যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে দক্ষিণাঞ্চলের ১৩২ নদ-নদী অস্তিত্ব সংকটে
১৪ জানুয়ারি ২০২৫, ০১:০২ পিএম | আপডেট: ১৪ জানুয়ারি ২০২৫, ০১:০৫ পিএম
মূল বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির অভাবের সাথে সীমান্তের ওপারে অভিন্ন নদ-নদী সমুহের প্রবাহ নিয়ন্ত্রন সহ জলবায়ু পরিবর্তনে বরিশাল সহ দক্ষিণাঞ্চলের ছোট বড় ১৩২টি নদ-নদীতে নাব্যতা সংকট ক্রমশ প্রকট হচ্ছে। এমনকি প্রবাহ হ্রাসের ফলে সাগরের নোনা পানি বরিশাল অতিক্রম করে চাঁদপুরের ভাটিতে মেঘনার মূল প্রবাহ পর্যন্ত পৌছে যাচ্ছে। ফলে এ অঞ্চলে লবনাক্ততার মাত্রাও ক্রমশ বাড়ছে। সাথে পানির স্তর ক্রমশ নিচে নামায় চলতি রবি মৌসুমে বরিশাল কৃষি অঞ্চলে প্রায় ৫ লাখ হেক্টরে বোরো ধান ও গম ছাড়াও ২০ হাজার হেক্টরে শীতকালীন সবজির আবাদ নির্বিঘœ সহ কাঙ্খিত উৎপাদন নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। নব্যতা সংকটে নদ-নদী সমুহের প্রবাহ ক্ষমতা হ্রাসের ফলে বর্ষা মৌসুম ও এর শেষভাগের অতি বর্ষণে ভাঙনের তীব্রতাও বাড়ছে।
ফলে দক্ষিণাঞ্চলের প্রায় কোটি মানুষের জন্য অতীতের আশির্বাদ এসব নদ-নদী যথাযথ সংরক্ষন ও উন্নয়ন সহ ভাঙন রোধে সময়োচিত পদক্ষেপের অভাবে ক্রমশ অভিশাপ হয়ে উঠছে। প্রায় ৫ হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ এসব নদ-নদী পরিবেশ সংকটে ক্রমশ ভয়াবহ বিপর্যয়ের সম্মুাখিন। একইসাথে বরিশাল সহ দক্ষিণাঞ্চলের ১৩২টি নদ-নদীর প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটার নৌপথের প্রায় ৫শ কিলোমিটারে নাব্যতা সংকট ভয়াবহ। অথচ সীমন্তের ওপারের অভিন্ন ৫৪টি নদ-নদীর প্রবাহের ৭৮ভাগই উত্তরবঙ্গ হয়ে বঙ্গোপসাগরে পৌছে দিচ্ছে দক্ষিণাঞ্চলের ছোট বড় ১৩২টি নদ-নদী। এমনকি নাব্যতা সংকটে বিপুল মৎস্য সম্পদের ভবিষ্যতও ক্রমশ বিপদের সম্মুখিন। মৎস্য সম্পদে প্রায় আড়াইলাখ টন উদ্বৃত্ত দক্ষিণাঞ্চলে সারা দেশের আহরিত ইলিশের ৭০ ভাগই উৎপন্ন ও আহরিত হয়ে থাকে। কিন্তু ক্রমাগত নব্যতা সংকটের রেশ ধরে প্রবাহ হ্রাস সহ নদী দুষনে নদী-নদী থেকে ইলিশ উপক’ল ছাড়িয়ে গভীর সমুদ্রে চলে যাবার প্রবনতা মৎস্য বিজ্ঞানীদের মাঝে উদ্বেগ সৃষ্টি করছে।
নদী বিশেষজ্ঞ এবং মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, বিভিন্ন বৈশিষ্ট ও বৈচিত্রপূর্ণ সম্পদে সমৃদ্ধ বঙ্গোপসাগর বিশে^র একমাত্র উপসাগর যেখানে সবচেয়ে বেশী নদী বিধৌত পানি প্রবেস করে। আর উজানেরপানি সাগরে বয়ে নিয়ে যেতে দক্ষিণাঞ্চলের মেঘনা,তেতুলিয়া,বলেশ^র ও বিষখালী,বুড়িশ^র, আগুনমুখা সহ বিভিন্ন নদ-নদী যেমনি বর্ষা মৌসুমে দু কুল ছপিয়ে প্রবাহিত হয়, তেমনি নদী ভাঙনও তীব্র আকার ধারন করে। কিন্তু একই নদীতে শুষ্ক মৌসুমে প্রবাহ হ্রাসে নাব্যতা সংকট নৌ যোগাযোগ সহ মৎস্য ও কৃষি ব্যাবস্থাকে বিপন্ন করছে।
দেশের ৩টি সমুদ্র বন্দর সহ সারা দেশের সাথে নৌ যোগাযোগও দক্ষিণাঞ্চলে প্রবাহিত মেঘনা, তেতুলিয়া, কির্তনখোলা, গাবখান চ্যানেল সহ বিভিন্ন নদ-নদীর ওপর নির্ভরশীল। এমনকি পায়রা ও মোংলা বন্দরের সাথে রাজধানী ঢাকা সহ উত্তরবঙ্গের নৌ যোগাযোগও দক্ষিণাঞ্চলের নদীগুলোর ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু মেঘনা সহ মাঝারী ও বড় নদ-নদীগুলোতে নাব্যতা সংকটে দক্ষিণাঞ্চলের সাথে চাঁদপুর হয়ে ঢাকা সহ উত্তরবঙ্গের এবং চট্টগ্রামের নৌ যোগাযোগ ক্রমশ ঝুকিপূর্ণ হয়ে পড়ছে। ভোলার ইলিশা থেকে লক্ষ্মীপুরের মজুচৌধুরীর হাট পর্যন্ত ২৮ কিলোমিটার প্রসস্ত ভাটি মেঘনায়ও ডুবো চরে ফেরি সহ সব ধরনের নৌযান চলাচল বিঘিœত হচ্ছে।
তবে প্রতি বছরই শুষ্ক মৌসুমে বরিশাল সহ দক্ষিণাঞ্চলের সিমিত কিছু নৌপথের নব্যতা ধরে রাখতে পরি অপসারন হলেও পুরো নদী ও তার প্রবাহকে সচল রাখতে কার্যকর ভূমিকা রাখছে না। অথচ এসব নদ-নদী পরিবশে, প্রতিবেশ এবং কৃষি ও মৎস্য সম্পদ সহ দক্ষিণাঞ্চলের কোটি মানুষের দৈনন্দিন জীবন ব্যবস্থার উন্নয়নের চাবিকাঠি হলেও তার সংরক্ষন ও উন্নয়নে যথাযথ ব্যবস্থা এখনো নিশ্চিত হয়নি।
অথচ সারা দেশের নদ-নদীর প্রবাহ সচল রাখতে সর্বাধিক কার্যকরি ভ’মিকা রাখছে দক্ষিণাঞ্চলের ১৩২টি নদ-নদী। কিন্তু যথাযথ সংরক্ষনের অভাবেই এসব নদ-নদীগুলোর অনেকগুলোই এখন অস্তিÍত্ব সংকটে। অথচ নৌপথে পন্য ও যাত্রী পরিবহন ব্যায় যেমনি অন্য যেকোন ক্ষেত্রের তুলনায় সাশ্রয়ী, তেমনি নিরাপদ।
২০২০ সালে ‘সেন্টার ফর এনভায়রমেন্টাল এন্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেস-সিইজিআইএস’ দক্ষিনাঞ্চলের ৩১টি নৌপথের ১ হাজার ৪৭৫ কিলোমিটার এলাকায় এক সমিক্ষায় নদীসমুহের নব্যতা বৃদ্ধি, প্রধান নৌপথের সাথে ঘাটসমুহের সংযোগ স্থাপন, সেচ ও পানি নিস্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন, জলজ সম্পদ বৃদ্ধি এবং নদী ভাঙন রোধের বিষয়ে প্রতিবেদন পেস করে । সমিক্ষাকৃত ৩১টি নৌপথের মধ্যে ৪৭০ কিলোমিটারে ৪২ মিলিয়ন ঘন মিটার পলি অপসারনের প্রস্তাব করা হয়েছিল। পাশাপাশি পরবর্তি ৭ বছরে সংরক্ষন ড্রেজিং-এর মাধ্যমেও আরো ১৭০ মিলিয়ান ঘন মিটার পলি অপসারনের প্রস্তাব করা হয়েছে।
মাঠ পর্যায়ের ঐ জরিপে ২৪৪টি লঞ্চঘাট চিঞ্হিত করে ট্রাফিক সমিক্ষা এবং স্থানীয় জনগনের চাহিদার আলোকে নতুন ঘাট স্থাপন ছাড়াও বিদ্যমান ঘাটসমুহের উন্নয়নেরও সুপারিশ করা হয়। সুপারিশে ৩টি নতুন লঞ্চঘাট নির্মান ছাড়াও বিদ্যমান ৬০টি লঞ্চ ঘাট, ১১টি কার্গো ঘাট, ৩৮টি খেয়াঘাট উন্নয়ন এবং ৩টি পর্যটন কেন্দ্রিক ঘাটের উন্নয়নের প্রস্তাব করা হয়েছিল।
কিন্তু পরবর্তিতে এ লক্ষ্যে কোন ‘উন্নয়ন প্রকল্প-প্রস্তাব,ডিপিপি’ অনুমোদিত হয়নি। তবে সিইজিআইএস-এর প্রস্তাবনার আলোকে একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের ডিপিপিতে দক্ষিণাঞ্চলের নৌপথের নদ-নদী সমুহের নাব্যতা উন্নয়ন এবং সংরক্ষন সহ লঞ্চ ঘাট সমুহের উন্নয়নে ৫ হাজার কোটি টাকারও বেশী প্রয়োজন হবে বলে জানা গেছে। তবে আরো বেশ কিছু বিষয় প্রকল্পটিতে অন্তভর্’ক্তির কথা বলা হলেও সে আলোকে এখনো বড় ধরনের অগ্রগতি নেই।
অপরদিকে শুষ্ক মৌসুমে উজানে প্রবাহ হ্রাস সহ গত কয়েকটি বছরের মূল বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির অভাবে দক্ষিণাঞ্চলের নদ-নদীতে লবনাক্ততার মাত্রাও ক্রমশ বাড়ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের একটি সূত্রের মতে ২০০৬ সালের জানুয়ারীতে বরিশালের কির্তনখোলা নদীতে লবনাক্ততার মাত্রা ছিল ৬১০-৬৩০ পার্সেন্ট পার মিলিয়ন-পিপিএম। সেখানে ২০১৭ সালের জানুয়ারীতে তা ৯১০ পিপিএম-এ পৌছে। ২০১৮ সালে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও ’১৯ সালে একই নদীতে লবনাক্ততার মাত্রা আবার ৯শ পিপিএম-এ বৃদ্ধি পায়। কিন্তু একই বছর ডিসেম্বরের পর থেকে দক্ষিণাঞ্চলের নদ-নদীতে লবনাক্ততার মাত্রা বাড়তে শুরু করে। ২০২১-এর মার্চ থেকে পরিস্থিতি আরো অবনতি হতে শুরু করে। এপ্রিলের শুরু থেকে বরিশালে কির্তনখেলায় লবনাক্ততার মাত্রা ১ হাজার পিপিএম অতিক্রম করে বলেও একাধীক সূত্র জানিয়েছে। এমনকি সাগরের লবনাক্ত পানি বরিশাল থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার উজানে চাঁদপুরের ভাটিতে হিজলা পর্যন্ত পৌছে যায়। অপরদিকে গোপালগঞ্জের মধুমতি নদীতে ২০২১-এর শুষ্ক মৌসুমে সর্বকালের সর্বোচ্চ ২১শ পিপিএম লবনাক্ততা সনাক্ত হয়েছিল। যা ২০১৬ সালে ছিল ১২শ পিপিএম। শুষ্কমৌসুমে দক্ষিণাঞ্চলে অনেক নদ-নদীতেই লবনাক্ততার মাত্রা ক্রমশ সহনীয় মাত্রার বাইরে চলে যাচ্ছে। যা সুস্থ পরিবেশ সহ প্রতিবেশের জন্যও হুমকি সৃষ্টি করছে। উল্লেখ্য, মানব দেহের জন্য সহনীয় লবনাক্ততার মাত্রা ৬শ পিপিএম।
এমনকি নদ-নদীর প্রবাহ বাঁধাগ্রস্থ হবার সাথে শুষ্ক মৌসুমে বরিশালে পানির স্তরও ক্রমশ নিচে নামছে। খোদ বরিশাল মহানগরীর অনেক গভীর নলকুপেও এখন পানি মিলছে না। অনেক নলকুপে লবনাক্ত পানি উঠে আসছে।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় এবং পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক আমাদের কৃষি ও মৎস্য সম্পদ সহ সুস্থ সমাজ ব্যবস্থা এবং নিরাপদ অর্থনীতির জন্য নদ-নদীর যথাযথ প্রবাহ অব্যাহত রাখার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। পাশাপাশি সুষ্ঠু পরিবেশ রক্ষায় নদী বাঁচাতে অবিলম্বে যথাযথ কার্যকরি পদক্ষেপ গ্রহনেরও তাগিদে দিয়েছেন শিক্ষক মন্ডলী।
বিভাগ : বাংলাদেশ
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
ছাত্রলীগ নেত্রী নিশি দুই দিনের রিমান্ডে
‘গ্রিনল্যান্ডকে সামরিক এলাকা বানাতে চান ট্রাম্প’
কারাগারে এস কে সুর
অবশেষে টিউলিপ সিদ্দিকের পদত্যাগ
বাড়ল এলপি গ্যাসের দাম
মাগুরায় নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের দুই কেন্দ্রীয় নেত্রী গ্রেফতার
ফ্যাসিবাদ সরকার মুক্ত গণমাধ্যমকে মত প্রকাশে বাধা দিয়ে রেখে ছিল- একেএম সামছুদ্দিন
কালিয়াকৈরে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে বিকাশ এজেন্টের ছয় লাখ টাকা ছিনতাই
শ্রীপুরে ড্রাম ট্রাকের ধাক্কায় এক মোটরসাইকেল আরোহী নিহত
তারুণ্যের উৎসবকে সামনে রেখে ফেডারেশনগুলোর নানা আয়োজন
সিরাজদিখানে ডিবি পরিচয়ে দিন-দুপুরে ১৫ লাখ ৭০ হাজার টাকা ছিনতাই
মীরসরাইয়ে ডোবা থেকে অজ্ঞাত ব্যক্তির লাশ উদ্ধার
সিলেট নর্থ ইষ্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বর্ণাঢ্য আয়োজনে পিঠা উৎসব
গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে ঐক্যের আহ্বান : হবিগঞ্জে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা মিফতাহ্ সিদ্দিকি
পোস্তগোলা-নারায়ণগঞ্জ সড়ক মেরামতের দাবি
হাত, পা ও বুকের লোম কাটা প্রসঙ্গে।
দেশের যাবতীয় সংকট দূর করতে নির্বাচিত সরকার দরকার: ড. আসাদুজ্জামান রিপন
সমতাভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবার বিকেন্দ্রীকরণ সময়ের দাবি
ইবতেদায়ি মাদরাসা এমপিওভুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার: সচিব
ফুলতলী ছাহেব কিবলা মানুষকে জীবনভর আল্লাহর পথে ডেকেছেন