ঢাকা   শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৫ আশ্বিন ১৪৩১

খণ্ডিত সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক এজেন্ডায় অখণ্ড রাষ্ট্র গঠন করা সম্ভব নয়

Daily Inqilab জামালউদ্দিন বারী

১৩ জুন ২০২৩, ০৮:০৩ পিএম | আপডেট: ১৪ জুন ২০২৩, ১২:০২ এএম

ভারতের নতুন সংসদ ভবনে স্থাপিত অখণ্ড ভারতের ম্যুরাল মানচিত্র নিয়ে পুরো উপমহাদেশ জুড়ে অসন্তোষ-উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে। ক্ষমতাসীন হিন্দুত্ববাদী বিজেপি জাতিকে বরাবরই অখণ্ড ভারতের স্বপ্ন দেখাচ্ছে। সেই অখ- ভারতের মানচিত্রে পাকিস্তান, আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ, মিয়ানমারসহ উপমহাদেশের দেশগুলোর বিশাল ভূ-ভাগকে অখণ্ড একটি রাষ্ট্র হিসেবে দেখানো হয়েছে। প্রতীকি অর্থে হিন্দুত্ববাদীরা তাদের কল্পিত মহাভারত বা অখণ্ড ভারতের স্বপ্ন ফিরিয়ে আনার জন্য একটি প্রচ্ছন্ন রাজনৈতিক এজেন্ডা গ্রহণ করেছে। নতুন পার্লামেন্ট ভবনে অখণ্ড ভারতের মানচিত্র স্থাপন এবং হিন্দুত্ববাদের প্রবর্তক ও আরএসএস’র রাজনৈতিক গুরু বিনায়ক দামোদর সাভারকরের জন্মদিন ২৮ মে তারিখে নতুন পার্লামেন্ট ভবন উদ্বোধনের ঘটনা থেকে আঁচ করা যায়, হিন্দুত্ববাদীরা একটি অখণ্ড ভারত প্রতিষ্ঠার সংকল্প লালন করে চলেছে। বিজেপি একদিকে দেশকে আড়াই হাজার বছর আগের ঐতিহাসিক-রাজনৈতিক মানচিত্রে ফিরিয়ে নেয়ার কথা বললেও খ-িত ভারতের আজকের সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক বাস্তবতাকে অটুট রাখার বদলে ক্রমশ খ--বিখ- ও ভঙ্গুর করে তুলেছে। খৃষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকে মৌর্য সা¤্রাজ্যের আয়তন আফগানিস্তান থেকে সিংহল পর্যন্ত বিস্তৃত হলেও স¤্রাট অশোকের মৃত্যুর পর সেই অখ- ভারত ভেঙ্গে বহুধাবিভক্ত সামান্ত সমাজে পরিনত হয়েছিল। পারস্য ও তুর্কি থেকে আসা মুসলমান সুলতানরাই হাজার বছর পর প্রথম বহুধাবিভক্ত ভারতকে একটি একক বিশাল সা¤্রাজ্যে পরিনত করতে সক্ষম হয়েছিল। সুলতান ও মুঘলরা ভারতে হাজার বছর ধরে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের মধ্য দিয়ে যে সমৃদ্ধ স্বাধীন সা¤্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত ধরে বৃটিশরা এসে তার পরিচর্যার বদলে ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ পলিসি প্রয়োগ করে একদিকে নিজেদের ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করা ও সম্পদ পাচারের অর্থনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রাখার কৌশল গ্রহণ করেছিল। মতলববাজ বৃটিশরাই প্রথম বাবরি মসজিদের স্থানে রামমন্দিরের কল্পকাহিনী ছড়িয়েছিল। আশির দশকের শেষদিকে ভারতীয় চলচ্চিত্রকার আনন্দপটবর্ধনের নির্মিত ‘রাম কা নাম’ ডক্যুমেন্টারি চলচ্চিত্রে হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক রাজনীতির মুখোশ অনেকটা উন্মোচিত হয়ে পড়ে। সাড়ে ৫শ’ বছরের পুরনো ঐতিহাসিক স্থাপনা বাবরি মসজিদ ভেঙ্গে রাম মন্দির নির্মানের উন্মাদনা ছড়িয়ে বিজেপি, আরএসএস, বজরং সংঘপরিবারের সদস্যরা মূলত ভারতে হাজার বছরের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ঐতিহ্যের উপর কুঠারাঘাত করেছিল। প্রামাণ্য চিত্রের বর্ণনায় আনন্দ পটবর্ধন বলেছেন, বাবরি মসজিদ নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছিল ১৫২৮ সালে, এর ৫০ বছর পর তুলসিদাস রামচরিত মানস নামের একটি গ্রন্থ লিখে প্রথমবারের মত রামের জন্মকথা সাধারণ মানুষের মধ্যে তুলে ধরেন। রামমন্দিরের উপর বাবরি মসজিদ নির্মিত হলে নিশ্চয়ই তুলসিদাসের রামচরিত মানস বইয়ে উল্লেখ থাকত বলে দাবি করেন চলচ্চিত্রকার। বৃটিশরাই প্রথম রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এই অপপ্রচার চালিয়েছিল যে, রামমন্দিরের স্থানে বাবরি মসজিদ নির্মিত হয়েছিল। অত:পর ধর্মান্ধ হিন্দুরা বাবরি মসজিদের বাইরে সীমিত পরিসরে পূজার আয়োজন শুরু করে। এরপর বিজেপির অখ- হিন্দু রাষ্ট্রের ধারণাকে একটি সাম্প্রদায়িক উত্তেজক-উন্মাদনা সৃষ্টিকারী সংঘাতে পরিনত করে ভারতের রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের পথ রচনা করতে মুসলমান বিদ্বেষের অস্ত্র ক্রমেই শানিত করা হয়।

রাষ্ট্র শুধুমাত্র একটি ভ’মিখন্ড নয়। রাষ্ট্রের প্রতিটা অঙ্গের সাজুয্যপূর্ণ সমন্বয় ও সব মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও জাতীয়তার বোধই একেকটি বৃহৎ সাম্রাজ্যের পত্তন ঘটিয়েছিল। শান্তি ও সমৃদ্ধির বার্তা নিয়ে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য ও তার মন্ত্রী চানক্য যে সা¤্রাজ্যের গোড়াপত্তন ঘটিয়েছিলেন, চন্দ্রগুপ্তের দৌহিত্র অশোক মৌর্যের আমলে সেই সা¤্রাজ্যের চুড়ান্ত বিকাশ ঘটেছিল। তবে তা খুব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। বৌদ্ধ ধর্মালম্বী মৌর্য রাজারা শান্তির বাণী নিয়ে ভারতে যে সা¤্রাজ্যের পত্তন করেছিলেন, সেখান থেকে বৌদ্ধদের বিতাড়িত করার এক নির্মম- অন্ধকার ইতিহাস রয়েছে। বৌদ্ধ ধর্মের প্রবর্তক সিদ্ধার্থ গৌতম বুদ্ধের জন্মস্থান থেকে তার ধর্ম বিতাড়িত হয়ে তা চীন-কোরিয়া, জাপানে হিজরত করতে বাধ্য হয়। স¤্রাট অশোকের মৃত্যুর ৫০ বছরের মধ্যে মৌর্য সা¤্রাজ্য ভেঙ্গে পড়ার জন্য হিন্দু ব্রাহ্মণদের বিরোধিতা এবং যুদ্ধনীতির বদলে অশোকের অহিংসার নীতিকে দায়ী করেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ও রমিলা থাপারের মত ঐতিহাসিকরা। আজকের ভারতে হিন্দুত্ববাদীরা যেভাবে গোহত্যা বন্ধের নামে মুসলমান হত্যায় মেতে উঠে, ঠিক বিপরীতভাবে স¤্রাট অশোক যখন বৌদ্ধ ধর্মের অহিংস বানী ও পশু হত্যা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছিলেন, তখন ভারতীয় ব্রহ্মণরা তাদের যাগ-যজ্ঞ বন্ধের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠে অশোকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সূচনা করেছিলেন। রাজপ্রাসাদের ভেতরে এবং বাইরের বিশৃঙ্খলা বিভিন্ন রাজ্যের শাসকদের বিদ্রোহের সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়। রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা ও সাম্প্রদায়িক বিভক্তির কারণে গ্রীক আক্রমণকারীদের কাছে ভারতীয় স্থানীয় শাসকরা অসহায়ভাবে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। সুলতান-মুঘল ও বৃটিশদের হাত ঘুরে দুই হাজার বছর পেরিয়ে আসার পরও গণতন্ত্র, স্যেকুলারিজম ও মাল্টিকালচারালিজমের উপর ভিত্তি করে ঔপনিবেশোত্তর স্বাধীন ভারতের রাজনৈতি- অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার সম্ভাবনার পথে ব্রাহ্মণ্যবাদ ও রাজনৈতিক হিন্দুত্ববাদ প্রধান প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছে। স¤্রাট অশোকের আমল থেকে আজকের একবিংশ শতাব্দীতে এসে ভারতের সহিংস সাম্প্রদায়িকতার রূপ খুব বেশি বদলায়নি।

অখ- ভারতের স্বপ্নচারি বিজেপি সরকার নতুন পার্লামেন্ট ভবনে অখ- ভারতের মানচিত্র স্থাপনের মধ্য দিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোর কোটি কোটি মানুষের অনাস্থা-সন্দিগ্ধ চেতনায় সংক্ষোভ উস্কে দেয়ার পাশাপাশি নিজদেশেও রাজনৈতিক-সাম্প্রদায়িক বিভক্তির দেয়ালের উপর যেন নতুন গাঁথুনি তুলেছে। জাতীয় কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস, আম আদমি পার্টিসহ ১৯টি রাজনৈতিক দল নতুন সংসদ ভবন উদ্বোধনের অনুষ্ঠান বর্জন করেছিল। ভারতের প্রধানমন্ত্রী সরকার প্রধান হলেও রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের প্রধান, তিনি জাতীয় ঐক্য ও নিরপেক্ষতার প্রতিক। প্রথমবারের মত একজন দলিত শ্রেণীর নারীকে ভারতের রাষ্ট্রপতির পদে অভিষিক্ত করা হয়েছে। রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদি মুর্মুকে সংসদ ভবন উদ্বোধনে দাওয়াত না করায় বেশকিছু রাজনৈতিক দল তা বর্জনের ঘোষণা দেয়। অবশেষে সংসদ ভবন উদ্বোধনের অনুষ্ঠানটি অনেকটা বিজেপির দলীয় অনুষ্ঠানে রূপ নেয়। সেই সাথে অখ- ভারতের মানচিত্র ভারতকে আরেকবার আঞ্চলিক রাজনীতিতে প্রশ্নবোধক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন করে। ভারতের নতুন পার্লামেন্ট ভবনে উপমহাদেশের স্বাধীন রাষ্ট্রগুলোকে একিভূত করে অখ- ভারতের মানচিত্র স্থাপনের বিরুদ্ধে সবগুলো দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া হওয়া স্বাভাবিক। এই মুহূর্তে পাকিস্তান বড় ধরণের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সংকট ও অস্থিতিশীলতার সম্মুখীন। পাকিস্তান সরকার ভারতের অখন্ড মানচিত্র নিয়ে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রনালয়ের মুখপাত্র মুমতাজ জাহরা বালুচ আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ায় ভারতের অখন্ড মানচিত্রকে তার সম্প্রসারণবাদী নীতির বহিঃপ্রকাশ বলে অভিহিত করে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। বিশ্বের একমাত্র হিন্দু রাষ্ট্র নেপাল শুধু ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, কাঠমান্ডুর মেয়র অখ- ভারতের পাল্টা অখ- নেপালের একটি মানচিত্র তার অফিসে টানিয়েছে বলে খবর বেরিয়েছে। সেই মানচিত্রে ভারতের দখলে থাকা কালাপানি ও লেপুলেখকে নেপালের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে দেখানো হয়েছে। ইতিপূর্বে ২০১৯ সালে চীনের সাথে সীমান্ত বিরোধের সময়ও নেপাল কালাপানি ও লেপুলেখ এলাকায় নিজেদের সার্বভৌমত্ব দাবি করে মানচিত্র প্রকাশ করেছিল। ভারতীয়দের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, চীনের কাছ থেকে ইন্ধন পেয়ে নেপাল এমন দাবি তোলার সাহস পাচ্ছে। নেপালের এমন দাবির বিপরীতে ভারতের পক্ষ থেকে পাল্টা কোনো ব্যবস্থা নিতেও দেখা যায়নি। সে সময় ক্ষুদ্র দেশ ভুটানও ভারতের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। তবে ভারতের মুসলমানদের উপর নির্যাতন, সিটিজেনশিপ আইনের নামে লাখ লাখ ভারতীয় মুসলমানকে বাংলাদেশে ঠেলে দেয়া এবং কাশ্মিরের বিশেষ মর্যাদা খর্ব করে সেখানে কেন্দ্রীয় শাসন জারির ঘটনায় বিশ্বসম্প্রদায়ের তরফ থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করা হলেও এসব কর্মকা-ে শতকরা ৯০ ভাগ মুসলমানের বাংলাদেশ ভারতকে অন্ধভাবে সমর্থন দিয়েছে। তবে এবার ভারতের পার্লামেন্টে অখ- ভারতের মানচিত্র প্রকাশের পর দিল্লীর কাছে এর উপযুক্ত ব্যাখ্যা দাবি করেছে বাংলাদেশ। যে সময় ভারতীয় শাসকরা ধর্মান্ধ জাতিকে পৌরাণিক মহাভারত কিংবা আড়াই হাজার বছর আগের অশোকের সময়ের অখ- ভারত গঠণের স্বপ্ন দেখাচ্ছে, তখন ভারতের অভ্যন্তরে নানা বিভক্তির দেয়াল ক্রমে উঁচু হয়ে উঠতে দেখা যাচ্ছে। সেই সাথে ভারতের প্রতিবেশীদের সাথে তিক্ততা ও দূরত্ব বেড়ে চলেছে। ভারতের আভ্যন্তরীন রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িক বৈষম্য, গণতন্ত্রহিনতা, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং দ্বিতীয় বৃহত্তম জনগোষ্ঠী মুসলমানদের বিরুদ্ধে নিবর্তনমূলক রাজনৈতিক তৎপরতার কারণে আন্তর্জাতিক বিশ্ব থেকেও ভারত কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে শুরু করেছে।

রাষ্ট্রীয় অখন্ডতা একটি সামগ্রিক সমন্বিত বিষয়। হিটলার যখন জার্মানিকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ জাতি দাবি করে প্রতিবেশী দেশগুলো দখলের পায়তারা করেছিল তখন পুরো ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বের বেশিরভাগ রাষ্ট্র তা রুখে দাঁড়িয়েছিল। দুইিিট বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর রাশিয়া ও আমেরিকার ভাগাভাগিতে জার্মানী পূর্ব-পশ্চিমে দ্বিখ-িত হয়েছিল। তবে পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদের মূল টার্গেট ছিল অটোমান সা¤্রাজ্যের ভাগাভাগি। ¯œায়ুযুদ্ধ অবসানের সাথে সাথে দুই জার্মানী একিভূত হলেও দুই কোরিয়ার দূরত্ব যেন আরো বেড়েছে। প্রথম মহাযুদ্ধের সময় বৃটিশ,ফরাসী ও ইতালির গোপণ সমঝোতায় ভাগ হওয়া মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর বিভাজনরেখা এখনো অটুট রয়েছে। রাষ্ট্রের ভূমি, সাগর, নদনদী, বনভূমি, প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জনসমষ্টি ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ে কোনো পরিবর্তন না ঘটলেও একেকটি বৃহৎ রাষ্ট্র কিভাবে বহুধা বিভক্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রে পরিনত হয়, গত এক শতাব্দীর ইতিহাস তার জ্বলন্ত উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। বিশ্বের বৃহত্তম রাষ্ট্র রাশিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পশ্চিমা ইন্ধনে ইউক্রেন এখন রাশিয়ার সাথে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। হাজার বছর আগে মৌর্য শাসকরা শান্তি ও সৌহার্দ্য ও শৃঙ্খলার বাণীকে সামনে রেখে যে বিশাল ভারতের পত্তন ঘটিয়েছিলেন, ব্রাহ্মণ্যবাবদী সাম্প্রদায়িক রাজনীতি তা বহুধাবিচ্ছিন্ন করে একেকটি দুর্বল ভঙ্গুর রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছিল। পারস্য ও তুরস্ক থেকে আসা মুসলমান সুলতান ও মুঘলরা সেই বহুধাবিচ্ছিন্ন জাতিকে আবার একত্রিত করে বিশাল মুঘল সা¤্রাজ্যের পত্তন ঘটিয়েছিলেন। মুঘলদের প্রাসাদ ষড়যন্ত্র ও রাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে বৃটিশরা ভারত দখলে নেয়ার পর ডিভাইড অ্যান্ড রুল বা হিন্দু-মুসলমান বিভাজনের মাধ্যমে ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ টিকিয়ে রাখার কৌশল গ্রহণ করে সফল হয়েছিল। হাজার বছরে গড়ে ওঠা রাষ্ট্রীয় সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক ঐতিহ্যের ফলকে সময়ে সময়ে যে রক্তাক্ত ক্ষতচিহ্ন ও বিভেদের দাগ লেগে আছে তা নিরসন না করে কোনো জাতিকে তার অখন্ড সত্তায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। গণতন্ত্র, সুশাসন ও মাল্টিকালচারালিজমকে অগ্রাহ্য করে মুসলমানসহ সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠির উপর হিন্দুত্ব চাপিয়ে দিয়ে অখ- ভারতের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার রাজনৈতিক উচ্চাভিলাস বড় ধরণের বোকামি ছাড়া কিছুই নয়। নরেন্দ্র মোদি বা অমিত শাহ যেমন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য, অশোক বা চানক্যের সমতুল্য নন, তেমনি ডোনাল্ড ট্রাম্পও জনসন বা আব্রাহাম লিঙ্কনের কাছাকাছি কেউ নন। বর্ণবাদী ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন বলেন, ‘আমেরিকা ফার্স্ট’, কিংবা ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’ তখন আমেরিকাকে সবদিক থেকে পিছিয়ে পড়তে দেখি, বিশ্ব থেকে নানাভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে দেখি। হিন্দুত্ববাদী নরেন্দ্র মোদিরা যখন অখ- ভারতের রাজনৈতিক স্বপ্ন নিয়ে হাজির হন, তখন ভারত ভেতরে ভেতরে খন্ডিত ও দুর্বল হয়ে যেতে থাকে, বিশ্ব থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে তার আঞ্চলিক প্রভাব ক্রমে দুর্বল হয়ে পড়তে থাকে। হিন্দুত্ববাদী ভারতের মত জায়নবাদী ইসরাইলও তাদের পৌরাণিক ‘প্রমিজড ল্যান্ড’ ও গ্রেটার ইসরাইলের এজেন্ডা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। শক্তিশালী নিজস্ব সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ঐতিহ্য না থাকলে, শুধুমাত্র পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদের লাঠিয়াল হয়ে কিছুদিনের জন্য টিকে থাকা সম্ভব হলেও পৌরাণিক মানচিত্রের রোডম্যাপ নিয়ে রাজনৈতিক সা¤্রাজ্য গড়ে তোলা অসম্ভব, আকাশ কুসুম কল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়। এ ধরণের অবাস্তব পরিকল্পনাকারীরা প্রতিবেশীদের কাছ থেকে অনাস্থা ও বিরোধিতার সম্মুখীন হয়ে প্রতিপক্ষের কাছে সামরিক, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিকভাবে শক্ত চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হওয়াই স্বাভাবিক। বিশ্বের জায়নবাদী, বর্ণবাদী ও উচ্চাভিলাষি সাম্প্রদায়িক এজেন্ডাধারি, বিভাজন সৃষ্টিকারী রাজনৈতিক শক্তিগুলোর মধ্যে যত তাড়াতাড়ি শুভববুদ্ধির উদয় হবে, বিশ্বমানবতার ততই মঙ্গল।

[email protected]


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

বিদেশে সাবেক ভুমিমন্ত্রীর আট হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি

বিদেশে সাবেক ভুমিমন্ত্রীর আট হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি

ইউনূস গুড উইলের প্রতিফলন দেখতে চায় জনগণ: রিজভী

ইউনূস গুড উইলের প্রতিফলন দেখতে চায় জনগণ: রিজভী

সময় থাকতে হাসিনাকে ফেরত পাঠান : ভারতকে দুদু

সময় থাকতে হাসিনাকে ফেরত পাঠান : ভারতকে দুদু

রুশ সেনা কুরস্কের দুটি শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে

রুশ সেনা কুরস্কের দুটি শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে

বিমানবন্দর এলাকা হবে শব্দদূষণ মুক্ত

বিমানবন্দর এলাকা হবে শব্দদূষণ মুক্ত

যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ওসি আবুল হাসান ৭ দিনের রিমান্ডে

যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ওসি আবুল হাসান ৭ দিনের রিমান্ডে

বিচার শুরু হলে হাসিনাকে ফেরত চাওয়া হবে : আইন উপদেষ্টা

বিচার শুরু হলে হাসিনাকে ফেরত চাওয়া হবে : আইন উপদেষ্টা

লোহাগড়ায় দিনে-দুপুরে বসতবাড়ি পুড়ে ছাই

লোহাগড়ায় দিনে-দুপুরে বসতবাড়ি পুড়ে ছাই

রাষ্ট্রীয় কল্যাণে অবদান রাখার সুযোগ দিন আলেমদেরকে

রাষ্ট্রীয় কল্যাণে অবদান রাখার সুযোগ দিন আলেমদেরকে

দুই মেডিকেল টেকনোলজিস্টের ওপর হামলার ঘটনায় বিএমটিএর নিন্দা

দুই মেডিকেল টেকনোলজিস্টের ওপর হামলার ঘটনায় বিএমটিএর নিন্দা

জিএম কাদের ও মজিবুল হক চুন্নুকে অবিলম্বে আটক করতে হবে : আবু হানিফ

জিএম কাদের ও মজিবুল হক চুন্নুকে অবিলম্বে আটক করতে হবে : আবু হানিফ

উপদেষ্টাদের আয় ও সম্পদ বিবরণী  প্রকাশের নীতিমালা অনুমোদন

উপদেষ্টাদের আয় ও সম্পদ বিবরণী প্রকাশের নীতিমালা অনুমোদন

সাবেক মন্ত্রী শ ম রেজাউল-এমপি হেনরিসহ ৩ জনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা

সাবেক মন্ত্রী শ ম রেজাউল-এমপি হেনরিসহ ৩ জনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা

পটুয়াখালী মেডিক্যাল কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতিকে একবছর ,সাধারন সম্পাদককে দুই বছর একাডেমীক কার্যক্রম থেকে বহিস্কারসহ উভয়কে হোস্টেল থেকে আজীবন বহিস্কার।

পটুয়াখালী মেডিক্যাল কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতিকে একবছর ,সাধারন সম্পাদককে দুই বছর একাডেমীক কার্যক্রম থেকে বহিস্কারসহ উভয়কে হোস্টেল থেকে আজীবন বহিস্কার।

ঢাবিতে যুবককে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগে ৫ শিক্ষার্থী গ্রেফতার

ঢাবিতে যুবককে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগে ৫ শিক্ষার্থী গ্রেফতার

রাজউক চেয়ারম্যানের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল

রাজউক চেয়ারম্যানের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল

‘স্পেন্ড অ্যান্ড উইন’ ক্যাম্পেইনের বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করেছে মাস্টারকার্ড

‘স্পেন্ড অ্যান্ড উইন’ ক্যাম্পেইনের বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করেছে মাস্টারকার্ড

সিটি ব্যাংক আনল অভূতপূর্ব ভিসা ইনফিনিট ক্রেডিট কার্ড

সিটি ব্যাংক আনল অভূতপূর্ব ভিসা ইনফিনিট ক্রেডিট কার্ড

শেখ হাসিনার কোনো ক্ষমা নেই, জবাব তাকে দিতেই হবে : মির্জা ফখরুল

শেখ হাসিনার কোনো ক্ষমা নেই, জবাব তাকে দিতেই হবে : মির্জা ফখরুল

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে খুনিদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনতে হবে

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে খুনিদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনতে হবে