ঢাকা   রোববার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

অবৈধ ড্রেজার ড্রাম ট্রাকে গিলে খাচ্ছে আড়িয়াল বিল

Daily Inqilab এমএ কাইয়ুম, পদ্মাসেতু উত্তর (মুন্সীগঞ্জ) থেকে

০২ আগস্ট ২০২৩, ১০:৩৩ পিএম | আপডেট: ০৩ আগস্ট ২০২৩, ১২:০২ এএম

এক শ্রেণির অসাধু ভূমিদস্যু সেন্ডিকেট সদস্যরা সরকারি নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে অবৈধ ড্রেজার ও ড্রাম ট্রাক দিয়ে বালু ভরাটের মাধ্যমে গিলে খাচ্ছে আড়িয়াল বিলসহ উপজেলার কৃষি জমি। ড্রেজার ও ড্রাম ট্রাক দিয়ে কৃষি ও সরকারি খাসজমিসহ খাল, জলাশয়, পুকুর ভরাটের ফলে আড়িয়াল বিলের পানি আসতে না পারায় বিলের মৎস্য ও শস্য ভান্ডার পুরোপুরি হুমকিতে পড়েছে এবং ছোট বড় খাল, জলাশয় ও পুকুর ভরাটে পানিবদ্ধতার সৃষ্ট হয়ে বিপাকে পড়েছেন হাজার হাজার কৃষকসহ সাধারণ মানুষ। কৃষি জমি ভরাট করে ভূমিদস্যুরা গড়ে তুলেছে আবাসনের নামে অবৈধ হাউজিং প্রকল্প। এর ফলে দেশের কৃষি উৎপাদনের বিরাট একটি অংশ দেশের কৃষি খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।

দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম আড়িয়াল বিল প্রমত্তা পদ্মা নদী ও ধলেশ্বরী নদীর মাঝখানে মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর, সিরাজদিখান, ঢাকার দোহার ও নবাবগঞ্জ উপজেলার অর্ন্তগত অবস্থিত একটি অবভূমি। এটি দেশের মধ্যাঞ্চলের সবচেয়ে বড় ও প্রাচীন বিল। আড়িয়াল বিলের বেশিরভাগ এলাকাই শুষ্ক ঋতুতে আর্দ্র থাকে ও বিলে যথেষ্ট পরিমাণ পানি সঞ্চিত থাকতো। বর্ষায় পানিতে টইটুম্বুর থাকলেও শীতকালে এটি বিস্তীর্ণ শস্য ক্ষেতে পরিণত হয়। এখানে শীতকালে নানা ধরনের সবজির চাষ করা হয়, এ বিলের বিশেষ আকর্ষণ হচ্ছে, বর্ষাকালে পানি থৈ থৈ পালতোলা নৌকা চলাচল, শীতকালে মাঠে মাঠে সরিষা ফুলের অবাক সৌন্দর্য ও বিশাল আকৃতির মিষ্টি কুমড়া। এই বিলের আয়তন ১শত ৩৬ বর্গকিলোমিটার। এখানে ২৮ হাজার হেক্টর জমির মধ্যে প্রায় ১০ হাজার হেক্টর জমিই খাস ও ভেস্টেড প্রপারটি। এতে যে পরিমাণ কৃষি খাদ্য উৎপাদন হত তাতে পুরো দেশের প্রায় আড়াই থেকে তিন দিনের খাদ্য চাহিদার যোগান হত।

উপজেলাসহ আড়িয়াল বিল পাড়ের চুর্দিকে যে হাড়ে অবৈধ ড্রেজার ও ড্রাম ট্রাক দিয় কৃষি ও খাস জমি ভরাট হচ্ছে। এতে অল্প সময়ের ব্যবধানে আড়িয়াল বিলসহ উপজেলার বেশিরভাগ অংশের কৃষি জমিই আর থাকবে না বলে জানান স্থানীয় কৃষকরা। অবৈধ ড্রেজারের পাশাপাশি বালু ভর্তি বড় বড় ড্রাম ট্রাক দিয়ে দিবারাত্রি কৃষি জমি ভরাট করা হচ্ছে সমান তালে। এই ড্রাম ট্রাক চলাচলে গ্রামীণ কাঁচা পাকা সড়কসহ সরকারের হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত মহাসড়ক, আন্তঃসড়কগুলোও পড়েছে হুমকির মুখে। নির্মাণ বা সংস্কারে বছর না পেরুতে সড়কগুলো এবড়ো থেবড়ো হয়ে সড়কের পার্শ্ব ভেঙ্গে জনচলাচলেন অনুপযোগী হয়ে পড়ছে।

ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে, স্বপ্নের পদ্মাসেতু ও রেলওয়ে নির্মাণে এই অঞ্চলের জমির মূল্যে বেশ কয়েকগুন বেড়ে যাওয়া এখানে গড়ে উঠেছে ছোট বড় শতাধিক হাউজিং কোম্পানির অপরিকল্পিত নগরায়ন। আড়িয়াল বিলে গড়ে তুলেছে রয়েল প্রপারটিস, ধরিত্রী এবং এক্সপ্রেসওয়ের পূর্ব পাশে ঠিকানা, প্রিমিয়াম ভ্যালি, কৃষ্ণচূড়া নামে পরিবেশের ছাড়পত্রহীন নামে-বে-নামে হাউজিং কোম্পানি।

পরিবেশের ছাড়পত্রহীন এসব হাউজিং প্রকল্পে ছাড়পত্রহীন বহুতল বিল্ডিং উত্তোলনে নেই কোনো ড্রেনেজ ব্যবস্থা।
কৃষি প্রধান এদেশের তিন-চতুর্থাংশ মানুষ সরাসরি কৃষি অর্থনীতির সাথে জড়িত। বর্তমানে কৃষি জমি ভরাট করে অপরিকল্পিত আবাসন প্রকল্প ও নগরায়নের ফলে ক্রমশ কমছে উপজেলার এসব আবাদি জমির পরিমাণ।

অনেকেই বলে থাকেন- কৃষি জমির পরিমাণ কমে যাওয়ার পেছনে জনসংখ্যা বৃদ্ধি দায়ী। কিন্তু বাস্তব প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, অপরিকল্পিত শিল্পায়ন ও নগরায়নের জন্য আবাদি জমি অকৃষিতে পরিণত হচ্ছে। এভাবে কৃষি জমি কমতে থাকলে ৬৮ শতাংশ মানুষের জীবন-জীবিকা চরম হুমকির মুখে পড়বে।

সচেতনমহলের লোকজন মনে করেন, এভাবে যদি আবাদি জমি অকৃষি খাতে চলে যেতে থাকে এবং কৃষি জমি অনাবাদি হয়, তবে বিষয়টি অত্যন্ত উদ্বেগজনক বাস্তবতাকে স্পষ্ট করে-যা আমলে নিয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের কোনো বিকল্প থাকতে পারে না। বিভিন্ন কোম্পানি প্রায় সারা দেশেই শত শত বিঘা জমি কিনছে। এতে কৃষকরা ভূমিচ্যুত হচ্ছে। কোম্পানিগুলো প্রথম দিকে কৃষি কাজের নাম করে কেনা জমিতে গাছপালা রোপণ বা বপন করে। পরে জমিটিতে মাটি ভরাট করে অন্য কাজে লাগায়।

বাংলাদেশ ছোট্ট একটি ভূ-খ-, অথচ জনসংখ্যা ১৬ কোটি ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এখনই মাথাপিছু আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ অতি সামান্য। তারপরও যদি কৃষি জমি এমন দ্রুত হারে কমতে থাকে, তাহলে এই জনসংখ্যার খাদ্যের জোগান দেওয়া একসময় কষ্টকর নয়, রীতিমতো অসম্ভব হয়ে পড়বে। ভূ-গর্ভের পানির স্তর অত্যাধিক নিচে নেমে যাওয়ায় এখনই অনেক জায়গায় গভীর নলকূপেও পানি ওঠে না। খাল-বিল-নালা ভরাট হয়ে যাওয়ায় বৃষ্টির পানি ভূ-গর্ভে যেতেও পারছে না।

এ অবস্থায় ফসল উৎপাদনে বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। সর্বসাধারণের সচেতনতা কৃষি জমি হারানোর সমস্যা সমাধানে সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করতে পারে। দরকার সরকারের সঠিক পরিকল্পনা।

সরেজমিনে আড়িয়াল বিল এলাকা ঘুরে দেখা যায়, শুষ্ক মৌসুমে ভূমিদস্যুরা স্থানীয় কৃষকদের লোভ দেখিয়ে তাদের কৃষি জমি থেকে মাটি কেটে বিশালাকৃতির স্তুপ রেখে বর্ষা মৌসুমে বড় বড় ট্রলার যোগে দেশের বিভিন্ন ইট ভাটা নিয়ে বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছি এসব সিন্ডিকেটের সদস্যরা।

বাঘড়া ইউনিয়নের মাঘডাল নয়াবাড়ি এলাকায় পশ্চিম বাঘড়ার ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা আলমের নেতৃত্বে জনচলাচলের রাস্তার উপর অবৈধ ড্রেজার স্থাপন করে পদ্মানদী থেকে সরাসরি বালু উত্তোলন করে এলাকার কৃষিজমিসহ জলাশয় ও পুকুর ভরাট করা হচ্ছে।

ভাগ্যকুল ইউনিয়ন পরিষদের পূর্ব পাশে ও ভাগ্যকুল মান্দ্রা এলাকায় ইউপি চেয়ারম্যান কাজী মনোয়ার হোসেন শাহাদাতের পৃষ্ঠ পোষকতায় ও ইউপি সদস্য রতন শাহার নেতৃত্বে বেশ কয়েকটি অবৈধ ড্রেজার সড়কের উপর ও আন্তঃসড়ক বোরিং করে বসিয়ে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করে কৃষি, খাস জমি, খাল ও জলাশয়, পুকুর ভরাট করা হচ্ছে। এখানে বেশ কয়েকটি ড্রেজার প্রায় সাড়া বছর চলে।

রাঢ়ীখাল ইউনিয়নে তুহেল, মানু’র নেতৃত্বে একাধিক ড্রেজার মান্দ্রা ও কবুতরখোলায় পদ্মানদীতে স্থাপন করে ইউনিয়নের খাস জমিসহ কৃষি জমি ভরাট করছে বছর ভরে।

কুকুটিয়া ইউনিয়নে হাশিম আলী আমিনের নেতৃত্বে প্রায় অর্ধশত অবৈধ ড্রেজার কৃষি জমির মাটি কেটে পুনরায় কৃষি আবাদি শতশত একর জমি ভরাটের কর্মজ্ঞ চালাচ্ছে কয়েক বছর যাবৎ।
ষোলঘর ইউনিয়নে রফিক মেম্বার, রাসেল মাদবর ও সাবেক আলী মেম্বারের নেতৃত্বে বেশ কয়েকটি অবৈধ ড্রেজার শ্রীনগর গোয়ালী মান্দ্রা খালে স্থাপন করে ঐ ইউনিয়নের কৃষি জমিসহ খাস জমি ভরাট করা হচ্ছে।
আড়িয়াল বিল পাড়ের কৃষক মোসলেম ঢালী জানান, আড়িয়াল বিলে আমরা মাছসহ প্রচুর ফসল উৎপাদন করি। আমরা বিলের কৃষি জমিতে ফসল আবাদ করে জীবনজীবিকা চালাই। যেভাবে আমাদের এই অঞ্চলে কৃষি জমি ভরাটের হিড়িক পড়েছে তাতে কয়েক বছরের মধ্যেই আড়িয়াল বিলটাকে আমরা হারাবো। চুর্দিকে ভরাটের কারণে এখনিতো বিলে পানি আসতে পারে না। এখন বর্ষা মৌসুম বিলে আগের মত পানি নেই।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মহসিনা জাহান তোরণ বলেন, কৃষিজমি ভরাটের ব্যাপারে আমাদের সকলকেই উদ্যোগী হয়ে এটা বন্ধ করতে হবে। শুধু প্রশাসনের একার পক্ষে সম্ভব নয়। এজন্য সবাইকে সচেতন হতে হবে। তাহলেই আমাদের কৃষি জমিসহ আড়িয়াল বিলের জীববৈচিত্র রক্ষা হবে।

উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ হোসেন পাটওয়ারী বলেন, ইতোমধ্যে আমরা অভিযান পরিচালনা করে অবৈধ ড্রেজার গুলোর সংযোগ বিছিন্ন করেছি এবং কিছু কিছু ড্রেজার মালিকদের ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে জরিমানা করছি। বাকী গুলোর খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। পরিবেশ অধিদফতর, মুন্সীগঞ্জ উপ-পরিচালক মো. মিজানুর রহমান বলেন, আড়িয়াল বিলে এ পর্যন্ত কোনো আবাসন প্রকল্পের অনুমতি আমরা দেইনি। অন্যান্য গুলোর বিষয়ে আমরা খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।


বিভাগ : বাংলাদেশ


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

গোল উৎসবে নেশন্স কাপে উড়ন্ত সূচনা জার্মানির

গোল উৎসবে নেশন্স কাপে উড়ন্ত সূচনা জার্মানির

জয়ে ইংল্যান্ডের সাউথগেট-পরবর্তী অধ্যায় শুরু

জয়ে ইংল্যান্ডের সাউথগেট-পরবর্তী অধ্যায় শুরু

পোপের ১৫৪ রানের পরেও ইংল্যান্ডের ৩২৫,কামিন্দু-সিলভায় লংকানদের লড়াই

পোপের ১৫৪ রানের পরেও ইংল্যান্ডের ৩২৫,কামিন্দু-সিলভায় লংকানদের লড়াই

স্কটল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করলো অস্ট্রেলিয়া

স্কটল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করলো অস্ট্রেলিয়া

মানিকগঞ্জে ইছামতী নদীতে থেকে মরদেহ উদ্ধার

মানিকগঞ্জে ইছামতী নদীতে থেকে মরদেহ উদ্ধার

‌'শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের কঠাগড়ায় দাঁড় করাতে হবে'

‌'শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের কঠাগড়ায় দাঁড় করাতে হবে'

শেষ ম্যাচও জিততে চায় বাংলাদেশ

শেষ ম্যাচও জিততে চায় বাংলাদেশ

সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় জামায়াতকে পাহারাদারের ভূমিকা পালন করতে হবে

সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় জামায়াতকে পাহারাদারের ভূমিকা পালন করতে হবে

আইওসির কোচিং কোর্সে বাংলাদেশের মাহফিজুল

আইওসির কোচিং কোর্সে বাংলাদেশের মাহফিজুল

নাটোরে পৌরসভার পরিচ্ছন্নতা সপ্তাহ শুরু

নাটোরে পৌরসভার পরিচ্ছন্নতা সপ্তাহ শুরু

পটিয়ায় জশনে জুলুসে ঈদে মিলাদ্ন্নুবী অনুষ্ঠিত

পটিয়ায় জশনে জুলুসে ঈদে মিলাদ্ন্নুবী অনুষ্ঠিত

মীরসরাইয়ে কমছে পানি তীব্র হচ্ছে নদীভাঙন

মীরসরাইয়ে কমছে পানি তীব্র হচ্ছে নদীভাঙন

বিএনপিতে কোনো সন্ত্রাসী চাঁদাবাজের ঠাঁই হবে না

বিএনপিতে কোনো সন্ত্রাসী চাঁদাবাজের ঠাঁই হবে না

নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেয়াই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব

নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেয়াই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব

নেমে গেছে বানের পানি স্পষ্ট হচ্ছে ক্ষতচিহ্ন

নেমে গেছে বানের পানি স্পষ্ট হচ্ছে ক্ষতচিহ্ন

সভাপতি শওকত সম্পাদক মানিক

সভাপতি শওকত সম্পাদক মানিক

সংযোগ সড়ক ভেঙে দুর্ভোগে ৬ গ্রামবাসী

সংযোগ সড়ক ভেঙে দুর্ভোগে ৬ গ্রামবাসী

বাড়িভিটা হারিয়ে দিশেহারা তিস্তা পাড়ের মানুষ

বাড়িভিটা হারিয়ে দিশেহারা তিস্তা পাড়ের মানুষ

ভয়াবহ বন্যায় কৃষি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের সর্বনাশ

ভয়াবহ বন্যায় কৃষি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের সর্বনাশ

মাদরাসা শিক্ষার সংস্কার : একটি পর্যালোচনা

মাদরাসা শিক্ষার সংস্কার : একটি পর্যালোচনা