ঢাকা   শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৫ আশ্বিন ১৪৩১

ফিলিস্তিনে ইসরাইলি বর্বরতা, ইউক্রেনের পরাজয় এবং নতুন বিশ্বব্যবস্থার সম্ভাবনা

Daily Inqilab জামালউদ্দিন বারী

০৮ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০৯ এএম | আপডেট: ০৮ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০৯ এএম

সময়ের প্রবাহমানতার সাথে সাথে পরিবর্তনশীল প্রকৃতি ও পরিবেশ-পরিস্থিতির হাত ধরে বদলে যায় অনেক কিছুই। সেই পরিবর্তনকে উপলব্ধি করে নিজেদের অভিযোজন ও পরিবর্তনকে গ্রহণ করতে না পারলে প্রকৃতির অমোঘ প্রতিশোধের হাত থেকে কেউ রেহাই পায় না। গত তিন হাজার বছরের ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতায় আধুনিক বিশ্বসভ্যতার উত্থান-পতনের ধারাক্রম কখনো এক জায়গায় থেমে থাকেনি। একটির ধ্বংসের মধ্য দিয়ে আরেকটি সভ্যতা ও নতুন রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক শক্তির জন্ম হয়েছে। ইহুদি জাতির ইতিহাস আধুনিক সভ্যতাসমূহের ধারাবাহিক ইতিহাসের সাথে ওতোপ্রতোভাবে সম্পর্কযুক্ত। তবে তারা কখনো সভ্যতার বিনির্মাণে মূল শক্তি হয়ে উঠতে পারেনি। আব্রাহামিক রিলিজিয়নের বিবর্তনের ইতিহাসে প্রতিটি সন্ধিক্ষণে ইহুদিদের বিতর্কিত ভূমিকায় দেখা যায়। যিশু খ্রিষ্ট কিংবা হজরত ঈসা (আ.) থেকে ইসলামের সর্বশেষ নবী হজরত মোহাম¥দ (সা.) এর নবুয়তের পরিণতি এবং ক্রসেডের সময় পর্যন্ত ইহুদিরা কখনোই ধর্ম কিংবা সভ্যতার মূল শক্তি হয়ে উঠতে না পারলেও প্রতিটি ক্ষেত্রেই তারা প্রতিবন্ধকতার অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে। ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক যুগে শিল্পায়নের হাত ধরে ভোগবাদী পুঁজিবাদের বিস্তারের সাথে সাথে বিশ্ব রাজনীতিতে নতুন নতুন দ্বন্দ্ব-সংঘাতের ক্ষেত্রগুলোতে ইহুদিদের নেপথ্য ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দেখা গেছে। প্রথম মহাযুদ্ধ থেকে আজকের ইউক্রেন-গাজা যুদ্ধের নেপথ্য শক্তি হিসেবে জায়নবাদী ইহুদিদের চিহ্নিত করা যায়। বিশ্ব রাজনীতিতে জায়নবাদীদের তৎপরতা দৃশ্যমান হওয়ার অনেক আগে বিশ্ব রাজনীতির প্রধান দার্শনিকরা ইহুদিদের রাজনৈতিক দর্শন হিসেবে জায়নবাদের উত্থান ও তার সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে সতর্ক করেছিলেন। আধুনিক জায়নবাদের প্রতিষ্ঠাতা থিওডর হার্জেলের নেতৃত্বে ইউরোপে প্রথম ওয়ার্ল্ড জায়নিস্ট কংগ্রেসের মধ্য দিয়ে জায়নবাদের রাজনৈতিক আত্মপ্রকাশের বহু আগে ১৮৪৩ সালে জার্মান দার্শনিক ও ধর্মতত্ত্ববিদ ব্রুনো বাওয়ার ‘জুইশ কোশ্চেন’ নামে বই লিখে ইহুদি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে জার্মানিতে বা ইউরোপে কোনো সার্বভৌম শক্তির উত্থানের অসাড়তা প্রমাণ করেছিলেন। তবে এই বই প্রকাশের পরের বছর ১৮৪৪ সালে বলশেভিক বিপ্লবের প্রধান দার্শনিক কার্ল মার্ক্স বাওয়ারের সাথে কিছুটা দ্বিমত পোষণ করে ‘জুইশ কোশ্চেন’ নামে একটি দীর্ঘ নিবন্ধ লিখেছিলেন। এটিও গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়ে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত ও পঠিত হচ্ছে। আজকের বিশ্বের অন্যতম দার্শনিক প্রাচ্যতত্ত্ববিদ নোয়াম চমস্কি এবং অরিয়েন্টালিজমের প্রবক্তা ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত অ্যাকাডেমিসিয়ান এডয়ার্ড সাঈদও জায়নবাদের উত্থান ও ক্রমবিকাশের ধারাক্রমের সাথে চলমান বিশ্বের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সংকটের যোগসূত্র তুলে ধরেছেন। বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকা এবং লাখ লাখ সৈনিক ও সাধারণ মানুষের মৃত্যুর সাথে অরিয়েন্টাল বা প্রাচ্যের কোনো দায় না থাকলেও পাশ্চাত্য সমাজের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক আধিপত্যের দ্বন্দ্ব থেকে সৃষ্ট এসব যুদ্ধে প্রাচ্য-মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ও জনগোষ্ঠিকে ভিকটিমাইজ করা হচ্ছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের নাৎসি বাহিনীর ইহুদি নিধনের যে ইতিহাস রচিত হয়েছে, সেটা মূলত ইউরোপীয় সমাজে ইহুদি সম্প্রদায়ের অধিকার এবং খ্রিষ্টানদের সাথে তাদের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অভিযোজনা এবং আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় মানুষের মৌলিক অধিকারের প্রশ্নে ইহুদিদের অবস্থানের নিরীখে ব্রুনো বাওয়ারের বয়ানকে আজকের জায়নবাদী কিংবা পশ্চিমা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো অতিক্রম করতে পারেনি।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর দুনিয়ায় সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে পারমাণবিক স্নায়ুযুদ্ধ থেকে শুরু করে একটি নিরবচ্ছিন্ন যুদ্ধের মধ্য দিয়েই পার হচ্ছে। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অন্তহীন যুদ্ধ, ইউক্রেন যুদ্ধ এবং হামাস-ইসরাইল যুদ্ধের চলমান বিভীষিকাময় মানবিক বিপর্যয়কর পরিস্থিতির মূলে যে ঐতিহাসিক, দার্শনিক-মনস্তাত্ত্বিক বিষয় জড়িত আছে তা সম্যকভাবে উপলব্ধি করে মোকাবেলার প্রস্তুতি না থাকলে শান্তিকামী বিশ্বকে আরো বহুকাল ভিকটিমাইজড হতে হবে বা এর করুণ পরিণতি ভোগ করতে হবে। এতদিন ধরে পশ্চিমাদের ছকবাঁধা নিয়মে বা নীলনকশার আওতায় যুদ্ধ শুরু হলেও এখন অনেকটাই তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে শুরু করেছে। তবে প্রতিটা যুদ্ধের নেপথ্য কুশীলব ও উসকানিদাতা হিসেবে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীরাই সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। ২০১৪ সালে রাশিয়ার ক্রিমিয়া অধিকার, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে সামরিক অভিযান কিংবা ৭ অক্টোবর হামাসের অপারেশন আল আকসা ফ্লাড ও ইসরাইলের গাজা যুদ্ধের নেপথ্য উসকানি ও মদতদাতা হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় শক্তিগুলো দায়ী। অস্বাভাবিক, অন্যায্য ও অমানবিক-অরাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় ফিলিস্তিনিদের জমি দখল করে, গণহত্যা ও বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদ করে ইসরাইল রাষ্ট্র গঠনের পর সেই রাষ্ট্রের আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য যে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া থাকা দরকার ছিল তা না করে শুধুমাত্র অস্ত্রের শক্তিতে প্রতিবেশী আরবদের সন্ত্রস্ত রাখার প্রতিক্রিয়া হিসেবে আরব-ইসরাইলের মধ্যে তিনটি বড় যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। পশ্চিমারা অত্যাধুনিক মারণাস্ত্রসহ সামরিক-কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতার ব্লাঙ্কচেক দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলকে নিজেদের স্বার্থের লাঠিয়াল হিসেবে অজেয় শক্তি হিসেবে গড়ে তোললেও প্রতিবেশীদের সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের মাধ্যমে ইহুদিদের জন্য একটি স্থিতিশীল ও নিরাপদ আবাসভূমি হিসেবে গড়ে তোলার কোনো পদক্ষেপ তারা গ্রহণ করেনি। অন্যদিকে আরব মুসলমানরা নিজেদের মধ্যে ঐক্য, কার্যকর রাজনৈতিক ও সামরিক কর্মপন্থা ও সমন্বিত কৌশলগত অবস্থান নিশ্চিত না করেই আবেগের বশে ইসরাইলিদের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে আল আকসার মুক্তি ও স্বাধীন ফিলিস্তিন বাস্তবায়নের উদ্যোগকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। সে সব যুদ্ধে পশ্চিমাদের প্রকাশ্য ভূমিকা এবং নিজেদের ব্যর্থতার কারণ অনুসন্ধানে মধ্যপ্রাচ্য কিংবা ওআইসিভুক্ত দেশগুলোর তেমন কোনো তৎপরতা কখনোই দেখা যায়নি। জায়নবাদী এজেন্ডার স্বার্থে এ ধরনের যেকোনো সম্ভাবনাকে পশ্চিমারা সমূলে উৎপাটন করেছে। ইরান-ইরাক যুদ্ধ, ইরাকের পারমাণবিক প্রকল্পে ইসরাইলি বিমান হামলা, সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ, আইএসএস’র উত্থান, মিশরে গণতান্ত্রিক সরকারের পতন ঘটিয়ে সামরিক স্বৈরাচারের পক্ষাবলম্বন, ইরাক দখল ও সাদ্দাম হোসেনকে হত্যা এবং লিবিয়ায় গৃহযুদ্ধ ও মুয়াম্মার গাদ্দাফিকে হত্যার পেছনে জায়নবাদীদের অভিন্ন এক নীল নকশা ছিল। ইরানের সাথে সউদি আরবের সম্পর্কোন্নয়নের চলমান বাস্তবতায় সাদ্দাম হোসেন ও মুয়াম্মার গাদ্দাফির মতো নেতারা ঐক্যবদ্ধভাবে সক্রিয় থাকলে জায়নবাদী দখলদার ইসরাইল গাজায় যুদ্ধাপরাধ অব্যাহত রাখতে সাহস পেত না। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা ও মুসলমানদের ঐক্যের প্রশ্নে তাদের চেতনাকে বিভ্রান্ত ও বিরত রাখতেই একের পর এক গৃহযুদ্ধ, প্রক্সিযুদ্ধ ও সামরিক আগ্রাসন চালিয়ে এসব নেতাদের নিরাপত্তাহীন করে রাখার ডিস্ট্যাবিলাইজেশন এজেন্ডায় ব্যস্ত রেখে হত্যা করা হয়েছিল। আরব ও মুসলমানদের পরস্পর বিচ্ছিন্নতা ও অনৈক্যই মধ্যপ্রাচ্যের সামগ্রিক সমস্যার মূল। ইসলামের মূল স্পিরিটের বিপরীতে আরব-অনারব, শিয়া-সুন্নী ইত্যাদি বিভক্তিকে সামনে রেখে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে পরস্পর বিচ্ছিন্ন ও বৈরিতার নিগড়ে আবদ্ধ করে রাখা হয়েছে।

ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা, জেরুজালেম ও আল-আকসার অমীমাংসিত ইস্যুকে পাশ কাটিয়ে তেলসমৃদ্ধ আরব দেশগুলোর সাথে ইসরাইলের একটি স্বাভাবিক সম্পর্ক গড়ে তোলতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তার কূটনৈতিক মহল ‘ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি’ ও ‘আব্রাহাম অ্যাকর্ড’ নামের একাধিক পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নামে। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা, আল আকসা ও জেরুজালেমের উপর মুসলমানদের অধিকার ও নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে কোনো সুস্পষ্ট অবস্থান ছাড়াই জায়নবাদীদের সেই পরিকল্পনায় ইতোমধ্যেই কয়েকটি আরব দেশ সম্মত হয়েছিল। এমনকি সউদি আরবও এতে যোগ দেয়ার আলোচনায় সক্রিয় ছিল। এর মানে হচ্ছে, তিনটি আরব-ইসরাইল যুদ্ধে হাজার হাজার আরবের রক্ত, পঁচাত্তর বছর ধরে ফিলিস্তিনিদের রক্তঝরা সংগ্রামের লিগ্যাসিকে অস্বীকার ও অগ্রাহ্য করে জায়নবাদীদের গ্রেটার ইসরাইল গঠনের পরিকল্পনার পথে সহায়ক ভূমিকা পালন করা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় আরবরা যতই ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে ইতিবাচক সাড়া দিচ্ছিল, ফিলিস্তিনিদের উপর ইসরাইলিদের নিপীড়ন-নির্মমতা ততই বেড়ে চলেছিল। গত রমজান মাসে ইসরাইলি সামরিক বাহিনী আল আকসা মসজিদে ঢুকে এবাদত ও ইতেকাফরত মুসল্লিদের উপর পৈশাচিক হামলা চালায়। এরপর গাজা ও পশ্চিম তীরের অধিকৃত অঞ্চলের শরণার্থী শিবিরগুলোতে অনবরত হামলা চালিয়ে হাজার হাজার ফিলিস্তিনিকে হতাহত ও আটকের ঘটনা হামাসকে ক্রমেই বিক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর প্রত্যুষে গাজার রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ হামাসের সামরিক শাখা আল কাশেম ব্রিগেড ইসরাইলের অভ্যন্তরে হাজার হাজার রকেট হামলা ও স্থল অভিযান চালিয়ে আল আকসা ফ্লাড অপারেশনের সূচনা করেছিল। সেই হামলার ঘটনাকে পুঁজি করে দখলদার ইসরাইলি বাহিনী একমাসের বেশি সময় ধরে গাজা উপত্যকার ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলোতে অব্যাহতভাবে বোমা হামলা চালিয়ে মূলত ধ্বংসযজ্ঞ ও গণহত্যা সংঘটিত করেছে। জাতিসংঘসহ বিশ্বসম্প্রদায় এই হামলাকে গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধ হিসেবে আখ্যায়িত করে একাধিক প্রস্তাব পাস হলেও একটি মানবিক যুদ্ধবিরতি কার্যকর করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনীহা এবং কার্যত অব্যাহত একটি এথনিক ক্লিনজিংয়ে মদত দিয়ে গাজায় জায়নবাদীদের নারকীয় বিভৎস উৎসব চলছে। তবে এবারের যুদ্ধ আরব-ইসরাইলিদের আগের যুদ্ধগুলোর মতো নয়। ইসরাইলের নিরাপত্তায় প্রযুক্তিগত অপ্রতিদ্বন্দ্বিতার অহংকার ৭ অক্টোবরের প্রথম প্রহরেই চূর্ণ করে দিয়েছে হামাস যোদ্ধারা। বিশ্বের অন্যতম সেরা সামরিক পরাশক্তির দাবিদার ইসরাইল হামাস নির্মূলের নামে ১৭ বছর ধরে অবরুদ্ধ গাজার উপর একমাস যাবৎ প্রতিদিন হাজার হাজার টন নির্বিচার বোমা হামলা চালিয়ে বেসামরিক-নিরস্ত্র মানুষ, নারী ও শিশুদের হত্যা করেও ন্যূনতম সামরিক বা কৌশলগত লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি। হামাসের হাতে আটক জিম্মিদের উদ্ধারের জন্য স্থল হামলা চালানোর কথা বলা হলেও হামাসের টানেল যোদ্ধাদের হাতে সৈন্য, ট্যাঙ্ক ও সাজোয়া যান হারিয়ে পিছু হঠতে বাধ্য হচ্ছে।

ইতোমধ্যে হামাসের সাথে হিজুবুল্লাহসহ আরো বেশ কয়েকটি মুজাহিদ গ্রুপ ইসরাইলের বিরুদ্ধে গাজা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে মিসাইল হামলা শুরু করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন ইসরাইলের পাশে দাঁড়িয়ে একটি ফিলিস্তিনি গণহত্যায় নেতৃত্ব দিচ্ছে, তখন হামাসের সমর্থনে আরবদের বাগাড়ম্বর ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। তুরষ্ক, মিশর, সউদি আরব, লেবানন, সিরিয়া, জর্ডান, ইরাক, কাতার, বাহরাইন, সংযুক্ত আরব আমিরাত গত ২০ বছরে পশ্চিমা দেশগুলোর কাছ থেকে হাজার হাজার কোটি ডলারের অস্ত্র কিনেছে। এসব অস্ত্র বিক্রি করা হয়েছিল মূলত ইরানের সম্ভাব্য হুমকির জুজু দেখিয়ে। ইয়েমেনে ইরান সমর্থিত হুথিদের বিরুদ্ধে সামরিক জোট করে ৮ বছর ধরে যুদ্ধ করেও কোনো লক্ষ্য অর্জন করা যায়নি। সেই ইরানের সাথে এখন সউদি আরবসহ আরব উপদ্বীপের দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে চীন-রাশিয়ার দূতিয়ালি মধ্যপ্রাচ্যে এক নতুন ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতার জন্ম দিয়েছে। তুরস্ক, ইরান-সউদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের অপরাপর দেশগুলো ঐক্যবদ্ধ হলে মার্কিনী ও পশ্চিমা সমর্থনপুষ্ট ইসরাইলকে এক সপ্তাহের মধ্যে গর্তের ভেতর ঢুকিয়ে দেয়া সম্ভব। গাজার যুদ্ধে রাশিয়া ও চীনের ভূমিকা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূরাজনৈতিক এজেন্ডার বিপরীত হওয়াই স্বাভাবিক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুটি বিমানবাহী রণতরী ভূমধ্যসাগরে মোতায়েন করার পর পর চীনের ৫টি রণতরী এ অঞ্চলে মোতায়েন করার খবর প্রকাশিত হয়েছে। রাশিয়াও নতুন কৌশলগত পারমাণবিক ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছে। ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া, ইয়েমেনসহ মধ্যপ্রাচ্যে সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পরিচালিত কোনো যুদ্ধেই পশ্চিমারা সামরিক ও ভূরাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি।

মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমা স্বার্থ রক্ষায় ইসরাইল রাষ্ট্রকে সফলভাবে পরিচালিত করার অভিজ্ঞতার আলোকে রাশিয়ার সীমান্তে ইউরোপে অনুরূপ একটি সামরিক পরাশক্তি তৈরির পরিকল্পনা থেকেই ইউক্রেনকে ন্যাটোভুক্ত করে সেখানে একটি বশংবদ শাসন প্রতিষ্ঠার মার্কিনি ও পশ্চিমা উদ্যোগ থেকেই ইউক্রেনে রাশিয়ান আগ্রাসনের সূত্রপাত। প্রায় দুই বছর ধরে ইউক্রেন যুদ্ধে হাজার হাজার কোটি ডলারের তহবিল, সব ধরনের সামরিক প্রযুক্তি ও কূটনৈতিক সহায়তা নিয়ে অন্তহীনভাবে পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েও ইউক্রেনে জেলেনস্কির বাহিনীর পরাজয় ঠেকানো যাচ্ছে না। উল্লেখ্য, ইসরাইলের পর ইউক্রেনই সম্ভবত একমাত্র দেশ যার প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্ট জায়নবাদী ইহুদি। এ সপ্তাহে টাইম ম্যাগাজিনসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিশেষজ্ঞদের কলামে ইউক্রেনে জেলেনস্কি বাহিনীর অনিবার্য পরাজয়ের চিত্র উঠে এসেছে। ইউক্রেনে পশ্চিমা সমর্থনপুষ্ট বাহিনীর পরাজয়ের অন্যতম অনুঘটক ওয়াগনার বাহিনী ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগ দিতে ইতোমধ্যে লেবানন সীমান্তে জড়ো হতে শুরু করেছে বলে কোনো কোনো সূত্রে জানা গেছে। সম্মিলিত পশ্চিমাশক্তির সর্বাত্মক সমর্থন পেয়েও জেলেনস্কির বাহিনী রাশিয়ার কাছে চরমভাবে মার খেয়ে পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সরাসরি অংশগ্রহণের আগেই শুধুমাত্র হামাস-হিজবুল্লাহর গেরিলা আক্রমণে ইসরাইলের সব নিরাপত্তা ও দর্প-অহংকার চুর্ণ-বিচুর্ণ হতে শুরু করেছে। মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইল নামক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে পশ্চিমা পুঁজিবাদের নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডারের সূচনা ঘটেছিল। ওয়ার অন টেররিজমের মাধ্যমে সেই বিশ্বব্যবস্থাকে আরো অনেকদিন টিকিয়ে রাখার প্রয়াস চালানো হলেও তা ইতোমধ্যেই ব্যর্থ হয়েছে। ইসরাইলের সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অন্য উদ্যোগগুলোও হোচট খেয়েছে। গাজা যুদ্ধ তার সর্বশেষ পদক্ষেপের প্রথম ধাপ। ইরান-তুরস্ক-মিশর ও সউদি আরবের পাশাপাশি চীন-রাশিয়ার প্রত্যক্ষ সমর্থনে এবার গাজায় ইসরাইলের পরাজয় এবং স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় বাস্তব রূপ লাভ করলে বিশ্ব পরিবর্তিত ও ভারসাম্যপূর্ণ একটি নতুন বিশ্বব্যবস্থায় পদার্পণ করবে। একটি বিকল্প ব্যবস্থা গড়ে তুলতে মধ্যপ্রাচ্য, রাশিয়া, চীন, লাতিন আমেরিকাসহ নন-ওয়েস্টার্ন দেশগুলোর মধ্যে এক প্রকার ঐক্য গড়ে উঠলেও ইসরাইল এবং ভারতের উগ্রবাদী শাসকদের কারণে তা প্রলম্বিত হচ্ছিল। সাংহাই কো-অপারেশন এবং ব্রিক্সের মতো সংস্থার শুরুতে ভারতের অংশ্রগহণ ও সদস্যপদ থাকলেও আঞ্চলিক আধিপত্যবাদের প্রতিযোগিতা এবং জায়নবাদীদের সাথে হিন্দুত্ববাদীদের গোপন ও প্রকাশ্য আঁতাত বেশ কিছু জটিলতার জন্ম দিয়েছে। জায়নবাদী ইসরাইলের পাশাপাশি ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীদের রাজনৈতিক পতনের মধ্য দিয়ে নতুন বিশ্বব্যবস্থার পথ সুগম হতে পারে। মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলের জায়নবাদী এজেন্ডা এবং দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডা এ অঞ্চলের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার অন্তরায় হয়ে আছে।

[email protected]


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

বিদেশে সাবেক ভুমিমন্ত্রীর আট হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি

বিদেশে সাবেক ভুমিমন্ত্রীর আট হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি

ইউনূস গুড উইলের প্রতিফলন দেখতে চায় জনগণ: রিজভী

ইউনূস গুড উইলের প্রতিফলন দেখতে চায় জনগণ: রিজভী

সময় থাকতে হাসিনাকে ফেরত পাঠান : ভারতকে দুদু

সময় থাকতে হাসিনাকে ফেরত পাঠান : ভারতকে দুদু

রুশ সেনা কুরস্কের দুটি শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে

রুশ সেনা কুরস্কের দুটি শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে

বিমানবন্দর এলাকা হবে শব্দদূষণ মুক্ত

বিমানবন্দর এলাকা হবে শব্দদূষণ মুক্ত

যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ওসি আবুল হাসান ৭ দিনের রিমান্ডে

যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ওসি আবুল হাসান ৭ দিনের রিমান্ডে

বিচার শুরু হলে হাসিনাকে ফেরত চাওয়া হবে : আইন উপদেষ্টা

বিচার শুরু হলে হাসিনাকে ফেরত চাওয়া হবে : আইন উপদেষ্টা

লোহাগড়ায় দিনে-দুপুরে বসতবাড়ি পুড়ে ছাই

লোহাগড়ায় দিনে-দুপুরে বসতবাড়ি পুড়ে ছাই

রাষ্ট্রীয় কল্যাণে অবদান রাখার সুযোগ দিন আলেমদেরকে

রাষ্ট্রীয় কল্যাণে অবদান রাখার সুযোগ দিন আলেমদেরকে

দুই মেডিকেল টেকনোলজিস্টের ওপর হামলার ঘটনায় বিএমটিএর নিন্দা

দুই মেডিকেল টেকনোলজিস্টের ওপর হামলার ঘটনায় বিএমটিএর নিন্দা

জিএম কাদের ও মজিবুল হক চুন্নুকে অবিলম্বে আটক করতে হবে : আবু হানিফ

জিএম কাদের ও মজিবুল হক চুন্নুকে অবিলম্বে আটক করতে হবে : আবু হানিফ

উপদেষ্টাদের আয় ও সম্পদ বিবরণী  প্রকাশের নীতিমালা অনুমোদন

উপদেষ্টাদের আয় ও সম্পদ বিবরণী প্রকাশের নীতিমালা অনুমোদন

সাবেক মন্ত্রী শ ম রেজাউল-এমপি হেনরিসহ ৩ জনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা

সাবেক মন্ত্রী শ ম রেজাউল-এমপি হেনরিসহ ৩ জনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা

পটুয়াখালী মেডিক্যাল কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতিকে একবছর ,সাধারন সম্পাদককে দুই বছর একাডেমীক কার্যক্রম থেকে বহিস্কারসহ উভয়কে হোস্টেল থেকে আজীবন বহিস্কার।

পটুয়াখালী মেডিক্যাল কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতিকে একবছর ,সাধারন সম্পাদককে দুই বছর একাডেমীক কার্যক্রম থেকে বহিস্কারসহ উভয়কে হোস্টেল থেকে আজীবন বহিস্কার।

ঢাবিতে যুবককে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগে ৫ শিক্ষার্থী গ্রেফতার

ঢাবিতে যুবককে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগে ৫ শিক্ষার্থী গ্রেফতার

রাজউক চেয়ারম্যানের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল

রাজউক চেয়ারম্যানের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল

‘স্পেন্ড অ্যান্ড উইন’ ক্যাম্পেইনের বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করেছে মাস্টারকার্ড

‘স্পেন্ড অ্যান্ড উইন’ ক্যাম্পেইনের বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করেছে মাস্টারকার্ড

সিটি ব্যাংক আনল অভূতপূর্ব ভিসা ইনফিনিট ক্রেডিট কার্ড

সিটি ব্যাংক আনল অভূতপূর্ব ভিসা ইনফিনিট ক্রেডিট কার্ড

শেখ হাসিনার কোনো ক্ষমা নেই, জবাব তাকে দিতেই হবে : মির্জা ফখরুল

শেখ হাসিনার কোনো ক্ষমা নেই, জবাব তাকে দিতেই হবে : মির্জা ফখরুল

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে খুনিদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনতে হবে

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে খুনিদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনতে হবে