ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রসঙ্গে
০৩ মে ২০২৩, ০৭:২৩ পিএম | আপডেট: ০৪ মে ২০২৩, ১২:০১ এএম
অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা উঠে যেতে বসেছে। দুর্নীতির সংবাদ প্রচার বা প্রকাশের সাহস দেখানো এখন দুঃসাহসিকতার উদাহরণ। হোক সে দুর্নীতি সরকার, গোষ্ঠী, প্রতিষ্ঠান কিংবা ক্ষমতাধর ব্যক্তির। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আইনের অপব্যবহার এমন হচ্ছে যে, অবস্থা দৃষ্টে মনে হয় আইন বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোকে দেশের সাধারণ জনগণের বিপক্ষে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রকারান্তরে জনগণের সত্য বলার আর সত্য জানার সাংবিধানিক অধিকারকে যেন কেড়ে নেওয়া হচ্ছে।
এমনতর দুঃসময়ে সাইবার স্পেস, সাইবার সিকিউরিটি ও আইসিটি অ্যাক্ট বিষয়ে একটি গবেষণা প্রবন্ধের আলোচনায় অংশ নেয়ার আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন একজন গবেষক। দেশের গণমাধ্যম কর্মীদের পেশাগতভাবে শক্ত পোক্ত করতে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা নিউজ নেটওয়ার্ক এ আলোচনার আয়োজন করে। এতে ‘সাইবার ল অ্যান্ড ক্রিমিনালাইজেশন অব ডিজিটাল রাইটস ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামে গবেষক রেজাউর রহমান লেলিন ‘তথ্য প্রযুক্তি আইন-২০০৬ ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮’র প্রেক্ষিত ও বাস্তবতা তুলে ধরেন।
গবেষক তার প্রবন্ধে সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্ট্যাডিস (সিজিএস) এর বরাত দিয়ে জানান, শুধু ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে ৮ অক্টোবর ২০১৮ সাল থেকে মামলা হয়েছে ২০২২ অগস্ট পর্যন্ত ১১২৯টি। এর মধ্যে রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে ৩০১টি, আইনজীবীদের বিরুদ্ধে ২২টি, শিক্ষক/শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে ১৫৭টি এবং সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ২৮০টি।
এসব মামলার মধ্যে ৫৯৬টি প্রথম শুনানিতে আদালত খারিজ করে দিয়েছেন জানিয়ে রেজাউর রহমান লেলিন বলেন, এর সবগুলোই ছিলো মিথ্যা মামলা। কিন্তু এই মিথ্যা মামলাকারীদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা হয়নি। মামলায় অভিযুক্তরা কোনো ক্ষতিপূরণ পাননি। তার উপস্থাপিত তথ্যানুসারে, ২৭ জন শিশুর বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে। শিশুদের যে কোনো অপরাধের মামলা শিশু আইনে করার বিধান থাকলেও তা উপেক্ষিত হওয়ার নজির রয়েছে।
গবেষণায় বলা হয়েছে, ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে এখন স্মার্ট বাংলাদেশের সুরক্ষায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রয়োজনীয়তা আছে বলে মনে করছে সরকার। কিন্তু সরকারের এ প্রয়োজনীতার বিপক্ষে শুরু থেকে দেশের বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের যে মতামত তুলে ধরা হয়েছিলো তা আমলে না নিয়ে তথ্য প্রযুক্তি আইন-২০০৬ এর অনেকগুলো ধারা সম্পৃক্ত করে সরকার এ আইন পাশ করে। এ আইন বাস্তবায়নে যা ইতোমধ্যে ঘটেছে তা কতোটা সাংবিধানিক অধিকার পরিপন্থী সে প্রশ্ন ক্রমেই জোরালো হচ্ছে। এ আইনে সন্তানসম্ভবা নারীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে এবং কারা ভোগ করেছেন। আট বছর আগে মারা যাওয়া ব্যক্তির বিরুদ্ধেও মামলা হয়েছে। এ আইনে শিশুদের বিরুদ্ধেও মামলা হয়েছে। এসব বিবেচনায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন শিশু আইনের সাথেও সাংঘর্ষিক বলে মতামত তুলে ধরা হয়েছে। তা ছাড়া এ আইনের ১৭ থেকে ৩৪ পর্যন্ত ধারাগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে বলে মন্তব্য করা হয়েছে।
‘নিবর্তন’ বা ‘নিপীড়নমূলক’ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে দেশের প্রায় সব পেশার মানুষের মধ্যে অসংখ্য প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। চল্লিশ বছরের আইন পেশায় অভিজ্ঞ সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্নার মতামত সম্প্রতি একটি পত্রিকান্তরে পড়লাম, সেখানে সাক্ষাৎকারে তিনি সোজা সাপটা বলেছেন, ‘ডিজিটাল সুরক্ষা পেতে বিভিন্ন দেশেই আইন আছে। কিন্তু আমাদের দেশে যা হচ্ছে; যেমন নওগাঁর জেসমিনের ক্ষেত্রে যা হলো কিংবা ভিন্নমত বন্ধ করতে বা সাংবাদিকদের দমনে যা হচ্ছে, তা রীতিমত অন্যায়।’ তিনি বলেন, আমাদের দেশে বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করা হয়েছে। অথচ, আইন হওয়া উচিত অপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করতে। আর এখানে বড় অপরাধীদের সুরক্ষা দিতেই এমন আইন করা হয়। আইনটি আমাদের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বিধায় এটি বাতিলের দাবি তুলেছেন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক এই সভাপতি।
প্রায় অভিন্ন দাবি করেছেন মানবাধিকার কর্মী রেজাউর রহমান লেলিন। তিনি বলেন, ‘এই আইনে যে ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতার কথা বলা হয়েছে, তা খুব বিস্তৃত এবং তা আদালতের নজরদারির বাইরে। একই সাথে এ আইনটি ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং জনস্বার্থে দুর্নীতির বিরুদ্ধে তথ্য প্রকাশের ক্ষেত্রে নিরুৎসাহিত করে এবং অধিকার হরণ করে। সুতারং এ নির্বতনমূলক অবৈধ আইনটি সম্পূর্ণরূপে বাতিল করতে হবে।’
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে চতুর্মুখী সমালোচনা যখন তুঙ্গে তখন সরকারের অবস্থান বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে। দেখা গেছে, যারা ক্ষমতাসীন দলে বড় তেমন পদ পদবিতে নেই, অথচ মন্ত্রিসভায় আছেন তারা আইনের নানান দুর্বলতা ও আপপ্রয়োগ নিয়ে সংশোধনের মতামত দিয়েছেন। পক্ষান্তরে যারা দলীয় বড় পদ পদবিতে এবং গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে রয়েছেন তারা কোনো অবস্থাতেই বাতিলতো দূরের কথা সংশোধনের পক্ষেও নন। একজন মন্ত্রী তাচ্ছিল্যের সাথে সাংবাদিকদের বলেছেন, সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সংবাদ সেন্সর করা হচ্ছে না, সাংবাদিকরা নিজেরাই সেন্সর করছেন। এ বিষয়ে দৃশ্যত অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন পক্ষের সাথে একাধিক বৈঠক করেছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। জানিয়েছেন আরো বৈঠক করার কথা। এক সভায় তিনি বলেছেন, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে আবার বসা হবে, সেখানে যে কেউ মতামত দিতে পারবেন। অনেকেই বলেছেন, এই আইন করে কোনো উপকার হয়নি। আমার মনে হয় কিছু কিছু উপকার হয়েছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘ আমি এমন কথা বলব না যে আইনটির কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি নেই। সব আইনেরই কিছু পদ্ধতিগত সমস্যা থাকে। আবার কিছু কিছু বাস্তবায়নের সমস্যা থাকে। যখন বাস্তবায়নে সমস্যা হয় তখন আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা হয়। ঠিক সে কারণেই বলছি, এই আইন নিয়ে আমরা আবার বসব। যদি বিধি পরিবর্তন করে সমস্যার সমাধান করতে পারি, তা হলে অবশ্যই আমরা সে দিকে যাব।’
এখন দেখা যাক, মন্ত্রীর কথা কীভাবে মানুষের প্রত্যাশার অনুকূলে বাস্তবায়িত হয়।
লেখক: সাংবাদিক
[email protected]
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
পরলোকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং :ভারতে ৭ দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা
কালীগঞ্জে রাঙ্গামাটিয়া ধর্মপল্লীর সংবাদ সম্মেলন
গ্রাম আদালত সম্পর্কে জনসচেতনতা তৈরিতে সমন্বয় সভা অনুষ্ঠিত
মিসরে প্রেসিডেন্ট সিসির বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ
কুর্দি যোদ্ধাদের ভয়ঙ্কর হুঁশিয়ারি এরদোগানের
৩৫শ’ এজেন্টের অধিকাংশই গুজরাটের পাচারকারী
৫ সাংবাদিককে হত্যা করল ইসরাইল বিমান
তুষারপাতে অচল হিমাচল দুই শতাধিক রাস্তা বন্ধ
ক্রিপ্টো রিজার্ভ গড়বেন ট্রাম্প?
মোজাম্বিকে কারাদাঙ্গায় নিহত ৩৩, পলাতক ১৫০০ কয়েদি
গাজায় যুদ্ধবিরতি বিলম্বে পাল্টাপাল্টি দোষারোপ হামাস-ইসরাইলের
পাকিস্তানে সড়ক অবরোধে শতাধিক শিশুর প্রাণহানি
আফগানিস্তানে ৭১ সন্ত্রাসীকে হত্যা করেছে পাকিস্তান
শুধু নারীদের জন্য
নিথর দেহ
আত্মহননে
জকিগঞ্জে প্রাক্সিসের ৭ দিনব্যাপী ইংলিশ স্পিকিং চ্যালেঞ্জ কম্পিটিশনের পুরস্কার বিতরণী
মাদ্রাসার ছাদ থেকে পাইপ বেয়ে নামার সময় পড়ে গিয়ে শিশুর মৃত্যু
গাজীপুরে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ নেতাকে ছাড়িয়ে আনতে থানায় বিএনপি নেতাদের ভিড়
শুধু নামেই জিমনেসিয়াম