ঢাকা   বুধবার, ১৩ নভেম্বর ২০২৪ | ২৯ কার্তিক ১৪৩১

জ্বালানি তেল আমদানি কমেছে ২০ শতাংশ, উদ্বিগ্ন ব্যবসায়ীরা

Daily Inqilab অর্থনৈতিক রিপোর্টার

০৬ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:২৩ এএম | আপডেট: ০৬ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:২৩ এএম

 চলমান বৈশ্বিক সঙ্কট ও বাংলাদেশের আর্থিকখাতের দুর্বলতায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশের জ্বালানি খাত। এটি দেশে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। কারণ জ্বালনি ছাড়া শিল্পকারখানা থেকে শুরু দৈনন্দিন সবকিছুইতেই অচলাবস্থা নেমে আসে। জ্বালানির দাম বাড়ায় বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা সক্ষমতায় পিছিয়ে পড়ছেন স্থানীয় উদ্যোক্তারা। এদিকে দেশের আমদানি ব্যয় প্রায় অপরিবর্তিত থাকলেও ২০২৩ সালে বাংলাদেশের জ্বালানি তেল আমদানির পরিমাণ কমেছে প্রায় ২০ শতাংশ। যার প্রভাব পড়েছে দেশের শিল্পখাতে। থমকে আছে নতুন কর্মসংস্থান। এ অবস্থায় চলমান ডলার সংকটের প্রেক্ষাপটে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছেন ব্যবসায়ীরা। তাদের ভাষ্য হলো সরকার ২০৪১ সাল নাগাদ দেশে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা তৈরির পরিকল্পনা নিয়েছে। এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিচালনা করতে বিপুল পরিমাণ জ্বালানি আমদানি করতে হবে। এজন্য প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান করতে গিয়ে বিপাকে পড়ার জোর আশঙ্কা রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০২৩ সালে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের দাম উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়েনি, কিছু ক্ষেত্রে বরং কমেছে। তবে এ সময় ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে ২০ শতাংশের বেশি, যার আমদানি ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে গেছে। আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় সরকার কৃচ্ছ্রতা পদক্ষেপ অবলম্বন করে, যার অংশ হিসেবে অন্যান্য পণ্যের মতো জ্বালানি আমদানি কমে যায়। এর ফলে লোডশেডিংয়ের কারণে দেশের শিল্প খাতের পাশাপাাশি বাসাবাড়ির গ্রাহকদেরও ভুগতে হয়েছে। পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, টাকার অবমূল্যায়ন হওয়ায় আমদানি খরচ বেড়েছিল। কিন্তু পর্যাপ্ত ডলারের অভাবে জ্বালানি তেল আমদানি কমেছে, যার জন্য শিল্প ও মানুষকে ভুগতে হয়েছিল। সামনের দিনগুলোতে এ সমস্যা আরও বাড়বে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন আহসান এইচ মনসুর।

চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজের তথ্য অনুসারে, ২০২২ সালে ১ দশমিক ০৪ কোটি টন জ্বালানি তেল আমদানিতে বাংলাদেশ খরচ করেছে ৪৭ হাজার ৭৮৯ কোটি টাকা। কিন্তু ২০২৩ সালে ৮২ দশমিক ৬৬ লাখ টন জ্বালানি তেল আমদানিতে খরচ হয়েছে ৪৭ হাজার ২৬১ কোটি টাকা। অর্থাৎ ২০২২ সালের সমপরিমাণ আমদানি ব্যয়ে ২০ শতাংশ কম জ্বালানি তেল আমদানি হয়েছে ২০২৩ সালে। আমদানি ব্যাপকভাবে কমে গেলেও মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাওয়ার কারণে খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় আমদানি ব্যয় কমেনি। আমদানি করা জ্বালানির মধ্যে রয়েছে হাই স্পিড ডিজেল তেল, ফার্নেস তেল, পেট্রোলিয়াম তেল এবং বিটুমিন খনিজ ও অপরিশোধিত তেল থেকে প্রাপ্ত তেল। আমদানিকৃত জ্বালানি তেল বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন, সার উৎপাদন, পরিবহন এবং কৃষিসহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হয়।

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের পরিচালক অনুপম বড়ুয়া বলেন, ব্যবহার কমে যাওয়া ও টাকার অবমূল্যায়নসহ বেশ কয়েকটি কারণে জ্বালানি তেল আমদানি কমেছে। তিনি বলেন, কনজাম্পশন কমে যাওয়ায় আমাদের আমদানি [বিপিসির মাধ্যমে] ১০ শতাংশের মতো কমেছে। ডলার সঙ্কটও একটি ইস্যু। তবে এটি বড় কারণ নয়। কেননা কম আমদানির কারণে তো কোনোকিছু বন্ধ নেই।

যদিও কাস্টমস কর্মকর্তারা জানান, একই সময়ে ২০ শতাংশ আমদানি কমলেও বর্ধিত মূল্যের কারণে তা রাজস্ব আদায়ে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেনি। বরং আগের বছরের তুলনায় ৫০ কোটি টাকা বেশি আয়কর আদায় হয়েছে, যার পরিমাণ ১২ হাজার কোটি টাকার বেশি। দেশের আমদানিকৃত জ্বালানি তেলের প্রায় পুরোটাই চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে আসে, যার অ্যাসেসমেন্ট করা এবং রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব পালন করে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজ।

এদিকে এফবিসিসিআই’র প্রাক্কলনে সরকারের গ্যাসের চাহিদা ও জ্বালানি আমদানি বিষজোনানো হয়েছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছর নাগাদ দেশে প্রাকৃতিক গ্যাসের চাহিদা দাঁড়াবে দৈনিক ৫ হাজার ৭৯ মিলিয়ন ঘনফুট, যা বর্তমান চাহিদার চেয়ে প্রায় ৬ শতাংশ বেশি। দেশে গ্যাসের মজুদ কমে যাওয়ায় এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে। তবে বর্তমানে চাহিদা পূরণে কেবল আমদানিনির্ভরতা থাকলে ২০৩০ সাল নাগাদ শুধু জ্বালানি আমদানিতেই ব্যয় হবে ২৪ থেকে ৩০ বিলিয়ন ডলার।

দেশে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয়ের বড় অংশই ব্যয় হয় বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জ্বালানি আমদানিতে। এক প্রক্ষেপণে দেখা যায়, ২০২৭ সাল নাগাদ দেশে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সক্ষমতা হবে গ্যাসভিত্তিক ১৬ হাজার ৬৫০ মেগাওয়াট, ফার্নেস অয়েলভিত্তিক ৬ হাজার ৪৯৭ মেগাওয়াট ও কয়লাভিত্তিক ৭ হাজার ৯১ মেগাওয়াট। পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সক্ষমতা হবে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট। নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা তৈরি হবে ৫৯১ মেগাওয়াট। আমদানি করা হবে ২ হাজার ৭৬০ মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎ। এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জ্বালানি চাহিদা ও বিদ্যমান বাজার দর হিসাব করলে জ্বালানি আমদানিতে ব্যয় বাড়বে ২০ বিলিয়ন ডলারের বেশি। এ অতিরিক্ত ব্যয়ের ৬-৭ বিলিয়ন ডলার যাবে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর জন্য। এছাড়া কয়লায় ৫ বিলিয়ন এবং আমদানিনির্ভর বিদ্যুৎ, ফার্নেস অয়েল, নিউক্লিয়ার ফুয়েলের জন্য ব্যয় বাড়বে ৯ বিলিয়ন ডলার।

অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০২৩ অনুযায়ী, দেশে ২০২৫-২৬ অর্থবছর নাগাদ গ্যাসের চাহিদা দাঁড়াবে সাড়ে পাঁচ হাজার মিলিয়ন ঘনফুটের বেশি। বিদ্যমান গ্যাসের সরবরাহ সক্ষমতা রয়েছে তিন হাজার মিলিয়ন ঘনফুটের কিছু বেশি (এলএনজিসহ)। স্থানীয় গ্যাসের সরবরাহ একই পরিমাণ থাকলে দৈনিক আরো প্রায় আড়াই হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের ঘাটতি তৈরি হবে।

বিদ্যুৎ, শিল্পসহ অন্যান্য খাতের জ্বালানি চাহিদা মেটাতে আমদানি করা হচ্ছে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি), কয়লা ও জ্বালানি তেল। এসব খাতে প্রতি বছর ক্রমবর্ধমান হারে দেশে জ্বালানি চাহিদা বাড়ছে। সরকারের জ্বালানি ব্যয়ের প্রাক্কলন ধরে ব্যবসায়ীরা বলছেন, ২০৩০ সাল নাগাদ দেশে জ্বালানি আমদানিতে ব্যয় হবে ২৪ থেকে ৩০ বিলিয়ন ডলার।

চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজসের ডেপুটি কমিশনার মো. বদরুজ্জামান মুনশি বলেন, আমদানি কমলেও বর্ধিত মূল্যের কারণে রাজস্ব আদায় কমেনি, বরং কিছুটা বেড়েছে। এছাড়া ট্যারিফ ভ্যালুর পরিবর্তে ইনভয়েস ভ্যালুতে বর্ধিত দরের বিষয়টিকে বিবেচনায় নেওয়াও এ খাত থেকে রাজস্ব আদায় বাড়ার কারণ।


বিভাগ : বাংলাদেশ


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

মাকে হত্যা করে লাশ ডিপ ফ্রিজে রাখা ছেলে গ্রেফতার
সীমান্তে ৪ বাংলাদেশী নারী আটক
সিলেটে মতবিনিময় সভা করলো নেজামে ইসলাম পার্টির
১৭ বছরের ফ্যাসিস্ট আওয়ামী শাসন থেকে মুক্ত হলো ময়মনসিংহ জিলা মটর মালিক সমিতি
ফরিদপুরে পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগে ভুয়া পরীক্ষার্থী আটক
আরও

আরও পড়ুন

লিসান্দ্রো মার্তিনেজকে বিশ্বকাপ বাছাইয়ে পাচ্ছেনা আর্জেন্টিনা

লিসান্দ্রো মার্তিনেজকে বিশ্বকাপ বাছাইয়ে পাচ্ছেনা আর্জেন্টিনা

খালাস পেলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সাবেক এপিএস অপু

খালাস পেলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সাবেক এপিএস অপু

পশ্চিমবঙ্গ ও ঝাড়খণ্ডে ব্যাপক তল্লাশি

পশ্চিমবঙ্গ ও ঝাড়খণ্ডে ব্যাপক তল্লাশি

আমদানি বিল পরিশোধের পর রিজার্ভ কমে ১৮.৪৬ বিলিয়ন ডলার

আমদানি বিল পরিশোধের পর রিজার্ভ কমে ১৮.৪৬ বিলিয়ন ডলার

অফিস-আদালতসহ সর্বত্রই দুঃশাসনের চিহ্ন রাখা উচিত নয় : রিজভী

অফিস-আদালতসহ সর্বত্রই দুঃশাসনের চিহ্ন রাখা উচিত নয় : রিজভী

পার্লামেন্টে ক্ষমা

পার্লামেন্টে ক্ষমা

ক্ষেপণাস্ত্র হামলা

ক্ষেপণাস্ত্র হামলা

ডোনাল্ড ট্রাম্পের নিরাপত্তায় নতুন প্রহরী: রোবট কুকুর!

ডোনাল্ড ট্রাম্পের নিরাপত্তায় নতুন প্রহরী: রোবট কুকুর!

লুকিয়ে প্রেমিকের সঙ্গে দেখা করায় মিস ইউনিভার্স প্রতিযোগিতা থেকে বহিস্কার

লুকিয়ে প্রেমিকের সঙ্গে দেখা করায় মিস ইউনিভার্স প্রতিযোগিতা থেকে বহিস্কার

মাকে হত্যা করে লাশ ডিপ ফ্রিজে রাখা ছেলে গ্রেফতার

মাকে হত্যা করে লাশ ডিপ ফ্রিজে রাখা ছেলে গ্রেফতার

সীমান্তে ৪ বাংলাদেশী নারী আটক

সীমান্তে ৪ বাংলাদেশী নারী আটক

গুলি বর্ষণকারী ৭৪৭ পুলিশ শনাক্ত গ্রেফতারের উদ্যোগ নেই

গুলি বর্ষণকারী ৭৪৭ পুলিশ শনাক্ত গ্রেফতারের উদ্যোগ নেই

সিলেটে মতবিনিময় সভা করলো নেজামে ইসলাম পার্টির

সিলেটে মতবিনিময় সভা করলো নেজামে ইসলাম পার্টির

স্বামী স্ত্রীকে শর্ত লাগিয়ে তালাক দেওয়ার পর শর্ত উঠিয়ে নেওয়া প্রসঙ্গে।

স্বামী স্ত্রীকে শর্ত লাগিয়ে তালাক দেওয়ার পর শর্ত উঠিয়ে নেওয়া প্রসঙ্গে।

আন্তঃনগর ট্রেনের সময় পরিবর্তন করুন

আন্তঃনগর ট্রেনের সময় পরিবর্তন করুন

জনপ্রশাসনে মেধাশূন্যতা : কারণ ও প্রতিকার

জনপ্রশাসনে মেধাশূন্যতা : কারণ ও প্রতিকার

ভারতীয় হেজিমনি ও আওয়ামী লীগের আত্মঘাতী রাজনীতি

ভারতীয় হেজিমনি ও আওয়ামী লীগের আত্মঘাতী রাজনীতি

বিতর্ক পরিহার করতে হবে

বিতর্ক পরিহার করতে হবে

ইসরাইলি বাহিনী হিজবুল্লাহর সঙ্গে অস্ত্রবিরতিতে যাবে না

ইসরাইলি বাহিনী হিজবুল্লাহর সঙ্গে অস্ত্রবিরতিতে যাবে না

নির্বাচনে হারার পর প্রথমবার জনসমক্ষে বাইডেন ও কমলা

নির্বাচনে হারার পর প্রথমবার জনসমক্ষে বাইডেন ও কমলা