ঢাকা   শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৫ আশ্বিন ১৪৩১

পরিবেশ রক্ষায় নদী দূষণমুক্ত করতে হবে

Daily Inqilab এম এ.কাদের

১৩ জুন ২০২৩, ০৭:৫৮ পিএম | আপডেট: ১৪ জুন ২০২৩, ১২:০২ এএম

প্রকৃতি ও পরিবেশ দূষণ নিয়ে গভীর উদ্বেগ রয়েছে বিশ্বব্যাপী। ১৯৬৮ সালের ২০ মে জাতিসংঘের অর্থনীতি ও সামাজিক পরিষদের কাছে একটি চিঠি পাঠায় সুইডেন সরকার। এরই ধারাবাহিকতায় সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে ১৯৭২ সালের ৫ জুন থেকে ১৬ জুন, জাতিসংঘ মানব পরিবেশ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনটি ইতিহাসের ‘প্রথম পরিবেশ বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলন’-এর স্বীকৃতি পায়। ১৯৭৩ সালে সম্মেলনের প্রথম দিন ৫ জুনকে জাতিসংঘ ‘বিশ্ব পরিবেশ দিবস’ হিসেবে ঘোষণা দেয়। এরপর ১৯৭৪ সাল থেকে প্রতি বছর দিবসটি বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে আসছে। আমাদের দেশে গত ৫ জুন পালিত হলো ‘বিশ্ব পরিবেশ দিবস’। পরিবেশ ও জীববৈচিত্র সংরক্ষণ, পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ এবং পরিবেশগত মান উন্নয়নে বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক কর্মোদ্যোগ আর জনসচেতনতার লক্ষ্যে পালন করা হয় দিবসটি। প্রকৃতি ও পরিবেশ আজ সংকটের মুখোমুখি। এ সংকট বিশেষ কোনো গোষ্ঠী, দেশ বা জাতির নয়; সমগ্র মানবজাতির। প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট বিভিন্ন কর্মকা-ের ফলে বিপন্ন পরিবেশ। মানুষের বসবাস উপযোগী বিশ্ব গড়ার লক্ষ্যে চাই দূষণমুক্ত পরিবেশ। আমাদের দেশে দূষণমুক্ত পরিবেশের জন্য সবার আগে দরকার নদী দূষণমুক্ত করা।

যে নদীর অপরূপ দৃশ্য দেখে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় গেয়ে উঠেছিলেন, ‘ও নদীরে, একটি কথা সুধাই শুধু তোমারে। বল কোথায় তোমার দেশ? তোমায় নেই কি চলার শেষ?’ দেশের সেই নদীগুলোর ওপর অত্যাচারের দূষনচিত্র দেখে ক্ষোভ প্রকাশ করে ভূপেন হাজারিকা গঙ্গার কাছে জানতে চান, ‘তবুও তুমি বইছ কেন?’। দেশে নদ-নদী দখল ও দূষণের চিত্র অত্যন্ত উদ্বেগজনক। দীর্ঘদিন ধরে এদিকে খেয়াল না দেওয়ায় দেশের ২৩০টি নদ-নদী আজ মৃতপ্রায়। এ সমস্ত নদ-নদী, প্রায় ১০ হাজার প্রভাবশালী ভূমিদস্যু দখলবাজরা দীর্ঘদিন ধরে দখল করে আসছে। এছাড়া নদীগুলো আরও ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে, মিল-কলকারখানার বর্জ্য, নদীর পাড়ে গড়ে ওঠা শহর, নগরের মানুষের ব্যবহারের দূষিত নোংরা পানি, শহর বাজারের (মাছ, গোশতের বাজারের নোংরা বর্জ্য) ড্রেনে দীর্ঘদিন জমে থাকা দূষিত বর্জ্য সরাসরি ড্রেনের মাধ্যমে নদীর সাথে সংযোগ রাখার কারণে মারাত্মকভাবে নদী দূষিত হচ্ছে। মৃতপ্রায় এ সমস্ত নদ-নদীগুলো দেখলে মনে হয়, এ যেন বর্জ্য রাখার ভাগাড়। নদ-নদী ধ্বংস করার পেছনে কাজ করছে একশ্রেণীর প্রভাবশালী ব্যক্তি। সম্প্রতি সরকারের বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থা ৪ ক্যাটাগরিতে ১ হাজার ৮৯ পৃষ্টার এক প্রতিবেদনে এই তথ্য পাওয়া গিয়েছে (সুত্রঃ সংবাদ ১৩-০৩-২০২০)। এতে বলা হয়েছে, নদ-নদী দখলবাজদের সঙ্গে অধিকাংশ স্থানীয় ভুমি অফিস ও বিআইডব্লিউটি’র কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর দায়িত্বহীনতা রয়েছে। এছাড়া স্থানীয় ক্ষমতাধর প্রভাবশালী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের দৌরাতœ্যও রয়েছে।

নদীদূষন ও দখল এখন নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়ে পরিনত হয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই নদীদূষনের ও দখলের খবর মিডিয়ার মাধ্যমে চোখে পড়ে। বিআইডব্লিউটিএ’র এসমস্ত বিষয়ে দেখভাল করার কথা থাকলেও তাদের দায়িত্বহীনতার কারণে দখলদাররা নদী দখল অব্যাহত রেখেছে। সারা দেশে নদীনালা, খাল-বিল অবৈধভাবে দখল হওয়ার কারণে পানি প্রবাহের গতিপথ পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া দেশের অধিকাংশ মিল কলকারখানার বর্জ্য ও বসতবাড়ি, হাট-বাজারের নোংরা দূষিত পানি, মৃত প্রাণী, প্রাণীর পঁচা উচ্ছিষ্ট অংশ অহরহ নদ-নদীতে ফেলা হচ্ছে। শহর এলাকায় বস্তিবাসীদের অপরিকল্পিত অস্বাস্থ্যকর টয়লেট ব্যবস্থা ও বিভিন্ন ভবনের টয়লেট ড্রেনের সাথে সংযোগ করে নদীতে ফেলা হচ্ছে। এতে নদ-নদীর পানি ব্যবহারের অনুপযোগী ও জলজ প্রাণী ধ্বংস হচ্ছে। নদীদূষণ সবচেয়ে বেশি হচ্ছে, বড় বড় শহরের পাশে গড়ে ওঠা বিভিন্ন কলকারখানার বর্জ্য ড্রেনের মাধ্যমে খাল নদীর সাথে সংযোগ রাখায়। ঢাকা শহরের পরিবেশদূষণ, অস্বাস্থ্যকর বুড়িগঙ্গার দুর্গন্ধযুক্ত পানি ও বিভিন্ন খাল ডোবার দিকে তাকালেই এ দৃশ্য চোখে পড়ে। এভাবে নদীদূষণ ও দখলের কারণে নদীগুলোকে মেরে ফেলা হচ্ছে, পরিবেশ মারাতœকভাবে হুমকির মুখে পড়ছে। নদীর প্রবাহ না থাকায় প্রতি বছরই বর্ষাকালে বন্যার সুষ্টি হচ্ছে। নদীদূষণকারী শুধু প্রভাবশালী কলকারখানার মালিকরাই নয়, সরকার নিয়ন্ত্রিত বিভিন্ন সংস্থা বিভিন্নভাবে নদ-নদী দূষন করছে। দেশের নদীগুলোর পাড়ে গড়ে ওঠা শহর ও শত শত পৌর এলাকার বর্জ্য অপরিকল্পিতভাবে ড্রেনের মাধ্যমে সরাসরি নদীতে ফেলা হচ্ছে। এছাড়া দেশের সুগারমিলগুলো অস্বাস্থ্যকর বর্জ্য, রোগজীবানু বহনকারী মশা-মাছির উপদ্রব ও বংশবিস্তারে সাহায্য করে। এই বর্জ্য ড্রেনের মাধ্যমে সরাসরি নদীতে সংযোগ করা হয়, যা নদীদূষণের অন্যতম কারণ।

দেশের বেশির ভাগ মিল কলকারখানার নিজস্ব বর্জ্য শোধনাগার না থাকায় দূষনকারীরা নদীগুলে কে তাদের নিজস্ব সম্পদ মনে করে দূষিত করছে। নদী দখল ও দূষণকারীরা এতই শক্তিশালী যে রাষ্ট্্রীয় সব উদ্যোগ তাদের কাছে অসহায় হয়ে পড়ছে। তাছাড়া নদী দখল এবং দূষণ ঠেকানোর জন্য সরকারী যে সমস্ত সংস্থাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, এ সমস্ত অনিয়ম দেখেও তাদের চুপ থাকার রহস্য উন্মেচিত হওয়া দরকার। অনেক সময় আমরা দেখেছি, সরকারের পক্ষ থেকে নদ-নদী মুক্ত করতে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করতে প্রভাবশালীদের বাঁধার সম্মুখীন হয়ে আর বেশিদুর এগোতে পারে না, থেমে যায়। ক্ষমতাশীল, প্রভাবশালীদের স্বার্থের কাছে নদী উদ্ধারের উন্নয়ন কাজ ব্যাহত হোক দেশের ১৭ কেটি মানুষ তা আশা করে না।

নদী রক্ষায় শুধু প্রকল্প গ্রহণ করলেই হবে না, বাস্তবায়নও করতে হবে। নদীর তীরে মিল-কলকারখানা নির্মাণ বন্ধ করতে হবে। যে সমস্ত মিল-কলকারখানার বর্জ্য শোধনাগার নাই, সেগুলোর শোধনাগার তৈরি বাধ্যতামূলক করতে হবে। দেশের বড় বড় শহর ও পৌর এলাকার দূষিত বর্জ্য ড্রেনের মাধ্যমে নদীর সাথে সংযুক্ত না করে শোধনাগারের মাধ্যমে শোধন করতে হবে। সমুদ্রের পাড়ে জাহাজ ভাঙ্গা শিল্পের মাধ্যমে নদীদূষণ ও পরিবেশদূষণ বন্ধ করতে হবে। নদীদূষণ ঠেকাতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। লঞ্চ-স্টিমার নির্মাণ ও মেরামতকালে নদী ও সমুদ্রের পাড়ে তৈলাক্ত বর্জ্য নিঃসরণ বন্ধ করতে হবে।

পানিই জীবন, কথাটি মনে রেখে সবসময় পানির প্রবাহ সচল রাখতে নদী খননের সাথে সাথে জীবন বাঁচানোর তাগিদে নদীদূষণ ঠেকাতে হবে। যেহেতু ক্ষমতাবান ও প্রভাবশালীরা নদীকে ধ্বংস করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে, তাই নদী উদ্ধারের কাজে সরকারের সাথে সাধারণ জনগণের সম্পৃক্ততা বেগমান করতে হবে। খননের সাথে সাথে নদী দূষণমুক্ত হলে দেশের ২৩০টি নদী বাঁচবে, জলজ প্রাণী বাঁচবে, পরিবেশ বাঁচবে।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
[email protected]


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

বিদেশে সাবেক ভুমিমন্ত্রীর আট হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি

বিদেশে সাবেক ভুমিমন্ত্রীর আট হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি

ইউনূস গুড উইলের প্রতিফলন দেখতে চায় জনগণ: রিজভী

ইউনূস গুড উইলের প্রতিফলন দেখতে চায় জনগণ: রিজভী

সময় থাকতে হাসিনাকে ফেরত পাঠান : ভারতকে দুদু

সময় থাকতে হাসিনাকে ফেরত পাঠান : ভারতকে দুদু

রুশ সেনা কুরস্কের দুটি শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে

রুশ সেনা কুরস্কের দুটি শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে

বিমানবন্দর এলাকা হবে শব্দদূষণ মুক্ত

বিমানবন্দর এলাকা হবে শব্দদূষণ মুক্ত

যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ওসি আবুল হাসান ৭ দিনের রিমান্ডে

যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ওসি আবুল হাসান ৭ দিনের রিমান্ডে

বিচার শুরু হলে হাসিনাকে ফেরত চাওয়া হবে : আইন উপদেষ্টা

বিচার শুরু হলে হাসিনাকে ফেরত চাওয়া হবে : আইন উপদেষ্টা

লোহাগড়ায় দিনে-দুপুরে বসতবাড়ি পুড়ে ছাই

লোহাগড়ায় দিনে-দুপুরে বসতবাড়ি পুড়ে ছাই

রাষ্ট্রীয় কল্যাণে অবদান রাখার সুযোগ দিন আলেমদেরকে

রাষ্ট্রীয় কল্যাণে অবদান রাখার সুযোগ দিন আলেমদেরকে

দুই মেডিকেল টেকনোলজিস্টের ওপর হামলার ঘটনায় বিএমটিএর নিন্দা

দুই মেডিকেল টেকনোলজিস্টের ওপর হামলার ঘটনায় বিএমটিএর নিন্দা

জিএম কাদের ও মজিবুল হক চুন্নুকে অবিলম্বে আটক করতে হবে : আবু হানিফ

জিএম কাদের ও মজিবুল হক চুন্নুকে অবিলম্বে আটক করতে হবে : আবু হানিফ

উপদেষ্টাদের আয় ও সম্পদ বিবরণী  প্রকাশের নীতিমালা অনুমোদন

উপদেষ্টাদের আয় ও সম্পদ বিবরণী প্রকাশের নীতিমালা অনুমোদন

সাবেক মন্ত্রী শ ম রেজাউল-এমপি হেনরিসহ ৩ জনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা

সাবেক মন্ত্রী শ ম রেজাউল-এমপি হেনরিসহ ৩ জনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা

পটুয়াখালী মেডিক্যাল কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতিকে একবছর ,সাধারন সম্পাদককে দুই বছর একাডেমীক কার্যক্রম থেকে বহিস্কারসহ উভয়কে হোস্টেল থেকে আজীবন বহিস্কার।

পটুয়াখালী মেডিক্যাল কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতিকে একবছর ,সাধারন সম্পাদককে দুই বছর একাডেমীক কার্যক্রম থেকে বহিস্কারসহ উভয়কে হোস্টেল থেকে আজীবন বহিস্কার।

ঢাবিতে যুবককে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগে ৫ শিক্ষার্থী গ্রেফতার

ঢাবিতে যুবককে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগে ৫ শিক্ষার্থী গ্রেফতার

রাজউক চেয়ারম্যানের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল

রাজউক চেয়ারম্যানের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল

‘স্পেন্ড অ্যান্ড উইন’ ক্যাম্পেইনের বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করেছে মাস্টারকার্ড

‘স্পেন্ড অ্যান্ড উইন’ ক্যাম্পেইনের বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করেছে মাস্টারকার্ড

সিটি ব্যাংক আনল অভূতপূর্ব ভিসা ইনফিনিট ক্রেডিট কার্ড

সিটি ব্যাংক আনল অভূতপূর্ব ভিসা ইনফিনিট ক্রেডিট কার্ড

শেখ হাসিনার কোনো ক্ষমা নেই, জবাব তাকে দিতেই হবে : মির্জা ফখরুল

শেখ হাসিনার কোনো ক্ষমা নেই, জবাব তাকে দিতেই হবে : মির্জা ফখরুল

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে খুনিদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনতে হবে

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে খুনিদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনতে হবে