ঢাকা   শুক্রবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪ | ১৩ পৌষ ১৪৩১

ঢাকার রাস্তায় এত যানজট কেন

Daily Inqilab মীর আব্দুল আলীম

১৭ মে ২০২৩, ০৮:১৪ পিএম | আপডেট: ১৮ মে ২০২৩, ১২:০১ এএম

রাজধানী ঢাকার রাস্তায় যানজটের কারণে চলাই দায় হয়ে পড়েছে। প্রশ্ন হলো, উড়াল সেতু, মেট্রোরেল ইত্যাদি একের পর এক হলেও যানজট কমছে না কেন? এত অর্থ ব্যয়ের পরও যানজটমুক্ত হচ্ছে না কেন ঢাকা? সড়ক আইন অনেকেই মানছে না। সড়ক আইন মানতে বাধ্যও করছে না সরকার। আইনের শাসন না থাকায় যে যার মতো চলছে সড়কে। আর তাতে যানজট হচ্ছে। ফ্লাইওভার, মেট্রোরেল এসব মেগা প্রকল্প যানজট কমানোর জন্যই হয়েছে। জনগণের কল্যাণেই সরকার তা করেছে। কিন্তু আইন না মানায় রাষ্ট্রের এতো ব্যয় বোধ করি জলেই যাচ্ছে।

রাজধানীতে এমন ফ্লাইওভার হবে, পাতাল সড়ক হবে, মেট্রোরেলে আমরা চড়বো ভাবিনি কখনো। তা কিন্তু হয়েছে এবং ভালো মানের। আমাদের মেট্রোরোলের গুণগতমান ভারতের চেয়েও উন্নত। অথচ, এদেশের কিছু অসৎ মানুষ কুবুদ্ধি খাটিয়ে নিজেদের কামাই বাড়ানোর জন্য এসবের সুফল প্রাপ্তি ম্লান করে চলেছে। মানবসৃষ্ট যানজটে ঢাকার সড়কের বারোটা বাজছে। এদের হাত থেকে সড়ক, ফুটপাত দখলমুক্ত করা গেলে তবেই যানজটমুক্ত হবে ঢাকা।

ঢাকা এখন যানজটের শীর্ষে। মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার করেও রাজধানীর প্রবেশ মুখ যাত্রাবাড়িতে বারো মাসই যানজট লেগে থাকে। গুলিস্তানের যানজট পরিস্থিতি ভয়াবহ। প্রায়ই ফ্লাইওভারে যানজট থাকে। বাড্ডায় ইউলুপ তৈরি হলো রামপুরা, বাড্ডা, এয়ারপোর্টে যানজট কমানোর জন্য। সেখানেও বারো মাস যানজট থাকে। নানামুখী সমস্যায় ঢাকা মহানগরের জীবনযাত্রা ক্রমেই আরও বেশি মাত্রায় দুর্ভোগময় হয়ে উঠছে। সবচেয়ে প্রকট ও জটিল সমস্যা হলো এই যানজট। গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হচ্ছে যে, ঢাকার যানজট নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।

ঘঅগইওঙ নামের একটি গ্লোবাল ডাটাবেজের সমীক্ষায় সর্বশেষ ঢাকা বিশ্বের সর্বাধিক যানজটের শহর হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। ঢাকায় বিশ্বের সবচেয়ে ধীরগতিতে গাড়ি চলে। ফ্লাইওভারগুলো চালু হলে ঢাকার যানজট অনেকটাই কমে যাবে, এমনটাই স্বপ্ন ছিল। কিন্তু গোড়ায় গলদ আছে। যাত্রাবাড়ী মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের কথায় ধরুন। ফ্লাইওভারের নিচে সবসময় যানজট থাকে। সেই যানজট ফ্লাইওভারে গিয়ে ঠেকে। ফ্লাইওভারেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকে যানবাহন। সংশ্লিষ্টরা কারণ খুঁজতে গিয়েছেন কি কখনো? টোল দিয়ে যেন পরিবহন ফ্লাইওভারে ওঠে এর জন্য মানবসৃষ্ট যানজট তৈরি করা হয় সেখানে। কীভাবে? ফ্লাইওভারের নিচের রাস্তা বারো মাসই ভাঙাচোরা থাকে। তা খতিয়ে দেখার দায়িত্ব রয়েছে রাষ্ট্রের।

দেশের সব রাস্তাঘাট উন্নত হয়, আর রাজধানীর প্রবেশমুখের এই সামান্য রাস্তাটুকুর এই বেহাল অবস্থা কেন? যানজটের ভয়ে পরিবহনগুলো যেন ফ্লাইওভারে টোল দিয়ে যাতায়াত করে এজন্য? হয়তো, হয়তো না। প্রশ্ন হলো, সংশ্লিষ্টরা যদি কিছু পেয়ে মুখে কুলুপ এঁটে রাখে তাহলে কী হবে? তাছাড়া রাজধানীর প্রবেশ মুখে বিশাল পাইকারি বাজারও যানজটের কারণ হচ্ছে। বাজার সরিয়ে নেওয়ার কথা শুনছি বহুদিন ধরে। সরছে না বিশেষ কারণে। কিছু ব্যক্তির স্বার্থ আছে বলে নাকি যানজট সৃষ্টিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখা বাজার সরানো হচ্ছে না। গেল পাইকারি কাঁচা বাজার, ফ্লাইওভার আর সরু ভাঙাচোরা রাস্তার কাহিনি। আরও আছে ঘটনা। কথিত আছে, কখনো কখনো নাকি যারা ভূত তাড়ায়, তাদের ভেতরেই নাকি ভূত থাকে। কী সেই ভূত? অনেক সময় যারা রাস্তা যানজটমুক্ত করবেন, তারাই নাকি যানজটের কারণ হন।

ডেমরার রাস্তাগুলোয় যানজট থাকলে নাকি পরিবহনের কাগজ পরীক্ষার নামে ভালো ঘুষ বাণিজ্য চালানো যায়। কাগজপত্র ঠিক না থাকলে তো কথা নেই, টাকা দিতে হয়। পরিবহনের কাগজ সব ঠিক থাকলেও দিতে হয়। গাড়িতে ঘষা লেগেছে কেন, নেমপ্লেটের রং জ্বলে গেছে দেখা যায় না কেন? নানান সব বাহানা। আর যখন দাবি মিটে যায় তখন সব শেষ। হয়তো সালামও পায় মালিক কিংবা চালক। বাড্ডা ইউলুপে যানজট কমার কথা। কমছে না কেন? হাতিরঝিলের গুলশান প্রবেশমুখ থেকে আসা সড়ক যেটা বাড্ডা সড়কে যুক্ত হয়েছে সেখানে একটা গ্যাস পাম্প আছে। পাম্পের গাড়ি রাস্তায় লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। গুলশান থেকে ঢুকতে আর রামপুরা থেকে যে গাড়ি আসে সেখানে এসে আটকে যায়। ইউলুপ চালুর সময় জানতাম যানজট কমানোর স্বার্থে পাম্প নাকি সরিয়ে নেওয়া হবে। কিন্তু হয়নি।

রাজধানীর আরেক প্রবেশমুখ শীতলক্ষ্যা সুলতানা কামাল সেতুর ডেমরার স্টাফ কোয়ার্টারে নিত্য চলে ট্রাফিক পুলিশের খেলা। তাই সেখানে যানজটও নিত্য। রাস্তা ফাঁকা থাকলে এই বাণিজ্য জমে না। তাই নাকি ট্রাফিক পুলিশই নানা অজুহাতে যানজট তৈরি করে সেখানে। এমন অভিযোগ স্থানীয় সাংবাদিক এবং ব্যবসায়ী মহলের। এমনটা করা হচ্ছে রাজধানীর প্রবেশ মুখ টঙ্গি, গাবতলী, সাভারে। এসব প্রবেশদ্বারে যানজট তৈরি হলে রাজধানীর ভেতরের সড়কগুলো যানজট হবে এটাই স্বাভাবিক।

রাজধানীর অভ্যন্তরে কথিত পার্কিং বাণিজ্য, ট্রাফিক পুলিশের র‌্যাকার বাণিজ্য চলতে থাকলে যতই ফ্লাইওভার আর মেট্রোরেল কিংবা পাতাল সেতু চলুক ঢাকায়; যানজট কমবে না। ঢাকায় কি ফুটপাত আছে? থাকলেও ওগুলো চাঁদাবাজদের পকেটের খোরাক তৈরির জন্য দখল হয়ে থাকে সবসময়। একটা ফুটপাতের দু’ধারেই অবৈধ দোকান বসানো হয়। ফলে মানুষ ফুটপাত দিয়ে হাঁটতে পারে না। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা দিয়ে হাঁটে মানুষ। গুলিস্তান, মতিঝিল, দিলকুশা, শান্তিনগর এমনকি গুলশান, বনানীর অনেক সড়ক এখন হকারদের দখলে। অবশ্য হকাররা দ্বিতীয় দখলদার। রাজনৈতিক ব্যক্তিরা কথিত লিজ নিয়ে হকারদের ফুটপাত ভাড়া দেয়। এটা বাংলাদেশেই সম্ভব।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অফপিকে রাত ৮টার পর ফুটপাতে কিংবা বিশেষ কোনো সড়কে ভ্রাম্যমাণ দোকানপাট বসে। তাতে সেই শহরে কোনো যানজট তৈরি হয় না। তা থাকে পরিকল্পিত। কলকাতার ফুটপাতেও এমন দেখা যায়। ওরা সড়কগুলো ওয়ানওয়ে করে রাখে বলে যানজট তেমন হয় না। পৃথিবীর অনেক ধনী ও উন্নত দেশের বড় বড় শহরে যানজটের সমস্যা আছে, কিন্তু ঢাকা মহানগরের যানজট সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে। এই দুর্ভাগ্যজনক পরিণতি স্বল্প সময়ে ঘটেনি। আমাদের চোখের সামনে এই সমস্যা পুঞ্জীভূত হতে হতে আজ এই পরিণতি। কিন্তু এটাও শেষ পরিণতি নয়। কারণ, যানজট ক্রমেই আরও বেড়ে চলেছে এবং সামনের দিনগুলোয় স্পষ্টতই আরও বাড়বে। কবে, কোন দূর ভবিষ্যতে গিয়ে যানজট থেমে যাবে, তা এই মুহূর্তে বলা প্রায় অসম্ভব। কারণ, সমস্যা সমাধানের জন্য কার্যকর পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ নেই।

বিশ্বব্যাংকের তথ্য, বর্তমানে যানজটের কারণে বছরে যে আর্থিক ক্ষতি হয়, অঙ্কের হিসাবে তা প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। প্রতিদিন এর পরিমাণ ৮৪ কোটি টাকার মতো। যানজটের কারণে রাজধানীতে পরিবহন প্রবেশ করতে না পারায় প্রতিদিন বিভিন্ন খাত থেকে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা নষ্ট হচ্ছে। সব মিলিয়ে যানজটের কারণে দিনে আর্থিক ক্ষতি প্রায় ১০০ কোটি টাকা। এছাড়া সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা এই ১২ ঘণ্টায় রাজধানীতে চলাচলকারী যানবাহনকে যানজটের কারণে প্রায় সাড়ে ৭ ঘণ্টা আটকে থাকতে হয়। এর মধ্যে প্রতিদিন রাস্তায় নামছে প্রায় ২০০ বিভিন্ন ধরনের পরিবহন।

২০৩০ সালে ঢাকায় জনসংখ্যা হবে ৩০ কোটি। এই প্রেক্ষাপটে যানজট নিরসনে উদ্যোগ নেওয়ার সময় এখনই। রাজধানী ঢাকাকে সবার জন্য বসবাসের উপযোগী করতে হলে যথাযথ সুদূরপ্রসারী ও সমন্বিত মহাপরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন জরুরি। যানবাহন এবং যানজট যে শহরের সচলতা কমিয়ে দিচ্ছে তাই নয়, আর্থিক ক্ষেত্রেও অভিঘাত হানছে। এখন যে পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে আছে ঢাকা শহর, সেই পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থাকলে এই শহর অচল হয়ে পড়বে। রাজধানীর যানজট সহনীয় মাত্রায় আনতে স্বল্পগতির যানবাহন ও প্রাইভেট কারের সংখ্যাধিক্যের দিকে নজর দেয়া দরকার। ট্রাফিক আইন যাতে সব ক্ষেত্রে কড়াকড়িভাবে মানা হয় সে ব্যাপারেও যতœবান হতে হবে। ফুটপাথ থেকে দোকানপাট উঠিয়ে দেয়া, যেখানে-সেখানে গাড়ি পার্কিং বন্ধে ব্যবস্থা নেয়া এবং দিনের ব্যস্ত সময়ে প্রাইভেট কার চলাচল কমিয়ে আনার কথাও ভাবতে হবে।

লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট, সমাজ গবেষক, চেয়ারম্যান, আল-রাফি হাসপাতাল লি:


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

শুধু নামেই জিমনেসিয়াম
মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতিতে কী পরিবর্তন আসছে?
অন্তর্বর্তী সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতদ্বৈততা কাম্য নয়
সচিবালয়ে আগুন সন্দেহজনক
বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের যত্ন নিতে হবে
আরও

আরও পড়ুন

পরলোকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং :ভারতে ৭ দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা

পরলোকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং :ভারতে ৭ দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা

কালীগঞ্জে রাঙ্গামাটিয়া ধর্মপল্লীর সংবাদ সম্মেলন

কালীগঞ্জে রাঙ্গামাটিয়া ধর্মপল্লীর সংবাদ সম্মেলন

গ্রাম আদালত সম্পর্কে জনসচেতনতা তৈরিতে সমন্বয় সভা অনুষ্ঠিত

গ্রাম আদালত সম্পর্কে জনসচেতনতা তৈরিতে সমন্বয় সভা অনুষ্ঠিত

মিসরে প্রেসিডেন্ট সিসির বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ

মিসরে প্রেসিডেন্ট সিসির বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ

কুর্দি যোদ্ধাদের ভয়ঙ্কর হুঁশিয়ারি এরদোগানের

কুর্দি যোদ্ধাদের ভয়ঙ্কর হুঁশিয়ারি এরদোগানের

৩৫শ’ এজেন্টের অধিকাংশই গুজরাটের পাচারকারী

৩৫শ’ এজেন্টের অধিকাংশই গুজরাটের পাচারকারী

৫ সাংবাদিককে হত্যা করল ইসরাইল বিমান

৫ সাংবাদিককে হত্যা করল ইসরাইল বিমান

তুষারপাতে অচল হিমাচল দুই শতাধিক রাস্তা বন্ধ

তুষারপাতে অচল হিমাচল দুই শতাধিক রাস্তা বন্ধ

ক্রিপ্টো রিজার্ভ গড়বেন ট্রাম্প?

ক্রিপ্টো রিজার্ভ গড়বেন ট্রাম্প?

মোজাম্বিকে কারাদাঙ্গায় নিহত ৩৩, পলাতক ১৫০০ কয়েদি

মোজাম্বিকে কারাদাঙ্গায় নিহত ৩৩, পলাতক ১৫০০ কয়েদি

গাজায় যুদ্ধবিরতি বিলম্বে পাল্টাপাল্টি দোষারোপ হামাস-ইসরাইলের

গাজায় যুদ্ধবিরতি বিলম্বে পাল্টাপাল্টি দোষারোপ হামাস-ইসরাইলের

পাকিস্তানে সড়ক অবরোধে শতাধিক শিশুর প্রাণহানি

পাকিস্তানে সড়ক অবরোধে শতাধিক শিশুর প্রাণহানি

আফগানিস্তানে ৭১ সন্ত্রাসীকে হত্যা করেছে পাকিস্তান

আফগানিস্তানে ৭১ সন্ত্রাসীকে হত্যা করেছে পাকিস্তান

শুধু নারীদের জন্য

শুধু নারীদের জন্য

নিথর দেহ

নিথর দেহ

আত্মহননে

আত্মহননে

জকিগঞ্জে প্রাক্সিসের ৭ দিনব্যাপী ইংলিশ স্পিকিং চ্যালেঞ্জ কম্পিটিশনের পুরস্কার বিতরণী

জকিগঞ্জে প্রাক্সিসের ৭ দিনব্যাপী ইংলিশ স্পিকিং চ্যালেঞ্জ কম্পিটিশনের পুরস্কার বিতরণী

মাদ্রাসার ছাদ থেকে পাইপ বেয়ে নামার সময় পড়ে গিয়ে শিশুর মৃত্যু

মাদ্রাসার ছাদ থেকে পাইপ বেয়ে নামার সময় পড়ে গিয়ে শিশুর মৃত্যু

গাজীপুরে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ নেতাকে ছাড়িয়ে আনতে থানায় বিএনপি নেতাদের ভিড়

গাজীপুরে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ নেতাকে ছাড়িয়ে আনতে থানায় বিএনপি নেতাদের ভিড়

শুধু নামেই জিমনেসিয়াম

শুধু নামেই জিমনেসিয়াম