প্রকৃতি ও আগুনের দাহ

Daily Inqilab রিন্টু আনোয়ার

০৪ মে ২০২৩, ০৭:৫৫ পিএম | আপডেট: ০৫ মে ২০২৩, ১২:০১ এএম

ঈদের ক’দিন আগে তাপেচাপে মাত্রা ছাড়ানো আজাবে ভুগেছে মানুষ। আগুন সইছে। তাপদহের কারণে অসুখ-বিসুখে ভুগছে। ভয়াবহ তাপদাহ, ঢাকা থেকে চুয়াডাঙ্গা-ঈশ্বরদী মিলিয়ে দেশে সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড। পাশাপাশি রাজধানীর বনানীর এআর টাওয়ার থেকে কক্সবাজারের রোহিঙ্গাক্যাম্প পর্যন্ত ঘুরছে আগুনের কু-লি। এর মাঝেই বিদ্যুতের লোডশেডিং। তা আরো বাড়বে বলে আভাস দিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ, যার সারকথা হচ্ছে, সামনে ভোগান্তি আরো আছে। বাড়তি টাকা দিয়ে বিদ্যুতের ভোগান্তি যেন খরিদ করতে হয়েছে মানুষকে। বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির যৌক্তিকতা নিয়ে আইনত প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই। আবার একে মূল্যবৃদ্ধি না বলে সরকার বলতে চায় সমন্বয়। সরকারের নির্বাহী আদেশে এক মাসের ব্যবধানে ফের বাড়ানো হলো বিদ্যুতের দাম। গত ১৪ বছরে পাইকারি পর্যায়ে ১১ বার ও খুচরা পর্যায়ে ১৩ বার বাড়ানো হলো বিদ্যুতের দাম। আগে গণশুনানির মাধ্যমে বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ করতো এ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন-বিইআরসি। আইন সংশোধন করে এ ক্ষমতা হাতে নিয়েছে সরকার। এরপর থেকে নির্বাহী আদেশে দাম বাড়াচ্ছে বিদ্যুৎ বিভাগ।

একদিকে প্রকৃতির নিষ্ঠুরতা আরেকদিকে মানবসৃষ্ট দুর্গতির এ যোগফল সামনে কেবল আজাবের বার্তাই দিচ্ছে। স্বস্তির ভরসা কম বা নেই। টানা খরা, তাপদাহ ও লোডশেডিং কৃষিখাতসহ গোটা আর্থ-সামাজিকতায় কী বিপর্যয় ডাকছে তা এ মুহূর্ত্যে অনেকেরই ধারনার বাইরে। বিদ্যুৎ বিভাগের হিসাবে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২৫ হাজার মেগাওয়াট বলা হচ্ছে। কিন্তু উৎপাদন ১৫ হাজার মেগাওয়াটের বেশিতে নেয়া যাচ্ছে না। রামপাল, আশুগঞ্জ নর্থ ও আশুগঞ্জ ইস্টসহ কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র কারিগরি ত্রুটি ভর করেছে। সাধারণ কা-জ্ঞানেই বোঝা সম্ভব, সামনে আরো বিপর্যয় অপেক্ষা করছে।

এমনিতেই প্রচ- গরমের কারণে ঘরে-বাইরে কোথাও একদ- স্বস্তি নেই। তার ওপর লোডশেডিংয়ের অস্বাভাবিক মাত্রা। প্রকৃতির নিষ্ঠুরতার মাঝে বিদ্যুতের যন্ত্রণা। তার ওপর আজ এখানে, কাল সেখানে আগুন লাগছে। মহাখালীর সাততলা বস্তি, কাপ্তানবাজারের সুইপার কলোনি থেকে বঙ্গবাজার, নবাবপুর, নিউমার্কেট হয়ে বায়তুল মোকাররম, উত্তরা বিজিবি মার্কেট, ওয়ারি কোথাও বাদ নেই। গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ছাড়িয়ে চট্টগ্রাম এমন কি কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্প পর্যন্ত বিস্তৃতি ঘটছে আগুনের। আগুন নিজে লাগে, না কেউ লাগিয়ে দেয়, এ নিয়ে বহুকথা আছে। কিছুদিন ধরে আগুন কি এত শক্তিশালী হয়ে গেছে, নিজে নিজেই লেগে যাচ্ছে? আবিষ্কারের শুরুতেও আগুন কখনো নিজে নিজে জ্বলেনি। ঘষা লেগে কিংবা ঘষা লাগিয়েই জ্বলে উঠতে হয়েছে আগুনকে। একের পর এক আগুনের সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো এসব কথাকে প্রাসঙ্গিক করে তুলেছে।
মাস কয়েক ধরে ‘খেলা হবে, খেলা হবে’ নামে একটি নি¤œমানের রাজনৈতিক স্লোগান চলেছে। রাজনীতির মাঠে উত্তাপ থাকলেও ঘোষণা বা স্লোগান মতো তেমন খেলা স্পষ্ট নয়। তবে, কথার খেলা চলছে আচ্ছা মতো। এর মাঝেই ভর করেছে আগুন খেলা।

ক্ষমতাসীন মহল থেকে প্রথমে ইঙ্গিত, পরে নাম ধরেই এ আগুনের জন্য বিএনপিকে দায়ী করা হচ্ছে। সরকারের তার থেকে বলা হয়েছে, আন্দোলনে ব্যর্থ হয়ে বিএনপি এখন আগুন লাগানো শুরু করেছে। পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বলা হয়েছে বিষয়টি খতিয়ে দেখতে। সরকার থেকে যখন আগুনের হোতা দেখিয়ে দেয়া হচ্ছে, তখন আর খতিয়ে দেখার কিছু থাকে না। হোতা তো সনাক্তই। বিএনপিরও সরাসরি আক্রমণ সরকারের দিকে। বঙ্গবাজার-নিউমার্কেটসহ বিভিন্ন জায়গার নতুন করে দখল ও বরাদ্দের জন্য এ আগুন খেলা চলছে বলে তার অভিযোগ। আওয়ামী লীগ আর আগুনকে সমার্থক করে বলা হচ্ছে, দলটির আমলে ৭৩-৭৪ সালেও এমন ঘটেছে। অবিরাম এসব অগ্নিকা-ের পেছনে নাশকতা-ষড়যন্ত্র বলে দাবি সরকারের। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রশ্ন তুলেছেন আগুন কেন শেষ রাতে?

স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে প্রত্যাহিক অগ্নিকা- ছিল নাশকতা ও অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকা-ের অন্যতম অস্ত্র। দেশ সদ্য স্বাধীন কিনা, মানুষ অভাবে আছে কিনা- এসব ভাবার বোধ তাদের ছিল না। বর্তমানের অগ্নিকা-গুলোও নিয়েও অনেকে প্রশ্নবিদ্ধ। এসব আগুন লাগে, নাকি কেউ লাগায়-এ প্রশ্নের নিস্পত্তি টানা যায় না। অবস্থানগতভাবে বঙ্গবাজার আর পুঁজিবাজার এক বরাবর। উভয় বাজারের বিনিয়োগকারীদেরই মাথায হাত। দুই জায়গায়ই এই বেলা লাখপতি-কোটিপতি নিঃস্ব পরের বেলা। এই নিঃস্বরা রাজনীতিকদের কাছে পণ্যের মতো। আর রাজনীতিকদের আইটেম হয়ে গেলে কোনো ঘটনা কোনদিকে যায় ঠিকঠিকানা থাকে না। ক্ষমতাসীন দল থেকে বলা হচ্ছে, বিএনপি আন্দোলনে ব্যর্থ হয়ে বাজারে আগুন দেয়ার নাশকতায় নেমেছে। বিএনপি এ আগুনের জন্য সরকারকে দূষছে।

সামনে নির্বাচন। ওই নির্বাচনের আগে এটিই শেষ রমজান গেলো। হয়তো এ কারণে এবারের রমজানে রাজনৈতিক উত্তেজনা, সংঘাত-সংঘর্ষের খবর তুলনামূলক বেশি ছিলো। বাজারে নিত্যপণ্যের দামে রয়েছে আগুন। সেই সাথে বাস্তব আগুনও। ঘরপোড়ার মাঝে আলুপোড়া খাওয়ার কোনো আগুনখেলা কি না, প্রশ্ন অনেকের। প্রকৃতিও আগুনের মতো নিরপেক্ষ। পক্ষপাতিত্ব করে না। গত কয়েক বছর ধরেই প্রকৃতি তার প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে। শীতকালে শীত নেই, বর্ষাকালে দেখা নেই বৃষ্টির। প্রকৃতির এ বদলে যাওয়ার দায় কার? ক্লাইমেট চেঞ্জ নাম দিয়ে একটা যুক্তি দাঁড় করানো হয়। সে এমনি এমনি চেঞ্জ হয় না। তার সাথে যা করা হয়, সে তার প্রতিক্রিয়া বা প্রতিদানই দেয়। কখনো কখনো সেটা একটু সময়সাপেক্ষ হয় মাত্র। তা রুখতে পারার দৃষ্টান্ত দুনিয়াতে নেই। প্রকৃতি এভাবে দহন করতে থাকলে সামনে কী হতে পারে? সেই ভাবনা-বিশ্লেষণ চোখে পড়ে না।
আলামত বলছে, আরো দুর্গতি অপেক্ষমান। এরই মাঝে কয়েক দিনের খরায় ধান, পাটসহ সব ধরনের ফসল ফসল নিয়ে কৃষকেরা চরম বিপাকে। ধানের ব্লাস্ট রোগ হয়ে ধানে চিটা হয়ে যাচ্ছে। গরমের সঙ্গে বাতাসে আগুনে হলকা ক্ষেতখামারের কী সর্বনাশ করছে তা ভুক্তভোগী ছাড়া অন্যদের বোঝা সম্ভব নয়। বোরো ধানের ক্ষেত কেমন বিবর্ণ হয়ে গেছে শহরে থাকা অনেকের জানার বাইরে। হাওরাঞ্চলসহ বিভিন্ন জায়গায় বোরো ধানে চিটার নমুনা দেখছে কৃষকরা। হাওরাঞ্চলে বিআর ২৮ ও ২৯ ধানের ব্যাপক ফলনে কতো আশাবাদী ছিল তারা। বলা হয়ে থাকে, বাজার পুড়লে মাজারও থাকে না; লোকালয়ে আগুন লাগলে দেবালয়ও রক্ষা পায় না। এ ধরনের আরো অনেক কথার প্রচলন আছে আমাদের সমাজে ও লোক সাহিত্যে। কথাগুলোর অর্থ বহুমুখী। আক্ষরিক-আভিধানিকে অনেক তফাত। কোনো রাজ্যে অনিয়ম-নৈরাজ্য নিয়মের মধ্যে পড়ে গেলে সেখানে আগুন-পানিও আর নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় না।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
[email protected]


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

জিতেও ইউরোপা লীগ থেকে বিদায় লিভারপুলের

জিতেও ইউরোপা লীগ থেকে বিদায় লিভারপুলের

আমিরের ফেরার ম্যাচ বৃষ্টিতে পরিত্যক্ত

আমিরের ফেরার ম্যাচ বৃষ্টিতে পরিত্যক্ত

নেতাকর্মীদের ওপর অবর্ণনীয় নির্যাতন শুরু হয়েছে : মির্জা ফখরুল

নেতাকর্মীদের ওপর অবর্ণনীয় নির্যাতন শুরু হয়েছে : মির্জা ফখরুল

অপপ্রচার রোধে ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের সহায়তা নেব : তথ্য প্রতিমন্ত্রী

অপপ্রচার রোধে ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের সহায়তা নেব : তথ্য প্রতিমন্ত্রী

ভারতের সহায়তা নিয়েই সরকার দেশের গণতন্ত্রকে বন্দি করেছে : রহুল কবির রিজভী

ভারতের সহায়তা নিয়েই সরকার দেশের গণতন্ত্রকে বন্দি করেছে : রহুল কবির রিজভী

পরীমণিকে আদালতে হাজির হতে সমন জারি

পরীমণিকে আদালতে হাজির হতে সমন জারি

ভারতে আজ থেকে ৭ দফার লোকসভা নির্বাচন

ভারতে আজ থেকে ৭ দফার লোকসভা নির্বাচন

বাংলাদেশ-আমিরাত কুটনৈতিক সম্পর্ক অনন্য উচ্চতায় অধিষ্ঠিত -স্বাধীনতা বার্ষিকী ও সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানে কনসাল জেনারেল

বাংলাদেশ-আমিরাত কুটনৈতিক সম্পর্ক অনন্য উচ্চতায় অধিষ্ঠিত -স্বাধীনতা বার্ষিকী ও সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানে কনসাল জেনারেল

শহীদ ও মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সম্মানি বৃদ্ধির প্রস্তাব সরকারের বিবেচনাধীন

শহীদ ও মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সম্মানি বৃদ্ধির প্রস্তাব সরকারের বিবেচনাধীন

রিজার্ভ ফের ২০ বিলিয়নের নিচে নামল

রিজার্ভ ফের ২০ বিলিয়নের নিচে নামল

বোতলজাত সয়াবিনের দাম বাড়লো ৪ টাকা, খোলা তেল কমেছে ২ টাকা

বোতলজাত সয়াবিনের দাম বাড়লো ৪ টাকা, খোলা তেল কমেছে ২ টাকা

বিএনপি আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয় : ওবায়দুল কাদের

বিএনপি আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয় : ওবায়দুল কাদের

ফরিদপুরে মাত্র ১ হাজার টাকার লোভে ভ্যানচালক খুন?

ফরিদপুরে মাত্র ১ হাজার টাকার লোভে ভ্যানচালক খুন?

বান্দরবানে আটক ৫৩ জন কেএনএফ সদস্যদের ২ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদালত

বান্দরবানে আটক ৫৩ জন কেএনএফ সদস্যদের ২ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদালত

প্রাণিসম্পদ খাতের উন্নয়নে বেসরকারি খাতকে এগিয়ে আসার আহ্বান প্রধানমন্ত্রীর

প্রাণিসম্পদ খাতের উন্নয়নে বেসরকারি খাতকে এগিয়ে আসার আহ্বান প্রধানমন্ত্রীর

পিএসসি’র সদস্য হিসেবে শপথ নিয়েছেন প্রদীপ কুমার পাণ্ডে

পিএসসি’র সদস্য হিসেবে শপথ নিয়েছেন প্রদীপ কুমার পাণ্ডে

রাজশাহীতে সাবেক প্রেমিকার ফেসবুক আইডি হ্যাক করে অশ্লীল ছবি প্রকাশের দায়ে কলেজ ছাত্রের কারাদন্ড

রাজশাহীতে সাবেক প্রেমিকার ফেসবুক আইডি হ্যাক করে অশ্লীল ছবি প্রকাশের দায়ে কলেজ ছাত্রের কারাদন্ড

এবার ডিপফেকের শিকার আমির খান, ভিডিও ভাইরাল

এবার ডিপফেকের শিকার আমির খান, ভিডিও ভাইরাল

ব্রিটিশ হাইকমিশনারের সঙ্গে বিএনপি নেতাদের বৈঠক

ব্রিটিশ হাইকমিশনারের সঙ্গে বিএনপি নেতাদের বৈঠক

ময়মনসিংহে দুইদিনে চার খুন, জনমনে চাঞ্চল্য

ময়মনসিংহে দুইদিনে চার খুন, জনমনে চাঞ্চল্য