জৈব কৃষিতে টিস্যু কালচার-এর ভূমিকা
০৯ মে ২০২৩, ০৮:৫৯ পিএম | আপডেট: ১০ মে ২০২৩, ১২:০৫ এএম
মানবদেহের সুস্থ্যতা বজায় রাখতে প্রয়োজন কেমিক্যালমুক্ত প্রাকৃতিক পরিবেশে বেড়ে উঠা সবজি, ফলমূল এবং অন্যান্য খাদ্য। কৃষিক্ষেত্র আমাদের খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহের প্রধান উৎস। সময়ের সাথে সাথে বেড়েছে জনসংখা ও প্রাকৃতিক সম্পদের চাহিদা।
জৈব কৃষি এমন এক কৃষি ব্যাবস্থা, যা সামাজিক এবং আর্থিক উন্নয়নের একটি উপায়। এ পদ্ধতি প্রাকৃতিক উৎস বা সম্পদের সংরক্ষণ, পরিবেশ ও মানুষের স্বাস্থ্য উন্নয়নের দিকে গুরুত্ব দেয়। ইউএসডিএ ন্যাশনাল অর্গানিক স্ট্যান্ডার্ডস বোর্ড (এনওএসবি) অনুসারে, জৈব কৃষি হল, একটি পরিবেশগত উৎপাদন ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থা যা জীববৈচিত্র্য, জৈব চক্র এবং মাটির জৈবিক কার্যকলাপকে বৃদ্ধি করে যা পরিবেশগত ভারসাম্য পুনরুদ্ধার এবং উন্নত করে। এর প্রাথমিক লক্ষ্য হলো, মাটি, উদ্ভিদ, প্রাণী এবং মানুষের পরস্পর নির্ভরশীল স্বাস্থ্য ও উৎপাদনকে অপ্টিমাইজ করা।
বর্তমানে জৈব কৃষির চাহিদা বেড়ে চলছে। কারণ, মানুষ এখন আগের চেয়ে বেশি সতর্ক ও সচেতন। সুস্থ পরিবেশ ও সুস্বাস্থ্য এখন সবার কাম্য। সীমিত প্রাকৃতিক সম্পদকে কিভাবে কাজে লাগিয়ে অতিরিক্ত চাহিদা পূরণ করা যায়, সে ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা সর্বদা গবেষণা করে আসছেন। সেসকল গবেষণার মাঝে সফল এক ফলাফল হলো টিস্যু কালচার।
উদ্ভিদের যেকোনো বিভাজনক্ষম অঙ্গ থেকে (যেমন-শীর্ষমুকুল, কক্ষমুকুল, কচি পাতা বা পাপড়ি ইত্যাদি) বিচ্ছিন্ন করে কোনো টিস্যু সম্পূর্ণ জীবাণুমুক্ত অবস্থায় উপযুক্ত পুষ্টির মাধ্যমে বৃদ্ধিকরণ (এবং পূর্ণাঙ্গ চারা সৃষ্টি) করাকে টিস্যু কালচার বলে। অর্থাৎ গবেষণাগারে কোনো টিস্যুকে পুষ্টির মাধ্যমে কালচার করাই হলো টিস্যু কালচার।
টিস্যু কালচার প্রযুক্তির ধাপসমূহ হলো, মাতৃউদ্ভিদ বা এক্সপ্লান্ট নির্বাচন, টিস্যু কালচারের জন্য সুস্থ, নিরোগ ও উৎকৃষ্ট বৈশিষ্ট্যের উদ্ভিদ থেকে টিস্যু সংগ্রহ করা হয। এরপর কালচার মিডিযাম বা আবাদ মিডিয়াম তৈরি করা যেখানে বিভিন্ন ধরনের মুখ্য ও গৌণ উপাদান, ভিটামিন, সুকরোজ, ফাইটোহরমোন প্রভৃতি থাকা প্রয়োজন। পাত্রটিকে নির্বীজকরণ যন্ত্র দিয়ে জীবাণুমুক্ত করা হয়। মিডিয়ামকে অটোক্লেভ যন্ত্রে নির্দিষ্ট তাপ, চাপ ও সময়ে রাখা হয়। এক্সপ্লান্টকে সম্পূর্ণ নির্বীজ অবস্থায় কাচপাত্রে রাখা মিডিয়ামে স্থাপন করা হয়। পাত্রটিকে বৈদ্যুতিক আলো, তাপমাত্রা ও আপেক্ষিক আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রিত কক্ষে রাখা হয়। কযয়েকদিন পর টিস্যুটি বারবার বিভাজিত হয়ে একটি কোষীয় ম-ে পরিণত হয়। যে অবয়বহীন অবিন্যস্ত টিস্যুগুচ্ছ সৃষ্টি হয় তাকে বলা হয় ‘ক্যালাস’। ক্যালাস থেকে এক সময় অসংখ্য মুকুল সৃষ্টি হয়। উপযুক্ত সংখ্যক সুগঠিত মূল সৃষ্টি হলে পূর্ণাঙ্গ চারাগাছ কালচার করা পাত্র থেকে সরিয়ে সাবধানতার সাথে টবে স্থানান্তর করা হয়। এভাবে টিস্যু কালচারের মাধ্যমে চারাগাছ উৎপাদন কাজ সম্পন্ন করা হয়। মুকুলগুলোকে সাবধানে কেটে মূল উৎপাদনকারী মিডিয়ামে রাখা হয় এবং সেখানে প্রতিটি মুকুল, মূল সৃষ্টি করে পূর্ণাঙ্গ চারাগাছে পরিণত হয়। টবসহ চারাগাছকে কিছুটা আর্দ্র পরিবেশে রাখা হয়, তবে রোপিত চারাগাছগুলো কক্ষের বাইরে রেখে মাঝে মাঝে বাইরের প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে হয়। পূর্ণাঙ্গ চারাগাছগুলো সজীব ও সবল হয়ে উঠলে সেগুলোকে এক পর্যায়ে প্রাকৃতিক পরিবেশে মাটিতে লাগানো হয়। এ সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটিতে কোনরকম কেমিক্যাল কীটনাশক ব্যাবহƒত হয় না এবং নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ এ সম্পন্ন করা হয় বলে রোগমুক্ত থাকে। সেজন্য এ পদ্ধতিতে সবচেয়ে উচ্চমানের ফসল পাওয়া সম্ভব।
সাধারণভাবে, শস্য উৎপাদন বা পণ্য তখনই জৈবকৃষির আওতায় আসবে, যখন পুরো প্রক্রিয়া জেনেটিক পরিবর্তন থেকে মুক্ত হবে, প্রচলিত সার এবং কীটনাশক ছাড়া বৃদ্ধি পাবে, খাদ্য সংযোজন বা আয়নাইজিং বিকিরণ ছাড়াই প্রক্রিয়াজাত করা হয়। জৈব কৃষিতে টিস্যু কালচার-এর এক অনবদ্য ভূমিকা রয়েছে, যার মাধ্যমে একটি ফসলের চারা থেকে শুরু করে পরিপক্ব হওয়া পর্যন্ত সম্পূর্ণরূপে প্রাকৃতিক উপায়ে প্রস্তুত হয়ে থাকে।
রোগমুক্ত উদ্ভিদ উপাদান: বহু বছর আগে থেকেই গতানুগতিক কৃষিতে নানা ধরনের রোগমুক্ত করে ফলন বৃদ্ধির জন্য কীটনাশকের ব্যাবহার আমরা ব্যাপকহারে দেখতে পাই। দিনের পর দিন এর ব্যবহার বেড়ে চলছে। কিন্তু কীটনাশকের ক্ষতিকর দিকগুলো আমরা যেনো ভুলে যাই। ফসলে কীটপতঙ্গ আক্রমণ করবে, নানা ধরনের রোগ হবে, এটা প্রাকৃতিক নিয়ম। তবে মানব চাহিদা যে হারে বেড়ে চলছে, সেই হার এর সাথে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য আমরা ব্যবহার করি নানা ধরণের কেমিক্যাল কীটনাশক। এই কীটনাশক কৃষি ক্ষেত্রে ব্যাবহারের পর মাটির সাথে এবং পানির সাথে মিশে দূষণ ঘটায়। এমন কিছু কীটনাশক আছে যা দীর্ঘদিন পরিবেশে অবস্থান করে দূষিত করতে থাকে, যেমন ডিডিটি, ডাইলড্রিন, অ্যালড্রিন ইত্যাদি। এই কীটনাশকগুলো মাটিতে থেকে বৃষ্টির পানির মাধ্যমে আশেপাশের জলাশয়ে প্রবেশ করে। ফলে জলাশয়ের পানির গুণগত মান নষ্ট হয়ে যায়। দূষিত পানিতে প্রাকৃতিক ইকোসিস্টেম নষ্ট হতে শুরু করে এবং মাছ খাবার যোগ্য থাকে না। মাছের মধ্যে কেমিক্যাল জমা হয়। সেই মাছ বেশি পরিমাণে খেলে, কেমিক্যাল বেশি হারে শরীরে প্রবেশ করে, যাকে বলা হয় বায়োএকুমুলেশন। এতে মানুষ বেশি ক্ষতির শিকার হচ্ছে। এই সমস্যা দূর করতেই জৈব কৃষি এগিয়ে আসছে, যেখানে টিস্যু কালচারের মাধ্যমে রোগমুক্ত ফসল তৈরি করে। টিস্যু কালচার প্যাথোজেনমুক্ত উদ্ভিদ উপাদান তৈরি করতে পারে, যা জৈব চাষের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে সিন্থেটিক কীটনাশক এবং ছত্রাকনাশক অনুমোদিত নয়। এর কারণ হলো, টিস্যু কালচার গাছ সাধারন গাছের তুলনায় কীটপতঙ্গ এবং রোগ প্রতিরোধী হয়, যা রাসাযনিক কীটনাশকের প্রযয়োজনীয়তা হ্রাস করে।
দ্রুত বংশবিস্তার: টিস্যু কালচার একটি একক উপাদান থেকে দ্রুত প্রচুর পরিমাণে উদ্ভিদ উৎপাদন করতে পারে। এটি বিরল বা মূল্যবান উদ্ভিদ প্রজাতির দক্ষ বংশবিস্তার করেতে পারে বা বাণিজ্যিক পরিবেশে ব্যবহারের জন্য বিপুল সংখ্যক উদ্ভিদের দ্রুত উৎপাদন করে থাকে। যার ফলে বর্ধিত চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে। স্বল্প ভূমি এবং উৎপাদন বৃদ্ধি টিস্যু কালচার একটি সফল মাধ্যম।
টিস্যু কালচার ঋতু নির্বিশেষে জৈব কৃষকদের সারা বছর ফসল উৎপাদনে সহায়তা করতে পারে। এটি কৃষকদের একটি নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে গাছপালা বৃদ্ধি করতে দেয়, এর অর্থ হচ্ছে, তারা উদ্ভিদের বৃদ্ধিকে অনুকূল করতে তাপমাত্রা, আলো এবং আর্দ্রতা নিযন্ত্রণ করতে পারে।
উন্নত উদ্ভিদ কর্মক্ষমতা: টিস্যু কালচার উদ্ভিদের পছন্দসই বৈশিষ্ট্য যেমন রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বা মান বৃদ্ধির জন্য বৈশিষ্ট্য নির্বাচন করতেও ব্যবহার করা যেতে পারে। এটি ফসলের ফলন এবং গুণমান উন্নত করতে পারে।
বিরল বা বিপন্ন প্রজাতির সংরক্ষণ: টিস্যু কালচার বিরল বা বিলুপ্তপ্রায় উদ্ভিদ প্রজাতি সংরক্ষণ ও প্রচারের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে, যা তাদের সংরক্ষণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। জৈব কৃষিতে এর প্রাথমিক সুবিধা হচ্ছে, এটি বিরল বা বিপন্ন উদ্ভিদ প্রজাতির বংশবৃদ্ধিতে সহায়ক। এটি দ্রুত এবং দক্ষতার সাথে বিপুল সংখ্যক উদ্ভিদ উৎপাদন করে।
সামগ্রিকভাবে, জৈব কৃষিতে টিস্যু কালচারের অনেক প্রয়োগ রয়েছে। বিরল এবং বিপন্ন উদ্ভিদ প্রজাতির বংশবিস্তার থেকে শুরু করে কৃত্রিম রাসায়নিক বা জিএমও ব্যবহার ছাড়াই রোগ-প্রতিরোধী ফসল উৎপাদনে এটি অত্যন্ত কার্যকর পদ্ধতি।
লেখক: শিক্ষার্থী, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ।
ইমেইল: [email protected]
বিভাগ : আজকের পত্রিকা
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
বেগমগঞ্জে জুমার নামাজ শেষে ফেরার পথে বিএনপি কর্মিকে গুলি ও জবাই করে হত্যা
নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমেই দেশে পরিপূর্ণ সংস্কার হবে: আমিনুল হক
সাংবাদিক বশিরসহ জনবাণী’র সম্পাদকের উপর হামলার ঘটনায় ডিআরইউ-র্যাকের উদ্বেগ
রামগতিতে ভিক্ষুকের জমি রেজিস্ট্রি না দেয়ায় লাশ দাফনে বাঁধা
র্যাকের সভাপতি আলাউদ্দিন আরিফ, সাধারণ সম্পাদক তাবারুল
রাষ্ট্রদূত হলেন সেনাবাহিনীর ২ সিনিয়র কর্মকর্তা
ব্রাহ্মণপাড়ায় আলোচিত শফি উল্লাহ হত্যার ঘটনায় গ্রেপ্তার ১
ফরিদপুরের ধলার মোড়ে ৮ম ঘুড়ি উৎসব অনুষ্ঠিত
খালেদ মুহিউদ্দীনকে কী পাঠ পড়ালেন ড. আলী রীয়াজ
জানুয়ারিতে আরও ৫০ মডেল মসজিদ উদ্বোধন করবেন প্রধান উপদেষ্টা
আটঘরিয়ায় বিএনপির সম্মেলনকে কেন্দ্র করে আলোচনা সভা ও মিছিল
আগে মানুষকে স্বস্তি দিতে হবে: ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য
মহাবিশ্বের সুদূর পারে মিলল অতিকায় মহাসাগরের সন্ধান
‘সচিবালয়ে আগুন প্রমাণ করে দুস্কৃতিকারীরা সক্রিয়, সরকারকে আরো সতর্ক হতে হবে’
নৌযান শ্রমিকদের অনির্দিষ্টকালের পণ্যবাহী ধর্মঘটে অচল আশুগঞ্জ নদী বন্দর
মাহমুদুর রহমান’কে হত্যাচেষ্টা মামলার অগ্রগতি শুন্য
সচিবালয়ে আগুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ব্যর্থ করার চক্রান্ত: ইউট্যাব
মির্জাপুরে ঘর ভেঙে দিয়ে সরকারি জমি উদ্ধার
নামাজ পড়ে সাইকেল উপহার পেলো ৫৬ শিশু
দৌলতদিয়ায় আগুনে গবাদি পশুসহ বাড়ি পুড়ে ছাই