পোশাকশিল্পে অস্থিরতা কাম্য নয়
০৮ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০৯ এএম | আপডেট: ০৮ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০৯ এএম
পোশাক এদেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত, অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি। এ খাতকে কেন্দ্র করে কর্মসংস্থানের বিশাল একটি বাজার গড়ে উঠেছে। অথচ, এই পোশাকশিল্পে কিছুদিন পর পর অস্থিরতা ও বিশৃংখলা দেখা দেয়। কখনো শ্রমিকরা তাদের বেতন-ভাতা পরিশোধের দাবিতে বিক্ষোভ করে, আবার কখনো বেতন-ভাতা বৃদ্ধির দাবিতে কারখানায় হামলা করে এবং মূল্যবান জিনিসপত্র ভাংচুর করে। এই অস্থিরতা এবং বিশৃংখলা এদেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান এই খাতকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এ খাতে সরাসরি কর্মরত আছে প্রায় ৪০ লক্ষ মানুষ। এ খাতকে অবলম্বন করে গড়ে উঠেছে অনেক ব্যাকওয়ার্ড শিল্পকারখানা এবং এ খাতই দেশের অর্থনীতির চাকাকে গতিশীল রেখেছে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, এত গুরুত্বপূর্ণ খাতটি এখনো অস্থিরতামুক্ত হয়নি। এই অস্থিরতার কারণে ইতোমধ্যেই অনেক পোশাকশিল্প-কারখানায় হামলা ও ভাংচুর হয়েছে। একইভাবে বিশৃংখলা ও নৈরাজ্যের কারণে অনেক কারখানার উৎপাদন বন্ধ হয়েছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে বিনিয়োগকারীরা নতুন কোনো শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠা করবে না এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও এদেশে বিনিয়োগ করবে না। ফলে বিনিয়োগ ক্ষেত্রে সৃষ্টি হবে নতুন এক ধরনের স্থবিরতা, যা দেশের বিকাশমান অর্থনীতিকে বাধাগ্রস্ত করবে। প্রত্যেক বিনিয়োগকারী চায় তার কারখানায় উৎপাদনের নিশ্চয়তা, চায় প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা। একই সাথে তার বিনিয়োগকৃত অর্থের রিটার্নের নিশ্চয়তাও চায়। এছাড়া বিদেশি ক্রেতারা মুখ ফিরিয়ে নেবে এবং তাদের কাজের অর্ডার অন্য দেশে চলে যাবে। উৎপাদনের পরিবেশ এবং কারখানার নিরাপত্তা যদি বিঘ্নিত হয় তাহলে তো কোনো বিনিয়োগকারীই শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপনে এগিয়ে আসবে না।
বিগত শতকের আশির দশক থেকে এদেশে পোশাকশিল্প প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এর পর থেকে তা কেবল বিকশিতই হয়েছে। দেশের মোট রপ্তানি আয়ের সিংহভাগই এইখাত থেকে আসছে। ২০২১-২০২২ অর্থবছরে দেশের মোট রপ্তানি আয়ের পরিমাণ ছিল ৫২০৮ কোটি ডলার। তার মধ্যে তৈরি পোশাকশিল্পের একক অবদান ৪২৬১ কোটি ডলার। শতকরা হিসাবে যার পরিমাণ ৮১.৮২ শতাংশ। একইভাবে ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে দেশের মোট রপ্তানি আয়ের পরিমাণ ছিল ৫৫৫৬ কোটি ডলার। তার মধ্যে তৈরি পোশাকশিল্পের একক অবদান ৪৬৯৯ কোটি ডলার। শতকরা হিসাবে যার পরিমাণ ৮৪.৫৭ শতাংশ। টোটাল রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬.৬৭ শতাংশ আর পোশাক খাতে এককভাবে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০.২৭ শতাংশ। সুতরাং বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পোশাকশিল্পের গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলাদেশের পোশাকশিল্প আন্তর্জাতিক বাজারে ভালো অবস্থান সৃষ্টি করেছে। এমনকি ২০০৫ সালের ১ জানুয়ারি থেকে কোটামুক্ত প্রতিযোগিতার বাজারেও এই শিল্পের বিকাশ অব্যাহত রয়েছে। বিদেশি অনেক বিনিয়োগকারী এমনকি বিশ্ববিখ্যাত অনেক পোশাক প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান এদেশে পোশাকশিল্প স্থাপন করেছে। অথচ, এই পোশাকশিল্পে মাঝে মাঝে অস্থিরতা দেখা দেয়। এই অস্থিরতার কারণ সম্পর্কে কেউ বলে ষড়যন্ত্র, কেউ বলে শ্রমিক অসন্তোষ। পোশাকশিল্পের মালিকরা শ্রমিকদের ওপর শোষণ ও বঞ্চনা চালালে, তার প্রতিক্রিয়ায় শ্রমিকদের মাঝে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এই শ্রমিক অসন্তোষকে পুঁজি করে ষড়যন্ত্রকারীরা তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে। সুতরাং শ্রমিক অসন্তোষই পোশাক শিল্পে অস্থিরতার মূল কারণ। তাই এর আসল কারণকে আগে চিহ্নিত করতে হবে এবং তা সমাধানের কার্যকর ও বাস্তবসম্মত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এছাড়া বিকল্প যত পথই খুঁজি না কেন তাতে সমাধান আসবে না। কারণ, জোর করে শ্রমিকদের দিয়ে কোনো শিল্প প্রতিষ্ঠান চালানো সম্ভব নয়। শিল্পকারখানা পরিচালনা করতে মালিকদের প্রয়োজন শ্রমিকদের সমর্থন। মালিক-শ্রমিক সুস¤পর্ক থাকলে পোশাকশিল্পে হামলা-ভাংচুর, বিক্ষোভ আর নৈরাজ্য হবে না এবং উৎপাদনও ব্যাহত হবে না। বরং যে কোনো দুর্যোগ মোকাবিলায় শ্রমিকেরা পোশাক শিল্পকে রক্ষায় এগিয়ে আসবে এবং মালিকের পাশে দাঁড়াবে। মালিক ও শ্রমিক একে অপরের প্রতিপক্ষ হলে কোনো প্রতিষ্ঠানই সুষ্ঠুভাবে চলতে পারে না। অতএব, পোশাকশিল্পের অস্থিরতা ও বিপর্যয় বন্ধ করতে হলে প্রথমেই শ্রমিকদের প্রতি আন্তরিক হতে হবে, শ্রমিকদের যথাযথ মূল্যায়ন করতে হবে। তাহলেই কেবল পোশাকশিল্পসহ যে কোনো শিল্পে সফলতা আসতে পারে।
পোশাকশিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের বেশ কিছু দাবি রয়েছে। সেগুলো হচ্ছে চাকরির নিয়োগপত্র প্রদান, নির্দিষ্ট সময়ে বেতন প্রদান, ওভারটাইমের টাকা প্রদান, সাপ্তাহিক ছুটি প্রদান, ন্যূনতম মজুরি প্রদান, মহিলাদের মাতৃত্বকালীন ছুটি, ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার এবং কথায় কথায় চাকরিচ্যুত বন্ধ করা। পোশাকশিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের দাবিসমূহ ন্যূনতম, মানবিক এবং মৌলিক অধিকার। একজন শ্রমিককে যদি ন্যূনতম বেতন প্রদান করা না হয়, তাহলে সে চলবে কী করে? পোশাকশিল্পের মালিকেরা হয়তো বলবেন, তারা যে বেতন দেয় তাতে না পোষালে শ্রমিকরা চাকরিতে যোগদান করে কেন? বাস্তবতা হলো, যখন ক্ষুধা লাগে, সংসারে যখন অভাব থাকে তখন কিন্তু যা পায় তাই গ্রহণ করতে একজন মানুষ বাধ্য হয়। এক্ষেত্রে তার দর কষাকষির কোনো সুযোগ থাকে না এবং এটা সম্ভবও নয়। এটা যে কোনো মানুষের বেলায় সত্য। পোশাকশিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের শতকরা ৮০ ভাগই নারী। বলতে গেলে পুরো পোশাকশিল্পই দাঁড়িয়ে আছে নারীদের ওপর। মা হতে গেলে চাকরিটা হারাতে হবে এ ভয়ে পোশাকশিল্পে কর্মরত অনেক মহিলা মা হতে চায় না। তাছাড়া সামান্য কিছুতেই চাকরি চলে যাবার ভয়ে এ শিল্পের শ্রমিকরা সবসময় আতংকে থাকে। অনেক পোশাক কারখানায় পর্যাপ্ত টয়লেট নেই, স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ নেই, অগ্নি নিরোধক ব্যবস্থা নেই। আর এ অবস্থায় তো কোনো শ্রমিকের পক্ষে স্বতঃস্ফূর্ত ও স্বাভাবিকভাবে কাজ করা সম্ভব নয়। আর এসব দাবি তো একজন শ্রমিকের যৌক্তিক, ন্যায্য ও ন্যায়সঙ্গত অধিকার। শ্রমিকদের প্রতি ভালো ব্যবহার, শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার দেয়া এবং মালিক-শ্রমিক সহযোগিতা ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা, ন্যায্য অধিকারের নামে শ্রমিকদের আকাশ কুসুম আবদার এবং দাবি চলবে না। ন্যায্য অধিকারের নামে শ্রমিকরা যদি অবাস্তব দাবি-দাওয়া করে, তাহলে তা তো মালিকদের পক্ষে মানা সম্ভব নয়। সুতরাং শ্রমিকদের দাবি-দাওয়া যুক্তিসঙ্গত, বাস্তবসম্মত এবং গ্রহণযোগ্য হতে হবে।
সরকার পোশাকশিল্পসহ সকল শিল্পের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য ইন্ডাস্ট্রি পুলিশ গঠন করেছে। এটা একটা ভালো উদ্যোগ কিন্তু সব সমস্যার সমাধান নয়। পুলিশ না হয় কারখানার নিরাপত্তা দিল, কিন্তু কারখানার মালিকের নিরাপত্তা দেবে কে? তার বাসায় নিরাপত্তা দেবে কে? তাকে রাস্তায় নিরাপত্তা দেবে কে? সুতরাং সকল ধরনের নৈরাজ্য, বিশৃংখলা, চাঁদাবাজি এবং সন্ত্রাস থেকে পোশাকশিল্পকে রক্ষা করতে হবে। পোশাকশিল্পের সমস্যাসমূহ চিহ্নিত করে তা সমাধান করার জন্য একটি বিশেষ কমিটি গঠন করা প্রয়োজন। এই কমিটি বিজেএমইএ’র নেতাদের সাথে পোশাকশিল্পের সমস্যা দূরীকরণে যৌথভাবে কাজ করবে। একইভাবে পোশাকশিল্পকে মনিটরিং করার জন্য আলাদা একটি মন্ত্রণালয় গঠন করা হোক। তাহলে পোশাকশিল্পের সমস্যাসমূহ দূর করাটা সহজ হবে বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করেন।
লেখক: প্রকৌশলী ও উন্নয়ন গবেষক
[email protected]
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
বিদেশে সাবেক ভুমিমন্ত্রীর আট হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি
ইউনূস গুড উইলের প্রতিফলন দেখতে চায় জনগণ: রিজভী
সময় থাকতে হাসিনাকে ফেরত পাঠান : ভারতকে দুদু
রুশ সেনা কুরস্কের দুটি শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে
বিমানবন্দর এলাকা হবে শব্দদূষণ মুক্ত
যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ওসি আবুল হাসান ৭ দিনের রিমান্ডে
বিচার শুরু হলে হাসিনাকে ফেরত চাওয়া হবে : আইন উপদেষ্টা
লোহাগড়ায় দিনে-দুপুরে বসতবাড়ি পুড়ে ছাই
রাষ্ট্রীয় কল্যাণে অবদান রাখার সুযোগ দিন আলেমদেরকে
দুই মেডিকেল টেকনোলজিস্টের ওপর হামলার ঘটনায় বিএমটিএর নিন্দা
জিএম কাদের ও মজিবুল হক চুন্নুকে অবিলম্বে আটক করতে হবে : আবু হানিফ
উপদেষ্টাদের আয় ও সম্পদ বিবরণী প্রকাশের নীতিমালা অনুমোদন
সাবেক মন্ত্রী শ ম রেজাউল-এমপি হেনরিসহ ৩ জনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা
পটুয়াখালী মেডিক্যাল কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতিকে একবছর ,সাধারন সম্পাদককে দুই বছর একাডেমীক কার্যক্রম থেকে বহিস্কারসহ উভয়কে হোস্টেল থেকে আজীবন বহিস্কার।
ঢাবিতে যুবককে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগে ৫ শিক্ষার্থী গ্রেফতার
রাজউক চেয়ারম্যানের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল
‘স্পেন্ড অ্যান্ড উইন’ ক্যাম্পেইনের বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করেছে মাস্টারকার্ড
সিটি ব্যাংক আনল অভূতপূর্ব ভিসা ইনফিনিট ক্রেডিট কার্ড
শেখ হাসিনার কোনো ক্ষমা নেই, জবাব তাকে দিতেই হবে : মির্জা ফখরুল
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে খুনিদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনতে হবে