ঢাকা   শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৫ আশ্বিন ১৪৩১

দেশপ্রেমিক নেতৃত্বের কেন প্রয়োজন

Daily Inqilab আফতাব চৌধুরী

২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:১৪ এএম | আপডেট: ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:১৪ এএম

এ যুগ গণতন্ত্রের। তবে গণতন্ত্র মুখে যত সহজে বলা যায়, কার্যে পরিণত করা তত সহজ নয়। ‘গণ’ শব্দের বহু অর্থ আছে। ‘গণ’ অর্থে জনগণ, আবার ‘গণ’ মানে সমষ্টিও বুঝায়। ‘গণ’ শব্দের অন্য অর্থ সেনা। আবার আধ্যাত্মিক দৃষ্টিতে ‘গণ’ শব্দটির অর্থ হচ্ছে ইন্দ্রিয়। সে কারণেই গণতন্ত্রে যারা নেতা বা নায়ক হবেন তাদের রিপু ও ইন্দ্রিয় অসংযত ও উচ্ছৃঙ্খল হলে গণতন্ত্র রক্ষা অসম্ভব। তাছাড়া গণতন্ত্রে আরো একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, জনগণ গণ-প্রতিনিধি বলে যাকে সাব্যস্ত করবে, সেই ব্যক্তি শুধু অনুমোদন দেবেন। অনুমোদনের বাইরে তার দিক থেকে বিশেষ কোনো বক্তব্য রাখা চলবে না। তিনি যদি দেশ ও জাতির সেবায় আত্মোৎসর্গ করতে প্রস্তুত থাকেন তাহলেই তিনি গণতন্ত্রের বাহক। সে কারণেই গণ-প্রতিনিধিকে সামাজিক নেতা বলা হয়ে থাকে, যিনি নিজের জন্য ভাববেন না, ত্যাগ যার জীবনের ব্রত, জনগণের শোক-দুঃখে যিনি উতলা হবেন। গণতন্ত্রের দন্ড তার হাতেই শোভা পায়।

এখন আসা যাক রাজনীতি ও রাজনীতিবিদ প্রসঙ্গে। রাজ শব্দে আছে স্বরাজ, গণ শব্দের সমষ্টিগত রূপ। ওই স্বরাজ সমষ্টির চরিত্রগত আদর্শ ও কল্যাণকর নিয়ম-শৃঙ্খলা কী হওয়া উচিত এবং সেসব নিয়ম-নীতি মেনে চলার বিধি-নিষেধ কী হওয়া প্রয়োজন সেটা রাজনীতি। আর সেই সব জ্ঞানপুষ্ট ব্যক্তিই রাজনীতিবিদ। তবে রাজনীতিবিদ মাত্রেই যে গণ-প্রতিনিধি হবেন তা নয়। গণ-প্রতিনিধি জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধি। কিন্তু রাজনীতিবিদ রাষ্ট্রের কল্যাণ কামনায় রত স্বাধীন সত্তাভুক্ত সুনীতিদাতা। আমরা যদি অতীত ইতিহাস পর্যালোচনা করি তাহলে দেখি আগেকার দিনে নেতাদের মধ্যে প্রচুর দেশপ্রেম ছিল আর ছিল মানুষের সেবা করার মনোভাব ও মানসিকতা।

চেতনা যখন কোনো দেশের ব্যষ্টিক ও সামষ্টিক জীবনে উদারতা ও পবিত্রতার মহাভাব জাগ্রত করে তখন সেই ভাবাদর্শ হতে ক্রমশ রাষ্ট্রোদ্ধার, জাতিগঠন ও সমাজ সংস্কারের প্রেরণা ও উদ্যম-উৎসাহ জাগ্রত হয়ে ওঠে। তাই রাষ্ট্রচেতনাই প্রকৃত রাজনীতিবিদ তৈরি করে। সাময়িক জোড়াতালি দিয়ে কোনো রাষ্ট্রের সংগঠন বা ঐক্য দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না। আমরা যদি কাজী নজরুল ইসলাম বা রবীন্দ্রনাথের স্বদেশপ্রেম নিয়ে আলোচনা করি তাহলে দেখব, তারা আত্মিক চেতনা অনুভব করে সমাজ রচনার কথা বলে গেছেন।

বলতে হয়, প্রাক-স্বাধীনতা ও তার আগের সময়ের রাজনীতিবিদদের চিন্তা-চেতনা ও দেশপ্রেম বর্তমানে এবং সমাজের প্রকৃত রাজনীতিবিদ তৈরিতে প্রতিবন্ধক হওয়ার কারণ হয়তো দেশের বেশিরভাগ জনগণের কারণেই। ফলে প্রকৃত রাজনীতিবিদ সংসদীয় গণতন্ত্রের মন্ডলীতে খুব কম সংখ্যক আসছেন। তাই বলে রাজনীতিবিদ যে এ দেশে এখন আর বেশি সংখ্যায় জন্মগ্রহণ করেন না, তা বলাটা যুক্তিসঙ্গত নয়। রাজনীতিবিদ আছেন। গণতন্ত্রের মহান আদর্শ অনুধাবন করে যোগ্য ব্যক্তিকে মনোনয়ন করাতে সক্ষম হলেই রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের আত্মপ্রকাশ হবে। সচেতন জনগণ দেখতে পাচ্ছে বর্তমান বহু দলীয় সংগঠনগুলোর দেশপ্রেমের নমুনা। ওই সংগঠনগুলোর বেশিরভাগের পরিচয় রাজনৈতিক হলেও প্রকৃত রাজনীতির মূলনীতি অনেকেই মেনে চলে না। সে কারণেই বহুদলীয় রাজনীতির প্রতি মানুষের শ্রদ্ধাবোধ কমে আসছে।

রাজা না থাকলেও একালে রাজ স্বরূপ সংসদ আছে। সংসদই রাজনীতির ধ্বজা বহন করছে। ওই সংসদেই রাজনীতিবিদরা রাষ্ট্রের সুশাসনের নিমিত্তে সুচিন্তিত মত প্রদান করবেন। সরকার পক্ষেরই হোক বা সরকার-বিরোধী পক্ষের হোক যারাই জনপ্রতিনিধিত্ব করছেন, তারা কিন্তু কেউই ব্যক্তি হিসাবে সংসদে উপস্থিত থাকেন না। তারা নির্বাচিত প্রতিনিধি। অর্থাৎ জনগণের প্রতিনিধিত্ব করেন। তাদের চিন্তা-চেতনা এবং মুখনিঃসৃত বাক্য ব্যক্তি বা দলকেন্দ্রিক হতে পারে না, যদি তারা সত্যিকার রাজনীতিবিদ হন। যে রাজনীতিবিদদের প্রাচীনকালে মন্ত্রীমন্ডলী ত্যাগী, নিঃস্বার্থবাদী ও ঋষিতুল্য বলে গণ্য করা হতো, সেইসব ব্যক্তিরই বিধি-বিধান ও অনুশাসনেই পরিচালিত হতো রাজতন্ত্র। তাদের রিপু ও ইন্দ্রিয় সংযত ও সুশৃঙ্খল ছিল। কিন্তু আজ সংসদের চিত্রটা কী? সত্যের মূল কেন্দ্রবিন্দু স্বরূপ সংসদে দাঁড়িয়ে আত্মকেন্দ্রিক স্বাধীনতা কি সমষ্টিগত স্বাধীনতার অমর্যাদা করছে না? প্রতিটি মুহূর্ত যেখানে রাষ্ট্রের দিকদর্শন ঘটাতে অতি প্রয়োজনীয়, সেখানে মুহূর্তকে কষাঘাত করা হচ্ছে না?

গণতন্ত্রে বিরোধী পক্ষ শত্রু পক্ষ নয়। বিরোধী নাম থাকলেও সংসদে তারা মিত্রপক্ষ। কারণ, সরকারের ভুল-ত্রুটির দিকদর্শন করে বিরোধী পক্ষ। সে কারণে গণতন্ত্রকে ধরে রাখে বিরোধী পক্ষ। বিরোধী পক্ষ কখনও শত্রুপক্ষ হতে পারে না, এটা সঠিক গণতন্ত্র নয়। এ ব্যাপারে সরকারি দলের ভূমিকাই বেশি হওয়া উচিত। প্রকৃত রাজনীতিবিদ না-হয়ে গণতন্ত্র রক্ষার ভুয়ো প্রতিশ্রুতি দিয়ে যারা নিজ থেকে জনপ্রতিনিধি হতে চান এবং বিভেদের রাজনীতি বা কৌশলে জয়ী হয়ে যান, তাদের দ্বারা রাষ্ট্রের উন্নতি হয় না।

বর্তমান রাজনীতি হলো প্রচারসর্বস্ব দলীয় রাজনীতি। সাধারণ জনগণের পক্ষে বোধগম্য হওয়াও কঠিন। সে কারণেই জনগণ অনেক সময় দিকভ্রষ্ট হয়ে পড়ে। নির্বাচন প্রহসন হয়ে দাঁড়ায়। আরো একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, বহুদলীয় রাজনীতির আঁতাত বর্তমানে জনগণকে আরো বিভ্রান্ত করছে। কোনো দলকে যদি জনগণ সমর্থন করে থাকে এবং ওই দলের কোনো প্রার্থীকে যদি নির্বাচন করে জয়ী করে থাকে, তাহলে ওই দল এবং প্রার্থী কোনো কারণে কোনো দলের সঙ্গে আঁতাত করতে গেলে দল সমর্থিত জনগণের মতামত নেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। কারণ, যে দলের সঙ্গে আঁতাত করতে যাবে দল, সেই দলের প্রতি সমর্থিত জনগণের সমর্থন না-ও থাকতে পারে। কারণ, জনগণের দল সমর্থন পুরো মানসিক ব্যাপার। কিন্তু দেখা যাচ্ছে দলের ইচ্ছামতো আঁতাতে জনগণ মানসিক আঘাত পাচ্ছে। জনগণের সমর্থন আছে কি না, তা যাচাই না-করে দলীয় নেতারা দলের স্বার্থ দেখিয়ে জনমতকে বিভ্রান্ত করছেন। তাই অতীতে রাজনীতিতে ভালো ফল করতে পারেনি বলে অসংখ্য বহুদলীয় রাজনীতি দিন দিনই পিছনের দিকে যাচ্ছে।

এটা সত্য, আমাদের দেশের গণতন্ত্রে একটা বড় পরিবর্তন আসছে। সংসদীয় গণতন্ত্র নিজের অবস্থান একদিন স্পষ্ট করবেই রাষ্ট্রের খাতিরে, গণতন্ত্রের খাতিরে। বর্তমান স্বার্থপর রাজনীতির দিনকাল বোধ হয় শেষ হয়ে আসছে।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

ইয়ামালের মাইলফলকের রাতে হারের তেতো স্বাদ বার্সার

ইয়ামালের মাইলফলকের রাতে হারের তেতো স্বাদ বার্সার

আর্সেনালের স্বস্তির ড্র,অ্যাটলেটিকোর দারুণ জয়

আর্সেনালের স্বস্তির ড্র,অ্যাটলেটিকোর দারুণ জয়

হেডের বিধংসী শতকে লন্ডভন্ড  ইংল্যান্ড

হেডের বিধংসী শতকে লন্ডভন্ড  ইংল্যান্ড

পয়েন্ট হারিয়েও শীর্ষে আর্জেন্টিনা,অবনতি বাংলাদেশের

পয়েন্ট হারিয়েও শীর্ষে আর্জেন্টিনা,অবনতি বাংলাদেশের

বিদেশে সাবেক ভুমিমন্ত্রীর আট হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি

বিদেশে সাবেক ভুমিমন্ত্রীর আট হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি

ইউনূস গুড উইলের প্রতিফলন দেখতে চায় জনগণ: রিজভী

ইউনূস গুড উইলের প্রতিফলন দেখতে চায় জনগণ: রিজভী

সময় থাকতে হাসিনাকে ফেরত পাঠান : ভারতকে দুদু

সময় থাকতে হাসিনাকে ফেরত পাঠান : ভারতকে দুদু

রুশ সেনা কুরস্কের দুটি শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে

রুশ সেনা কুরস্কের দুটি শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে

বিমানবন্দর এলাকা হবে শব্দদূষণ মুক্ত

বিমানবন্দর এলাকা হবে শব্দদূষণ মুক্ত

যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ওসি আবুল হাসান ৭ দিনের রিমান্ডে

যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ওসি আবুল হাসান ৭ দিনের রিমান্ডে

বিচার শুরু হলে হাসিনাকে ফেরত চাওয়া হবে : আইন উপদেষ্টা

বিচার শুরু হলে হাসিনাকে ফেরত চাওয়া হবে : আইন উপদেষ্টা

লোহাগড়ায় দিনে-দুপুরে বসতবাড়ি পুড়ে ছাই

লোহাগড়ায় দিনে-দুপুরে বসতবাড়ি পুড়ে ছাই

রাষ্ট্রীয় কল্যাণে অবদান রাখার সুযোগ দিন আলেমদেরকে

রাষ্ট্রীয় কল্যাণে অবদান রাখার সুযোগ দিন আলেমদেরকে

দুই মেডিকেল টেকনোলজিস্টের ওপর হামলার ঘটনায় বিএমটিএর নিন্দা

দুই মেডিকেল টেকনোলজিস্টের ওপর হামলার ঘটনায় বিএমটিএর নিন্দা

জিএম কাদের ও মজিবুল হক চুন্নুকে অবিলম্বে আটক করতে হবে : আবু হানিফ

জিএম কাদের ও মজিবুল হক চুন্নুকে অবিলম্বে আটক করতে হবে : আবু হানিফ

উপদেষ্টাদের আয় ও সম্পদ বিবরণী  প্রকাশের নীতিমালা অনুমোদন

উপদেষ্টাদের আয় ও সম্পদ বিবরণী প্রকাশের নীতিমালা অনুমোদন

সাবেক মন্ত্রী শ ম রেজাউল-এমপি হেনরিসহ ৩ জনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা

সাবেক মন্ত্রী শ ম রেজাউল-এমপি হেনরিসহ ৩ জনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা

পটুয়াখালী মেডিক্যাল কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতিকে একবছর ,সাধারন সম্পাদককে দুই বছর একাডেমীক কার্যক্রম থেকে বহিস্কারসহ উভয়কে হোস্টেল থেকে আজীবন বহিস্কার।

পটুয়াখালী মেডিক্যাল কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতিকে একবছর ,সাধারন সম্পাদককে দুই বছর একাডেমীক কার্যক্রম থেকে বহিস্কারসহ উভয়কে হোস্টেল থেকে আজীবন বহিস্কার।

ঢাবিতে যুবককে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগে ৫ শিক্ষার্থী গ্রেফতার

ঢাবিতে যুবককে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগে ৫ শিক্ষার্থী গ্রেফতার

রাজউক চেয়ারম্যানের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল

রাজউক চেয়ারম্যানের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল