বাঘ রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে
২৮ জুলাই ২০২৩, ০৮:২৮ পিএম | আপডেট: ২৯ জুলাই ২০২৩, ১২:০১ এএম
জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বিজ্ঞানীদের মতামতের ভিত্তিতে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ও বনাঞ্চল উজাড়ের ফলে বাঘের সর্ববৃহৎ ও সর্বশেষ আবাসস্থল বলে বিবেচিত সুন্দরবন চিরতরে বিলীন হয়ে যেতে পারে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, পরিবর্তিত জলবায়ু পরিস্থিতির সঙ্গে অভিযোজিত হওয়ার অক্ষমতার কারণে আগামী ৫০ বছরের মধ্যে রয়েল বেঙ্গল টাইগার বিলুপ্ত হয়ে যাবে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, পরিবর্তিত পরিবেশের সাথে মানিয়ে না চলার কারণে বিলুপ্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে আরও ৫ লক্ষ জাতের প্রাণী। উল্লেখ্য, গ্লোবাল টাইগার ইনিশিয়েটিভ, গ্লোবাল টাইগার ফোরাম এবং বিশ্বব্যাংকসহ অন্যান্য দাতা সংস্থার উদ্যোগে আয়োজিত এক আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাঘের সংখ্যা নিরূপণ, উৎপাদনবৃদ্ধি ও সংরক্ষণে পরামর্শ দিয়েছিলেন।
সুন্দরবনে বাঘ রক্ষার ব্যাপারে কিছু কিছু পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে বলে বাংলাদেশ বন বিভাগের পক্ষ থেকে বলা হলেও ‘দ্য ভ্যানিশিং ইন্ডিয়াস ওয়াইল্ডলাইফ ক্রাইসিস’ এর লেখক প্রেরণা সিং বিল্লা মনে করেন, জলবায়ু পরিবর্তন কিংবা শিল্পোন্নয়ন যাই হোক না কেন, বলতে দ্বিধা নেই, বাঘের আবাসস্থল ক্রমশই সংকুচিত হচ্ছে। তার মতে, অন্য একটি সুরক্ষিত ভূমিতে বাঘদের সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়ে থাকলেও তা টেকসই সমাধান দিতে পারবে না। প্রকৃতিগতভাবে সংরক্ষিত উপযুক্ত স্থানে তাদের নিরাপদে থাকার ও বংশবৃদ্ধির সুযোগ করে দিতে হবে।
সারা পৃথিবীতে সাকুল্যে তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার বাঘ অরণ্যে বেঁচে আছে, যার বেশির ভাগই ভারতে। বিশেষ এক সূত্রে জানা যায়, সে সংখ্যা মেরে কেটে দু’হাজারের আশপাশ হবে। কিন্তু এ তো গেল রয়েল বেঙ্গল টাইগারের কথা। জীবিত বাকি প্রজাতিগুলোর মধ্যে ইন্দো-চায়নিজ প্রজাতির বাঘের সংখ্যা নেমে দাঁড়িয়েছে তিনশ’র মতো, মালায়ান টাইগার পাঁচশোর মতো, সাইবেরিয়ান টাইগার-এর সংখ্যা মাত্র শ-তিনেক, সাউথ চায়না টাইগারের সংখ্যা একশোরও কম, সুমাত্রান টাইগারও বড় জোর শ’চারেক হবে। গত শতাব্দীর তিনের দশকে বালি টাইগার, সাতের দশকে ক্যাসপিয়ান টাইগার আর আটের দশকে জাভান টাইগার পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। সংখ্যাতত্ত্ব হতে অনুমান করা যাচ্ছে, বাকি প্রজাতিগুলোরও বিলুপ্তির বেশি দেরি নেই। পৃথিবী থেকে বাঘ বিলুপ্ত হলে হবেটা কী?
জঙ্গলের শক্তিশালী প্রাণী হলো লেপার্ড। কিন্তু গাউর, হাতি বা গন্ডারকে মারার ক্ষমতা তার নেই। ফলে তৃণভোজী প্রাণীদের অনিয়ন্ত্রিত প্রজননের দরুন এতটাই তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি ঘটেছে যে, মনুষ্য বসতিতে তারা প্রায়শই হানা দিচ্ছে। অভয়ারণ্য সংলগ্ন অঞ্চলে তারা শস্যের ক্ষতি করে চলেছে। মানুষের সঙ্গে এদের সংঘাত ঘটছে অনিবার্যভাবেই। এখানে যদি বাঘ থাকত, তৃণভোজীদের সংখ্যাবৃদ্ধির ওপর একটা রাশ থাকত। সুন্দরবনের কথাই ধরা যাক। সুন্দরবনের যে দ্বীপগুলো ব্যাঘ্র অধ্যুষিত নয়, সেখানকার জঙ্গলে আর ব্যাঘ্র অধ্যুষিত দ্বীপগুলোর জঙ্গলের তুলনা করলে সহজেই প্রতিভাত হবে আসল অবস্থান। সে শুধু জঙ্গলের রাজাই নয়, পাহারাদারও বটে। আসলে আমাদের খাদ্যশৃঙ্খলের শীর্ষে আছে বাঘ। অবলুপ্ত হলে খাদ্যশৃঙ্খলটা আর থাকবে না। প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিঘিœত হবে।
১৯০০ সালে উপমহাদেশে বাঘের সংখ্যা ছিল লক্ষের কাছাকাছি। সুন্দরবন অঞ্চলেই ছিল এর সংখ্যা বেশি। ১৯৭০-এ এই সংখ্যাটা নেমে এল চারা হাজারে। অর্থাৎ সত্তর বছরে ছিয়ানব্বই হাজার বাঘ মারা পড়েছে। আগে বাঘ মারাটা কোনো অপরাধ ছিল না। ছিল শৌর্যের পরিচয়। সুন্দরবন অঞ্চলে এক বাঘের রাজাই ১০৮টি বাঘ মেরেছিলেন। এটা নাকি তারা বংশানুক্রমে পালন করে চলতেন। এর বেশির ভাগই বহু লোক-লস্কর, বন্দুক, হাতি দিয়ে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হত্যা বিনা কারণে। ফলাফল ‘টাইগার ক্রাইসিস’। সেটা ছিল সত্তরের দশক। ইতোমধ্যে সংখ্যা বেড়েছে। শিল্প বিপ্লব এসে গেছে সর্বত্র। আরো বেশি জমি চাই। শহর বাড়াতে হবে, কৃষিজমি বাড়াতে হবে, আরও খাদ্য, চাই পানিবিদ্যুৎ, অতএব গাছ কাটো। পরিসংখ্যান বলছে, সুন্দরবন অঞ্চলে অরণ্যচ্ছেদনের হার বছরে তিন শতাংশেরও বেশি। আমাদের বাড়ি, আমাদের রাস্তা, আমাদের রেল, আমাদের কারখানা তৈরির ফলে উত্তরোত্তর বাঘেদের বাসস্থান কমছে। ফের খানিক পরিসংখ্যান। ভারতে শেষ দু’দশকে জনসংখ্যা বেড়েছে পঞ্চাশ শতাংশ, শেষ চার দশকে চীনের জনংসখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। চীন অরণ্য ধ্বংস করছে। ভারতে ঘটনাটা একটু অন্য রকম। সেখানে লাগোয়া দুটো অরণ্যের মধ্যে জাঁকিয়ে বসেছে দরিদ্র জনগণ। এই দুই পক্ষের সংঘর্ষ হয়ে উঠেছে নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। পশুর মাংসে মেশাচ্ছে বিষ। পেঞ্চ ন্যাশনাল পার্কে গেলে গ্রীষ্মেই বাঘিনালার বাঘিনী এই রকম এক ঘটনায় দুই বাচ্চাসহ প্রাণ হারিয়েছে। তাছাড়া, দালালদের কাছেও তো এসেছে তথ্য, যে বাঘেদের সর্বাঙ্গ বিক্রি হয় চড়া দামে।
বিপন্নতার আরও কারণ বাঘের স্বভাব। দুই থেকে তিন বছর বয়সের বাঘেরা মায়ের উপর নির্ভরশীল থাকার পর নিজেদের আলাদা জায়গা খুঁজতে থাকে। নিজ অস্তিত্ব বজায় রাখতে বাঘের ত্রিশ বর্গ কিলোমিটার এবং বাঘিনীর পাঁচ থেকে দশ বর্গ কিলোমিটার এলাকার প্রয়োজন। অরণ্যচ্ছেদের ফলে অরণ্য কমছে। ফলে এলাকা দখলের প্রয়োজনে বাঘকে ‘কোর’ এরিয়া ছেড়ে ‘ফ্রিঞ্চ’ এলাকায় চলে আসতে হচ্ছে। অতঃপর মানুষের সঙ্গে সংঘাতে বাঘ মারা পড়ছে।
বলতে দ্বিধা নেই সুন্দরবনকে বাঁচানো আজ কেবল বাংলাদেশের দাবি নয় এটি আন্তর্জাতিক শ্লোগানে পরিণত হয়েছে। পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট, বিশ্ব ঐতিহ্যের সাক্ষী বাংলাদেশের সুন্দরবনের অস্তিত্ব আজ ধ্বংস ও বিলুপ্তির মুখে। সুন্দরবনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় অজস সংবাদ যথা সুন্দরবনের গাছের রোগ, প্রাণী বৈচিত্র্যের বিলুপ্তি, বনজ সম্পদ ধ্বংস, বন্য প্রাণীর নির্বিচার নিধন ও চোরা শিকারে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সংখ্যা হ্রাস ইত্যাদি খুবই গুরুত্বের সাথে প্রচার করা হচ্ছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে আরেক ভয়াবহ তথ্য, সেটি হলো পৃথিবীব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তন ও সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, যার পরিণতিতে সুন্দরবনের এক বিরাট অংশ আগামী ৫০ বছরের মধ্যে সমুদ্র গর্ভে হারিয়ে যাবার আশংকা দেখা দিয়েছে। পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা এ অতুলনীয় বনভূমির অস্তিত্ব সংকটের আশংকায় চিন্তিত। সুন্দরবনের পাশেই রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং আরো নানা শিল্পকারখানা স্থাপন নিয়ে পরিবেশবাদীরা প্রতিবাদে সোচ্চার। পরিবেশ নিয়ে প্রায় তিন যুগেরও বেশি সময় থেকে আমিও গবেষণা ও লেখালেখি করে আসছি, পেয়েছি জাতীয় পুরস্কারও। আমারও সরকার বরাবরে বিনীত আবেদন থাকেলো, দেশের পরিবেশ বিনষ্ট হয়, সুন্দরবন তথা সারাদেশের ক্ষতি হয় এমন কাজটি করতে সংশ্লিষ্ট মহল যেন বার বার চিন্তা-ভাবনা করে।
এক সময় বাংলাদেশের বিভিন্ন বনাঞ্চলে বাঘ দেখা যেত। এখন সুন্দরবন ছাড়া কোথাও বাঘের আনাগোনা নেই। জানা যায়, বনরক্ষকদের সাহায্যে সুন্দরবনেই বাঘের সংখ্যা দিনে দিনে হ্রাস পাচ্ছে। বাঘ শিকারীরা বাঘ নিধনে তৎপর। কিন্তু যারা নিধন করছে তাদেরকে সামাল দেয়া যাদের কর্তব্য তারা নীরব। এ দিকে বনভূমি সংকুচিত হওয়ার ফলে পরিবেশগত কারণে এবং খাদ্যাভাবে দিনে দিনে বাঘের সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। সারাদেশেই বনভূমি সংকুচিত হচ্ছে আর এর সঙ্গে বাঘসহ সকল বনজ প্রাণীর সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। পাঁচ-দশ বছর আগে আমাদের দেশের বনভূমিতে নানা প্রকার পশু, পাখি দেখা যেত, আজ তার অস্তিত্বই নেই। সোজা ও সরল ভাষায় বলতে হয় আমাদেরকে অবশ্যই বাঘসহ সকল প্রকার বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে আন্তরিকতার সাথে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
বিমানে ‘ঘুমিয়ে’ ছিলেন বাইডেন : সেনাদের লাশ পেতে অপেক্ষায় স্বজনরা
ভারতে পণ আইন নিয়ে বিতর্ক, এক ব্যক্তির আত্মহত্যা ঘিরে আলোড়ন
ভারত সীমান্তের শূন্যরেখায় পড়ে ছিল বাংলাদেশির গুলিবিদ্ধ লাশ
এক্সপ্রেসওয়েতে কভার্ডভ্যান ও প্রাইভেটকার সংঘর্ষে নারী নিহত, আহত ৫
ব্রাজিলে বাড়ির ওপর বিমান বিধ্বস্ত, সব যাত্রী নিহত
চুয়াডাঙ্গার রামদিয়ায় জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধে একজনকে হত্যা, আহত ৫
চীনের নতুন বাঁধ প্রকল্পে তিব্বতিদের প্রতিবাদ,দমন-পীড়ন ও গ্রেফতার
গাজীপুরে চাঁদা তোলাকে কেন্দ্র করে প্রতিপক্ষের হামলায় যুবকের মৃত্যু
সউদীতে এক সপ্তাহে ২০ হাজারের বেশি প্রবাসী গ্রেপ্তার
শহীদ মিনারে ছাত্র আন্দোলনে নিহত আরাফাতের জানাজা বিকালে
নিউইয়র্ক সাবওয়েতে নারীকে পুড়িয়ে হত্যা
ঘনকুয়াশার কারণে ৭ ঘন্টা পর আরিচা-কাজিরহাট এবং পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুটে ফেরি সার্ভিস চালু
ইসরায়েলি হামলায় গাজায় নিহত আরও ৫০
আওয়ামী পন্থী মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যুক্তরাজ্য শাখা বিএনপি নেতার মতবিনিময়
পরিসংখ্যান ব্যুরোর ভারপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক শরিফুলের বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ
আ.লীগের দোসর সালাম আলী এখন বিএনপির সভাপতি প্রার্থী!
ঘুস নেওয়ার অভিযোগ, টিউলিপ সিদ্দিককে যুক্তরাজ্যে জিজ্ঞাসাবাদ
তালাক নিয়ে যুক্তরাজ্যে যেতে চান বাশার আল-আসাদের স্ত্রী
গভীর রাতে মেসে ছাত্রীদের বিক্ষোভ, মালিকের দুই ছেলেকে পুলিশে সোপর্দ
প্রোটিয়াদের হোয়াইট ওয়াশ করে পাকিস্তানের ইতিহাস