বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শরীরে ৫ শতাধিক বুলেট, যন্ত্রনায় চলাফেরা করেন লিটন
১৯ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০২ পিএম | আপডেট: ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০২ পিএম
নিজের আয় দিয়ে পড়ালেখা চালাতেন লিটন (২০)। অভাবের সংসারে মাঝে মাঝে সংসারের খরচও চালাতে হতো। এখন পড়ালেখা তো বন্ধ, আবার সংসারে অভাবও বেড়েছে। পরিবার চালাতেই হিমশিম, সেখানে চিকিৎসা খরচ কীভাবে চলবে- সে চিন্তায় রয়েছেন লিটনের মা, বাবা। অন্যদিকে লিটন পড়ালেখা ও সুস্থভাবে বেঁচে থাকার চিন্তায় সময় পার করছেন। টাকার অভাবে উন্নত চিকিৎসা হচ্ছে না তার।
গত ৪ আগস্ট ঠাকুরগাঁও শহরের কোর্ট চত্বর এলাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচিতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হন লিটন। সেই গুলিতে ঝাঁঝরা হয়েছিল লিটনের পুরো শরীর। চিকিৎসকরা বলছেন, লিটনের শরীরে এখনো ৫শর বেশি গুলি রয়ে গেছে।
লিটনের বাড়ি ঠাকুরগাঁও পৌরশহরের দক্ষিণ সালান্দর পাড়ার মিলন নগর মহল্লায়। বাবার নাম ইয়াকুব আলী। তিন ভাইয়ের মধ্যে লিটন সবার ছোট। তিনি ঠাকুরগাঁও সরকারি কলেজের অনার্স প্রথম বর্ষের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী। একটি ওষুধের দোকানে চাকরি করে পড়ালেখার খরচ চালান লিটন।
সরজমিনে লিটনের বাড়ি গিয়ে দেখা যায়, বিছানায় শুয়ে লিটন। তার পাশে হতাশা আর উদ্বিগ্ন হয়ে বসে আছেন তার মা। সন্তান সুস্থ হতে পারবে কি না, এ নিয়ে চিন্তিত তারা। মা লিলি বেগমের কপালে চিন্তার ভাঁজ, আর চোখ বেয়ে ঝরছিল অশ্রু।
পুরো শরীরজুড়ে গুলির ব্যথায় ছটফট করতে থাকা লিটন দৈনিক ইনকিলাব জেলা সংবাদদাতা মাসুদ রানা পলক কে জানান, গুলি লাগার পর শরীরের প্রতিটি জায়গা যেন অবশ হয়ে আছে। কোনো কাজ করতে পারি না, যা কিছু করতে হয়, একজন মানুষের সহযোগিতায় করতে হয়। বেশিক্ষণ দাঁড়িয়েও থাকতে পারি না, বসেও থাকতে পারি না। আবার গরম লাগলে ব্যথার তীব্রতা বেড়ে যায়। সারাক্ষণ বাতাস ও ঠান্ডা জায়গাতে থাকতে হয়। রাতে ঘুমাতে গেলে মাথায় বিদ্ধ গুলির যন্ত্রণায় ঘুম হয় না। বাবালিশও মাথায় দেওয়া যায় না। এখন সরকারের কাছে একটি চাওয়া, আমার গুলি যেন বের করে দেওয়া হয়। ফের আমি যেন স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারি।
সেদিনের রোমহর্ষক ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে তিনি জানান, ছাত্রদের ডাকা সব কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছিলেন। গত ৪ আগস্ট দুপুরে শহরের কোর্ট চত্বরের পূর্ব পাশের একটি গলিতে শিক্ষার্থীদের একটি অংশ অবস্থান করে। এ সময় পুলিশ তাদের গুলি না করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সেখান থেকে চলে যাওয়ার কথা বলে। এ সময় চলে যাওয়ার সময় পেছন দিক থেকে লিটনের মাথায় গুলি করে পুলিশ। গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। কিছু সময় জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। পরে জ্ঞান ফেরার পর উঠে দাঁড়ালে পুলিশ তাকে আবারও খুব কাছ থেকে এলোপাতাড়ি ছররা গুলি করতে থাকে। এতে তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত সমস্ত শরীর গুলিবিদ্ধ হয়।
এ সময় কোনোরকম হামাগুড়ি দিয়ে পাশের একটি বাড়িতে আশ্রয় নেন। ওই বাড়ির লোকজন লিটনের রক্তঝরা মাথা কাপড় দিয়ে বেঁধে দেন। বাড়ির লোকজনকে হাসপাতালে নেওয়ার জন্য বারবার আকুতি জানাচ্ছিলেন লিটন। তবে তাকে পুলিশের ভয়ে হাসপাতালে নেননি কেউ। একপর্যায়ে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা তাকেসহ গুলিবিদ্ধ অন্যদের হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যায় বলে জানান লিটন। সেখানেও ভালো চিকিৎসা পাননি তিনি। পরে ওইদিন শহরের একটি ক্লিনিকে অস্ত্রোপচার করে ১২টি গুলি বের করা হয়।
তখন পুলিশ ও ছাত্রলীগের ভয়ে ক্লেনিক ছাড়তে হয় তাকে। পরে ৬ তারিখ পরিবারের সদস্যদের সহযোগিতায় রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয় তাকে। সেখানে তিন দিন চিকিৎসার পর রংপুর সেনাবাহিনী পরিচালিত সিএমএইচ হাসপাতালে দুই সপ্তাহ ভর্তি থাকেন।
লিটনের মা লিলি বেগম দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, আমাদের অভাবের সংসার,কোনোরকম ডাল-ভাত খাইয়ে জীবন যায়। বিছানায় ব্যথায় কাতরাচ্ছে ছেলেটা। এখন ভালো চিকিৎসা করানোর মতো কোনো টাকা-পয়সা আমাদের হাতে নাই’ এ বলে দুচোখের পানি ছেড়ে দেন তিনি।
লিটনের বাবা মো: ইয়াকুব দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, আমিতো বাসায় ছিলাম না বাসায় আসে শুনছি আমার ছেলেটা গুলিখাইছে। আমরা গরীব মানুষ আমরা ছেলেটা যেহেতু গুলি খাইছে ওর চিকিৎসা করে সরকার ওর একটা চাকরির ব্যবস্থা করলে আমাদের ভাল হয়।
লিটনের এলাকাবাসী রাজিব ইসলাম বলেন, লিটন এখন ব্যথায় কাতর। অনেক কষ্ট করে ছেলেটা নিজের পড়ালেখার খরচ চালাত। এখন চাকরিও নেই, আবার সংসারে অভাব। সবাই একটু সহযোগিতা করলে লিটন আবার আগের অবস্থায় ফিরতে পারবে।
লিটনের বর্তমান চিকিৎসক ঠাকুরগাঁও জেনারেল হাসপাতালের সার্জারি বিশেষজ্ঞ ডা. শিহাব মাহমুদ শাহরিয়ার বলেন, ছররা গুলি যদি খুব অসুবিধা না হয়, তাহলে এসব গুলি বের করতে অনুৎসাহিত করি। কারণ মাথায় যে ১৫টি গুলি আছে, এর জন্য ১৫ বার তার অস্ত্রোপচার করতে হবে। এত বিপুলসংখ্যক গুলি বের করা একেবারে সম্ভব নয়।
ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসক ইশরাত ফারজানা এর সাথে সাক্ষাতে কথা হলে দৈনিক ইনকিলাব জেলা সংবাদদাতা মাসুদ রানা পলক কে জানান, জুলাই আগষ্টের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যারা আহত হয়েছেন তাদের খোজ খবর আমরা নিয়েছি। এবং তাদের মধ্যে যাদের চিকিৎসা ঠাকুরগাঁওয়ে সম্ভব হয়েছে তাদের চিকিৎসা ঠাকুরগাঁওয়ে করা হয়েছে। যাদের উন্নত চিকিৎসা করানো দরকার তাদের জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ঢাকায় পাঠিয়েছি কয়েকজন সিএমএইচ হাসপাতালে ও কয়েকজন পিজি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। এদর মধ্যে যারা অসচ্চল ছিল তাদের জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আর্থিক সহযোগীতা করানো হয়েছে। লিটনের সম্পর্কে আমরা খবর নিয়েছি। তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠিয়েছিলাম সেখানে তার চিকিৎসা করা হয়েছে। তার আরো উন্নত চিকিৎসা করানোর জন্য আর্থিক সহযোগীতা লাগলে জেলা প্রশাসন তার পাশে থাকবে।
বিভাগ : বাংলাদেশ
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
গাজায় শরনার্থীদের জন্য জাতিসংঘের খাদ্যবাহী ৯৭টি লরি লুট
সাবেক মন্ত্রী গোলাম দস্তগীরের পিএস গ্রেফতার
বগুড়ায় হাসপাতাল ভবন থেকে লাফিয়ে যুবকের আত্মহত্যা
রক্তপিপাসু মাকসুদের আমলনামা এবং নোংরামির ইতিবৃত্ত
গাজীপুরে সড়ক অবরোধ, দুর্ভোগ চরমে
জি-২০ সম্মেলনে গাজা ও লেবাননে যুদ্ধবিরতির আহ্বান
‘দিল্লিকে কিবলা বানিয়ে ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষা জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা’
সেন্টমার্টিনে পর্যটক যাতায়াতে বিধি-নিষেধ প্রত্যাহারের দাবীতে কক্সবাজারে মানববন্ধন
কোনো ব্যাংক বন্ধ হবে না: অর্থ উপদেষ্টা
কেরানীগঞ্জে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা আন্দোলনের প্রতিনিধির উপর হামলার প্রতিবাদে সংবাদ সম্মেলন
জার্মানি ও ফিনল্যান্ডের অন্তঃসামুদ্রিক কেবল বিচ্ছিন্ন
চিরিরবন্দরে ব্রীজের নিচ থেকে মরদেহ উদ্ধার
দীপু মনির সাম্রাজ্য চাঁদপুর ছিল অনিয়ম দুর্নীতিতে নিমজ্জিত
রাশিয়ার হুঁশিয়ারি,যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত করলে পাল্টা জবাব দেবে মস্কো
বায়তুল মোকাররমে বিশ্বের সর্ববৃহৎ আন্তর্জাতিক ক্বিরাত সম্মেলন ১৯ নভেম্বর
কুষ্টিয়ায় ৮০ লাখ টাকার কোকেন উদ্ধার করল বিজিবি
এই দিন দিন না, আরও দিন আছে’ : আদালতে গণহত্যাকারী কামরুলের দম্ভোক্তি
পোশাক কারখানায় নৈরাজ্য সৃষ্টিতে পরাজিত ফ্যাসিস্টদের ইন্ধন রয়েছে- অরবিন্দু বেপারী বিন্দু
নিউজিল্যান্ডের রাজধানী ওয়েলিংটনে মাওরি আদিবাসীদের বিক্ষোভ
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকের আশ্বাসে সড়ক ছাড়লেন সাদপন্থীরা