জাপানি বিনিয়োগের লক্ষ্য নিয়ে প্রশ্ন

Daily Inqilab ইনকিলাব

২৪ জুলাই ২০২৩, ০৯:১৩ পিএম | আপডেট: ২৫ জুলাই ২০২৩, ১২:০৮ এএম

বাংলাদেশের সঙ্গে জাপানের বিনিয়োগসহ অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা দু’ দেশের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের মাতারবাড়িতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ, বিমানবন্দর অবকাঠামো উন্নয়নসহ বিভিন্ন বৃহৎ প্রকল্পে জাপানের বিনিয়োগ কার্যকর রয়েছে। শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠার ব্যাপারেও জাপানের বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। মাতারবাড়ি শিল্পাঞ্চল এবং নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে ডেডিকেটেড জাপানি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠিত হলে সেখানেও জাপানের ব্যাপক বিনিয়োগ আশা করা হচ্ছে। জাপান এক্সটার্নাল ট্রেড অর্গানাইজেশনের তথ্যানুয়ায়ী, বর্তমানে প্রায় ৩৫০টি জাপানি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যবসা করছে। বাংলাদেশে বিনিয়োগকারী দেশগুলোর মধ্যে জাপানের অবস্থান শীর্ষস্থানীয়। শিল্পায়ন ও ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসারেও তার উদ্যম ও অগ্রসরতা প্রণিধানযোগ্য। বিনিয়োগ, শিল্পস্থাপন ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে অনুকূল অবস্থা ও সুযোগ-সুবিধা বিদ্যমান থাকায় জাপানের সরকার, বিনিয়োগকারী ও ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছে, তাতে সন্দেহ নেই। জাপান অবকাঠামো নির্মাণ, শিল্পায়ন এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বিশ্বে অত্যন্ত সক্ষম ও সামর্থ্য সম্পন্ন একটি দেশ। তার উদার সহযোগিতা ও অংশীদারিত্বে বাংলাদেশ দ্রুত তার উন্নয়ন, শিল্পবিকাশ ও বাণিজ্য বৃদ্ধি তরান্বিত করতে পারে। বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে জাপান স্বাধীনতার পর থেকেই উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখে আসছে। বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের মানুষ এজন্য কৃতজ্ঞ। তবে সাম্প্রতিককালে জাপানের বিনিয়োগ ও শিল্পায়নের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নিয়ে কিছু প্রশ্ন উঠেছে, যা কোনো বিচারেই কাক্সিক্ষত নয়। বিশেষ করে, মাতারবাড়ি সমুদ্রবন্দরে ও ওই অঞ্চলে প্রতিষ্ঠব্য শিল্পাঞ্চলে জাপানের শিল্পকারখানা স্থাপনের বিষয়ে প্রশ্ন উঠেছে। জাপানের লক্ষ্যের মধ্যে সমুদ্র বন্দর বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার এবং মাতারবাড়ি শিল্পাঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত শিল্পকারখনায় উৎপাদিত পণ্যাদি ভারতের ‘সাতবোন’ বলে কথিত রাজ্যসমূহ ও নেপাল-ভুটান প্রভৃতিতে রফতানি করা। এই যদি লক্ষ্য হয়ে থাকে, তবে বাংলাদেশ কেন সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নে নিজের ভূখন্ড জাপানকে ব্যবহার করতে দেবে?

দৈনিক ইনকিলাবে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত এক খবরে উল্লেখ করা হয়েছে, গত মার্চে জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা ভারত সফর করে দেশটির বাজারকে টার্গেট করে বাংলাদেশে বড় বিনিয়োগের প্রস্তাব দেন। এরপরই জাপান সরকার বাংলাদেশে ১২৭ কোটি ডলার বিনিয়োগ প্রস্তাব অনুমোদন করে। জাপানের বিনিয়োগ প্রস্তাবের মধ্যে ছিল: বাংলাদেশে একটি শিল্পাঞ্চল তৈরি। পাশাপাশি বন্দর তৈরিতেও বিনিয়োগ করা। শিল্পাঞ্চলে উৎপাদিত পণ্য ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল, নেপাল ও ভুটানে বাজারজাত করা হবে। এজন্য উপযোগী যোগাযোগ অবকাঠামোও গড়ে তোলা হবে। একই সঙ্গে জাপান ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও বঙ্গপোসাগর এলাকার উন্নয়নে নজর দেবে। এছাড়া তিনটি অবকাঠামো প্রকল্পে বিনিয়োগ করবে, যার মধ্যে আছে মাতারবাড়িতে একটি বাণিজ্যিক বন্দর, যার সঙ্গে যুক্ত হবে ত্রিপুরাসহ ভারতের স্থলবেষ্টিত উত্তর-পূর্বাঞ্চল। উল্লেখ্য, জাপানের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সময় যে বৈঠকে এসব আলোচনা হয়, তাতে উপস্থিত ছিলেন ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় অঞ্চল বিষয়ক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জি কিশান রেড্ডি। দেখা যাচ্ছে, পরিকল্পনা ও প্রস্তাবনায় জাপানের লক্ষ্য সাতবোন, নেপাল-ভুটান প্রভৃতি, আসলে ভারত। লাভও তাদের। এখানে বাংলাদেশ নেই। যেখানে বাংলাদেশ নেই, তার লাভ-স্বার্থ উপেক্ষিত, সে পরিকল্পনা প্রস্তাব ও কার্যব্যবস্থা বাংলাদেশ কীভাবে সমর্থন ও গ্রহণ করতে পারে? বাংলাদেশের মানুষ স্বভাবতই বলবে, দেশের ভূমি অন্য কোনো দেশের স্বার্থে ব্যবহৃত হবে, তা হতে পারে না। দেশের অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের মতে, জাপানের মাতারবাড়ি শিল্পাঞ্চলে উৎপাদিত পণ্যের লক্ষ্য হতে হবে বাংলাদেশ। এত বিপুল পরিমাণ ভূমি ব্যবহার করতে দেয়ার জন্য লাভের সিংহভাগীদার বাংলাদেশেরই হতে হবে। বিনিয়োগের কেন্দ্রবিন্দু হতে হবে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ সরকার, সরকারের নীতিনির্ধারকবৃন্দ এবং সংশ্লিষ্টদের বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে। দেশ ও জাতির স্বার্থের পরিপন্থী কোনো কিছু যাতে না হয়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে।

দুঃখজনক হলেও বলতে হচ্ছে, বিদেশের প্রতিপক্ষের তুলনায় আমাদের পক্ষের বা আমাদের দায়ত্বশীল কর্মকর্তাদের অধিকাংশের দরকষাকষির সক্ষমতা কম, যোগ্যতা কম, অভিজ্ঞতা কম। ফলে দ্বিপাক্ষিক অনেক আলোচনা সিদ্ধান্ত, সমঝোতা বা চুক্তিতে আমরা ঠকে যাই বা বঞ্চিত হই। জাপানের বিনিয়োগ লক্ষ্যের বিষয়টি এতই স্পষ্ট যে, না বুঝতে পারার কিছু নেই। অথচ, আমরা তো তার এই বিনিয়োগ প্রস্তাবে সম্মত হয়েছি। বলা বাহুল্য, সৎ, দক্ষ, যোগ্য, অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের বিকল্প নেই। আমাদের সার্বিক জাতীয় উন্নয়ন, অর্থনৈতিক অগ্রগতি, কর্মসংস্থান ইত্যাদির জন্য দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ অপরিহার্য। অথচ, নানা কারণে প্রত্যাশানুগ বিনিয়োগ হচ্ছে না। বিনিয়োগ দ্রুতায়িত হওয়ার জন্য বিনিয়োগসেবার দ্রুতায়ন দরকার। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) চেয়ারম্যান বিষয়টি সামনে এনে বলেছেন, বিনিয়োগ আকর্ষণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সামনে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, লাউস ও ভারত। তাদের কেউ ৩৫ দিনে, কেউ ৫০ দিনে কেউ বা ৬০ দিনে যে ধরনের বিনিয়োগসেবা দিয়ে থাকে, আমরা তা দিতে পারি না। আমরা ৪০ দিনের মধ্যে ওইসব সেবা দেয়ার চেষ্টা করছি। তিনি ওয়ান স্টপ সার্ভিসের কথাও বলেছেন। বিনিয়োগসেবা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে সহজতা বিশেষ করে আমলাতান্ত্রিক শ্লথতা দূর করতে পারলে বিনিয়োগে গতি আসবে বলে আশা করা যায়। অবশ্য গতি আসাই বড় কথা নয়, বড় কথা হলো, বিনিয়োগের সুফল ষোলআনা দেশ ও দেশের মানুষের পেতে হবে। এমনিতেই ভারতকে বন্দর, ট্রানজিট, বিনিয়োগ, ব্যবসা ইত্যাদি উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে। জাপানি বিনিয়োগের লক্ষ্যও যদি হয় ভারত, তাহলে বাংলাদেশের থাকলো কী? এটা ভাবতে হবে গভীরভাবে। ভেবে চিন্তে দেশমুখী সিদ্ধান্ত নিতে হবে।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

বিহারীরা কেমন আছে
পিলখানা হত্যাকান্ডের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দ্ব্যর্থহীন উচ্চারণ
বিহারিরা কেমন আছে
আসাদ সরকারের পতন : নতুন সিরিয়ায় ইসরাইলি আগ্রাসন
আরও

আরও পড়ুন

সিরিয়ার আকাশে নিষিদ্ধ হলো ইরানের বিমান

সিরিয়ার আকাশে নিষিদ্ধ হলো ইরানের বিমান

বিমানে ‘ঘুমিয়ে’ ছিলেন বাইডেন : সেনাদের লাশ পেতে অপেক্ষায় স্বজনরা

বিমানে ‘ঘুমিয়ে’ ছিলেন বাইডেন : সেনাদের লাশ পেতে অপেক্ষায় স্বজনরা

ভারতে পণ আইন নিয়ে বিতর্ক, এক ব্যক্তির আত্মহত্যা ঘিরে আলোড়ন

ভারতে পণ আইন নিয়ে বিতর্ক, এক ব্যক্তির আত্মহত্যা ঘিরে আলোড়ন

ভারত সীমান্তের শূন্যরেখায় পড়ে ছিল বাংলাদেশির গুলিবিদ্ধ লাশ

ভারত সীমান্তের শূন্যরেখায় পড়ে ছিল বাংলাদেশির গুলিবিদ্ধ লাশ

এক্সপ্রেসওয়েতে কভার্ডভ্যান ও প্রাইভেটকার সংঘর্ষে নারী নিহত, আহত ৫

এক্সপ্রেসওয়েতে কভার্ডভ্যান ও প্রাইভেটকার সংঘর্ষে নারী নিহত, আহত ৫

ব্রাজিলে বাড়ির ওপর বিমান বিধ্বস্ত, সব যাত্রী নিহত

ব্রাজিলে বাড়ির ওপর বিমান বিধ্বস্ত, সব যাত্রী নিহত

চুয়াডাঙ্গার রামদিয়ায় জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধে একজনকে হত্যা, আহত ৫

চুয়াডাঙ্গার রামদিয়ায় জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধে একজনকে হত্যা, আহত ৫

চীনের নতুন বাঁধ প্রকল্পে তিব্বতিদের প্রতিবাদ, দমন-পীড়ন ও গ্রেফতার

চীনের নতুন বাঁধ প্রকল্পে তিব্বতিদের প্রতিবাদ, দমন-পীড়ন ও গ্রেফতার

গাজীপুরে চাঁদা তোলাকে কেন্দ্র করে প্রতিপক্ষের হামলায় যুবকের মৃত্যু

গাজীপুরে চাঁদা তোলাকে কেন্দ্র করে প্রতিপক্ষের হামলায় যুবকের মৃত্যু

সউদীতে এক সপ্তাহে ২০ হাজারের বেশি প্রবাসী গ্রেপ্তার

সউদীতে এক সপ্তাহে ২০ হাজারের বেশি প্রবাসী গ্রেপ্তার

শহীদ মিনারে ছাত্র আন্দোলনে নিহত আরাফাতের জানাজা বিকালে

শহীদ মিনারে ছাত্র আন্দোলনে নিহত আরাফাতের জানাজা বিকালে

নিউইয়র্ক সাবওয়েতে নারীকে পুড়িয়ে হত্যা

নিউইয়র্ক সাবওয়েতে নারীকে পুড়িয়ে হত্যা

ঘনকুয়াশার কারণে ৭ ঘন্টা পর আরিচা-কাজিরহাট এবং পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুটে ফেরি সার্ভিস চালু

ঘনকুয়াশার কারণে ৭ ঘন্টা পর আরিচা-কাজিরহাট এবং পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুটে ফেরি সার্ভিস চালু

ইসরায়েলি হামলায় গাজায় নিহত আরও ৫০

ইসরায়েলি হামলায় গাজায় নিহত আরও ৫০

আওয়ামী পন্থী মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যুক্তরাজ্য শাখা বিএনপি নেতার মতবিনিময়

আওয়ামী পন্থী মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যুক্তরাজ্য শাখা বিএনপি নেতার মতবিনিময়

পরিসংখ্যান ব্যুরোর ভারপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক শরিফুলের বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ

পরিসংখ্যান ব্যুরোর ভারপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক শরিফুলের বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ

আ.লীগের দোসর সালাম আলী এখন বিএনপির সভাপতি প্রার্থী!

আ.লীগের দোসর সালাম আলী এখন বিএনপির সভাপতি প্রার্থী!

ঘুস নেওয়ার অভিযোগ, টিউলিপ সিদ্দিককে যুক্তরাজ্যে জিজ্ঞাসাবাদ

ঘুস নেওয়ার অভিযোগ, টিউলিপ সিদ্দিককে যুক্তরাজ্যে জিজ্ঞাসাবাদ

তালাক নিয়ে যুক্তরাজ্যে যেতে চান বাশার আল-আসাদের স্ত্রী

তালাক নিয়ে যুক্তরাজ্যে যেতে চান বাশার আল-আসাদের স্ত্রী

গভীর রাতে মেসে ছাত্রীদের বিক্ষোভ, মালিকের দুই ছেলেকে পুলিশে সোপর্দ

গভীর রাতে মেসে ছাত্রীদের বিক্ষোভ, মালিকের দুই ছেলেকে পুলিশে সোপর্দ