গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা শুধু নির্বাচনের একদিনের বিষয় নয়

Daily Inqilab জামালউদ্দিন বারী

১৫ আগস্ট ২০২৩, ০৯:০৮ পিএম | আপডেট: ১৬ আগস্ট ২০২৩, ১২:০১ এএম

অস্বস্তিকর এক জটিল রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতার মুখোমুখি দেশের মানুষ। দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে সৃষ্ট অনিশ্চয়তার ধূ¤্রজাল পুরো রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থাকে গ্রাস করেছে। ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করতে এটি ক্ষমতাসীনদের সৃষ্ট একটি কৃত্রিম সংকট। যে নির্বাচনকালীন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য তারা একসময় সারাদেশে আন্দোলন করে দেশকে অচল করে দিয়েছিল, তাদের হরতাল-অবরোধ, জালাও-পোড়াও আন্দোলনে বাধ্য হয়ে তৎকালীণ বিএনপি সরকারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া একটি একতরফা নির্বাচন করে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল পাশ করে সংসদ ভেঙ্গে দিয়ে তিন মাসের মধ্যে নতুন নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে(১৯৯৬ সালের জুন) সংসদে আওয়ামী লীগ খুব ন্যারো মার্জিনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় আসন না থাকায় জাতীয় পার্টির সমর্থন নিয়ে একুশ বছর পর ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন করার সুযোগ লাভ করেছিল। এরপর অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনও নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয় এবং নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিএনপিসহ চারদলীয় জোট ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন করে। পঞ্চম, ৬ষ্ঠ এবং অষ্টম জাতীয় নির্বাচনে জনগণের ভোটে ক্ষমতার পালাবদলের মধ্য দিয়ে এটাই প্রমানিত হয়েছে, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে ক্ষমতায় ফিরে আসা কঠিন। নির্বাচনী ব্যালটে ক্ষমতার পালাবদলের এই ক্ষমতাই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জনগণের মালিকানার মূল শক্তি। এই ক্ষমতাকে পাকাপোক্তভাবে অর্জনের মধ্য দিয়ে নিজেদের ইচ্ছা অনুসারে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্যই এ দেশের মানুষ ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। লাখো মানুষের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত সেই স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য থেকে রাষ্ট্রকে বিচ্যুত করার মধ্য দিয়ে সামরিক স্বৈরশাসন থেকে এখন হাইব্রিড রিজিমের পরিচয় বহন করছে বাংলাদেশ। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নিজেদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে চায়। যেখানে কোনো পক্ষেরই নির্বাচনী ফলাফলকে নিজেদের পক্ষে নিতে কোনো রাষ্ট্রীয় প্রভাব কাজে লাগানোর সুযোগ থাকবে না। আওয়ামী লীগের অসহযোগিতার কারণে ষষ্ঠ জাতীয় নির্বাচন ছিল সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা। পঞ্চম থেকে অষ্টম সংসদ নির্বাচন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতার পালাবদলের মধ্য দিয়ে দেশে একটি গণতান্ত্রিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠিত হলেও নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ দেশের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ক্ষমতার ভারসাম্যমূলক অবস্থানের নিরিখে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে কোনো সরকারই কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। এ কারণেই রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে সেনা সমর্থিত বিশেষ সরকারের উত্থান এবং বর্তমান রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, অস্বস্তি ও উদ্বেগজনক অবস্থার জন্ম হয়েছে। এ থেকে উত্তরণের জন্য নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুন:প্রতিষ্ঠা এবং রাষ্ট্রকাঠামো তথা রাষ্ট্রের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আমূল সংস্কার তথা রাষ্ট্র মেরামতের রূপরেখা বাস্তবায়নের উদ্যোগের কোনো বিকল্প নেই।

বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে বছর ধরে পশ্চিমাদের নানামুখী উদ্যোগ, চাপ ও দৌড়ঝাপ চলছে। গুম-খুনের মত মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে র‌্যাবের শীর্ষ কর্মকর্তাদের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি থেকে শুরু করে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদ, আমলা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য এমনকি বিচার বিভাগের সংশ্লিষ্টদের উপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগ এবং সবশেষে দুর্নীতি দমন ও মানি লন্ডারিং বিষয়ে তদন্তসাপেক্ষে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা, সম্পদ জব্দ এবং আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের মার্কিন হুমকি দেখা দিয়েছে। স্বাভাবিকভাবে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের উপর বাইরের শক্তির এমন খবরদারি ও প্রভাব বিস্তারের প্রবণতা কোনো দেশের জন্য শোভন বা সমর্থনযোগ্য হতে পারেনা। তবে দেশের মূলধারার রাজনৈতিক দল ও জনগণের যৌক্তিক প্রত্যাশা ও নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের লক্ষ্যসমূহ যদি শ্রেফ ক্ষমতার অপপ্রয়োগের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে অগ্রাহ্য ও ব্যর্থ করে দিয়ে বিরোধীমত দমনের মাধ্যমে ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করার প্রয়াস অব্যাহত থাকে, সেখানে বিদেশি শক্তির চাপকে জনগণ সমর্থন জানায়। বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের নানামুখী উদ্যোগ ও খবরদারিকে বাংলাদেশের বিরোধীদল এবং গণতন্ত্রকামী সাধারণ মানুষ অকুণ্ঠ সমর্থন জানাচ্ছে বলেই প্রতিয়মান হচ্ছে। র‌্যাব-পুলিশের কতিপয় শীর্ষ কর্মকর্তার উপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ এবং গুম-খুনের শিকার ভিকটিম পরিবারের অভিযোগগুলোর তদন্ত ও বিচারিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার কোনো পদক্ষেপ না নেয়া হয়নি। মানবাধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও স্বচ্ছ নির্বাচনের ব্যাপারে পশ্চিমারা দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের প্রত্যাশা ও মনোভাব আঁচ করেই নিজেদের শক্ত অবস্থানের জানান দিলেও ক্ষমতাসীন দলের অবস্থান একেবারেই বিপরীত। সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে বলা হয়েছে, যারা নিষেধাজ্ঞা দিবে, তাদের কাছ থেকে কিছু কিনব না। বিশ্বে আরো মহাদেশ ও মহাসাগর আছে, বিশ হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে আমেরিকায় যাব না। এমন বক্তব্যের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় প্রতিনিধিদের নানাবিধ তৎপরতা ও দৌড়ঝাঁপ বেড়ে গেছে। মানবাধিকারের প্রশ্নে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী মিশনে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের যাচাই-বাছাই করে বাদ দেয়ার প্রস্তাব নিয়েও আলোচনা উঠেছে। পশ্চিমা বার্তা ও চাপ উপেক্ষা করে প্রধান বিরোধীদলকে নির্বাচনের বাইরে রেখে কারসাজির নির্বাচনের মাধ্যমে নিরঙ্কুশ বিজয় ঘোষণার পর ইতিমধ্যে প্রায় চারদশক ধরে ক্ষমতায় থাকায় কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হুনসেনের উপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর হুনসেন পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। বাংলাদেশের মতই আদালতের উপর একচ্ছত্র ক্ষমতা ব্যবহার করে কম্বোডিয়ার হুনসেন তার প্রতিপক্ষ বিরোধীদলীয় নেতা কেম সোখাকে ২৭ বছরের কারাদ- দিয়ে এবং বিরোধীদলকে নির্বাচনের অযোগ্য ঘোষণার মাধ্যমে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে বিরত রেখেছিল। বেশিরভাগ ভোটার ভোট দিতে না গেলেও নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি দেখানো হয়েছে শতকরা ৮৪ ভাগ। ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ব্যালট পেপারে ‘এক্স’ চিহ্ন কিংবা নেতিবাচক কমেন্ট লিখে ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করার অপরাধে কয়েকজনকে আটক করার খবরও গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের প্রধান উন্নয়ন ও বাণিজ্য অংশীদার। কোনো একক দেশ হিসেবে দেশের তৈরী পোশাক রফতানির প্রধান বাজার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। অঞ্চল হিসেবে প্রধান বাজার ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এই দুই বাজারে বাংলাদেশের তৈরী পোশাক খাতের আশি ভাগের বেশি রফতানি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে এফডিআই বা সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগেরও সবচেয়ে বড় উৎস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশের খাদ্য ঘাটতি ও চাহিদা পূরণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনুদান ও খাদ্য সহায়তাসহ উৎপাদন উন্নয়ন ও নানা ক্ষেত্রে দক্ষতা বৃদ্ধিতে মার্কিন প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তি সহায়তার ইতিহাসও অনেক দীর্ঘ। সাম্প্রতিক বিশ্বের সবচেয়ে বড় দুর্যোগ করোনা ভাইরাস মহামারি। এই দুর্যোগের সময় প্রতিবেশী ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট ভ্যাকসিন উৎপাদনে বিশ্বে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা রাখলেও বাংলাদেশের সাথে রীতিমত গাদ্দারি করেছে। সাড়ে তিন কোটি ভ্যাকসিনের মূল্য আগাম নেয়ার পরও তারা বাংলাদেশকে ভ্যাক্সিন দেয়নি। করোনা ভ্যাক্সিনের উপর আন্তর্জাতিক এভিয়েশন, ট্যুরিজম, ভিসা-যোগাযোগ, বাণিজ্য ইত্যাদি অনেক কিছুই নির্ভর করছিল। এহেন বাস্তবতায় পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কার মধ্যে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সক্ষমতায় সারাবিশ্বে কোটি কোটি ভ্যাক্সিন জরুরি অনুদান হিসেবে দিয়েছে তারা। এক্ষেত্রে, বাংলাদেশকে সর্বোচ্চ সাড়ে ১১ কোটি করোনা ভ্যাক্সিন ও আনুসাঙ্গিক সরঞ্জাম সরবরাহ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। শুধুমাত্র আর্থিক মূল্যের মানদ-ে এই দানের মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়। বাংলাদেশের জনগণের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এমন উদার সহায়তাকে দুই দেশের অংশীদারিত্বের উদাহরণ হিসেবে বর্ণনা করেছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস। সম্প্রতি মানবজমিন পত্রিকা অফিসে গিয়ে সাংবাদিকদের সাথে আড্ডা ও মতবিনিময়ে অংশ নিয়ে পিটার হাস বিগত ৫ দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আর্থিক অনুদান হিসেবে বাংলাদেশকে সহায়তার পরিমান ৮.১ বিলিয়ন ডলার বলে উল্লেখ করেন পিটার হাস। কিছু বিচ্ছিন্ন কৌশলগত ব্যতিক্রম বাদ দিলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মানদ- হিসেবে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও সুশাসনকে অনুসৃত নীতি হিসেবে গ্রহণ করেছে। ওয়ার অন টেররিজমের বিভ্রান্তিপূর্ণ গোলক ধাঁধা পেরিয়ে নতুন বাস্তবতায় প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন তার কৌশলগত সম্পর্কের ক্ষেত্রে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের শর্তগুলোকে নতুনভাবে ঝালিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে অনড় অবস্থানের ঘোষণা দিয়েছেন। ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্রাটেজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের তোড়জোড় ও নানামুখী চাপের মূল কারণ এখানেই নিহিত, এটা সহজেই অনুমেয়। তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বাংলাদেশের শীর্ষ প্রতিনিধিদের সমস্যা সমাধানের সদিচ্ছার বদলে কুতর্কে জড়াতেই বেশি দেখা গেছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেনের কূটনৈতিক ভারসাম্যহীন কথাবার্তা অনেক দিন ধরেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিনোদনের বিষয় হয়ে আসছে। এবার পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত ও শীর্ষ কূটনীতিকদের সাথে অহেতুক টুইট তর্কে জড়াতে দেখা গেছে। প্রেস্টিজিয়াস উইলসন সেন্টারের গবেষক, ৮৭ বছর বয়েসী কূটনীতিক উইলিয়াম বি মাইলাম বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতা ও উত্তরণের পথ সম্পর্কে বই লিখেছেন। উইলিয়াম বি মাইলাম ও জন ডেনিলোয়েজের প্রতি শাহরিয়ার আলমের আক্রমণাত্মক টুইট বার্তাকে ’চরিত্র হননমূলক’ কাজ বলে অভিহিত করেছেন ডেনিলোয়েজ।

বাংলাদেশে স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে জনমতের প্রতিফলন নিশ্চিত করতে দীর্ঘদিন ধরেই প্রয়াস চালাচ্ছে পশ্চিমারা। ১৯৯৪ সালে ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে কমনওয়েলথের প্রতিনিধি স্যার নিনিয়ান স্টিফেন ঢাকায় বিরোধীদল আওয়ামী লীগকে আলোচনার টেবিলে এনে একটি রাজনৈতিক সমঝোতায় পৌঁছাতে দেড়মাস ধরে চেষ্টা করে বিফল হয়ে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। তৎকালীণ প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া সমঝোতার প্রস্তাবে রাজি হলেও বিরোধীদলীয় নেত্রীকে মানাতে পারেননি তিনি। অস্ট্রেলিয়ায় ফিরে গিয়ে ক্যানবেরা টাইমস পত্রিকায় নিজের মতামত ব্যক্ত করতে গিয়ে স্যার নিনিয়ান বলেছিলেন, দুই প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনার মধ্যে স্পষ্ট কোনো আদর্শিক দ্বন্দ্ব না থাকলেও দুই জনের ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্ব সমস্যা সমাধানের মূল অন্তরায়। নিনিয়ানের সমঝোতা ফর্মূলা সরকার প্রধান খালেদা জিয়া মেনে নিতে রাজি হলেও বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ ছাড়া আর কিছুই মানতে নারাজ বলে মন্তব্য করেন নিনিয়ান। সে সময় প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার দৃঢ় ঐকান্তিক ইচ্ছায় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নতুন সংসদ গঠন করে তত্বাবধায়ক সরকারের বিল পাস করে সাংবিধানিক জটিলতা উত্তরণে সক্ষম হয়েছিলেন। আদালতের একটি রায়ের নির্দেশনাকে খ-িত অর্থে নিজেদের স্বার্থে কাজে লাগিয়ে বর্তমান সরকার সংবিধান থেকে নির্বাচনকালীণ সরকার ব্যবস্থা বাতিলের মধ্য যে রাজনৈতিক সংকটের জন্ম দিয়েছে, তা নিরসনে শুরু থেকেই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের তৎপরতা দেখা গেছে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ এনভয়, সহাকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো ২০১৩ সালের ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে চারদিনের সফরে ঢাকা আসেন। এখনকার আজরা জেয়া, ডোনাল্ড লু কিংবা মার্কিন কংগ্রেস ম্যানদের মত সব পক্ষের সাথে আলোচনা করেও কোনো সুরাহা করতে না পেরে অনেকটা হতাশ হয়ে নিউইয়র্কে ফিরে যান তারানকো। বিদায় বেলায় আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ১৯৯৭ সালে নেলসন মেন্ডেলার বাংলাদেশ সফরের সময় দেয়া একটি বক্তৃতার উদ্ধৃতি তুলে ধরে তিনি বলেছিলেন, ‘একটি জাতি যদি তার অভিন্ন লক্ষ্য ও স্বার্থে ঐক্যবদ্ধভাবে ভূমিকা পালন করতে পারে, তাহলে তারা যেকোনা কঠিন সংকটও উত্তরণ ঘটাতে সক্ষম হতে পারে।’ বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক সমস্যা খুব জটিল কিছু নয়। নিজেদের ইচ্ছামত পরিবর্তিত সংবিধানের দোহাই দিয়ে নিজেদের অধীনে আরেকটি একপাক্ষিক নির্বাচনের ছক এঁেক দেশে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে, তা দেশের সব মানুষের কাছে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা উন্নয়ন সহযোগিদের কাছে আবারো স্পষ্টরূপে ধরা পড়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস স্পষ্ট করে বলেছেন, গণতন্ত্র মানে একদিনের নির্বাচনের পরিস্থিতিকে বুঝায় না। এটি একটি সামগ্রিক প্রক্রিয়া। রাজনৈতিক দলের কর্মকা-, সরকারি প্রশাসনের কর্মকর্তা, নির্বাচন কমিশন, গণমাধ্যম, সুশীল সমাজ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যসহ সকলেরই এখানে ভূমিকা রাখতে হয়। এখন থেকে তা শুরু করতে না পারলে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশ্রগহণমূলক নির্বাচন আশা করা দুরুহ। বিরোধীদলের জনসভায় ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়া কিংবা আইনগত চাপে গণমাধ্যমের সেল্ফ সেন্সরশিপ সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক নির্বাচনী প্রক্রিয়ার অন্তরায়। এসব বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন সরকারের উপর অব্যাহত চাপ সৃষ্টির পাশাপাশি, রাজনৈতিক দল, নির্বাচন কমিশন, সরকারি কর্মকর্তা, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সাথে আলোচনা চালিয়ে গেলেও চূড়ান্ত ফয়সালার মালিক দেশের জনগণ। মানবজমিনের আড্ডায় পিটার ডি হাস সবশেষে এটাই স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।

[email protected]


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

বিহারীরা কেমন আছে
পিলখানা হত্যাকান্ডের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দ্ব্যর্থহীন উচ্চারণ
বিহারিরা কেমন আছে
আসাদ সরকারের পতন : নতুন সিরিয়ায় ইসরাইলি আগ্রাসন
আরও

আরও পড়ুন

বিনা খরচে কৃষকের দেড়’শ ধানের চারা রোপন  করে দিল কালীগঞ্জ কৃষি আফিস

বিনা খরচে কৃষকের দেড়’শ ধানের চারা রোপন করে দিল কালীগঞ্জ কৃষি আফিস

আরাফাত রহমান কোকো ৮ দলীয় ফুটবল টুর্নামেন্টে উদ্দীপন যুব সংঘ চ্যাম্পিয়ন

আরাফাত রহমান কোকো ৮ দলীয় ফুটবল টুর্নামেন্টে উদ্দীপন যুব সংঘ চ্যাম্পিয়ন

সাতক্ষীরার নলতায় চার দফা দাবিতে ছাত্র -ছাত্রীদের আন্দোলন, ক্যাম্পাসের নাম বদল

সাতক্ষীরার নলতায় চার দফা দাবিতে ছাত্র -ছাত্রীদের আন্দোলন, ক্যাম্পাসের নাম বদল

অর্থনৈতিক সংকটে আফগান রুটি, ঐতিহ্য ও জীবনের অংশ

অর্থনৈতিক সংকটে আফগান রুটি, ঐতিহ্য ও জীবনের অংশ

আশুগঞ্জে গ্যারেজ মালিককে হত্যা করে  অটোরিকশা নিয়ে পালিয়েছে দুর্বৃত্তরা

আশুগঞ্জে গ্যারেজ মালিককে হত্যা করে  অটোরিকশা নিয়ে পালিয়েছে দুর্বৃত্তরা

উত্তরপ্রদেশে ৩ খলিস্তানি বিদ্রোহীকে গুলি করে হত্যা পুলিশের

উত্তরপ্রদেশে ৩ খলিস্তানি বিদ্রোহীকে গুলি করে হত্যা পুলিশের

শিবালয়ের যমুনায় অবৈধভাবে বালু উত্তোলন হুমকিতে বৈদ্যুতিক টাওয়ার

শিবালয়ের যমুনায় অবৈধভাবে বালু উত্তোলন হুমকিতে বৈদ্যুতিক টাওয়ার

হিলিতে কমেছে আলু পেঁয়াজের দাম

হিলিতে কমেছে আলু পেঁয়াজের দাম

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে উত্তর কোরিয়ার ১,১০০ হতাহতের শিকার : সিউল

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে উত্তর কোরিয়ার ১,১০০ হতাহতের শিকার : সিউল

ঢাকা - মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে ঘণ কুয়াশায় আবারো দূর্ঘটনা , নিহত ১ আহত ৪

ঢাকা - মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে ঘণ কুয়াশায় আবারো দূর্ঘটনা , নিহত ১ আহত ৪

ড্রোন হামলার জবাবে ইউক্রেনে ‘ধ্বংসযজ্ঞ’ চালানোর হুমকি পুতিনের

ড্রোন হামলার জবাবে ইউক্রেনে ‘ধ্বংসযজ্ঞ’ চালানোর হুমকি পুতিনের

রাহাত ফতেহ আলী খানের সম্মানে পাকিস্তান হাইকমিশনারের নৈশভোজ আয়োজন

রাহাত ফতেহ আলী খানের সম্মানে পাকিস্তান হাইকমিশনারের নৈশভোজ আয়োজন

‘চা পান স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী’, স্বীকৃতি যুক্তরাষ্ট্রের

‘চা পান স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী’, স্বীকৃতি যুক্তরাষ্ট্রের

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে কাপ্তাই ভূমিকা রেখেছিলো, আগামীতেও রাখবে : ঢাবি শিবির সেক্রেটারি

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে কাপ্তাই ভূমিকা রেখেছিলো, আগামীতেও রাখবে : ঢাবি শিবির সেক্রেটারি

মার্কিন টাইফুন ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা অর্জনের পথে ফিলিপাইন

মার্কিন টাইফুন ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা অর্জনের পথে ফিলিপাইন

সুন্দরবনকেন্দ্রিক দস্যুতা বন্ধে পুলিশের নজরদারি বৃদ্ধি করা হচ্ছে জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভা অনুষ্ঠিত

সুন্দরবনকেন্দ্রিক দস্যুতা বন্ধে পুলিশের নজরদারি বৃদ্ধি করা হচ্ছে জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভা অনুষ্ঠিত

মায়োতে সাইক্লোন চিডোর ধ্বংসযজ্ঞে ফ্রান্সে জাতীয় শোক

মায়োতে সাইক্লোন চিডোর ধ্বংসযজ্ঞে ফ্রান্সে জাতীয় শোক

সাড়ে ৪মাস পর হিলিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহত নাঈমের লাশ কবর থেকে উত্তোলন

সাড়ে ৪মাস পর হিলিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহত নাঈমের লাশ কবর থেকে উত্তোলন

কলাপাড়ায় অগ্নিকান্ডে দু'টি দোকান পুড়ে ছাই

কলাপাড়ায় অগ্নিকান্ডে দু'টি দোকান পুড়ে ছাই

গাছ আর জিও ব্যাগ পেয়ে খুশি খুলনার ছাদবাগানীরা

গাছ আর জিও ব্যাগ পেয়ে খুশি খুলনার ছাদবাগানীরা