ঢাকা   শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৫ আশ্বিন ১৪৩১

প্রবীণরা সমাজের সম্পদ বোঝা নয়

Daily Inqilab আফতাব চৌধুরী

০১ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০৪ এএম | আপডেট: ০১ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০৪ এএম

পৃথিবীতে এখন প্রতি সেকেন্ডে জনসংখ্যা বাড়ছে প্রায় তিন জন, প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ১১০০ জন, প্রতিদিন ২,৮০,০০০ জন। এর সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ৬০ বছরের বেশি বয়সী মানুষের সংখ্যা। আগামী দিনে প্রবীণদের সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পাবে। পৃথিবীতে প্রতি মাসে দশ লাখ নারী-পুরুষ পৌঁছে যাচ্ছেন ৬০-এর কোঠায়। এমন চললে আগামী ২০৫০ সালের মধ্যে দাদা-দাদীর সংখ্যা নাতি-নাতনিদের সংখ্যার দ্বিগুণ হবে।

তৃতীয় বিশ্বের কথা বাদ দিলে উন্নত দেশগুলোতে অর্থনৈতিক প্রগতি এবং পুষ্টি, চিকিৎসা ও জনস্বাস্থ্য খাতে প্রচুর অর্থ লগ্নি করার ফলে প্রত্যাশিত আয়ু বৃদ্ধি হয়েছে। ফলে ৬০ কোটি জ্যৈষ্ঠ নাগরিকের জীবন ও স্বাস্থ্যের পরিচর্যা নিয়ে নীতি নির্ধারকেরা ভাবনাচিন্তা করতে শুরু করেছেন। ১৯৫০ সালে প্রবীণ নাগরিকদের সংখ্যা ছিল ২০ কোটি, ২০৫০ সালে সারা বিশ্বে তা হবে ১২০ কোটি। আগামী দু-দশকের মধ্যে আমেরিকায় প্রতি চারজনে একজন এবং জাপানে মোট জনসংখ্যার ৩০ শতাংশ হবেন প্রবীণ নাগরিক। ইতালিতে এখন জনসংখ্যার ২৩ শতাংশ ৬০ বছরের বেশি, অন্যদিকে ১৫ বছর বয়সীদের সংখ্যা পৃথিবীতে ১৪ শতাংশ। ২০৩০ সালে ইতালিতে চাকরিরতদের সংখ্যাকে ছাড়িয়ে যাবে পেনশনভোগীদের বা প্রবীণ যুবকদের উপস্থিতি। কাজের লোকই পাওয়া যাবে না। ২০২৫ সালে ইতালি ও জাপানে সিনিয়র সিটিজিনদের হার হবে বিশ্বে সর্বাধিক, ৩৩ শতাংশ। ক্রমবর্ধমান প্রবীণ নাগরিকদের চাপে আমাদের দেশেও বয়স্কদের বরাত পালটে যাচ্ছে। ২০০০ সালে বাংলাদেশে প্রবীণদের সংখ্যা ছিল ৭৫ লাখের মতো। বর্তমানে তা হয়েছে প্রায় ৮০ লাখ। ২৫ বছর পরে তা বেড়ে হবে ১ কোটি ৫০ লাখ। বয়স্কদের এমন সংখ্যা বৃদ্ধি চলতে থাকলে ভবিষ্যতে সুনামি ভূমিকম্পের থেকেও ভয়াবহ হবে বয়োকম্প বা এজকোয়েক।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কখন এবং কেন বুড়ো হই। বয়স বাড়ার সাথে সাথে সবাইকেই একদিন বুড়ো হতে হয়। বয়স যত বাড়ে আমরা তত বুড়ো হই। বুড়ো হতে আমরা কেউ চাই না। কারণ, কার্যক্ষমতা এবং দেহের সৌন্দর্য হারাতে কে-ই বা চায়। বিজ্ঞানীরা বলেন, আমাদের শরীরে বুড়ো হবার প্রথম লক্ষণ ৩৫-৪৫ বয়স থেকেই শুরু হয়ে যায়। আসলে বয়স যখন বাড়তে থাকে তখন আমাদের দেহে কোলাজেন নামের এক তন্তুজাতীয় পদার্থ তৈরি করার ক্ষমতা হ্রাস পায়। কোলাজেন দেহত্বক, পেশি, হাড় প্রভৃতির মধ্যে থেকে আমাদের শরীরকে মজবুত রাখতে সাহায্য করে। বয়স বেশি হলে ওই কোলোজেন তন্তু তৈরি কমে যায়, ফলে বার্ধক্য আসে এবং শরীর নরম ও ভঙ্গুর হয়ে যায়। দেহে কোষের সংখ্যা বৃদ্ধি করে। কিন্তু এদের জীবনকাল কম। ফলে মৃত কোষের জয়াগায় নতুন কোষ এসে ভরাট করে। বয়স বাড়ার সাথে এদের বিভাজন ক্ষমতা কমে যায়, তখন তারা মৃত হতে শুরু করে ফলে যকৃত, বৃক্ক ইত্যাদির ওজন ও কার্যক্ষমতা কমতে শুরু করে। অধিক বয়স হলে মস্তিষ্কের ¯œায়ুকোষ ও দেহকোষের সংখ্যা কমতে শুরু করে। ফলে স্মৃতিলোপ, বৃদ্ধি হ্রাস ও চিন্তাশক্তি কমে যায়। বিজ্ঞানের অগ্রগতির ফলে গতিশীল সমাজে প্রবীণরা পাল্লা দিতে পারছে না।

প্রবীণরা সমাজের বোঝা নয়। সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অথনৈতিক উন্নয়নে তাদেরও কিছু দেওয়ার আছে। বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের প্রতি অনেক বেশি সংবেদনশীল হতে হবে। তাদের প্রতি তাচ্ছিল্য করা যাবে না। তাদের দিতে হবে সম্মান, স্বাধীনতা, মর্যাদা, পরিচর্যা, অংশগ্রহণ এবং আত্মতৃপ্তির সুযোগ। আমেরিকাতে এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে প্রস্তাব গৃহীত হয় যে ‘রিটায়ারমেন্ট’, বুড়ো, ‘দাদু’ শব্দগুলো তুলে দেওয়া হোক। কারণ, প্রতিদিন উচ্চারণে ‘দাদু, বুড়ো, অবসর’ এগুলো মনে করিয়ে দেয় জরা দুর্বলতা ও মৃত্যুর কথা। তাই সেখানে ষাটোর্ধ্ব বয়সের লোকদের বলা হয় ‘প্রবীণ যুবক’।

প্রাচীন সমাজে যৌথ পরিবার ছিল, এখন নেই। যৌথ পরিবার ভেঙ্গে হচ্ছে একক পরিবার। পুত্র-কন্যাদের দায়িত্ব হবে পিতা-মাতার প্রতি পূর্ণ মর্যাদায় সেবা করা ও সাহায্যের হাত প্রসারিত করা। কারণ, তারাও একদিন সন্তানের জন্য আত্মত্যাগ, সেবা ও শিক্ষার ব্যবস্থা করেছেন। কিন্তু ছেলে যদি মানুষ না হয় কিংবা পুত্রবধূ যদি নারীর আদর্শে উদ্বুদ্ধ না হয় তবেই সমস্যা। নবীনদের অনেকের অবস্থা এরকমÑ নিজের পিতামাতাকে চূূড়ান্ত অবহেলা, পাগল প্রতিপন্ন করে ঘর ছাড়া করা। মনে রাখতে হবে, আজকে যারা নবীন তারাও একদিন প্রবীণ হবে।

এমন অবস্থা আজকে যে, হিরের টুকরোর মতো হাই-টেক ছেলেরা পিতা-মাতার খবর রাখে না। ওরা দেশে-বিদেশে উচ্চপদে চাকরি করছে। মোটা বেতন পাচ্ছে আর শাশুড়ির সেবা করছে। বহু ছেলের বাড়িতে শ্বশুর-শাশুড়ি আছে, নেই নিজের মা-বাবা। যে মা-বাবা ছেলেকে উচ্চশিক্ষিত করার জন্য অন্য আরেক ছেলের দিকে দৃষ্টি দিতে পারেনি, সেই ছেলেই এখন মা-বাবাকে দেখছে। এটাই হচ্ছে বর্তমান যুগের শিক্ষার মূল্যবোধ।

আমেরিকাসহ উন্নত দেশগুলো বয়স্কদের সামাজিক সুরক্ষা দেওয়া রাষ্ট্রের কর্তব্য বলে মনে করে। জরা, স্থবিরতা, বার্ধক্য প্রতিরোধের গবেষণায় বিপুল অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে, যাতে মানুষদের বুড়িয়ে যাওয়ার রহস্য ভেদ করা যায়। প্রবীণদের সচল রাখতে চিকিসাশাস্ত্রে সংযোজিত হয়েছে নতুন শাখা, যার নাম ‘জেরিয়াট্রিক্স’। বয়সের সমস্যার সমাজতাত্ত্বিক ও চিকিৎসাগত দিকগুলো দেখার জন্য ইদানিং জেরেন্টোলজিককে আশ্রয় করার কথা ভাবতে হচ্ছে। জেরেন্টালজিস্টরা বলেছেন, বয়সের সঙ্গে মানসিক চিন্তাশক্তি হ্রাস পায়, এই ধারণাটা ভুল।

জেরেন্টালজি ও নিউরোসাইকোলজিক গবেষণা থেকে জানা যায়, মানসিক সক্রিয়তা মস্তিষ্ক সতেজ রাখে। ফলে বেঁচে থাকার মান বাড়বে। একটা সময় ছিল যখন আমাদের সমাজের বুড়ো মানুষদের দাম ছিল। পরিবারের সবাই তাদের কথা শুনত। সংসার, সমাজ তাদের সম্মান করত, মর্যাদা দিত। বর্তমানে জীবন-জীবিকার প্রতিযোগিতায় এবং উন্নত রুটি-রুজির টানে ভিটেমাটি ছেড়ে দেশ-বিদেশে চলে যাওয়ার ঝোঁক যৌথ পরিবারকে ভেঙ্গে চুরমার করে দিচ্ছে। নিউক্লিয়ার ফ্যামিলির আধুনিক বাতাবরণে বয়স্করা আর কর্তা নন। তারা অস্তিত্বটুকু বজায় রাখার জন্য নির্ভরশীল, নিজেরই উপার্জনশীল সন্তান-সন্ততির কাছে। উপার্জন না থাকলে ছেলের পরিবারে তিনি বোঝা।

বাংলাদেশে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা যা আছে তার মধ্যে ৪৫ শতাংশ মহিলা, এর অর্ধেকই আবার বিধবা। এই বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের প্রায় ৯০ শতাংশ পেনশন, প্রভিডেন্ট ফান্ড বা গ্র্যাচুইটি নির্ভর। কারণ, তারা অর্থনীতির অসংগঠিত ক্ষেত্রের বাসিন্দা। এদের ৫০ শতাংশ বাস করে দারিদ্রসীমার নিচে। এদের অবস্থা অত্যন্ত করুণ ও শোচনীয়। সরকারি সহায়তা ছাড়া তাদের বেঁচে থাকার পথ নেই।

পরিশেষে বলতে চাই, প্রবীণদের বা বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের অবজ্ঞা করা চলবে না, তাদের প্রতি পরিবারের বা রাষ্ট্রের বীভৎস আচরণ ও নিষ্ঠুর অত্যাচার করা চলবে না। তাদের ভেতর যে শক্তি ও সম্পদ আছে তা পরিবারের এবং দেশের কাজে ব্যবহার করতে হবে। এই শক্তি ও সম্পদকে অকেজো করে রাখলে দেশের ক্ষতি। সরকারকে বিভিন্ন পরিকল্পনা করে বা কমিটি করে কীভাবে তাদের ব্যবহার করা যায় তা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দেখতে হবে। জাতীয় নীতি প্রণয়ন করে প্রবীণদের কাজে লাগাতে হবে। দারিদ্রসীমার নিচে বসবাসকারী বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের মুখে হাসি ফোটাতে হবে। মনে রাখতে হবে, প্রবীণরাও সম্পদ।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

তোফাজ্জলের জানাজায় মানুষের ঢল, দাফন হলো বাবা-মা ও ভাইয়ের কবরের পাশে

তোফাজ্জলের জানাজায় মানুষের ঢল, দাফন হলো বাবা-মা ও ভাইয়ের কবরের পাশে

দ্রুত ৩ উইকেট হারিয়ে চাপে বাংলাদেশ

দ্রুত ৩ উইকেট হারিয়ে চাপে বাংলাদেশ

গণপিটুনিতে হত্যা: ঢালাওভাবে ছাত্রদের বিজয়কে খাটো করতে আওয়ামী মিডিয়ার আস্ফালন, সমালোচনার ঝড়

গণপিটুনিতে হত্যা: ঢালাওভাবে ছাত্রদের বিজয়কে খাটো করতে আওয়ামী মিডিয়ার আস্ফালন, সমালোচনার ঝড়

সাবেক এমপি ইয়াকুবসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা

সাবেক এমপি ইয়াকুবসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা

সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান কারাগারে

সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান কারাগারে

ভারতকে ৩৭৬ রানে গুটিয়ে দিল বাংলাদেশ, হাসানের ৫

ভারতকে ৩৭৬ রানে গুটিয়ে দিল বাংলাদেশ, হাসানের ৫

লিবিয়া থেকে ফিরলেন আরো ১৫০ অনিয়মিত বাংলাদেশি

লিবিয়া থেকে ফিরলেন আরো ১৫০ অনিয়মিত বাংলাদেশি

দোয়ারাবাজার সীমান্তে মহিষসহ মাছের চালান জব্ধ

দোয়ারাবাজার সীমান্তে মহিষসহ মাছের চালান জব্ধ

সিলেটে ১৫০ বোতল ফেনসিডিল উদ্ধার, নারী গ্রেফতার

সিলেটে ১৫০ বোতল ফেনসিডিল উদ্ধার, নারী গ্রেফতার

আশ্বিনকেও ফেরালেন তাসকিন

আশ্বিনকেও ফেরালেন তাসকিন

কক্সবাজার পাহাড়তলীতে অনৈতিক কাজে অতিষ্ঠ মানুষ, বাধা দেয়ায় বাসার মালিকের উপর হামলা

কক্সবাজার পাহাড়তলীতে অনৈতিক কাজে অতিষ্ঠ মানুষ, বাধা দেয়ায় বাসার মালিকের উপর হামলা

অংশীদারত্ব ও সহযোগিতা চুক্তির খসড়া পাঠিয়েছে ইইউ

অংশীদারত্ব ও সহযোগিতা চুক্তির খসড়া পাঠিয়েছে ইইউ

তাসকিনের জোড়া আঘাত, লিটনের রেকর্ড

তাসকিনের জোড়া আঘাত, লিটনের রেকর্ড

ডিবির আলোচিত ডিসি মশিউর গ্রেপ্তার

ডিবির আলোচিত ডিসি মশিউর গ্রেপ্তার

১৯৯ রানের জুটি ভাঙলেন তাসকিন

১৯৯ রানের জুটি ভাঙলেন তাসকিন

গণপিটুনিতে দুই মাসে ৩৩ জনের মৃত্যু

গণপিটুনিতে দুই মাসে ৩৩ জনের মৃত্যু

ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনায় প্রশ্ন তুললেন জয়

ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনায় প্রশ্ন তুললেন জয়

মেট্রোরেলের কাজীপাড়া স্টেশন খুলছে আজ

মেট্রোরেলের কাজীপাড়া স্টেশন খুলছে আজ

বিচিত্রার সম্পাদক দেওয়ান হাবিব আর নেই

বিচিত্রার সম্পাদক দেওয়ান হাবিব আর নেই

জাবিতে ছাত্রলীগ নেতা শামীম হত্যা : ৮ শিক্ষার্থীসহ অজ্ঞাতনামাদের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ

জাবিতে ছাত্রলীগ নেতা শামীম হত্যা : ৮ শিক্ষার্থীসহ অজ্ঞাতনামাদের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ