বিএনপির অহিংস আন্দোলন কতটা কার্যকর
১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৮:২১ পিএম | আপডেট: ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০৪ এএম
দুটি বিষয় সামনে রেখে বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। একটি হলো আমদানী অন্যটি হলো রফতানী। আমদানির জন্য অর্থের দরকার। আর অর্থ আসবে পণ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করে তা অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রফতানী করার মাধ্যমে। রফতানির মাধ্যমে অর্থ উপার্জন হয়। তাই সর্বাগ্রে উৎপাদন বাড়ানোর দরকার। আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে, ভারত বা চীন হলো আমাদের জন্য আমদানীকারক দেশ। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন হলো আমাদের রফতানিকারক দেশ। এসব দেশ ছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যের দেশ যেমন-কুয়েত, কাতার, সউদী আরব, ইউএই প্রভৃতিতে আমরা শ্রম রফতানি করি। আবার যুক্তরাষ্ট্র বা ইইউতে গার্মেন্ট ও শ্রম রফতানী করি। এছাড়াও চামড়া ও চামড়াজাত দ্রব্যের ৮৫ ভাগ রপ্তানি হয়ে থাকে ইউরোপিয় ইউনিয়ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়াতে। তাই ভারত বা চীন আমাদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির উৎস হতে পারে না। আমাদের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করে রফতানীকারক দেশগুলো। তাই যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপিয় ইউনিয়ন আমাদের শুভাকাক্সক্ষী। ফলে নির্বাচন সংক্রান্ত বিষয়ে বা অভ্যন্তরীণ সংকটে বা আঞ্চলিক সংকটে তাদের সহায়তা চাওয়া বুদ্ধিদৃপ্ত এবং আমাদের নিরাপত্তা, সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্র রক্ষার জন্য শ্রেয়। অন্যদিকে, চীন বা ভারতের নিকট সাহায্য চাওয়া গণতন্ত্রের জন্য বা সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি স্বরূপ। অভিজ্ঞতা থেকে, বিভিন্ন মিডিয়া তথ্য থেকে ধারণা করা হয়, আওয়ামী লীগ সরকার মূলত ভারতের উপর নির্ভরশীল। পর্যবেক্ষণ থেকে বলা যায়, প্রধানত সহিংস, অহিংস এবং শংকর -এই তিন ধারার আন্দোলন রয়েছে। যে আন্দোলনে রক্তাক্ত অধ্যায় রচিত হয় তা হচ্ছে, সহিংস আন্দোলন। শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলন, গণ অভ্যুত্থান প্রভৃতি সহিংস আন্দোলনের দৃষ্টান্ত। কিন্তু অহিংস আন্দোলন হলো, অধিকার আদায়ের জন্য যৌক্তিক দাবী উত্থাপনের মাধ্যমে জনমত অনুকূলে আনার জন্য যে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় তা। বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন হলো, অহিংস আন্দোলন। আবার রক্তপাতহীন সামরিক অভ্যুত্থান অহিংস আন্দোলনের দৃষ্টান্ত। বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। এই প্রবন্ধে আমি এর দুটি ভাগ দেখাচ্ছি। একটি হলো, নিরেট বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন। অন্যটি হলো, শংকর বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন। কোন রাজনৈতিক দলের সদস্যরা যুক্ত না হয়ে শুধুমাত্র পেশাজীবীগণ দেশের কল্যাণে সম্পৃক্ত থেকে যে আন্দোলন রচনা করেন, তা হলো নিরেট বুদ্ধিবৃত্তি আন্দোলন। এই ধরনের আন্দোলনের দেখা মিলা ভার। এই আন্দোলনে মুখ্য উদ্দেশ্য অনেকটা গোপনীয় হয়ে থাকে। অন্যদিকে, যে আন্দোলন পেশাজীবী ও রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের নিয়ে মিশ্রিতভাবে গঠিত হয়, তা হলো শংকর বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন। এই আন্দোলন অনেকটা প্রকাশ্য। এখানে যিনি পেশাজীবী তিনিই রাজনীতিবিদ হতে পারেন। আবার শুধুমাত্র রাজনীতিক বা শুধুমাত্র পেশাজীবীও হতে পারে। বেশ কয়েক বছর আগে গঠিত বর্তমানে ডাঃ জাহিদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন ‘বাংলাদেশ সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদ’ কর্তৃক আয়োজিত আন্দোলন, অবসরপ্রাপ্ত সিভিল সার্ভেন্টস নিয়ে গঠিত ‘পলিসি ম্যানেজম্যান্ট অ্যান্ড রিসার্চ সোসাইটি’ নামক সংগঠন, অধ্যক্ষ মোঃ সেলিম ভূঁইয়ার নেতৃত্বাধীন ‘শিক্ষক-কর্মচারী ঐক্যজোট’ এবং ‘প্রফেশনালস মুভমেন্ট অব বাংলাদেশ’ হলো শংকর বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন। এগুলোতে পেশাজীবী ও রাজনৈতিক লোকের সম্পৃক্ততা রয়েছে। অন্যদিকে, যে আন্দোলনে সহিংস ও অহিংস আন্দোলনের মিশ্রণ থাকে তা হলো শংকর আন্দোলন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, বিএনপি এবং তার জোট যে আন্দোলন করছে, তা কোন ধরনের আন্দোলন? আলোচনার সুবিধার্থে সহিংস আন্দোলনকে দুটি ধারায় ভাগ করে দেখানো হচ্ছে। ১. সক্রিয় সহিংস আন্দোলন। ২. অলস সহিংস আন্দোলন। যে আন্দোলনে নেতকর্মীরা দাবী আদায়ের লক্ষ্যে রাজপথে অবস্থান করে, প্রতিপক্ষের সশস্ত্র আক্রমণ মোকাবেলা করে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে মোকাবেলা করে অথবা প্রতিপক্ষকে সশস্ত্র আক্রমণ করে এবং দাবী আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন অব্যাহত রাখে তা হলো সক্রিয় সহিংস আন্দোলন। যেমন-হরতাল, অবরোধ, গণঅভ্যুত্থান প্রভৃতি মাঠ-ময়দান বা রাজপথ কেন্দ্রিক আন্দোলন। আবার যে সময়ে যে আন্দোলন করা দরকার, সে সময় সে আন্দোলন না করে, যথোপযুক্ত আন্দোলনের গতি নষ্ট করে মাঠে-ময়দানে বা রাজপথে কোন আন্দোলন সংগঠিত হলে, তা হবে লেথারজিক ভায়োলেন্স মুভমেন্ট। এই আন্দোলন হলো সংগঠিত হওয়ার আন্দোলন। যেকোনো অ্যাকটিভ ভায়োলেন্স মুভমেন্ট শুরু হওয়ার পূর্বের আন্দোলন। আরেক ভাষায় বললে, আন্দোলনের প্রাথমিক ধাপ। চূড়ান্ত আন্দোলনের প্রস্তুতি স্বরূপ ছাত্র সমাবেশ, শ্রমিক সমাবেশ, রাজনৈতিক দল কর্তৃক বুদ্ধিজীবী সমাবেশ হলো লেথারজিক ভায়োলেন্স মুভমেন্ট এর দৃষ্টান্ত। এই আন্দোলনের গতি দুর্বল কিন্তু ঊর্ধ্বমূখী। অনেক সময় সরকারবিরোধী আন্দোলনের ঊর্ধ্বতন নেতৃত্ব জেল, জুলুম, হুলিয়া, অপহরণ বা খুন-গুমের ভয়ে যথোপযুক্ত আন্দোলনের কর্মসূচী না দিয়ে কর্মীদের ব্যস্ত রাখতে লেথারজিক ভায়োলেন্স মুভমেন্ট’র কর্মসূচী ঘোষণা করেন।
বিএনপি এখন যে আন্দোলনে আছে, তা হলো ‘লেথারজিক ভায়োলেন্স মুভমেন্ট’। এই ধরণের আন্দোলন এখন সময় উপযোগী নয়, তবে মাঠে ময়দানে অব্যাহত থাকে। কর্মীদের চাঙ্গা রাখার জন্য মূল নেতৃত্ব এই ধরনের আন্দোলনের ডাক দিয়ে থাকে। প্রধান এবং শক্তিশালী বিরোধীদল বিএনপি’র তারণ্যের সমাবেশ, পদযাত্রা প্রভৃতি কর্মসূচী হলো অলস সহিংস আন্দোলন। কোন সন্দেহ নেই যে, ‘তারণ্যের সমাবেশ’ আন্দোলনে একটি নতুনত্ব রয়েছে। এই ধরনের কর্মসূচীর ধারণা যাদের মাথা থেকে এসেছে, তারা যথেষ্ট মেধাবী। তবে সরকার পতনের জন্য এই সমাবেশ খুব বেশি কার্যকর নয়। সময় বিবেচনায় এখন তীব্র আন্দোলনের ডাক দেয়া প্রয়োজন। তাই অ্যাকটিভ ভায়োলেন্স মুভমেন্ট অথবা বুদ্ধিবৃত্তিক সুশৃঙ্খল অভ্যুত্থানের প্রয়োজন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বুদ্ধিবৃত্তিক শৃঙ্খলাপূর্ণ অভ্যুত্থান ঘটেছে। ‘লিগেল আর্মস কেরিয়ার ফোর্স’ থেকে এই ধরনের ঘটনা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ঘটার উদাহরণ রয়েছে। বুদ্ধিবৃত্তিক শৃঙ্খলাপূর্ণ অভ্যুত্থানের সুবিধা হচ্ছে, রাষ্ট্রীয় সংকটকালীন কোন ধরনের রক্তক্ষয়ী সংঘাত ছাড়া সংকট থেকে সাময়িক উত্তরণ সম্ভব। এই ধরনের অভ্যুত্থান ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী সংঘাত থেকে রাষ্ট্রকে রক্ষা করে। ইউরোপী ইউনিয়নসহ অন্যান্যরা বাংলাদেশের নির্বাচনের জন্য যেভাবে দৌড়ঝাপ শুরু করেছে, তা ইতিবাচক। এটা শান্তিপূর্ণভাবে গণতন্ত্র পূনরুদ্ধারের জন্য একটা উত্তম ব্যবস্থা। স্বীকার করতে হবে, এসব দৌড়ঝাপ কোনভাবেই সংবিধান সম্মত নয়। আবার এটাও স্বীকার করতে হবে যে, সাংবিধানিকভাবে এগুলে বর্তমান সংকটের কোন গ্রহণযোগ্য সমাধান আসবে না। একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে উত্তম নির্বাচনের মাধ্যমে যারা ক্ষমতায় আসবে, তারা বর্তমান নির্বাচনী ব্যবস্থাকে পরিবর্তন করবে। তাই এই মূহুর্তে দুটি কাজ অত্যন্ত জরুরী হয়ে পড়েছে।
প্রথমত, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারকে বিরোধীদলের দাবী মানতে বাধ্য করা। দ্বিতীয়তঃ নতুন কাউকে নির্বাচনকালীন রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য দায়িত্ব দেয়া। নতুন কাউকে দায়িত্ব দেওয়ার জন্য সাময়িক রাষ্ট্র পরিচালনা পর্ষদ বা ‘টেনটেটিভ স্ট্যাট গভার্নিং বডি’ (টিএসজিবি) গঠন করা যেতে পারে। অবসরপ্রাপ্ত সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তা, অবসরপ্রাপ্ত সুপরিচিত অধ্যক্ষ বা উচ্চ শিক্ষার শিক্ষক, বাংলাদেশ ব্যাংকের অবসরপ্রাপ্ত শীর্ষ কর্মকর্তা, বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস পরিবারের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, বিসিএস পুলিশ বিভাগের উর্দ্ধতন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, অবসর প্রাপ্ত বিচারপতি (সুপ্রীম কোর্ট), প্রবীন প্রথিতযশা আইনজীবী, বয়োজোষ্ঠ্য উচ্চ শিক্ষিত মানবাধিকারকর্মী নিয়ে টিএসজিবি গঠন করা যায়।
তাই টিএসজিবি গঠনের জন্য আমাদের দরকার সক্রিয় আন্দোলন। কিন্তু এ ধরনের আন্দোলনে ব্যাপক রক্তক্ষয়ী সংঘাত ঘটে বলে বিকল্প কিছুও চিন্তা করতে হবে। এই বিকল্প চিন্তার অংশ হিসেবে নিরেট বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে। সক্রিয় আন্দোলনকারীগণ নিরেট বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনকারীদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতে হবে। নিরেট বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য গোপনীয় বলে এরা অহিংস অবস্থায় বড় রাজনৈতিক দলের ছায়াতলে থেকে কার্যক্রম চালাতে হবে।
লেখক : প্রবন্ধকার ও কলামিস্ট।
email: [email protected]
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
ঝিনাইগাতীতে আইন শৃঙ্খলা কমিটিসহ ৪ কমিটির সভা অনুষ্ঠিত
গফরগাঁওয়ে ভিজিডির ৫১ বস্তা চুরি
গোলাপগঞ্জে মাদক সেবনের অপরাধে দুই জনকে জরিমানা ও কারাদণ্ড
ফ্যাসিস্ট সরকারের নিপীড়ন থেকে রাজনৈতিক দলগুলো শিক্ষা নেয়নি ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ
ঢাকাকে উড়িয়ে আসর শুরু রংপুরের
নিজ জমিতে যাওয়া হলো না সিলেটে এক ব্যবসায়ীর : হামলা করলো যূবদলনামধারী ভূমিখেকো চক্র
প্রতারণার দায়ে অনন্ত জলিলের বিরুদ্ধে সমন জারি
রেকর্ড পুনরুদ্ধার করে শাহিদির ২৪৬, রেকর্ড গড়ল আফগানিস্তানও
‘ইসলাম প্রচার প্রসারে সউদী সরকার ব্যাপক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে’
টেলিটকের দুটি স্পেশাল ডাটা প্যাকেজের উদ্বোধন করলেন উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র তৈরি করবে সরকার: প্রেস সচিব
এসিআই লিমিটেড ২০ শতাংশ নগদ এবং ১৫ শতাংশ স্টক লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে
এবার ছাত্রদল সভাপতির পাশে দাঁড়ালেন হাসনাত আব্দুল্লাহ
কোয়ালিফাইয়ারের বাধা টপকাতে চায় রংপুর
খুশদিলের শেষের ঝড়ে রংপুরের বড় সংগ্রহ
চোখের চিকিৎসায় স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ও ইস্পাহানী চক্ষু হাসপাতালের যৌথ উদ্যোগ
পিলখানা হত্যাকাণ্ডের সব তথ্য প্রকাশ করা হবে: প্রধান উপদেষ্টা
১০ শতাংশ ক্যাশ ডিভিডেন্ট দেয়ার ঘোষণা বেস্ট হোল্ডিংস লিমিটেডের
এনআরবিসি ব্যাংকের বামেলকো কনফারেন্স অনুষ্ঠিত
১৭ দিন মৃত সন্তানকে বহন করেছিল, ফের মা হল সেই ওরকা তিমি