ঢাকা   শুক্রবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪ | ১৩ পৌষ ১৪৩১

প্রকৃতি ও আগুনের দাহ

Daily Inqilab রিন্টু আনোয়ার

০৪ মে ২০২৩, ০৭:৫৫ পিএম | আপডেট: ০৫ মে ২০২৩, ১২:০১ এএম

ঈদের ক’দিন আগে তাপেচাপে মাত্রা ছাড়ানো আজাবে ভুগেছে মানুষ। আগুন সইছে। তাপদহের কারণে অসুখ-বিসুখে ভুগছে। ভয়াবহ তাপদাহ, ঢাকা থেকে চুয়াডাঙ্গা-ঈশ্বরদী মিলিয়ে দেশে সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড। পাশাপাশি রাজধানীর বনানীর এআর টাওয়ার থেকে কক্সবাজারের রোহিঙ্গাক্যাম্প পর্যন্ত ঘুরছে আগুনের কু-লি। এর মাঝেই বিদ্যুতের লোডশেডিং। তা আরো বাড়বে বলে আভাস দিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ, যার সারকথা হচ্ছে, সামনে ভোগান্তি আরো আছে। বাড়তি টাকা দিয়ে বিদ্যুতের ভোগান্তি যেন খরিদ করতে হয়েছে মানুষকে। বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির যৌক্তিকতা নিয়ে আইনত প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই। আবার একে মূল্যবৃদ্ধি না বলে সরকার বলতে চায় সমন্বয়। সরকারের নির্বাহী আদেশে এক মাসের ব্যবধানে ফের বাড়ানো হলো বিদ্যুতের দাম। গত ১৪ বছরে পাইকারি পর্যায়ে ১১ বার ও খুচরা পর্যায়ে ১৩ বার বাড়ানো হলো বিদ্যুতের দাম। আগে গণশুনানির মাধ্যমে বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ করতো এ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন-বিইআরসি। আইন সংশোধন করে এ ক্ষমতা হাতে নিয়েছে সরকার। এরপর থেকে নির্বাহী আদেশে দাম বাড়াচ্ছে বিদ্যুৎ বিভাগ।

একদিকে প্রকৃতির নিষ্ঠুরতা আরেকদিকে মানবসৃষ্ট দুর্গতির এ যোগফল সামনে কেবল আজাবের বার্তাই দিচ্ছে। স্বস্তির ভরসা কম বা নেই। টানা খরা, তাপদাহ ও লোডশেডিং কৃষিখাতসহ গোটা আর্থ-সামাজিকতায় কী বিপর্যয় ডাকছে তা এ মুহূর্ত্যে অনেকেরই ধারনার বাইরে। বিদ্যুৎ বিভাগের হিসাবে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২৫ হাজার মেগাওয়াট বলা হচ্ছে। কিন্তু উৎপাদন ১৫ হাজার মেগাওয়াটের বেশিতে নেয়া যাচ্ছে না। রামপাল, আশুগঞ্জ নর্থ ও আশুগঞ্জ ইস্টসহ কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র কারিগরি ত্রুটি ভর করেছে। সাধারণ কা-জ্ঞানেই বোঝা সম্ভব, সামনে আরো বিপর্যয় অপেক্ষা করছে।

এমনিতেই প্রচ- গরমের কারণে ঘরে-বাইরে কোথাও একদ- স্বস্তি নেই। তার ওপর লোডশেডিংয়ের অস্বাভাবিক মাত্রা। প্রকৃতির নিষ্ঠুরতার মাঝে বিদ্যুতের যন্ত্রণা। তার ওপর আজ এখানে, কাল সেখানে আগুন লাগছে। মহাখালীর সাততলা বস্তি, কাপ্তানবাজারের সুইপার কলোনি থেকে বঙ্গবাজার, নবাবপুর, নিউমার্কেট হয়ে বায়তুল মোকাররম, উত্তরা বিজিবি মার্কেট, ওয়ারি কোথাও বাদ নেই। গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ছাড়িয়ে চট্টগ্রাম এমন কি কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্প পর্যন্ত বিস্তৃতি ঘটছে আগুনের। আগুন নিজে লাগে, না কেউ লাগিয়ে দেয়, এ নিয়ে বহুকথা আছে। কিছুদিন ধরে আগুন কি এত শক্তিশালী হয়ে গেছে, নিজে নিজেই লেগে যাচ্ছে? আবিষ্কারের শুরুতেও আগুন কখনো নিজে নিজে জ্বলেনি। ঘষা লেগে কিংবা ঘষা লাগিয়েই জ্বলে উঠতে হয়েছে আগুনকে। একের পর এক আগুনের সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো এসব কথাকে প্রাসঙ্গিক করে তুলেছে।
মাস কয়েক ধরে ‘খেলা হবে, খেলা হবে’ নামে একটি নি¤œমানের রাজনৈতিক স্লোগান চলেছে। রাজনীতির মাঠে উত্তাপ থাকলেও ঘোষণা বা স্লোগান মতো তেমন খেলা স্পষ্ট নয়। তবে, কথার খেলা চলছে আচ্ছা মতো। এর মাঝেই ভর করেছে আগুন খেলা।

ক্ষমতাসীন মহল থেকে প্রথমে ইঙ্গিত, পরে নাম ধরেই এ আগুনের জন্য বিএনপিকে দায়ী করা হচ্ছে। সরকারের তার থেকে বলা হয়েছে, আন্দোলনে ব্যর্থ হয়ে বিএনপি এখন আগুন লাগানো শুরু করেছে। পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বলা হয়েছে বিষয়টি খতিয়ে দেখতে। সরকার থেকে যখন আগুনের হোতা দেখিয়ে দেয়া হচ্ছে, তখন আর খতিয়ে দেখার কিছু থাকে না। হোতা তো সনাক্তই। বিএনপিরও সরাসরি আক্রমণ সরকারের দিকে। বঙ্গবাজার-নিউমার্কেটসহ বিভিন্ন জায়গার নতুন করে দখল ও বরাদ্দের জন্য এ আগুন খেলা চলছে বলে তার অভিযোগ। আওয়ামী লীগ আর আগুনকে সমার্থক করে বলা হচ্ছে, দলটির আমলে ৭৩-৭৪ সালেও এমন ঘটেছে। অবিরাম এসব অগ্নিকা-ের পেছনে নাশকতা-ষড়যন্ত্র বলে দাবি সরকারের। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রশ্ন তুলেছেন আগুন কেন শেষ রাতে?

স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে প্রত্যাহিক অগ্নিকা- ছিল নাশকতা ও অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকা-ের অন্যতম অস্ত্র। দেশ সদ্য স্বাধীন কিনা, মানুষ অভাবে আছে কিনা- এসব ভাবার বোধ তাদের ছিল না। বর্তমানের অগ্নিকা-গুলোও নিয়েও অনেকে প্রশ্নবিদ্ধ। এসব আগুন লাগে, নাকি কেউ লাগায়-এ প্রশ্নের নিস্পত্তি টানা যায় না। অবস্থানগতভাবে বঙ্গবাজার আর পুঁজিবাজার এক বরাবর। উভয় বাজারের বিনিয়োগকারীদেরই মাথায হাত। দুই জায়গায়ই এই বেলা লাখপতি-কোটিপতি নিঃস্ব পরের বেলা। এই নিঃস্বরা রাজনীতিকদের কাছে পণ্যের মতো। আর রাজনীতিকদের আইটেম হয়ে গেলে কোনো ঘটনা কোনদিকে যায় ঠিকঠিকানা থাকে না। ক্ষমতাসীন দল থেকে বলা হচ্ছে, বিএনপি আন্দোলনে ব্যর্থ হয়ে বাজারে আগুন দেয়ার নাশকতায় নেমেছে। বিএনপি এ আগুনের জন্য সরকারকে দূষছে।

সামনে নির্বাচন। ওই নির্বাচনের আগে এটিই শেষ রমজান গেলো। হয়তো এ কারণে এবারের রমজানে রাজনৈতিক উত্তেজনা, সংঘাত-সংঘর্ষের খবর তুলনামূলক বেশি ছিলো। বাজারে নিত্যপণ্যের দামে রয়েছে আগুন। সেই সাথে বাস্তব আগুনও। ঘরপোড়ার মাঝে আলুপোড়া খাওয়ার কোনো আগুনখেলা কি না, প্রশ্ন অনেকের। প্রকৃতিও আগুনের মতো নিরপেক্ষ। পক্ষপাতিত্ব করে না। গত কয়েক বছর ধরেই প্রকৃতি তার প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে। শীতকালে শীত নেই, বর্ষাকালে দেখা নেই বৃষ্টির। প্রকৃতির এ বদলে যাওয়ার দায় কার? ক্লাইমেট চেঞ্জ নাম দিয়ে একটা যুক্তি দাঁড় করানো হয়। সে এমনি এমনি চেঞ্জ হয় না। তার সাথে যা করা হয়, সে তার প্রতিক্রিয়া বা প্রতিদানই দেয়। কখনো কখনো সেটা একটু সময়সাপেক্ষ হয় মাত্র। তা রুখতে পারার দৃষ্টান্ত দুনিয়াতে নেই। প্রকৃতি এভাবে দহন করতে থাকলে সামনে কী হতে পারে? সেই ভাবনা-বিশ্লেষণ চোখে পড়ে না।
আলামত বলছে, আরো দুর্গতি অপেক্ষমান। এরই মাঝে কয়েক দিনের খরায় ধান, পাটসহ সব ধরনের ফসল ফসল নিয়ে কৃষকেরা চরম বিপাকে। ধানের ব্লাস্ট রোগ হয়ে ধানে চিটা হয়ে যাচ্ছে। গরমের সঙ্গে বাতাসে আগুনে হলকা ক্ষেতখামারের কী সর্বনাশ করছে তা ভুক্তভোগী ছাড়া অন্যদের বোঝা সম্ভব নয়। বোরো ধানের ক্ষেত কেমন বিবর্ণ হয়ে গেছে শহরে থাকা অনেকের জানার বাইরে। হাওরাঞ্চলসহ বিভিন্ন জায়গায় বোরো ধানে চিটার নমুনা দেখছে কৃষকরা। হাওরাঞ্চলে বিআর ২৮ ও ২৯ ধানের ব্যাপক ফলনে কতো আশাবাদী ছিল তারা। বলা হয়ে থাকে, বাজার পুড়লে মাজারও থাকে না; লোকালয়ে আগুন লাগলে দেবালয়ও রক্ষা পায় না। এ ধরনের আরো অনেক কথার প্রচলন আছে আমাদের সমাজে ও লোক সাহিত্যে। কথাগুলোর অর্থ বহুমুখী। আক্ষরিক-আভিধানিকে অনেক তফাত। কোনো রাজ্যে অনিয়ম-নৈরাজ্য নিয়মের মধ্যে পড়ে গেলে সেখানে আগুন-পানিও আর নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় না।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
[email protected]


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

শুধু নামেই জিমনেসিয়াম
মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতিতে কী পরিবর্তন আসছে?
অন্তর্বর্তী সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতদ্বৈততা কাম্য নয়
সচিবালয়ে আগুন সন্দেহজনক
বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের যত্ন নিতে হবে
আরও

আরও পড়ুন

পরলোকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং :ভারতে ৭ দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা

পরলোকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং :ভারতে ৭ দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা

কালীগঞ্জে রাঙ্গামাটিয়া ধর্মপল্লীর সংবাদ সম্মেলন

কালীগঞ্জে রাঙ্গামাটিয়া ধর্মপল্লীর সংবাদ সম্মেলন

গ্রাম আদালত সম্পর্কে জনসচেতনতা তৈরিতে সমন্বয় সভা অনুষ্ঠিত

গ্রাম আদালত সম্পর্কে জনসচেতনতা তৈরিতে সমন্বয় সভা অনুষ্ঠিত

মিসরে প্রেসিডেন্ট সিসির বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ

মিসরে প্রেসিডেন্ট সিসির বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ

কুর্দি যোদ্ধাদের ভয়ঙ্কর হুঁশিয়ারি এরদোগানের

কুর্দি যোদ্ধাদের ভয়ঙ্কর হুঁশিয়ারি এরদোগানের

৩৫শ’ এজেন্টের অধিকাংশই গুজরাটের পাচারকারী

৩৫শ’ এজেন্টের অধিকাংশই গুজরাটের পাচারকারী

৫ সাংবাদিককে হত্যা করল ইসরাইল বিমান

৫ সাংবাদিককে হত্যা করল ইসরাইল বিমান

তুষারপাতে অচল হিমাচল দুই শতাধিক রাস্তা বন্ধ

তুষারপাতে অচল হিমাচল দুই শতাধিক রাস্তা বন্ধ

ক্রিপ্টো রিজার্ভ গড়বেন ট্রাম্প?

ক্রিপ্টো রিজার্ভ গড়বেন ট্রাম্প?

মোজাম্বিকে কারাদাঙ্গায় নিহত ৩৩, পলাতক ১৫০০ কয়েদি

মোজাম্বিকে কারাদাঙ্গায় নিহত ৩৩, পলাতক ১৫০০ কয়েদি

গাজায় যুদ্ধবিরতি বিলম্বে পাল্টাপাল্টি দোষারোপ হামাস-ইসরাইলের

গাজায় যুদ্ধবিরতি বিলম্বে পাল্টাপাল্টি দোষারোপ হামাস-ইসরাইলের

পাকিস্তানে সড়ক অবরোধে শতাধিক শিশুর প্রাণহানি

পাকিস্তানে সড়ক অবরোধে শতাধিক শিশুর প্রাণহানি

আফগানিস্তানে ৭১ সন্ত্রাসীকে হত্যা করেছে পাকিস্তান

আফগানিস্তানে ৭১ সন্ত্রাসীকে হত্যা করেছে পাকিস্তান

শুধু নারীদের জন্য

শুধু নারীদের জন্য

নিথর দেহ

নিথর দেহ

আত্মহননে

আত্মহননে

জকিগঞ্জে প্রাক্সিসের ৭ দিনব্যাপী ইংলিশ স্পিকিং চ্যালেঞ্জ কম্পিটিশনের পুরস্কার বিতরণী

জকিগঞ্জে প্রাক্সিসের ৭ দিনব্যাপী ইংলিশ স্পিকিং চ্যালেঞ্জ কম্পিটিশনের পুরস্কার বিতরণী

মাদ্রাসার ছাদ থেকে পাইপ বেয়ে নামার সময় পড়ে গিয়ে শিশুর মৃত্যু

মাদ্রাসার ছাদ থেকে পাইপ বেয়ে নামার সময় পড়ে গিয়ে শিশুর মৃত্যু

গাজীপুরে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ নেতাকে ছাড়িয়ে আনতে থানায় বিএনপি নেতাদের ভিড়

গাজীপুরে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ নেতাকে ছাড়িয়ে আনতে থানায় বিএনপি নেতাদের ভিড়

শুধু নামেই জিমনেসিয়াম

শুধু নামেই জিমনেসিয়াম