নদী বাঁচাতে হবে
১৯ মে ২০২৩, ০৮:১৩ পিএম | আপডেট: ২০ মে ২০২৩, ১২:০৫ এএম
নদী বাংলাদেশের প্রাণ। এ দেশের সভ্যতা-সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে নদীকেই কেন্দ্র করে। মিশরকে নীল নদের দান বলা হয়; তেমনি বাংলাদেশকে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা নদ-নদীর দান বলা যায়। বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে অভিন্ন ৫৭টি নদী। নদী বিধৌত এ’দেশে ছোটো-বড়ো মোট ২৩০টি নদী আছে, আর শাখা-প্রশাখাসহ নদীর সংখ্যা প্রায় ৮০০টি। এ নদীগুলো সারাদেশে রক্তের শিরা-উপশিরার মতো বিস্তৃত। বিআইডব্লিউটিএর মতে, ১৯৭১ সালে দেশে নৌপথ ছিল প্রায় ২৪১৪০ কিলোমিটার। বর্তমানে তা মাত্র ৬ হাজার কিলোমিটারে দাঁড়িয়েছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটেও দেশের প্রায় এক তৃতীয়াংশ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অভ্যন্তরীণ নৌপথ ব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল।
নদী পরিবেশের অপরিহার্য অনুষঙ্গ। দেশের একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠীর জীবন ও জীবিকার সম্পর্ক রয়েছে নদীর সাথে। খরস্রোতা নদীগুলোতে জেলেরা মাছ ধরত, নৌকাবাইচ হতো, উৎসবের আমেজে মেতে উঠত নদীর পাড়ের মানুষগুলো। কৃষি, মৎস্য, জেলেদের পেশা এবং সংস্কৃতির পাশাপাশি মানুষের নিত্যদিনের কাজের জন্য প্রয়োজনীয় প্রাকৃতিক সম্পদ অনেককিছুর উৎস ছিল নদী। বাংলাদেশের নদীগুলোর বিচিত্র গড়ন, বিচিত্র চরিত্র। সিলেট অঞ্চলের নদীর সাথে রংপুরের নদীর মিল পাওয়া যাবে, এমন নয়। নদী আপন বেগে পাগলপারা; নদী তার আপন গতিতে চলতে অভ্যস্ত। বাংলাদেশের নদীগুলো মিঠা পানির প্রধান উৎস এবং দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ। কিন্তু আমাদের দায়িত্বহীনতায় নদীগুলো দখল ও দূষণের শিকার। গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত সর্বত্রই ময়লা-আবর্জনা নদীতে ফেলছি আমরা। উজান থেকে নেমে আসা পলিও এসে পড়ছে নদীতে। নদী আজ দখল, দূষণ আর ভরাটের প্রতিযোগিতায় বিপন্ন; অনেকাংশে বিলুপ্ত। নদীগুলোর নাব্য হারানোর নানাবিধ কারণের মধ্যে অবৈধ দখলদারিত্ব, অপরিকল্পিত নদীশাসন, দূষণ, ভরাট, অপরিকল্পিত ড্রেজিং, ইচ্ছামতো বাঁধ নির্মাণ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। বিশেষজ্ঞরা শিল্পবর্জ্য, পয়ঃবর্জ্য, শহরের কঠিন বর্জ্য এবং নৌযানের বর্জ্য এই চারটি উৎসকে নদীদূষণের অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। সব নিয়মনীতি উপেক্ষা করে নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে উঠছে বড়ো বড়ো কলকারখানা, শত শত বাঁধ। ঢাকার কোলঘেঁষা বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ আর বালু নদী তার প্রাণ। দূষণ-দখলের কবল থেকে এ নদীগুলোকেও আর বাঁচানো যাচ্ছে না। প্রতিদিনই বাড়ছে দূষণ; বাড়ছে দখলদারদের সংখ্যাও। প্রভাবশালীরা নদী ভরাট করে দখলের উৎসবে মেতেছে।
চারশ’ বছর আগে ঢাকার নগরায়ণ শুরু হয়েছিল বুড়িগঙ্গা নদীকে কেন্দ্র করে। এ নদীকে লন্ডনের টেমস নদীর সাথ তুলনা করা হতো। এটি রাজধানীর ফুসফুস হিসেবেও বিবেচিত হতো। আজ রাজধানীর প্রতিদিনের পয়ঃবর্জ্যের প্রায় সবটুকু উন্মুক্ত খাল, নদ-নদী, নর্দমা হয়ে অপরিশোধিত অবস্থায় বুড়িগঙ্গায় জমা হচ্ছে। বুড়িগঙ্গা নদীকে গিলে খাচ্ছে পলিথিন, ট্যানারিসহ শিল্প-কারখানার বিষাক্ত কেমিক্যাল ও বর্জ্য, হাসপাতাল-ক্লিনিকের পরিত্যক্ত কেমিক্যাল, লঞ্চ-জাহাজের পোড়া তেল, মবিল, ওয়াসার পয়ঃবর্জ্য, গৃহস্থালি বর্জ্য ও নদীর পাড়ে নির্মিত কাঁচা পায়খানা। ঢাকার প্রাণ বুড়িগঙ্গা এখন প্রাণহীন। স্বচ্ছ পানির কল কল শব্দ শোনা যায় না; দেখা যায় না তার বুকে সাপের ফনার মতো ঢেউ। এখন সে শীর্ণকায় ক্ষীণ স্রোতাস্বিনী; খরস্রোতা রূপ সে নব্বইয়ের দশকেই হারিয়েছে। এখন তার পানিও আর ‘পানি’র সংজ্ঞায় পড়ে না; পরিণত হয়েছে বিষে; রং হয়েছে কালো কুচকুচে। মাছ বিলুপ্ত হয়েছে বহু আগে। জীববৈচিত্র্যও নেই। এ নদীর পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন প্রায় শূন্যের কোঠায়।
পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ও প্রাণিবিজ্ঞানীদের মতে, মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণী বসবাসের জন্য প্রতি লিটার পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ ৫ মিলিগ্রাম বা তার বেশি থাকা প্রয়োজন। অন্যদিকে দ্রবীভূত হাইড্রোজেনের মাত্রা কমপক্ষে ৭ মিলিগ্রাম থাকা উচিত। অথচ, বুড়িগঙ্গা নদীর পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ মাত্র ২ মিলিগ্রামের মতো। এ অবস্থায় বুড়িগঙ্গায় প্রাণের অস্তিত্ব টিকে থাকার সুযোগ একেবারেই কম। আইন করেও ঠেকানো যাচ্ছে না বুড়িগঙ্গার দূষণ। কর্ণফুলী চট্টগ্রামের প্রাণ আর দেশের অর্থনীতির হৃদপিন্ড। দখল দূষণের শেষ নেই সে নদীতেও। দু’পাড়ের কলকারখানার দূষিত বর্জ্য, পলিথিন, প্লাস্টিক ও রাবারের বিষে বিষাক্ত কর্ণফুলী। নদী দূষণের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে জীববৈচিত্র্য ও জনজীবনে। ধংস হচ্ছে নদীর জীববৈচিত্র্য, হারিয়ে যাচ্ছে অনেক মাছ ও জলজপ্রাণী। বিজ্ঞানীদের মতে, দূষণের বিষ খাদ্যচক্রের মাধ্যমে মানব শরীরে প্রবেশ করছে। কিডনি বিকল, ক্যান্সারসহ নানাবিধ মরণব্যাধিতে আক্রান্ত মানুষ। নদী দূষণের কারণে মানুষ প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আজ বাংলাদেশের নদীগুলো অস্তিত্ব সংকটে; ক্রমাগত নাব্য হারাচ্ছে। অনেক ছোটো ছোটো নদী বিলুপ্ত হবার পথে। মানুষের অনিয়ন্ত্রিত কর্মকা-ই মূলত নদী দূষণের কারণ। কৃষি জমিতে ব্যবহৃত রাসায়নিক সার, কীটনাশক এসে মিশে যাচ্ছে নদীতে। নদীতে গবাদি পশুর গোছল, মৃত পশুপাখি, পরিত্যাক্ত আবর্জনা নদীতে ছুড়ে ফেলাসহ , নদীর তীরে অস্বাস্থ্যকর পায়খানা থেকে মলমূত্র নদীতে মিশে যাচ্ছে। মানুষ নির্বিচারে নদীতে ফেলছে দূষিত পদার্থ, শিল্প-কারখানার বর্জ্য, গৃহস্থালির বর্জ্য। এখানে মানবতাও উপেক্ষিত।
নদী জীবন্ত সত্তা, তারও প্রাণ আছে, আছে অনুভূতি এবং সেই অনুভূতির সঙ্গে মানুষেরও একাত্মতা রয়েছে, তা বহু আগেই উপলদ্ধি করেছিলেন রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ। তার লেখায় নদীর প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছিল। সেই লেখার অনেক বছর পরে, ২০১৯ সালে বাংলাদেশের উচ্চ আদালত রাজধানীর প্রতিবেশী তুরাগসহ দেশের সকল নদীকে ‘লিভিং এনটিটি’ বা ‘জীবন্ত সত্তা’ হিসেবে ঘোষণা করেন। অর্থাৎ দেশের নদীগুলো এখন থেকে মানুষ বা অন্যান্য প্রাণীর মতোই আইনি অধিকার পাবে। আদালতের রায় অনুযায়ী নদীগুলো এখন ‘জুরিসটিক পারসন’ বা ‘লিগ্যাল পারসন’। এর মধ্য দিয়ে মানুষের মতো নদীরও মৌলিক অধিকার স্বীকৃত হয়েছে। সুতরাং নদীকে হত্যা করার অর্থ হলো বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে হত্যা করা। আদালত স্পষ্ট করে বলেছেন, তুরাগ নদীসহ বাংলাদেশের সব নদীই মূল্যবান এবং সংবিধান, বিধিবদ্ধ আইন ও পাবলিক ট্রাস্ট মতবাদ দ্বারা সংরক্ষিত। নদী জীবন্ত সত্তা; মানুষের মতো তারও অধিকার আছে। বিষয়টি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক। কারণ বাংলাদেশকে ‘নদীমাতৃক’ বলা হয়। নদী মায়ের মতো; নদী মা হিসেবে স্বীকৃত। নদী দূষণও মাকে হত্যা করার সামিল।
নদী দূষণের উৎস একাধিক, দূষণ রোধ ও তদারকি করার কর্তৃপক্ষও একাধিক। নদীর অবৈধ দখল আর পরিবেশ দূষণ ঠেকাতে আছে ‘জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন।’ ২০১৯ সালে হাইকোর্ট কর্তৃক নদীকে জীবন্ত সত্তা ঘোষণা করে ‘নদী রক্ষা কমিশনকে ’ দেশের সব নদ-নদী-খালের আইনগত অভিভাবক হিসেবেও ঘোষণা দেয়। দেশের সব নদ-নদী-খাল-জলাশয় ও সমুদ্র সৈকতের সুরক্ষা এবং বহুমুখী উন্নয়নে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন বাধ্য থাকবে বলেও রায়ে উল্লেখ রয়েছে। এছাড়াও নদীরক্ষা কমিশনকে স্বাধীন ও কার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে সবধরনের পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দেয় আদালত। নদীকে ‘জীবন্ত সত্তা’ হিসেবে ঘোষণা করা যুগান্তকারী রায়টিও একটি মাইলফলক। নদীর পানি প্রবাহ ঠিক রাখা, দূষণ মুক্ত রাখা এবং দখল রোধে জড়িত আছে ২৭টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ। এরপরেও নদী রক্ষা পাচ্ছে না। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন আইন ২০২০ এর খসড়ায় বেশ কিছু কঠোর বিধান রাখা হয়েছে।
নদী তীরবর্তী শিল্প-কারখানাগুলোর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা না থাকা, যত্রতত্র প্লাস্টিকের ব্যবহারসহ পৌরসভাগুলোর ময়লা নদীতে ফেলা দূষণের প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এক সময় নদী কৃষিকাজ ও মাছ ধরার উৎস হলেও এখন তা শিল্প-কারখানার বিষাক্ত বর্জ্যে সম্পূর্ণ ব্যবহার-অনুপযোগী। নদীগুলোর আগের রূপে ফিরিয়ে নিতে শিল্প-কারখানা, পয়ঃনিষ্কাশন ও বর্জ্য নিষ্কাশনের ব্যবস্থাপনার ওপর জোর দিয়েছেন পরিবেশবিদরা। যে আইনগুলো আছে সেগুলো জরুরি প্রয়োগ; নৌপথকে সচল রাখতে নদীগুলোকে খনন, সব কারখানায় শিল্পবর্জ্য শোধনাগার (ইটিপি) নির্মানে উদ্যোগ নেওয়া দরকার। নদী রক্ষায় প্রয়োজনে সামাজিক আন্দোলনও গড়ে তুলতে হবে।
বিবিসির সমীক্ষায় বাংলাদেশের ৪৩৫টি নদী হুমকির মুখে; ৫০ থেকে ৮০টি নদী বিপন্নতার শেষ প্রান্তে। গবেষকদের মতে, এ অবস্থার প্রেক্ষিতে ২০৫০ সাল নাগাদ নদীমাতৃক বাংলাদেশের নাম শুধু ইতিহাসের পাতায় থাকবে। নদী রক্ষা শুধু সরকারের ওপর দায়িত্ব চাপিয়ে দিলেই সব শেষ হয়ে যাবে না। এখানে নাগরিকদের দায়িত্ব নিতে হবে। সকলকে সচেতন হতে হবে। নদী বাঁচলে পরিবেশ বাঁচবে, তাহলেই মানুষ বাঁচবে। রক্ষা পাবে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম। Ñপিআইডি ফিচার
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
পরলোকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং :ভারতে ৭ দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা
কালীগঞ্জে রাঙ্গামাটিয়া ধর্মপল্লীর সংবাদ সম্মেলন
গ্রাম আদালত সম্পর্কে জনসচেতনতা তৈরিতে সমন্বয় সভা অনুষ্ঠিত
মিসরে প্রেসিডেন্ট সিসির বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ
কুর্দি যোদ্ধাদের ভয়ঙ্কর হুঁশিয়ারি এরদোগানের
৩৫শ’ এজেন্টের অধিকাংশই গুজরাটের পাচারকারী
৫ সাংবাদিককে হত্যা করল ইসরাইল বিমান
তুষারপাতে অচল হিমাচল দুই শতাধিক রাস্তা বন্ধ
ক্রিপ্টো রিজার্ভ গড়বেন ট্রাম্প?
মোজাম্বিকে কারাদাঙ্গায় নিহত ৩৩, পলাতক ১৫০০ কয়েদি
গাজায় যুদ্ধবিরতি বিলম্বে পাল্টাপাল্টি দোষারোপ হামাস-ইসরাইলের
পাকিস্তানে সড়ক অবরোধে শতাধিক শিশুর প্রাণহানি
আফগানিস্তানে ৭১ সন্ত্রাসীকে হত্যা করেছে পাকিস্তান
শুধু নারীদের জন্য
নিথর দেহ
আত্মহননে
জকিগঞ্জে প্রাক্সিসের ৭ দিনব্যাপী ইংলিশ স্পিকিং চ্যালেঞ্জ কম্পিটিশনের পুরস্কার বিতরণী
মাদ্রাসার ছাদ থেকে পাইপ বেয়ে নামার সময় পড়ে গিয়ে শিশুর মৃত্যু
গাজীপুরে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ নেতাকে ছাড়িয়ে আনতে থানায় বিএনপি নেতাদের ভিড়
শুধু নামেই জিমনেসিয়াম