নিত্যপণ্যের বেপরোয়া মূল্যবৃদ্ধি
২৪ মার্চ ২০২৩, ০৮:১৩ পিএম | আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২৩, ০৭:৩৫ এএম
মুসলামনদের প্রিয় মাস রমজান শুরু হয়ে গেছে। বরাবরই রমজান আসার আগেই দেশের ব্যবসায়ীরা নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বাড়িয়ে দিয়ে জনজীবন অসহনীয় করে থাকেন। এবারো তার ব্যতিক্রম হয়নি। নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি নিয়ে সবাই উদ্বিগ্ন। যেভাবে প্রতিদিন দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে, তা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
পবিত্র রমজানকে সামনে রেখে প্রতি বছর অনেক মৌসুমি ব্যবসায়ী ও মজুতদারের আবির্ভাব ঘটে। এসব ব্যবসায়ী চিনি, ছোলা, ডাল, পেঁয়াজ, আদা, রসুন, চাল, সয়াবিন, খেজুর, পাঞ্জাবী, শাড়ি ইত্যাদি বিক্রী করে থাকে। এবার আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে, যার প্রভাব পড়েছে দেশের বাজারে। নিত্যপণ্যের পাশাপাশি পাল্লা দিয়ে বেড়েছে দুধ, ডিম, মাছ, মাংসের দাম। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, মূল্যসন্ত্রাসী, মুনাফাখোর, মজুদদার-সিন্ডিকেট ও অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি; নকল, ভেজাল ও মানহীন পণ্যের দৌরাত্ম্যের কারণে আজ নাগরিক জীবন অতিষ্ঠ। একশ্রেণির নীতি-আদর্শহীন, অতি মুনাফালোভী, অসাধু ব্যবসায়ী দ্রুত কোটিপতি হওয়ার বাসনায়, তাদের ইচ্ছামতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ সংকট সৃষ্টি করে ও দাম বাড়িয়ে দিয়ে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা প্রায় অচল করে দিচ্ছে। ফলে সাধারণ মানুষের জন্য জীবন ধারণ দুরূহ হয়ে পড়ছে। ব্যবসায়ীরা আন্তর্জাতিক বাজারের দোহাই দিয়ে দাম বাড়ালেও ওই পণ্যের মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারে কমলে তারা আর কমায় না। সরকারের নীতিনির্ধারণী মহলে গুটিকয়েক অসৎ ব্যবসায়ীর স্বার্থ সংরক্ষণে যাবতীয় রীতিনীতি প্রণয়ন করার কারণে সাধারণ জনগণের স্বার্থ বারবার উপেক্ষিত হচ্ছে। ফলে ব্যবসায়ীরা পণ্যের দাম ইচ্ছামতো বাড়িয়ে জনগণকে জিম্মি করে কোটি কোটি টাকা নিজেদের পকেটস্থ করে।
নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য সামগ্রী সহজলভ্য ও ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে রাখা সরকারের দায়িত্ব এবং ভোক্তা শ্রেণির অধিকার। কিন্তু আমাদের দেশের বাজার ব্যবস্থাপনা মজুদদার-লুটেরাদের কুক্ষিগত। বিশেষত রমজান ও ধর্মীয় উৎসবগুলোতে বাজার ব্যবস্থাপনায় শোচনীয় অবস্থা বিরাজ করে। তখন কিছু সংখ্যক ব্যবসায়ী নিত্য প্রয়োজনীয় সকল পণ্য মজুদ করে রাখে। এতে অস্বাভাবিকভাবে পণ্যের মূল্য হু হু করে বাড়তে থাকে। ভোক্তা শ্রেণি প্রয়োজনের তাগিতে চড়ামূল্যে পণ্যসামগ্রী ক্রয় করতে বাধ্য হয়। ফলে এ সুযোগে অতি মুনাফাখোর অসাধু ব্যবসায়ীরা সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলে। আর সাধারণ মানুষ চড়া মূল্যে পণ্য ক্রয় করে নিঃস্ব থেকে আরো নিঃস্ব হয়। এ সমস্যা নিয়ে প্রিন্ট মিডিয়ায় অনেক লেখালেখি হয় এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় বহু সচিত্র প্রতিবেদন ও প্রচার হয়। বিভিন্ন সময়ে সেমিনার-সিম্পোজিয়ামের আয়োজন করা হয়। সেমিনারে এ সমস্যা নিরসনে বিস্তারিত আলোচনা করা হয় এবং সুপারিশমালা গ্রহণ করা হয়। তখন সরকারি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ মজুদদারি ও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা গ্রহণের নানা কথা বলে থাকে এবং ব্যবসায়ীরা বহু প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকে। কিন্তু বাস্তবে এ সমস্যার প্রতিকার সামান্যই পরিলক্ষিত হয়।
কথিত আছে, এসব ব্যবসায়ী নাকি বলে থাকে, রমজানের একমাস ব্যবসা করব, সারা বছর আরামে কাটাব। রমজান মাস বিশ্ব মুসলিমের জন্য একটি বিশেষ নিয়ামত। এটি সংযম ও নাজাতের মাস, পাপমুক্তির মাস হলেও এসব মৌসুমি ব্যবসায়ীর দৌরাত্ম্যের কারণে জনজীবন হয়ে উঠে অসহনীয় ও যন্ত্রণাদায়ক। রমজান মাস নাজাতের মাস হলেও তা আতঙ্কের মাসে পরিণত হয়। ইসলামে অতিরিক্ত মূল্য আদায় কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। হাদিস শরীফে বলা হয়েছে, ‘ব্যবসায়ীরা যদি সীমাতিরিক্ত মূল্য আদায় করে এ সুযোগে যে, ক্রেতা পণ্যের মূল্য জানে না; তাহলে অতিরিক্ত পরিমাণের মূল্য সুদ হিসাবে গণ্য হবে।’ আবার মজুদদারী সর্ম্পকে হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘মজুদদার খুব নিককৃষ্টতম ব্যক্তি। যদি জিনিসপত্রের দাম হ্রাস পায়, তবে তারা চিন্তিত হয়ে পড়ে, আর দাম বেড়ে গেলে আনন্দিত হয়।’ (মেশকাত)। আর খাদ্যদ্রব্য মজুদ করে রাখা অথবা তা বাজার থেকে তুলে নিয়ে দাম বাড়ানো ইসলামে অবৈধ।
এ ধরনের কাজে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পায় এবং অনেক মানুষ দুর্ভোগে পড়ে। তাদের কষ্ট বেড়ে যায়। তাই ইসলাম এ প্রকার কাজ নিষিদ্ধ করেছে। এ প্রসঙ্গে রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি খাদ্যশস্য মজুদ রাখে, আল্লাহপাক তার ওপর দরিদ্রতা চাপিয়ে দেন।’ (আবু দাউদ, হাদিস নং: ৫৫)। ব্যবসায়িক পণ্য বিক্রি না করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে বর্ধিত মুনাফা আদায়ের প্রচেষ্টা একটি সামাজিক অপরাধ। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে খাদ্যশস্য গুদামজাত করে সে অভিশপ্ত।‘ (ইবনে মাজাহ) তিনি আরো বলেন, ‘যে ব্যক্তি ৪০ দিনের খাবার মজুদ রাখে, সে আল্লাহর জিম্মা থেকে বেরিয়ে যায়।’ (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা : ২০৩৯৬) অন্য হাদিসে এসেছে : ‘যে ব্যক্তি খাদ্যশস্য গুদামজাত করে সে অপরাধী।’ (আল মু’জামুল কাবির: ১০৮৬)। তবে গুদামজাত পণ্য যদি মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় বস্তু না হয় কিংবা মানুষ এর মুখাপেক্ষী না হয় অথবা এসব পণ্য চাহিদার অতিরিক্ত হয় বা গুদামজাতকারী বর্ধিত মুনাফা অর্জনের অভিলাষী না হয়, তাহলে এসব অবস্থায় পণ্য মজুদ রাখা অবৈধ নয়।
রমজান মাসে পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকারের নানা রকম অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতি থাকে। প্রধানমন্ত্রী ও সরকারের কর্তা ব্যক্তিরা ইতিমধ্যেই ব্যবসায়ীদের প্রতি দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু কতটা কার্যকর হয়, এটা দেখার বিষয়। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়লেই আমরা প্রায়শ সরকারকে দোষারোপ করে থাকি। এটি ঠিক যে, সরকারের যথাযথ মনিটরিংয়ের দুর্বলতার সুযোগে মুনাফাখোর, মজুদদারি, সিন্ডিকেট ও অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের অস্থিতিশীল হয়।
আবার যখনই কোনো পণ্যের দাম বাড়ে তখনই সাধারণ জনগণও সেখানে হুমড়ি খেয়ে পড়ে, দাম বাড়ার গুজবে নিজেরাই ঐ পণ্যের মজুদে তৎপর হয়ে ওঠে। কিন্তু বরাবর দেখা গেছে, কোনো বিশেষ উপলক্ষে বাজারের নাটাই থাকে অশুভ চক্রের হাতে। নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকারের অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতি ব্যবসায়ীরা থোড়াই কেয়ার করে। তারা পণ্যমূল্য ইচ্ছামত বাড়িয়ে দেয়। তাই বাজারে সুস্থ প্রতিযোগিতার পরিবর্তে অসুস্থ পরিবেশ তৈরি হয়। সে কারণে পবিত্র রমজান মাসে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সহনীয় পর্যায়ে রাখার জন্য সরকারপ্রধান থেকে শুরু করে সব মহল ব্যবসায়ীদের বার বার অনুরোধ করার পরও তাদের সেই প্রতিশ্রুতি কাজে আসে না।
প্রসঙ্গত বলতে চাই, প্রয়োজনীয় সচেতনতা ও যথেষ্ট অভিজ্ঞতা না থাকায় দেশের অধিকাংশ ক্রেতা-ভোক্তা তাদের অধিকার, দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন নয়। ফলে সহজেই অসাধু ব্যবসায়ীরা পণ্যর দাম বাড়িয়ে অনেক লাভ করে নিয়ে যায়। তাই ব্যাপক সচেতনতামূলক কার্যক্রম এবং অনেক প্রচার করতে হবে, যাতে সাধারণ নাগরিক জানতে পারে তাদের কীভাবে সঠিক পণ্য কিনতে হবে এবং কোন অন্যায় দেখলে সেখানে প্রতিবাদ করতে হবে। ব্যবসা-বাণিজ্য সংক্রান্ত যে কোনো নীতিনির্ধারণীমূলক ক্ষেত্রে ভোক্তাদের অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে, যাতে তারা তাদের অধিকারের কথা তুলে ধরতে পারে। আর কেউ যেন অন্যায়ভাবে অপরের রিজিক কেড়ে না নেয় সেজন্য মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে। রমজানের রোজা রেখে মানুষের আত্মশুদ্ধি হোক ও আত্মোপলব্ধি জাগ্রত হোক, এই কামনা করি।
লেখক: গবেষক
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
কাপ্তাইয়ে রাঙ্গামাটি জেলা পরিষদ দু'ই সদস্যকে সংবর্ধনা ও তিতুমীর একাডেমির শিক্ষার্থীদের বিদায় অনুষ্ঠিত
পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশের পতাকা অবমাননার ঘটনায় গ্রেপ্তার ৩
সিংগাইরে দুধর্ষ ডাকাতি, ১০ লক্ষ টাকার মালামাল লুট
সালথায় ঘরের চালা কেটে শিশুকে জিম্মি করে প্রবাসীর বাড়িতে ডাকাতি
বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর নব বিমানসেনা দলের প্রশিক্ষণ সমাপনী কুচকওয়াজ অনুষ্ঠিত
গাজায় যুদ্ধবিরতির আহ্বানে টার্নার প্রাইজ বিজয়ী স্কটিশ শিল্পী জাসলিন কাউর
সোনাহাট স্থলবন্দরে কমিটি গঠন নিয়ে দ্বন্ধ, সংবাদ সম্মেলন করে ২ গ্রুপের নতুন কমিটি গঠনের দাবি
নোয়াখালীর গুলিবিদ্ধ আরমানের চিকিৎসা খরচ নিয়ে বিপাকে পরিবার
লিয়ামের স্মৃতি বিজড়িত বাড়ি ছেড়ে কান্নায় ভেঙে পড়লেন লিয়াম পেইনের প্রেমিকা
ভিয়েতনামে বন্ধ হলো জনপ্রিয় শপিং অ্যাপ টেমু
১৫ বছরে রিজার্ভ থেকে উধাও ২৪ বিলিয়ন ডলার : গভর্নর
পাকিস্থানী নাগরিকের 'ক্ষমতায়' সম্পত্তি নিয়ে বিপাকে কসবার অসহায় নারী
নরসিংদীতে আন্ত:কলেজ খেলাধুলা ও ক্রীড়া প্রতিযোগীতা শুরু
ভারতীয় শাড়ি আগুনে পুড়িয়ে প্রতিবাদ জানালেন রিজভী
বাংলাদেশ নিয়ে কেউ মিথ্যাচার করলে মানুষ তার উচিত জবাব দিবে: কর্নেল অলি
হরিরামপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সহ সভাপতি গ্রেপ্তার
৫ আগস্ট বিজয়উল্লাসে হাসিনা বাহিনীর নির্মমতার আরেক উদাহরণ শিশু জাবিরের হত্যা
শিবালয়ে স্মার্ট কার্ড বিতরণ উদ্বোধন
অভ্যুত্থানে পর প্রথম বিজয় দিবস : কুচকাওয়াজ নয়, হবে ‘বিজয় মেলা’
যুক্তরাজ্যে স্থূলতা নিয়ন্ত্রণে নতুন ওষুধ ‘মাউনজারো’ অনুমোদন পেতে যাচ্ছে