শ্রমিক দমনের নামে দেশকে বিপর্যয়ের মধ্যে ফেলা যাবে না
০৬ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০৪ এএম | আপডেট: ০৬ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০৪ এএম
দেশের পোশাকপণ্যের প্রধান বাজার যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এই দুই বাজারেই অধিকাংশ রফতানি হয়ে থাকে। সাম্প্রতিক সময়ে নানা কারণে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে পোশাক রফতানি কমে গেছে। অর্থনৈতিক মন্দার কারণে আমদানিকারকরা আমদানি ও অর্ডার কমিয়ে দিয়েছে। আমাদের রফতানি আয়ে এর বিরূপ প্রভাব দেখা দিয়েছে। রফতানি আয় কমে যাওয়ায় ডলার আগম কমেছে। এর অপপ্রভাব বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও আমদানিতে পড়েছে। এখনো এ পরিস্থিতির ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটেনি। এর আগে পত্রপত্রিকায় এই মর্মে খবর প্রকাশিত হয়েছে যে, অর্ডার ও রফতানি কমে যাওয়ায় অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। বেকার হয়ে পড়েছে বহু শ্রমিক। এই পর্যায়ে নতুন করে গার্মেন্টশিল্পের জন্য আরো একটি দুঃসংবাদ এসেছে। খবরে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রসহ ১২টি দেশে শ্রমিকদের স্বাস্থ্যঝুঁকির অজুহাতে বাংলাদেশি পোশাক বিক্রী বন্ধ করতে বিক্রেতাদের বাধ্য করা হচ্ছে। কানাডায় জর্জ ব্র্যান্ডের ২ লাখ ১৬ হাজার পোশাক প্রত্যাহার করেছে ওয়াল্ডমাট। এভাবে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানও পোশাক প্রত্যাহার করছে। বলা বাহুল্য, এটা যদি ব্যাপক রূপ পায় তবে বাংলাদেশের পোশাক রফতানির ভবিষ্যত অনেকটাই অনিশ্চিত হয়ে যাবে। দেশের জন্য, অর্থনীতির জন্য, কর্মসংস্থানের জন্য তা যে কত বড় ক্ষতি ডেকে আনবে কল্পনাও করা যায় না। গার্মেন্ট দেশের সবচেয়ে সম্প্রসারণশীল শিল্প। এখানে হাজার হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ আছে। দেশের মোট রফতানি আয়ের ৮০ শতাংশের ওপরে আসে এখাত থেকে। এখানে কমপক্ষে ৫০ লাখ শ্রমিক সরাসরি কর্মরত রয়েছে। কোনো কারণে গার্মেন্টশিল্প বসে গেলে বস্ত্রশিল্পের অবস্থা হয়ে পড়বে সর্বাধিক শোচনীয়। গার্মেন্টশিল্পের ওপর নির্ভর করেই মূলত বস্ত্রশিল্পের বিস্তার ঘটেছে। গার্মেন্টশিল্পের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্প হিসেবে বহু শিল্প কারখানা গড়ে উঠেছে। লেভেল, ট্যাগ, পলি, চেইন, বোতাম, কার্টুন, ডায়িং, রংসহ আরো নানান শিল্প কারখানা গড়ে উঠেছে। এসবের ব্যবসা-বাণিজ্যহেতু বহু দোকানপাট ও লোকজনের কর্মসংস্থান হয়েছে। গার্মেন্ট ও সংশ্লিষ্ট শিল্পকারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য, দোকানপাট ইত্যাদি মাধ্যমে কয়েক কোটি মানুষ জীবননির্বাহ করছে। তাদের আয়ে তাদের পোষ্যদের ভরণ-পোষণ হচ্ছে। তাদের খাদ্য-খাবার ও পোশাক পরিচ্ছদসহ ব্যবহার্য সামগ্রীর যোগান আসছে। গার্মেন্টশিল্পের অস্তিত্বের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা কতটা অতঃপর তা আর ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না।
গার্মেন্টশিল্প মোটেই ভালো নেই। অর্ডার ও রফতানি কমে যাওয়ার ফলে কারখানা বন্ধ হওয়া, বিভিন্ন দেশে পোশাক বিক্রি বন্ধ বা প্রত্যাহার কারার পাশাপাশি গার্মেন্ট কারখানাগুলোতে শ্রমিক অসন্তোষ মারাত্মক রূপ নিয়েছে। বর্ধিত বেতন ও বকেয়া বেতনভাতা পরিশোধের দাবিতে শ্রমিকরা লাগাতার আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। আন্দোলন দমনে র্যাব-পুলিশ ব্যবহারের অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্তে পরিস্থিতি মারাত্মক রূপ নিয়েছে। গত পরশুও আশুলিয়া ও গাজীপুরে শ্রমিক-পুলিশ সংঘর্ষের ঘটনায় তিনজন শ্রমিক গুলিবিদ্ধ হয়েছে। এর আগে তিনজন শ্রমিক নিহত হয়েছে। শ্রমিকদের বেতনবৃদ্ধির দাবিকে পাত্তা না দিয়ে শক্তিবলে তাদের দমন করার পদক্ষেপ নেয়ায় হিতে বিপরীত হচ্ছে। বর্তমান মূল্যস্ফীতি ও জীবনযাত্রার অস্বাভাবিক ব্যয়বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধির দাবি অযৌক্তিক নয়। শ্রমিক, মালিক ও সরকারÑ এই তিনপক্ষ একসঙ্গে বসে আলাপ-আলোচনা করে বেতনের বিষয়টি ফয়সালা করা মোটেই অসম্ভব ছিল না। কিন্তু শ্রমিকদের আন্দোলন দমনের পথ বেছে নিয়েছে, মালিকদেরও হয়তো এই ব্যবস্থার প্রতি সমর্থন রয়েছে। তা না হলে এত হুমকি-ধমকি কেন? কারখানা বন্ধ করে দেয়ার হুমকি কিংবা কারখানা বন্ধ করে গ্রামে চলে যাওয়ার প্ররোচণা কেন? শ্রমিকদের আন্দোলনকে চলমান রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে এক করে দেখা হচ্ছে। উভয় ক্ষেত্রে দমন-পীড়ন, হামলা-মামলা ও গ্রেফতারের পথ অনুসরণ করা হচ্ছে। দুই আন্দোলন যে এক নয়, দুইয়ের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য যে অভিন্ন নয়, সেটা বুঝতে না পারা কিংবা না চাওয়া বিবেচনাবোধের দৈন্যের প্রমাণ বহন করে। অভিজ্ঞতা সাক্ষ্য দেয়, শ্রমিক আন্দোলন জিঁইয়ে রাখার ফল শুভ হয় না। তাই যত দ্রুত সম্ভব বর্ধিত বেতনের ব্যাপারে গ্রহণযোগ্য মীমাংসায় পৌঁছানো উচিত ছিল। গড়িমসি ও ভুল নীতির কারণে আন্দোলনের বিস্তার যেমন হয়েছে, তেমনি কারখানায় হামলা-ভাঙচুর, সংঘাত-সংঘর্ষ, প্রাণহানি ও কারখানা বন্ধ হয়েছে। গত শনিবার কিছু কারখানা খুললেও আন্দোলন অব্যাহত আছে।
শ্রমিক অসন্তোষ ও আন্দোলন বন্ধ কিংবা শ্রমিকদের ওপর দমন পীড়ন ও তাদের দাবিকৃত বেতন না দেওয়া ইত্যাদি নিয়ে সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো সক্রিয় হয়ে উঠেছে। ক্লিন ক্লথ ক্যাম্পেইন (সিসিসি) নামের অ্যাপারেল লেবার ইউনিয়ন অ্যালায়েন্স হিসাবে কাজ করা সংগঠনটি শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধির দাবি সমর্থন করার জন্য বাংলাদেশ থেকে পোশাক আমদানিকারক ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। সিসিসির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলোর উচিত শ্রমিকদের দাবিকৃত বেতন দেয়ার পক্ষে বিবৃতি দেয়া। ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলো অবশ্য এখনো ওই ধরনের কোনো বিবৃতি দেয়নি। তবে বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ড এডিডাস, মার্কিন ফ্যাশন ব্র্যান্ড লেডিস্ট্রাউস অ্যান্ড কোম্পানির পক্ষ থেকে গত মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে যৌথভাবে পাঠানো এক চিঠিতে স্টেক হোল্ডারদের মতামত নিয়ে দেশের অর্থনৈতিক বাস্তবতাকে প্রতিফলিত করে এমন ন্যূনতম বেতন নির্ধারণের অনুরোধ করা হয়। সিসিসির সক্রিয় ভূমিকা, ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলোর অনুরোধ ও বক্তব্য আন্দোলনকারীদের অনুপ্রাণিত করবে, সন্দেহ নেই। কিন্তু তা কোনো সমাধান এনে দেবে না। সমাধান শ্রমিক, মালিক ও সরকারকেই করতে হবে। এজন্য তিন পক্ষেরই সমআন্তরিকতা থাকতে হবে। গার্মেন্টসশিল্প বন্ধ হয়ে গেলে বা ক্ষতিগ্রস্ত হলে কি বিপুল ক্ষতি হবে দেশের, দেশের মানুষের ও অর্থনীতির, সেটা গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে। ষড়যন্ত্র খোঁজা, রাজনৈতিক উসকানি আবিষ্কার কিংবা র্যাব-পুলিশ দিয়ে আন্দোলন দমন করার হুমকি দেয়া, কোনোটাই সঙ্গত ও যুক্তিযুক্ত কাজ হবে না। এসব করার পরিণতি হবে ভয়াবহ, যা শুভবুদ্ধি সমর্থন করে না। দেশের বর্তমান নাজুক আর্থিক অবস্থা আর কোনোভাবেই অনবত করা যাবে না।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
বিদেশে সাবেক ভুমিমন্ত্রীর আট হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি
ইউনূস গুড উইলের প্রতিফলন দেখতে চায় জনগণ: রিজভী
সময় থাকতে হাসিনাকে ফেরত পাঠান : ভারতকে দুদু
রুশ সেনা কুরস্কের দুটি শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে
বিমানবন্দর এলাকা হবে শব্দদূষণ মুক্ত
যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ওসি আবুল হাসান ৭ দিনের রিমান্ডে
বিচার শুরু হলে হাসিনাকে ফেরত চাওয়া হবে : আইন উপদেষ্টা
লোহাগড়ায় দিনে-দুপুরে বসতবাড়ি পুড়ে ছাই
রাষ্ট্রীয় কল্যাণে অবদান রাখার সুযোগ দিন আলেমদেরকে
দুই মেডিকেল টেকনোলজিস্টের ওপর হামলার ঘটনায় বিএমটিএর নিন্দা
জিএম কাদের ও মজিবুল হক চুন্নুকে অবিলম্বে আটক করতে হবে : আবু হানিফ
উপদেষ্টাদের আয় ও সম্পদ বিবরণী প্রকাশের নীতিমালা অনুমোদন
সাবেক মন্ত্রী শ ম রেজাউল-এমপি হেনরিসহ ৩ জনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা
পটুয়াখালী মেডিক্যাল কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতিকে একবছর ,সাধারন সম্পাদককে দুই বছর একাডেমীক কার্যক্রম থেকে বহিস্কারসহ উভয়কে হোস্টেল থেকে আজীবন বহিস্কার।
ঢাবিতে যুবককে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগে ৫ শিক্ষার্থী গ্রেফতার
রাজউক চেয়ারম্যানের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল
‘স্পেন্ড অ্যান্ড উইন’ ক্যাম্পেইনের বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করেছে মাস্টারকার্ড
সিটি ব্যাংক আনল অভূতপূর্ব ভিসা ইনফিনিট ক্রেডিট কার্ড
শেখ হাসিনার কোনো ক্ষমা নেই, জবাব তাকে দিতেই হবে : মির্জা ফখরুল
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে খুনিদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনতে হবে