকারী শিল্পীরা সিন নদীর দুই তীরে, সেতুতে ও কাছাকাছি স্মৃতিস্তম্ভগুলোয় থাকবেন। নটর ডেম ক্যাথেড্রালও থাকবে এই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের অংশ হয়ে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের দুইতৃতীয়াংশ আয়োজন দিনের আলোয় আয়োজন করা হলেও বাকি অংশ দেখা যাবে গোধ‚লিবেলায়। আয়োজকদের প্রত্যাশা এই আয়োজনে প্যারিসের অপরূপ সূর্যাস্তের মুহ‚র্তও প্রাণভরে উপভোগ করতে পারবেন দর্শকেরা। এই আয়োজনে ফ্রান্সের সাংস্কৃতিক, ভাষিক, ধর্মীয় ও লৈঙ্গিক বৈচিত্যকে তুলে ধরতে চায় আয়োজকরা। পুরো অনুষ্ঠান সফলভাবে শেষ করতে সার্বিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে ফরাসি পুলিশও। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় এত বেশিসংখ্যক মানুষের নিরাপত্তার কথাটি বিবেচনায় রাখছেন আয়োজকরা। পুরো অনুষ্ঠানের নিরাপত্তায় নিয়োজিত থাকবেন প্রায় ৪৫ হাজার নিরাপত্তাকর্মী।

প্যারিস অলিম্পিক গেমসে থাকবেন বিশ্বের নানা খেলার নানা বড় ব্যক্তিত্ব। ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব ছাড়াও থাকছেন রাজনৈতিক, সামাজিক ব্যক্তিবর্গও। করোনা পরবর্তী সময় বিশ্বরাজনীতি এখন নানা বিভাগে বিভক্ত। এমন সময় বিশ্বের প্রায় সকল দেশ এক ছাদের নিচে। তাই শুধু ক্রীড়া নয়, রাজনৈতিক-ক‚টনৈতিক দৃষ্টিও থাকছে প্যারিসের দিকে। এজন্য ফ্রান্স সরকারও সচেষ্ট। নানা হুমকি মোকাবেলায় নিরাপত্তা খাতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব ও বাজেট রেখেছে।

শিল্প-সংস্কৃতির রাজধানী হিসেবে প্যারিসের খ্যাতি বিশ্বজোড়া। সাংস্কৃতিক রাজধানী প্যারিস আজ বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনেও আরেক কৃতিত্বের স্বাক্ষী হচ্ছে। বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনের সর্ববৃহৎ আসর অলিম্পিক সর্বোচ্চ তিন বার আয়োজনে লন্ডনের সমকক্ষ হচ্ছে প্যারিস। আধুনিক অলিম্পিকের যাত্রা ১৮৯৬ সালে। প্রথম অলিম্পিকের পরের আসরই হয়েছিল ফ্রান্সের প্যারিসে। ১৯০০ সালের পর অলিম্পিক আয়োজনে ফ্রান্সকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল দুই যুগ। ১৯২৪ সালের পর তৃতীয় বারের মতো প্যারিসে অলিম্পিক আয়োজন, এবার অপেক্ষা ঘুচছে ১০০ বছরের।