খোশ আমদেদ মাহে রমজান

Daily Inqilab ইনকিলাব

২৩ মার্চ ২০২৩, ০৭:৫৫ পিএম | আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২৩, ০১:৩৭ এএম

রহমত, বরকত, মাগফেরাত ও নাজাতের মাস পবিত্র রমজান। মহান রাব্বুল আলামীন এ মাসের রোজাকে ফরজ করেছেন। সুবেহ সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার এবং ইন্দ্রীয় সুখভোগ থেকে বিরত থাকার নামই রোজা। যে পাঁচটি স্তম্ভের ওপর ইসলাম দ-ায়মান, তার একটি রোজা। নামাজের পরই রোজার স্থান। মানুষের দৈহিক, মানসিক, আত্মিক, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক উন্নয়নে এ মাসের রোজা অত্যন্ত ফলপ্রসূ। সংযম, সহিষ্ণুতা ও আত্মশুদ্ধির অনন্য চেতনায় ভাস্বর মাহে রমজান। মহানবী (সা.) এ মাসকে এক সুমহান মাস হিসেবে অভিহিত করেছেন। এ মাসের প্রথম ১০ দিন রহমত, মধ্য ১০ দিন মাগফিরাত এবং শেষ দিনগুলো জাহান্নাম থেকে মুক্তির। অন্যান্য মাস অপেক্ষা রমজান মাসের শ্রেষ্ঠত্বের বড় কারণ এই যে, এ মাসেই বিশ্ব মানবতার মুক্তি সনদ পবিত্র আল কোরআন নাজিল হয়। পবিত্র কোরআনে আল্লাহপাক বলেছেন, ‘রমজান সেই মাস, যে মাসে কোরআন নাজিল হয়েছে। কোরআন, যা মানুষের হেদায়াত, সত্যের পথযাত্রীদের জন্য সুস্পষ্ট পথ নির্দেশক আর ন্যায়-অন্যায়ের মধ্যে পার্থক্য বিধানকারী। কাজেই তোমাদের মধ্যে যে কেউ এ মাসটি পাবে, সে এ মাসে রোজা রাখবে।’ এ মাসেই এমন একটি রাত রয়েছে, যাকে বলা হয় লাইলাতুল কদর বা সৌভাগ্যরজনী। আল্লাহপাক এ সম্পর্কে বলেছেন, ‘আমরা এটি (আল কোরআন) কদরের রাতে নাজিল করেছি। তুমি কি জান, কদরের রাত কী? কদরের রাত হাজার মাস অপেক্ষাও অধিক উত্তম।’ রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যখন রমজান শুরু হয়, দোজখের দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়, শয়তানকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয় এবং জান্নাতের দরজা খুলে দেয়া হয়।’ পবিত্র কোরআন ও হাদিসের আলোকে পবিত্র রমজান মাস, রমজান মাসের রোজা ও অন্যান্য ইবাদত কতটা মর্যাদা ও গুরুত্বপূর্ণ তা সহজেই উপলব্ধি করা যায়।

পবিত্র কোরআনের সঙ্গে রমজানের সম্পর্ক অচ্ছেদ্য। পবিত্র কোরআনের আলোকে জীবন গঠনের একটা প্রশিক্ষণ হয় মাহে রমজানে। আত্মিক উন্নয়ন, পবিত্রতা অর্জন ও আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য রমজানের রোজার কোনো তুলনা হয় না। আল্লাহপাক পবিত্র কোরআনে বলেছেন, ‘হে ঈমানদারগণ, তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন তা তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর ফরজ করা হয়েছিল, যাতে করে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো।’ তাকওয়া অর্থ সতর্ক, সংযত ও সাবধান থাকা। আল্লাহর ভয়ে, আখেরাতের জবাবদিহির ভয়ে সব ধরনের অন্যায়, অশ্লীলতা, পাপ ও অপরাধ থেকে দূরে থাকা। বলা বাহুল্য, তাকওয়ার গুণ মানুষকে সকল প্রকার পাপাচার, অন্যায়, অপরাধ, অপকর্ম, অশ্লীলতা, অনিয়ম, দুর্নীতি ও দুষ্কৃতি থেকে মুক্ত রাখতে পারে। রোজা রেখে মিথ্যাচার, পরচর্চা, ক্রোধ, হিংসা, নিন্দা, অহঙ্কার, আত্মগর্ব, কৃপণতা, চোগলখোরী ইত্যাদি থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘রোজা রাখা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি মিথ্যাচার ও পাপকর্ম থেকে বিরত রইল না, ক্ষুধা ও পিপাসায় কাতর হওয়া ছাড়া রোজা তার কোনো কাজেই এলো না।’ রোজা মানুষকে প্রকৃত আধ্যাত্মিক ও জাগতিক মানুষ হতে অনুপ্রাণিত করে, কার্যকরভাবে সহায়তা করে। এবার এমন এক সময় মাহে রমজান এসেছে, যখন দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বৃদ্ধি করে এক ভয়াবহ সংকট সৃষ্টি করেছে। অথচ বিভিন্ন দেশে অন্যান্য ধর্মের ধর্মীয় উৎসব উপলক্ষে ব্যবসায়ীরা জিনিসপত্রের দাম কমিয়ে কিংবা ডিসকাউন্ট দিয়ে থাকে। এটা সাধারণ মানুষকে খুশি করার জন্য তারা করে। আমাদের দেশে এর ব্যতিক্রম। রমজানকে উপলক্ষ করে ব্যবসায়ীরা অতি মুনাফার লোভে জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দেয়। ব্যবসায়ীদের এ আচরণ অত্যন্ত দুঃখজনক। রমজানে মানুষের সেবা করা অত্যন্ত পুণ্যের কাজ। এটা একটা সুযোগ। এ সুযোগকে ব্যবসায়ীরা নিচ্ছে অতি মুনাফা শিকারে। সরকারও নিত্যপণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারেনি। এতে সব পণ্যই সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে। রমজানে মসজিদগুলোতে ব্যবসায়ীসহ সবশ্রেণীর মুসল্লীদের ব্যাপক সমাগম হয়ে থাকে। এ সময় বিশেষ করে জুমার নামাজের খুতবায় যদি দ্রব্যমূল্য না বৃদ্ধির বয়ান দেয়া হয়, তাহলে হয়তো ব্যবসায়ীরাও তা শুনবে। মানুষও সচেতন হবে।

দেশে কোটিপতির সংখ্যা গত তিন মাসে কয়েক হাজার বাড়লেও এটা বলাই বাহুল্য, সাধারণ মানুষ প্রকট অর্থসংকটে আছে। তাদের আয় বাড়েনি, অনেকের আয় বরং কমেছে। কর্মসংস্থান বাড়া তো দূরের কথা, অনেকে কর্মসংস্থান হারিয়েছে পর্যন্ত। এমতাবস্থায়, বেশির ভাগ মানুষ খাদ্য তালিকা থেকে মাছ, গোশত, ডিম, দুধ, এমনকি তিন বেলার জায়গায় এক বেলা আহার বাদ দিতে বাধ্য হয়েছে। আর্থিক কারণে শুধু জনজীবনই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েনি, রাষ্ট্রীয় ও উন্নয়ন কার্যক্রমও অনেকাংশে ব্যহত হয়েছে বা হচ্ছে। খবর বেরিয়েছে, এডিপি বাস্তবায়নের হার কয়েক বছরের মধ্যে সর্বনি¤œ। পূর্ণ গতিতে এডিপি বাস্তবায়নের কাজ হলে মানুষের আর্থিক সংগতি বাড়তো। জীবনযাত্রায় যার ইতিবাচক প্রভাব পড়তো। বিদ্যমান বাস্তবতায় বিশেষ করে এই রমজানে মানুষের পাশে দাঁড়ানো সরকার, বিত্তবান সম্প্রদায়ের অপরিহার্য কর্তব্য। বিভিন্ন ব্যবসায়িক গোষ্ঠি, শিল্পগোষ্ঠি, ব্যাংক ইত্যাদির সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে সাহায্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়া উচিত। কোনো কোনো গোষ্ঠি ইতোমধ্যে সক্রিয় হয়েছে। সবাই সক্রিয় হলে মানুষের দুঃখ-কষ্ট কিছুটা হলেও কমবে।

রমজানের শিক্ষা ধৈর্য ও সংযম। রমজানের একটি নাম হচ্ছে শাহরুল মুওয়াসাত। এর অর্থ সহমর্মিতার মাস। একে অপরের প্রতি সম্প্রীতি, সমবেদনা ও সহমর্মিতা রমজানের মহান শিক্ষা। বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের ওপর নানা দিক থেকে আক্রমণ আসছে। অসহিষ্ণুতা প্রদর্শন, সাম্প্রদায়িক হামলা, অপপ্রচার সব মিলিয়ে বিশ্ব মুসলিমকে এক কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এ অবস্থায় শিক্ষা নিতে হবে সংযমের, ধৈর্যের। যেকোনো পরিস্থিতিতে উসকানিতে সাড়া না দিয়ে সংযম ও তাকওয়া রক্ষা করে চলাই রমজানের শিক্ষা। সহমর্মিতার প্রধান ক্ষেত্র হচ্ছে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল ও ক্রেতা-ভোক্তাসাধারণের হাতের নাগালে রাখা। খাদ্যে ভেজাল না মেশানো এবং ওজনে কমবেশি না করা। ইসলাম শুধু অনুষ্ঠানসর্বস্ব ধর্ম নয়, এর মূল বাণীই হচ্ছে মানবতার উৎকর্ষ। আল্লাহ ও রাসুলের আনুগত্য আর মানুষসহ সকল সৃষ্টির প্রতি সহানুভূতি ও ভালোবাসা। পবিত্র রমজানে মুসলমানের জীবন-জীবিকার সর্বত্র সততা, সংযম ও পবিত্রতার ছোঁয়া লাগুক, এটাই কাম্য।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

রাজধানীতে বেড়েছে তৃতীয় লিঙ্গের চাঁদাবাজি
হাফিজ আহমেদ মজুমদার : যার তুলনা তিনি নিজে
গরিব হয়ে যাচ্ছে দেশের মানুষ
সীমান্তে আর কত হত্যা করবে বিএসএফ?
ট্রেন বিলম্বে যাত্রীদের দুর্ভোগ
আরও

আরও পড়ুন

এবার রূপায়ণ সিটির সঙ্গি সাকিব

এবার রূপায়ণ সিটির সঙ্গি সাকিব

পাকিস্তানের সন্ত্রাসী হামলার নিন্দা জানিয়েছে জাতিসংঘ

পাকিস্তানের সন্ত্রাসী হামলার নিন্দা জানিয়েছে জাতিসংঘ

শিক্ষকদের বেতন বাড়ানোর সুপারিশ করলো গণস্বাক্ষরতা অভিযান

শিক্ষকদের বেতন বাড়ানোর সুপারিশ করলো গণস্বাক্ষরতা অভিযান

নিত্যপণ্যের দাম বাড়াতেই বিএনপির ভারত বর্জন কর্মসূচি : নাছিম

নিত্যপণ্যের দাম বাড়াতেই বিএনপির ভারত বর্জন কর্মসূচি : নাছিম

জলবায়ু সহনশীল মৎস্যচাষ প্রযুক্তি উদ্ভাবনে পদক্ষেপ নেয়া হবে : আব্দুর রহমান

জলবায়ু সহনশীল মৎস্যচাষ প্রযুক্তি উদ্ভাবনে পদক্ষেপ নেয়া হবে : আব্দুর রহমান

সরকারের এমপিরা ঘোষণা দিয়ে লুটপাট শুরু করেছে- এবি পার্টি নেতা এড. তাজুল ইসলাম।

সরকারের এমপিরা ঘোষণা দিয়ে লুটপাট শুরু করেছে- এবি পার্টি নেতা এড. তাজুল ইসলাম।

চীনের সঙ্গে এফটিএ করতে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রতিবেদন বিনিময়

চীনের সঙ্গে এফটিএ করতে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রতিবেদন বিনিময়

স্বাধীনতা আন্দোলনের পেছনে অন্যতম কারণ ছিল অর্থনৈতিক মুক্তি : শিল্পমন্ত্রী

স্বাধীনতা আন্দোলনের পেছনে অন্যতম কারণ ছিল অর্থনৈতিক মুক্তি : শিল্পমন্ত্রী

আধিপত্যবাদী শক্তিকে সম্মিলিতভাবে  রুখে দিতে হবে

আধিপত্যবাদী শক্তিকে সম্মিলিতভাবে রুখে দিতে হবে

সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকতে বিদেশী প্রভুদের কাছে দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিচ্ছে: আমিনুল হক

সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকতে বিদেশী প্রভুদের কাছে দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিচ্ছে: আমিনুল হক

টাকার বিছানায় ঘুম

টাকার বিছানায় ঘুম

চশমার যাদুঘর

চশমার যাদুঘর

শেরপুরের পৃথক ঘটনায় দুই জনের মৃত্যু

শেরপুরের পৃথক ঘটনায় দুই জনের মৃত্যু

বিডিএস ভূমি ব্যবস্থাপনায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে

বিডিএস ভূমি ব্যবস্থাপনায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে

গ্রেফতার সেই কুমির

গ্রেফতার সেই কুমির

লেভেল ক্রসিং স্থাপন প্রয়োজন

লেভেল ক্রসিং স্থাপন প্রয়োজন

রাজধানীতে বেড়েছে তৃতীয় লিঙ্গের চাঁদাবাজি

রাজধানীতে বেড়েছে তৃতীয় লিঙ্গের চাঁদাবাজি

হাফিজ আহমেদ মজুমদার : যার তুলনা তিনি নিজে

হাফিজ আহমেদ মজুমদার : যার তুলনা তিনি নিজে

গরিব হয়ে যাচ্ছে দেশের মানুষ

গরিব হয়ে যাচ্ছে দেশের মানুষ

সীমান্তে আর কত হত্যা করবে বিএসএফ?

সীমান্তে আর কত হত্যা করবে বিএসএফ?