ঢাকা   বুধবার, ০৪ অক্টোবর ২০২৩ | ২০ আশ্বিন ১৪৩০

তরবারির জোরে ভারতে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়নি

Daily Inqilab মুনশী আবদুল মাননান

৩০ মার্চ ২০২৩, ১১:৩৫ পিএম | আপডেট: ২৫ জুন ২০২৩, ০৮:১২ পিএম

এক শ্রেণির ইতিহাস লেখক বলার চেষ্টা করেছেন, ভারতে ইসলামের প্রচার-প্রতিষ্ঠা ঘটেছে তরবারির জোরে। মুসলিম অভিযানকারীরা ভারতে একের পর এক অভিযান চালিয়েছেন এবং হত্যা-নির্যাতনের মাধ্যমে স্থানীয়দের বাধ্য করেছেন ইসলাম গ্রহণে। কখনো প্রলোভনে বশীভূত করেও ইসলামে ধর্মান্তর করেছেন। শাসকরাও একই কাজ করেছেন।

এ অভিমত বা অভিযোগের সঙ্গে প্রকৃত সত্যের কোনো সম্পর্ক নেই। ইসলাম মানে শান্তি। বিশ্বময় শান্তি প্রতিষ্ঠাই ইসলামের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। তাই ইসলামের প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় বলপ্রয়োগ ও প্রলোভনের কোনো প্রশ্ন উঠতে পারে না। কালপ্রবাহে বিশ্বের সর্বত্র ইসলাম প্রচারিত হয়েছে, কোনো কোনো মুসলিম বসতি গড়ে উঠেছে। কিন্তু কোথাও জোর-জবরদস্তি করে, ভয় দেখিয়ে কিংবা অত্যাচার-নির্যাতন করে কাউকে মুসলমান করা হয়নি। প্রলোভন দেখিয়েও করা হয়নি। জবরদস্তি কিংবা প্রলোভন দেখিয়ে ধর্মান্তর ইসলাম সমর্থন করে না। মদীনায় মুসলমানদের প্রথম রাষ্ট্র পৌত্তলিক, খ্রিস্টান ও ইহুদিদের সঙ্গে চুক্তি করে গঠিত হয়েছিল। সেখানে নাগরিক হিসেবে সবারই ছিল সমানাধিকার। কোনো ক্ষেত্রে বৈষম্য ছিল না। এক সম্প্র্রদায়ের ওপর অন্য সম্প্রদায়ের অত্যাচার-নির্যাতনের অবকাশ ছিল না। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে: ধর্মে কোনো জবরদস্তি নেই। সূরা বাকারা: ২৫৬। আরো বলা হয়েছে: তোমাদের ধর্ম তোমাদের, আমার ধর্ম আমার। সূরা: কাফিরুন: ৬। ইসলামে ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি না করতে বলা হয়েছে। আল্লাহতায়ালা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় তাঁর রাসূলকে (সা.) উদ্দেশ্য করে বলেছেন: প্রচার করা ছাড়া রাসূলের অন্য কোনো কর্তব্য নেই। সূরা মায়িদা: ৯৯। প্রচার করাই নবী-রাসূলদের কাজ। প্রতিষ্ঠার কোনো বাধ্যবাদকতা তাদের নেই। এরপরও ইসলামের প্রচার-প্রতিষ্ঠা তরবারির জোরে হয়েছে, তা কীভাবে ধারণা করা যায়? বিশ্বের সব দেশ ও জনপদে ইসলাম যেভাবে প্রচার-বিস্তার লাভ করেছে, ভারতেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।

ভারতে মুসলমান অভিযানকারী বা রাজ্যপ্রতিষ্ঠাকামীদের আগমনের অনেক আগেই ইসলাম এসেছে। ঐতিহাসিকরা একমত: ইসলামের আবির্ভাব বহু আগে থেকেই ভারতের সঙ্গে আরবের যাতায়াত, যোগাযোগ ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। মালাবার ছিল তাদের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যকেন্দ্র। এই বাণিজ্যকেন্দ্রের সূত্রেই সেখানে আরব বসতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আরবে মহানবী (সা.) এর আবির্ভাব ও ইসলাম সম্পর্কে তারা সম্যক অবহিত ছিল। অনেকে তখনই ইসলাম গ্রহণ করেছিল। ঐতিহাসিক সুরজিৎ দাশগুপ্ত তার ‘ভারতবর্ষ ও ইসলাম’ গ্রন্থে এ বিষয়ে লিখেছেন: মালাবার উপকূলে ইসলাম ধর্মের উৎপত্তির আগে থেকেই আরব বণিকদের বসতি গড়ে উঠেছিল। বাণিজ্যিক সমৃদ্ধির জন্য শান্তি, শৃঙ্খলা বজায় রাখা তারা বিশেষ জরুরি মনে করত এবং দেশের শাসকদেরও এ ব্যাপারে সাহায্য করত। স্থানীয় অধিবাসীদের সঙ্গে আরব বণিকদের অসদ্ভাবের কোনো সাক্ষ্য পাওয়া যায় না। এর থেকে ধরে নেয়া যায় যে, নিতান্ত বাস্তব কারণেই উভয়ের মধ্যে সদ্ভাব ও সম্প্রীতি ছিল। পরে এই আরবরা ইসলাম গ্রহণ করে। তখন থেকে তারা পরিচিত হয় মুসলমান বলে।

সুরজিৎ দাশগুপ্ত আরো লিখেছেন: আরব বণিকরা যখন ইসলাম গ্রহণ করে এবং সেই ইসলামকে কেরলে নিয়ে আসে, কেরলস্থিত তাদের পরিবারবর্গের মধ্যে ইসলাম প্রচার করে তখন এই বণিকদের স্থানীয় কর্মচারিরাওÑ যাদের একটা বড় অংশ বণিকদের জন্য কায়িক পরিশ্রম করতÑ ইসলাম ধর্মের আদর্শ ও বদান্য সম্বন্ধে জানতে পায়। তারা জানতে পায় এমন এক শাস্ত্রের কথা, যাতে বলা হয়েছে, মানুষকে আলাদা আলাদা জাতিতে জন্ম দেয়া হয়েছে বটে, কিন্তু জন্ম দিয়ে নয়, মানুষের বিচার হয় তার স্বভাব-চরিত্র দিয়ে। (৩৯, ১৩-১৫)। বর্ণভেদ প্রথা জর্জরিত, মানুষের অধিকার থেকে বঞ্চিত কেরলের জনসাধারণ ইসলাম ধর্মের মধ্যে মানুষ হিসেবে বাঁচার ডাক শুনতে পেল।

তার মতে, এই ডাক তাদের কাছে একেবারে অচেনা নয়, বৌদ্ধ ধর্ম কেরলে একদা সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল। তখন তারা এই ডাক শুনেছিল। তখন তারা মানুষের মতো বাঁচত। খ্রিস্টীয় প্রথম শতকের মধ্যে পরিস্থিতির পরিবর্তন সূচিত হয় এবং পঞ্চম শতাব্দী নাগাদ বৌদ্ধ ধর্মকে উৎখাত করে ব্রাহ্মণ্য ধর্মই সর্বশক্তিমান হয়ে ওঠে ও সমাজের সর্বস্তরে তার কঠোর বিধান শাসনকে অমোঘরূপে প্রতিষ্ঠা করে। এই ব্রাহ্মণ্য ধর্মের মধ্যে উচ্চ আধ্যাতিকতার সঙ্গে মিশে গিয়েছিল জনসাধারণের বৃহত্তর অংশকে অপমান, ঘৃণা ও শোষণ করার সামাজিক সমর্থনÑ প্রকৃত পক্ষে আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে বিস্ময়কর অগ্রগামিতা ও উদারতা এবং ব্যবহারিক ক্ষেত্রে বিচিত্রতর প্রতিক্রিয়াশীলতা ও সংকীর্ণতা ব্রাহ্মণ্য ধর্মের অন্তর্নিহিত বিরোধ। ব্রাহ্মণ্য ধর্মের ব্যবহারিক দিকগুলোর চাপে কেরলের জনসাধরণ যখন মানুষ হিসেবে নিজেদের পরিচয় ভুলতে বসেছে, তখনই তাদের কাছে ইসলাম ধর্মের আগমন ও আহ্বান। এই আহ্বানে তারা প্রচন্ড উৎসাহে সাড়া দিল এবং ইসলাম গ্রহণ করতে শুরু করল। ‘তুহফৎ-উল মুজাহিদ্দীন’-এর লেখক জৈনুদ্দিন লিখেছেন, ‘যদি কোনো হিন্দু তখন মুসলমান হতো তাহলে অন্যরা তাকে এই (নি¤œবর্গ জন্মের) কারণে ঘৃণা করত না, অন্য মুসলিমদের সঙ্গে যে রকম বন্ধুত্ব নিয়ে মিশত, তার সঙ্গে সেভাবেই মিশত। মানুষের মূল্য পাবে, সমাজে মানুষের মতো ব্যবহার পাবেÑ এটা ছিল ইসলাম ধর্ম গ্রহণের প্রধান কারণ।

সুরজিৎ দাশগুপ্তের এই বক্তব্যের আলাদা ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। স্পষ্টতাই বোঝা যায়, তৎকালে ভারতে প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্মণ্য ধর্মে সাধারণ মানুষের কোনো মূল্য ছিল না। উচ্চবর্ণের মুষ্টিমেয় কিছু লোক দ-মু-ের অধিকর্তা ছিল এবং নি¤œবর্ণের বিপুল সংখ্যক মানুষকে তারা দাসের মতো যথেচ্ছ ব্যবহার করতো। তারা ছিল শোষিত, বঞ্চিত, নিগৃহীত ও অবহেলিত। পক্ষান্তরে ইসলাম ছিল শান্তি, সমতা, মর্যাদা, সম্মান ও ভ্রাতৃত্বের নিশ্চয়তাকারী মতাদর্শ। বলা বাহুল্য, ভারতেই নয়, বিশ্বের অন্যান্য স্থানেও ইসলাম প্রচারিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ইসলামের আপন বৈশিষ্ট্য ও গুণেই। (চলবে)


বিভাগ : বিশেষ প্রতিবেদন


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

গিয়াসুদ্দীন বলবন : স্থিতিস্থাপক সুলতান-৩
গিয়াসুদ্দীন বলবন : স্থিতিস্থাপক সুলতান-২
গিয়াসুদ্দীন বলবন : স্থিতিস্থাপক সুলতান-১
সুলতানুল হিন্দ খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী আজমিরী (রহ.)-২
সুলতানুল হিন্দ খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী আজমিরী (রহ.)-১
আরও

আরও পড়ুন

স্মার্ট বাংলাদেশের জন্য স্মার্ট সাংবাদিকতা জরুরি : স্পিকার

স্মার্ট বাংলাদেশের জন্য স্মার্ট সাংবাদিকতা জরুরি : স্পিকার

ক্ষমতা হারানোর ভয়ে আ.লীগ নেতাদের মাথা খারাপ হয়ে গেছে : ডা. শাহাদাত

ক্ষমতা হারানোর ভয়ে আ.লীগ নেতাদের মাথা খারাপ হয়ে গেছে : ডা. শাহাদাত

বাংলাদেশে ‘ম্যাগনিটস্কি নিষেধাজ্ঞা’ দেয়ার দাবি

বাংলাদেশে ‘ম্যাগনিটস্কি নিষেধাজ্ঞা’ দেয়ার দাবি

ডিবি পরিচয়ে কমলনগরের যুবক অপহরণ, ১৬ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি

ডিবি পরিচয়ে কমলনগরের যুবক অপহরণ, ১৬ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি

সদরপুরের চাঞ্চল্যকর মান্নান হত্যার পলাতক আসামি গ্রেপ্তার

সদরপুরের চাঞ্চল্যকর মান্নান হত্যার পলাতক আসামি গ্রেপ্তার

উদ্বোধনী ম্যাচে ‘বিপজ্জনক’ ইংল্যান্ডের সামনে নিউজিল্যান্ড

উদ্বোধনী ম্যাচে ‘বিপজ্জনক’ ইংল্যান্ডের সামনে নিউজিল্যান্ড

কাপাসিয়ার বাস চাপায় মাদরাসা শিক্ষক নিহত

কাপাসিয়ার বাস চাপায় মাদরাসা শিক্ষক নিহত

পাঁচ ম্যাচের সিরিজ খেলতে ভারত যাচ্ছে জাতীয় টার্গেটবল দল

পাঁচ ম্যাচের সিরিজ খেলতে ভারত যাচ্ছে জাতীয় টার্গেটবল দল

সাংবাদিককে মারধরের ঘটনায় হাসপাতালের বাবুর্চি স্ট্যান্ড রিলিজ

সাংবাদিককে মারধরের ঘটনায় হাসপাতালের বাবুর্চি স্ট্যান্ড রিলিজ

চারদিনের ব্যবধানে ফের কমল সোনার দাম

চারদিনের ব্যবধানে ফের কমল সোনার দাম

মার্কিন নিষেধাজ্ঞা নিয়ে বিএনপি মিথ্যাচার করছে: সালমান এফ রহমান

মার্কিন নিষেধাজ্ঞা নিয়ে বিএনপি মিথ্যাচার করছে: সালমান এফ রহমান

জাতীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন দিতে হবে

জাতীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন দিতে হবে

নিরপেক্ষ সরকারের অধীন ছাড়া নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না

নিরপেক্ষ সরকারের অধীন ছাড়া নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না

বেতের নামাজ না পড়া প্রসঙ্গে।

বেতের নামাজ না পড়া প্রসঙ্গে।

নিরাপত্তা হুমকির কারণেই বিশ্বকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান বাতিল!

নিরাপত্তা হুমকির কারণেই বিশ্বকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান বাতিল!

ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ মিলিয়ে দেবে নানা-নাতনিকে

ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ মিলিয়ে দেবে নানা-নাতনিকে

নীতি পুলিশের নিগ্রহ, কোমায় ১৬ বছরের কিশোরী! ফের উত্তপ্ত ইরান

নীতি পুলিশের নিগ্রহ, কোমায় ১৬ বছরের কিশোরী! ফের উত্তপ্ত ইরান

বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. বিমান বিহারী বোস মারা গেছেন

বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. বিমান বিহারী বোস মারা গেছেন

আইনের রাজনৈতিক ব্যাখ্যা করছেন আইনমন্ত্রী : কায়সার কামাল

আইনের রাজনৈতিক ব্যাখ্যা করছেন আইনমন্ত্রী : কায়সার কামাল

ঘুপচি একটা ঘরে ঘুমোতাম ১০-১১ জন: রোহিত

ঘুপচি একটা ঘরে ঘুমোতাম ১০-১১ জন: রোহিত