ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতি হ্রাসে সচেতনতা
১২ এপ্রিল ২০২৩, ০৮:১৮ পিএম | আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২৩, ১০:৩২ পিএম
বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশ। ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, খরা ইত্যাদি এমন কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ নেই, যা এ ভূখন্ডে হয় না। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানই একটি দুর্যোগপ্রবণ এলাকায়। কর্কট ক্রান্তীয় অঞ্চলে অবস্থান হওয়ায় এখানকার আবহাওয়া কিছুটা চরমভাবাপন্ন। ফলে ঘূর্ণিঝড় ও টর্নেডো এখানে বেশি হয়ে থাকে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলবর্তী জেলাগুলোতে স্থলভাগের আকৃতি অনেকটা উল্টানো ফানেল আকৃতির হওয়ায় বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন ভারত মহাসাগরে সৃষ্ট নি¤œচাপ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উপকূলবর্তী জেলাগুলোর উপর দিয়ে অগ্রসর হয়। ফলে সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড় এ অঞ্চলে বেশি হয়ে থাকে। এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে এদেশের মানুষ প্রাগৈতিহাসিককাল থেকেই পরিচিত এবং অনেকটা গা সওয়া হয়ে গেছে। এসব দুর্যোগ মোকাবিলা করতে মানুষ অনেকটা অভ্যস্ত হয়ে গেছে এবং এতে জানমালের ক্ষয়ক্ষতি অনেকটা হ্রাস পেয়েছে। এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে এতদাঞ্চলের মানুষের এডাপটেশনের কারণেই এটা সম্ভব হয়েছে।
তবে সম্ভাব্য ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি বিশেষ করে রাজধানী ঢাকার জন্য ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাম্প্রতিক তুরস্ক-সিরিয়া সীমান্তের ভয়াবহ ভূমিকম্প এবং তাতে বিপুল প্রাণহানি এদেশের জন্য বড়ো সতর্কবার্তা হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন, বিশেষ করে ভারি অবকাঠামো, অতীতের অপরিকল্পিত উন্নয়ন ও দুর্বল অবকাঠামো এই ভাবনায় ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে।
রাজধানী ঢাকা বিশ্বের অন্যতম জনবহুল শহর। এখানে দুই কোটির বেশি লোকের বসবাস। দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি রাজধানী ঢাকাকেন্দ্রিক। রাজধানী ঢাকার সুরক্ষা ও ঝুঁকি সর্বাগ্রে বিবেচ্য। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং কারিগরি সক্ষমতা বৃদ্ধির ফলে এখানে বহুতল ভবন নির্মিত হয়েছে প্রচুর। এসব ভারি অবকাঠামো রাজধানীতে ভূমিকম্প দুর্যোগের ঝুঁকি বৃদ্ধি করেছে। সেই সাথে অতীতের গড়ে ওঠা দুর্বল অবকাঠামো এবং অপরিকল্পিত স্থাপনা নির্মাণ শহরের ভূমিকম্প দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি আরও বৃদ্ধি করেছে। দেশের অন্যান্য বড়ো শহরগুলোরও প্রায় একই অবস্থা।
ভূপৃষ্ঠের অভ্যন্তরে টেকটোনিক প্লেটের সঞ্চালনের ফলে ভূমিকম্প হয়ে থাকে। এই টেকটোনিক প্লেটের সঞ্চালন একাধিক প্লেটের সংযোগস্থলে তীব্র মাত্রার ভূমিকম্প সৃষ্টি করতে পারে। টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলকে বলা হয় টেকটোনিক ফল্ট। এছাড়া টেকটোনিক প্লেটের বিভিন্ন স্থানে ফাটল থাকলে তাকে সাব ফল্ট বলা হয়ে থাকে। টেকটোনিক ফল্টে বড়ো মাত্রার ভূমিকম্পের আশঙ্কা থাকলেও সাব ফল্টে বড়ো ধরনের ভূমিকম্পের আশঙ্কা কম থাকে। বাংলাদেশ ইউরেশিয়ান টেকটোনিক প্লেট, ইন্ডিয়ান প্লেট এবং বার্মিজ সাবপ্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থিত। এসব প্লেটের সংযোগস্থল দেশের উত্তর-পূর্ব, পূর্ব এবং দক্ষিণ পূর্ব অঞ্চলের ভূগর্ভে অবস্থিত। এ কারণে সিলেট এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে বড় ধরনের ভূমিকম্পের আশঙ্কা থাকলেও দেশের মধ্যাঞ্চল বিশেষ করে রাজধানী ঢাকায় বড় ধরনের ভূমিকম্পের আশঙ্কা কম। মধুপুর এবং ডাউকি ফল্টের কারণে দেশের মধ্যাঞ্চলে মৃদু বা মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পের আশঙ্কা রয়েছে। কিন্তু এ দুটি ফল্ট সাব ফল্ট হওয়ার কারণে এখানে বড় ধরনের ভূমিকম্পের আশঙ্কা অনেক কম। উল্লেখ্য যে, ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল থেকে ২০০ কিলোমিটারের বাইরে তীব্রতা অনেকটা হ্রাস পায় এবং ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা কমে আসে। বড় ধরনের ভূমিকম্পের সম্ভাব্য অঞ্চল রাজধানী ঢাকা থেকে এই দূরত্বের বাইরে হওয়ায় ভূমিকম্পের প্রত্যক্ষ ক্ষয়ক্ষতি থেকে রাজধানী ঢাকা অনেকটাই নিরাপদ অবস্থানে রয়েছে।
কিন্তু আশঙ্কার জায়গা ভিন্ন। অপরিকল্পিত অবকাঠামো, অপর্যাপ্ত রাস্তাঘাট, গ্যাস ও বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনের বিন্যাস শহরকে ভূমিকম্প দুর্যোগের জন্য অতিমাত্রায় ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। রাজধানী ঢাকায় ভূমিকম্পে প্রত্যক্ষ ক্ষয়ক্ষতির চেয়ে পরোক্ষ ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা অতিমাত্রায় বেশি। এখানে ভবনধসে যত প্রাণহানি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি প্রাণহানির আশঙ্কা বিদ্যমান ভূমিকম্পজনিত অগ্নিকা-ের কারণে। এছাড়া অপর্যাপ্ত রাস্তাঘাটের ফলে সম্ভাব্য দুর্যোগে উদ্ধার কার্যক্রম ব্যাহত হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সবচেয়ে বেশি মাত্রায় প্রাণহানির আশঙ্কা রয়েছে উদ্ধার কার্যক্রম বিলম্বিত হওয়ার কারণে। রাজধানী ঢাকায় কত সংখ্যক ভবন ভূমিকম্পে ঝুঁকিপূর্ণ তার সঠিক কোনো হিসেব সরকারি কিংবা বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার কাছে নেই এবং এ সংক্রান্ত পূর্ণাঙ্গ কোনো সমীক্ষা বা গবেষণাও পরিচালিত হয়নি। সীমিত আকারে যেসব সমীক্ষা পরিচালনা করা হয়েছে তার ভিত্তিতে সঠিকভাবে বলা যাবে না যে প্রকৃতপক্ষে কতটি ভবন ঝুঁকিপূর্ণ। ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সংখ্যা নিরূপণ ও চিহ্নিত করতে হলে শহরের প্রত্যেকটি ভবন পৃথকভাবে পরীক্ষা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কাজটি যথেষ্ট ব্যয়বহুল, সময় সাপেক্ষ এবং অত্যন্ত জটিল। কিন্তু দেশের, বিশেষ করে নগরবাসীর জীবনের নিরাপত্তার দিক বিবেচনা করে যত ব্যয়বহুল, সময় সাপেক্ষ এবং যত জটিলই হোকনা কেন অতি শীঘ্রই তা করা উচিত।
ভূমিকম্প দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকার যথেষ্ট প্রোঅ্যাকটিভ কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। ইতোমধ্যে ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড হালনাগাদ করা হয়েছে এবং তা যথাযথ বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। রাজধানী ঢাকার সমন্বিত ও পরিকল্পিত উন্নয়নের লক্ষ্যে বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা ড্যাপ প্রণয়ন করা হয়েছে এবং তা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, প্রেক্ষিত পরিকল্পনা, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা, ডেল্টা প্লান ২১০০, জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নীতিমালা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার স্থায়ী আদেশাবলিসহ সকল জাতীয় কর্মপরিকল্পনায় ভূমিকম্প দুর্যোগ ঝুঁকি মোকাবিলার জন্য সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা রাখা হয়েছে। রাজধানী ঢাকার ভূমিকম্প দুর্যোগ ঝুঁকি নিরূপণ ও ঝুঁকি হ্রাসে করণীয় সম্পর্কে সুপারিশ প্রণয়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার, বিশ্বব্যাংক ও জাইকার অর্থায়নে আরবান রেজিলিয়েন্স প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করা হয়েছে। ভূমিকম্প সহনীয় অবকাঠামো নির্মাণে প্রয়োজনীয় পরামর্শ সেবা প্রদানের উদ্দেশ্যে Bangladesh Structural Risk and Resilience Institute সংক্ষেপে BSRRI নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
ভূমিকম্প এমন একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যার সঠিক পূর্বাভাস দেওয়া এখন পর্যন্ত সম্ভব নয়। ভূমিকম্প দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতি হ্রাস করার একমাত্র উপায় সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ এবং সম্ভাব্য দুর্যোগ সম্পর্কে প্রস্তুতি। এজন্য সরকারি বেসরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি প্রয়োজন সর্বস্তরে সচেতনতা। -পিআইডি ফিচার
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
শেষের গোলে জিতে চেলসির জয়রথ থামাল ফুলহ্যাম
পরলোকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং :ভারতে ৭ দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা
কালীগঞ্জে রাঙ্গামাটিয়া ধর্মপল্লীর সংবাদ সম্মেলন
গ্রাম আদালত সম্পর্কে জনসচেতনতা তৈরিতে সমন্বয় সভা অনুষ্ঠিত
মিসরে প্রেসিডেন্ট সিসির বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ
কুর্দি যোদ্ধাদের ভয়ঙ্কর হুঁশিয়ারি এরদোগানের
৩৫শ’ এজেন্টের অধিকাংশই গুজরাটের পাচারকারী
৫ সাংবাদিককে হত্যা করল ইসরাইল বিমান
তুষারপাতে অচল হিমাচল দুই শতাধিক রাস্তা বন্ধ
ক্রিপ্টো রিজার্ভ গড়বেন ট্রাম্প?
মোজাম্বিকে কারাদাঙ্গায় নিহত ৩৩, পলাতক ১৫০০ কয়েদি
গাজায় যুদ্ধবিরতি বিলম্বে পাল্টাপাল্টি দোষারোপ হামাস-ইসরাইলের
পাকিস্তানে সড়ক অবরোধে শতাধিক শিশুর প্রাণহানি
আফগানিস্তানে ৭১ সন্ত্রাসীকে হত্যা করেছে পাকিস্তান
শুধু নারীদের জন্য
নিথর দেহ
আত্মহননে
জকিগঞ্জে প্রাক্সিসের ৭ দিনব্যাপী ইংলিশ স্পিকিং চ্যালেঞ্জ কম্পিটিশনের পুরস্কার বিতরণী
মাদ্রাসার ছাদ থেকে পাইপ বেয়ে নামার সময় পড়ে গিয়ে শিশুর মৃত্যু
গাজীপুরে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ নেতাকে ছাড়িয়ে আনতে থানায় বিএনপি নেতাদের ভিড়