সাবেক হুইপ আতিকের দুর্নীতিসহ নানা অভিযোগ
১৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:১০ এএম | আপডেট: ১৮ নভেম্বর ২০২৪, ১১:০৯ এএম
শেরপুর-১ আসনের সাবেক এমপি ও হুইপ মো. আতিউর রহমান আতিকের দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার সময় শেরপুরে গড়ে ওঠেছিল একক সাম্রাজ্য। তার বিরুদ্ধে রয়েছে অনেক দুর্নীতি, অনিয়মের অভিযোগ। আর তার প্রভাবে কন্যা শারমিন রহমান অমি ছিলো অপ্রতিরোধ্য। তার প্রভাবে সরকারি কর্মকর্তারাও ছিলো অতিষ্ঠ। এদিকে আতিউর রহমান আতিক মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সার্টিফিকেট অর্জন করলেও এনিয়েও রয়েছে নানা প্রশ্ন। মাত্র ১২/১৩ বছর বয়সে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করা নিয়ে নিজ দলের নেতা মুক্তিযোদ্ধারাই নানা সময় প্রশ্ন তুলেছেন।
বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আতিউর রহমান আতিক। শেরপুর-১ (সদর উপজেলা) আসনের ছয়বারের সাবেক এই সংসদ সদস্য দুই মেয়াদে ছিলেন জাতীয় সংসদের হুইপ। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে ছিলেন শেরপুর জেলা ছাত্রলীগের সদস্য এবং শেরপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। দীর্ঘ সময় এমপি ও ক্ষমতায় থাকার সময় নিজ দলের অনেক ত্যাগী নেতাদের দল থেকে সরিয়ে দিয়ে জেলা ও উপজেলার রাজনীতিতে গড়ে তোলেন তার একক আধিপত্য। তার এ একক আধিপত্য বজায় রাখতে বিরোধী রাজনীতিকে দমন করতে নানা কৌশল ও ক্ষমতার দাপট খাটাইতেন। আর এই একক আধিপত্য ধরে রাখতে নিজের স্ত্রী, মেয়ে, ভাই, ভাতিজা এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের দলীয় পদ ও মুক্তিযোদ্ধা কোঠায় সরকারি চাকরি দেওয়ার পাশাপাশি বানিয়েছেন জনপ্রতিনিধিও। এমনকি ডজন-খানেক বাণিজ্যিক স্কুল-কলেজে সরকারি অর্থায়নে ভবন নির্মাণ করে নীতিমালা বহির্ভূতভাবে সেগুলোর নামকরণ করেছেন নিজের নামে। প্রভাব খাটিয়ে নিজের ছোট ভাইকে ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান বানান আতিউর রহমান আতিক। আর স্ত্রী শামছুন্নাহার শান্তাকে শেরপুর শহরের চন্দ্রকান্ত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা এবং বড় মেয়ে শারমিন রহমান অমিকে পরিবার পরিকল্পনা অফিসের কর্মকর্তা পদে বসান।
শারমিন রহমান অমি সরকারি চাকরির পাশাপাশি বাবার হয়ে টেন্ডার সিন্ডিকেট, চাঁদাবাজি এবং ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দলীয় প্রতীক বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করতেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এই অমির সঙ্গে কেউ কোনো কাজে দেখা করতে গেলে হাতের চুড়ি বা গলার চেইনের মতো সোনার কোনো না কোনো অলংকার উপহার হিসেবে নিয়ে যেতে হতো বলে এলাকায় জনশ্রুতি রয়েছে। আর কাজ শেষের পর উপঢৌকন হিসেবে কাজের ধরন অনুযায়ী নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা দিতে হতো। অমির দাপটে কেউ মুখ খুলতে সাহস পেতোনা। সরকারি কর্মকর্তারা ছিলো তার ভয়ে তটস্থ। অন্যদিকে ভাতিজা আশিককে দিয়ে আতিক করিয়েছেন নিয়োগ বাণিজ্য ও জমি দখল। সদর উপজেলা পরিষদের পরবর্তী নির্বাচনে প্রার্থী করতে সব রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মসূচিতে মেয়ে অমিকে সঙ্গে রাখতেন আতিক। স্ত্রী শান্তা নিয়োগ বানিজ্য ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বদলি বানিজ্য নিয়ন্ত্রণ করতো।
আতিক এমপি প্রতিবারই নানাভাবে অনিয়মের মাধ্যমে ও একটি বিশেষ এলাকায় সিল মেরে এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। এজন্য তিনি গড়ে তুলেছিলেন নির্বাচনী সিন্ডিকেট। তার পছন্দের লোকদের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক, অধ্যক্ষ, সুপার, সহকারী প্রধান পদে নিয়োগ দিয়েছিলেন। এদেরকে দেয়া হতো বিভিন্ন কেন্দ্রের নির্বাচনের দায়িত্ব। দিনশেষে নির্বাচনের ফলাফল তার পক্ষে আনতেন এসব কর্মকর্তারাই। এসব প্রতিষ্ঠান প্রধানরা এখনো বহাল তবিয়তেই আছেন।
ক্ষমতার অপব্যবহারের পাশাপাশি সম্পদ ও নামেরও কাঙাল ছিলেন আতিউর রহমান আতিক। নিজের ও স্ত্রী-সন্তানদের নামে বাড়ি, গাড়ি, শেরপুর এবং ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় জমি, ফ্ল্যাট ক্রয়, মার্কেট তৈরি, বাগানবাড়িসহ শত শত কোটি টাকার সম্পদ গড়েছেন তিনি।
তার রয়েছে শেরপুরের তিন আনি বাজারে বিলাসবহুল বাড়ি, গ্রামে ৩০ একর জমিতে বাগানবাড়ি, বনশ্রীসহ ঢাকার দুটি আবাসিক এলাকায় পাঁচটি প্লট, রাজউকের প্লট এবং উত্তরা, ধানমন্ডি ও গুলশানে তিনটি ফ্ল্যাট। সরকারি খাসজমি দলীয় নামে বরাদ্দ নিয়ে তা নিজের কাজে ব্যবহার করছেন। শেরপুরে বিভিন্ন বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ করে তিনি সোনালী ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, আয়কর অফিসসহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে তার ভবনে ফ্লোর ভাড়া নিতে বাধ্য করেছেন। শেরপুর সদর উপজেলায় দুরুঙ্গি বিলে ৬০ একর ফসলি জমি এবং তেঁতুলিয়া এলাকায় ৫ একর জমি রয়েছে তার। ঢাকার লালমাটিয়ায় একটি দামি ফ্ল্যাট এবং নিকুঞ্জ ও আরেকটি আবাসিক এলাকায় ২টি ফ্ল্যাট রয়েছে সাবেক এই এমপির।
এছাড়া নিজের, স্ত্রী ও মেয়েদের নামে বিভিন্ন ব্যাংকে এফডিআর এবং স্ত্রী-কন্যার শতভরি স্বর্ণালংকার রয়েছে। অথচ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় (২০১৮ সালের ২৮ নভেম্বর) দাখিল করা হলফ নামায় বাস্তবতার সঙ্গে রয়েছে আকাশ-জমিন ফারাক।
ওই হলফ নামায় বাৎসরিক আয় হিসেবে কৃষি খাত থেকে ১১ লাখ ৪ হাজার টাকা, সম্মানী ভাতা হিসেবে ১১ লাখ ৪ হাজার টাকা এবং মাছ চাষ থেকে ৩০ লাখ টাকা আয় উল্লেখ করেন। এছাড়া অস্থাবর সম্পদ হিসেবে নিজের নামে ২ কোটি ৩২ লাখ টাকা, স্ত্রীর নামে ১৮ লাখ ১৪ হাজার টাকা এবং বিভিন্ন সময় তার স্ত্রী ১০০ ভরি স্বর্ণলংকার উপহার পেয়েছেন বলে উল্লেখ করেন। স্থাবর সম্পদ হিসেবে নিজের নামে ৬ কোটি ২৪ লাখ টাকা এবং স্ত্রীর নামে ২১ লাখ ৯ হাজার টাকার কথা উল্লেখ করেছেন। শুধুমাত্র জমি কেনার কাগজপত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সাবেক এমপি আতিক নিজের ক্ষমতা এবং কর্মকর্তাদের বদলির ভয় দেখিয়ে সাব-রেজিস্ট্রি অফিস ও ভূমি অফিসকে দিয়ে শেরপুর সদরের বিভিন্ন এলাকায় ১৯৯৭ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত সময়ে কেনা, আমমোক্তারনামার মাধ্যমে গ্রহণ ও হেবাসহ বিভিন্ন ধরনের অন্তত ২১টি দলিল সম্পাদিত করেছেন। অভিযোগ রয়েছে, অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থ দিয়ে এসব জমি কিনেছেন তিনি। সেসব সম্পদের বর্তমান বাজারমূল্য আনুমানিক প্রায় শতকোটি টাকা। এর মধ্যে ৮৮৩৯ নম্বর দলিলে বারঘরিয়া মৌজায় এসএ ৬৫ ও বিআরএস ৮৭ খতিয়ানের এসএ ৯৪ এবং বিআরএস ১৬৪ নম্বর দাগের ১২৭ কাতে ৩৫ শতাংশ জমি লিখে দেন আব্দুল বারিক ও মৃত নছিমদ্দিন। এছাড়াও ৮৯১০ নম্বর দলিলে আন্দারিয়া এলাকার কবিরপুর আন্দারিয়া মৌজার এসএ ১২৬৫ ও বিআরএস ১২৩০ খতিয়ানের এসএ ২৯ এবং বিআরএস ২ দাগের ২২ কাতে ১০ দশমিক শতক এবং এসএ ২৯ এবং বিআরএস ৩ দাগের ২৯ কাতে ১০ শতক মোট ২০ শতক জমি আতিকের নামে লিখে দেন আবুল হোসেন ও আব্দুল সেখ।
সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানান, ২০১৭ সালে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সাবেক এমপি আতিকের বিরুদ্ধে একটি মামলা করলেও অদৃশ্য কারণে তা খুব বেশি আগায়নি। পরের বছরেরই জুলাই মাসে তাকে অব্যাহতি দেয় দুদক। জনশ্রুতি রয়েছে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের প্রিয়ভাজন হওয়ায় সব অভিযোগ থেকে সহজেই রেহাই পেতেন তিনি।
এছাড়াও তার সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা চারদলীয় জোট প্রার্থী জামায়াত নেতা কামারুজ্জামানকে যুদ্ধাপরাধী বানিয়ে তার লোকজন দিয়ে মিথ্যা সাক্ষী দেওয়ায়ে ফাঁসিতে ঝুলানোর অভিযোগ করেছেন কামারুজ্জামানের স্বজন ও জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে শেরপুরে ছাত্রহত্যার ঘটনায় হওয়া মামলার আসামি হওয়ায় গত ৫ আগস্ট রাষ্ট্রক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর স্বপরিবারে আত্মগোপনে চলে যান সাবেক হুইপ আতিক। যে কারণে অনিয়ম-দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগের বিষয়ে তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
এ ব্যাপার শেরপুর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আলহাজ্ব মোঃ হযরত আলী আতিউর রহমান আতিকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ করে বলেন, ‘বিগত পতিত স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক হুইপ আতিক ও তার দোসররা মিলে আমার বিরুদ্ধে ঢাকা এবং শেরপুরে ৭৫টি মামলা দিয়েছিলো। আমার মিল, ফ্যাক্টরি
একাধিকবার ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করে দিয়েছে। আমার মেয়েকে চাকরিচ্যুত করেছে। আমার নির্বাচনী এলাকার জনগণের পাশে, নিজ বাড়িতে, দলীয় কার্যালয়ে, রাজনৈতিক কোনো অনুষ্ঠানে এমনকি ঈদেও নিজ এলাকায় আসতে দেওয়া হয়নি। পুলিশের হয়রানি ও গ্রেপ্তার আতঙ্কের মধ্য দিয়ে দলীয় কার্যক্রম চালাতে হয়েছে আমাকে।
বিভাগ : বাংলাদেশ
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
বেতনের দাবিতে বেক্সিমকো শ্রমিকদের তৃতীয় দিনের মতো অবরোধ, সড়কে যৌথবাহিনী
১৩৭ একর জায়গাজুড়ে নির্মিত হলমার্ক এখন ধ্বংসস্তূপ, সব যন্ত্রপাতি লুট
লক্ষ্মীপুরের বিশিষ্ট আলেম হযরত মাওলানা আব্দুল হান্নান আর নেই!
ঢাবিতে ভর্তি: ১৪ দিনে সোয়া দুই লাখ আবেদন, বেশি বিজ্ঞানে
কখনো ভাবিনি নারীদের অধিকার এত সহজে হারিয়ে যাবে : মালালা
কিশোরগঞ্জে যুবকের ছুরিকাঘাতে ব্যবসায়ী নিহত
অস্ট্রিয়ার জাতীয় দিবসে অনারারি কনস্যুলেট, ঢাকার শুভেচ্ছা!
গণহত্যার মামলায় গ্রেফতার দেখানো হলো ১৩ আসামিকে
ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলায় নিহত ১০ এবং ব্যাপক বিদ্যুৎ বিপর্যয়
আন্তর্জাতিক বিজ্ঞাপনে নজর কেড়েছে শাহরুখ খান
কেরানীগঞ্জ প্রেস ক্লাব থেকে রায়হান ও ইউসুফ বহিষ্কার
যশোর শহরে ফের ভেজাল লুব্রিকেন্ট কারখানার সন্ধান, জরিমানা ও কারখানা সীলগালা
আন্দোলনে আহত ৭ জনকে বিনামূল্যে চিকিৎসা দেবে তুরস্ক: স্বাস্থ্য উপদেষ্টা
যশোরে যৌনকর্মীর সাথে মোবাইলে কথা বলায় বাস হেল্পার বাপ্পি খুন, আটক ১
‘তুমি আমার রাজা নও’ বিতর্কিত প্রতিবাদে অস্ট্রেলিয়ার সিনেটরকে নিন্দা
চার ঘণ্টা পর সোনারগাঁওয়ের আগুন নিয়ন্ত্রণে
ইঞ্জিনিয়ার বায়েজিদ হত্যা মামলায় বিএনপির আহ্বায়ক চাঁদ রিমান্ডে
পরিবেশ রক্ষায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের অ্যামাজন সফর
চলতি বছর শতাধিক বেশি বিদেশির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছে সউদী আরব
৮০ বছর পর সরিয়ে নেয়া হচ্ছে জাপানি সৈন্যদের দেহাবশেষ