পাট ও পাটপণ্যের গুরুত্ব
০৭ মে ২০২৩, ০৮:১৬ পিএম | আপডেট: ০৮ মে ২০২৩, ১২:০১ এএম
প্লাস্টিক তৈরি করতে ৬০-১০০ মিলিয়ন ব্যারেল তৈল লাগে, যা প্রতিনিয়ত পেট্রোলিয়ামের বৈশ্বিক মজুদ হ্রাস করছে। প্লাস্টিকের মাধ্যমে বিষাক্ত রাসায়নিক ছড়ানোর ফলে আলসার, হাঁপানি, মস্তিষ্কের প্রদাহ, স্থূলতা, হৃদরোগ এবং নির্দিষ্ট কিছু ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ছে। প্রচুর পরিমাণে প্লাস্টিকের ব্যাগ পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থাকে মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত করে এবং বায়ু, পানি ও মাটিকে দূষিত করে। প্লাস্টিক পণ্য প্রাকৃতিক খাদ্য শৃঙ্খলের ক্ষতিসাধান করে। সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০৫০ সালের মধ্যে সমুদ্রে মাছের চেয়ে প্লাস্টিকের বর্জ্য বেশি হবে। তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব প্লাস্টিক পরিহার করা উচিত। ৬৭.৫০ মিলিয়ন মেট্রিক টন প্লাস্টিক বর্জ্যের মধ্যে, আনুমানিক ১ মিলিয়ন মেট্রিক টন প্রতি বছর মহাসাগরে প্রবেশ করছে। ভয়ঙ্কর খবর হল, ১০টি মহাসাগরের প্লাস্টিক দূষণকারীর মধ্যে ৯টি দেশই এশিয়ার।
স্থানীয় চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি বাংলাদেশ বিস্তৃত পরিসরে পাটজাত পণ্য রপ্তানি করে থাকে। পাট এবং পাটজাত পণ্যের প্রধান রপ্তানি যথাক্রমে ৫৩০৩, ৫৩০৭, ৫৩১০, ৫৬০৩ এবং ৬৩০৫ এইচ.এস কোডসমূহের অধীনে সম্পাদিত হয়ে থাকে। ২০১৭-২০১৮ অর্থবছর থেকে শুরু করে গত ৫ বছরে এসব কোডের বিপরীতে রপ্তানি আয় অর্জিত হয় যথাক্রমে ১২৮৯.৯৫, ১০৭৮.৮০, ১১২৯.০৩, ১৫৩৭.০২ এবং ১৬০১.৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। উৎপাদন, স্থানীয় বাজার নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবসায়ী পরিমন্ডলে অনুকূল পরিবেশ বজায় রাখা সম্ভব হলে এ আয় বহুগুণে বৃদ্ধি করা অত্যন্ত যৌক্তিক বিষয়।
বাংলাদেশ হতে বিশ্বের ১০০টিরও বেশি গন্তব্যে পাটজাত পণ্য রপ্তানি হচ্ছে। সিংহভাগ আমদানিকারক দেশসমূহের মধ্যে রয়েছে অস্ট্রেলিয়া, বেলজিয়াম, ব্রাজিল, চীন, জিবুতি, জার্মানি, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, আইভরি কোস্ট, কোরিয়া প্রজাতন্ত্র, পাকিস্তান, রাশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাজ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ভিয়েতনাম। বাংলাদেশি পাট ও পাটজাত পণ্যের সবচেয়ে বড় আমদানিকারক অংশীদার হচ্ছে ভারতের সেভেন সিস্টার্স খ্যাত মিজুরাম, ত্রিপুরা, মেঘালয়, মণিপুর, নাগাল্যান্ড, আসাম এবং অরুণাচল প্রদেশ। ভারত সরকার কর্তৃক নতুন করে আরোপিত অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক এসব গন্তব্যে রপ্তানির উপর কিছুটা বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে মর্মে বাজার বিশ্লেষকগণ মনে করেন। আশা করা যায়, এ সমস্যার সমাধানে উভয় দেশের মধ্যে আনুষ্ঠানিক সংলাপ কাক্সিক্ষত ফলাফল বয়ে আনতে সক্ষম হবে।
পাট ও বহুমুখী পাটজাত পণ্যের গুরুত্ব অনুধাবন করে এ খাতের রপ্তানি উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকার কর্তৃক ২০২১-২০২৪ সালের রপ্তানি নীতিতে সংশ্লিষ্ট খাতটিকে ‘সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার খাত’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) পাটজাত পণ্যকে জনপ্রিয় করতে এবং এ খাতের উন্নয়নে বিনিয়োগকারী ও উদ্যোক্তাদের আকৃষ্ট করতে বিদেশে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক মেলায় অংশগ্রহণের সুযোগ প্রদান অব্যাহত রয়েছে। পাশাপাশি বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে স্থানীয়ভাবে পাটপণ্যের মেলা আয়োজন করা হচ্ছে। ইপিবি’র নিয়মিত কার্যক্রমের অংশ হিসেবে সাধারণ এবং পণ্য-ভিত্তিক মেলায় অংশগ্রহণ বিদেশি ক্রেতা সন্ধানের একটি বলিষ্ঠ প্ল্যাটফর্ম হিসাবে কাজ করে থাকে। রপ্তানি নীতি অনুযায়ী বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো পাটজাত পণ্য রপ্তানিকারকদের অনুকূলে কম সুদের হার/সার্ভিস চার্জে ঋণ মঞ্জুর করতে উৎসাহিত করবে। উৎপাদন, বৈচিত্রায়ণ এবং রপ্তানি প্রসারের উদ্দেশ্যে একটি সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা গৃহীত ও পরিচালিত হতে পারে। এর মাধ্যমে এ খাতের চ্যালেঞ্জসমূহ চিহ্নিতকরণ এবং সেগুলো হতে উত্তরণের উপায় খুঁজে বের করা সহজতর হবে। সরকার বৈচিত্র্যময় পাটজাত পণ্যের নকশা কেন্দ্র (ফবংরমহ পবহঃৎব) স্থাপনে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করবে। বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে পাট চাষের জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতি সংগ্রহ ও ব্যবহারে সহায়তা প্রদান করা হবে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা ও প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণের জন্য সরকারিভাবে সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে। সোনালী আঁশকে (পাট)-কে কৃষিপণ্য হিসাবে ঘোষণা করার ফলে এ পণ্যের কাস্টম সংক্রান্ত আনুষ্ঠানিকতায় এর উপযুক্ত শ্রেণিবিন্যাসকরণে অস্পষ্টতা দূরীভূত হবে।
বাণিজ্য, পাট ও বস্ত্র, কৃষি মন্ত্রণালয় সহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়/সংস্থা নানামুখী কর্মপরিকল্পনা, সমীক্ষা, কর্মসূচি, প্রকল্প, সেমিনার, কর্মশালা, মেলা এবং প্রচারমূলক পদক্ষেপ নিচ্ছে যাতে আরও বেশি পাট চাষে জনসচেতনতা তৈরি হয়। পাট পণ্য একদিকে দেশীয় বাজারের চাহিদা পূরণ করবে অন্যদিকে রপ্তানি অব্যাহত রাখবে। রপ্তানি বৃদ্ধির মাধ্যমে আমাদের সোনালি আঁশের গৌরবময় ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে অভিন্ন মিশন নিয়ে কাজ করা সময়ের দাবি।
২০১০ সালে পাটের জিনোম বা জীবন-নকশা আবিষ্কৃত হলেও পাটের জাতে আধুনিকায়নের বিষয়টি এখনও ব্যাপকতা লাভ করতে সক্ষম হয়নি। নতুন নতুন জাত উদ্ভাবন করে পাটের ফলন ও আঁশের মান উন্নতকরণ করা অত্যন্ত জরুরি। পাটজাত পণ্য উৎপাদন খাতের আকার অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র এবং তা আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর নয়। মধ্যপ্রাচ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো উন্নত বাজারের জন্য উচ্চ মূল্যের পণ্য উৎপাদিত হয় না। আমাদের উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে পাটপণ্যের বাংলাদেশি ব্র্যান্ড বিকাশে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জিত হয়নি। বিশ্বে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় বিপণনের আন্তর্জাতিক মাধ্যমসমূহের সাথে অনেক উদ্যোক্তাই পরিচিত নন। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে গ্রামীণ এলাকায় উৎপাদনশীলতা প্রায়ই কমে যায়। কিছু উদ্যোক্তা সার, সেচ, বীজ, কীটনাশক ও পরিবহনের বর্ধিত ব্যয়কে এজন্য দায়ী করেন। আবার কিছুসংখ্যক পাটকল বন্ধ হয়ে যাওয়াকে এ শিল্পের অনগ্রসরতার কারণ হিসেবেও দেখছেন। প্রতিনিয়ত বিপুল অঙ্কের লোকসান গুনে যাওয়াও সরকারের পক্ষে সম্ভব হয় না। কারণ যাই হোক না কেন, জাতীয় স্বার্থে পাটের উৎপাদন ও পাটজাত পণ্য নিয়ে আমাদের ব্যবসায়ের বর্তমান অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা অত্যন্ত প্রয়োজন। এ বিষয়ে অনেক গবেষণা হওয়া সত্ত্বেও পাট চাষি এবং মধ্যস্বত্বভোগী-বিপণনকারীদের মধ্যকার বিস্তর ব্যবধান এখনও স্পষ্ট। বিভিন্ন গবেষণার সুপারিশ বাস্তবায়ন প্রায়শই দীর্ঘমেয়াদী বিষয় হিসাবে প্রতীয়মান হয়।
জাতীয় পাট নীতি-২০১৮ এর মাধ্যমে কিছু কৌশলগত অগ্রাধিকারের ঘোষণা প্রদান করা হয়েছে; যেমন, মানসম্পন্ন পাটের উৎপাদন, পাটের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরণ, পাটজাত পণ্যের বৈচিত্র্যকরণ, পাটকলের আধুনিকায়ন এবং পাটজাত পণ্যের বাজার অন্বেষণ ইত্যাদি। এর মাধ্যমে পাটের উৎপাদন, প্রক্রিয়াকরণ, বৈচিত্র্যময় পণ্য উৎপাদন, বৈদেশিক বিনিয়োগ আকৃষ্টকরণ এবং বিশ্বব্যাপী নতুন বাজারে প্রবেশের সক্ষমতা অর্জনের সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতামূলক হতে এবং নিজেদের টিকিয়ে রাখতে পাটজাত পণ্য রপ্তানির বিপরীতে এখন ৭% হতে ২০% পর্যন্ত নগদ সহায়তা/ভর্তুকি প্রদান করা হচ্ছে। উক্ত নীতিমালায় টেকনোলজি আপগ্রেডেশন ফান্ড গঠনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এসব বিষয়কে সামনে রেখে প্রান্তিক পর্যায়ে এখন আমাদের উৎপাদকবৃন্দকে অধিক পরিমাণে পাট চাষের পদক্ষেপ নিতে এবং ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোকে একটি অনুকূল ব্যবসায়িক প্রক্রিয়া তৈরিতে উদ্বুদ্ধ করার প্রচেষ্টা সুফলদায়ক হতে পারে। বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসগুলো সম্ভাব্য ক্রেতা ও বাজার সম্পর্কে তথ্য প্রদানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। (সমাপ্ত)
লেখক: পরিচালক, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
জানা গেল ভেনেজুয়েলার বিপক্ষে ব্রাজিলের একাদশ
বাংলাদেশে ন্যায্য রুপান্তরে অর্থায়নের জন্য ধনী দেশগুলোর প্রতি আহ্বান
গোপালগঞ্জে কারাগারে থাকা বাবার অবশেষে জামিন মঞ্জর
ওসমানী বিমান বন্দরে বিদেশী বিমান উঠা-নামার ব্যবস্থা গ্রহণের দাবী- প্রধান উপদেষ্টা বরাবরে সিলেটে স্মারকলিপি
ময়মনসিংহে ফিলিং স্টেশনে আগুনের ঘটনায় মৃত্যু বেড়ে ৬
জানুয়ারি পর্যন্ত ছিটকে গেলেন এনগিডি
দুবাইয়ে নবনিযুক্ত কনসাল জেনারেলের সাথে বাংলাদেশ রেডিমেড গার্মেন্টস ট্রেডার্স আজমানের নেতৃবৃন্দের সৌজন্য সাক্ষাৎ
গণঅভ্যুত্থানে আহতদের সুবিধা নিশ্চিতে দেওয়া হবে ইউনিক আইডি কার্ড
যে কারণে হারপিকে মেতেছে নেটিজেনরা
আ.লীগের মতো পরিবারতন্ত্র করবে না বিএনপি: তারেক রহমান
প্যারাগুয়ে ম্যাচে কেমন হবে আর্জেন্টিনার একাদশ
অর্থাভাবে ব্যক্তিগত বিমান ভাড়া দিয়েছেন শন ডিডি, বিক্রি করবেন বাড়ি
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় শ্রেনী কক্ষে অসুস্থ ১০ শিক্ষার্থী
ভারতীয় গণমাধ্যম আমাদের সম্পর্কে অপপ্রচার চালাচ্ছে : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
নরসিংদীতে ট্রেনের নীচে ঝাঁপ দিয়ে যুবকের আত্মহত্যা
পুলিশ সংস্কার ও একটি কৌশলপত্র
মোস্তফা সরয়ার ফারুকীকে কেন উপদেষ্টা করতে হবে?
শ্যামনগরে সড়ক দুর্ঘটনায় মোটরসাইকেল চালক নিহত
অভ্যুত্থানে আহতদের প্রতি এই অবহেলা অমার্জনীয়
নাট্যকার হুমায়ূন আহমেদ