ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পূর্বাপর
০৯ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০৭ এএম | আপডেট: ০৯ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০৭ এএম
ফিলিস্তিনের গাজা থেকে দুই মাইল উত্তরে কিবুটস এলাকা। এখানে ১৯৩০’র দশকে পোল্যান্ড থেকে আসা ইহুদিরা কৃষি খামার গড়ে তুলেছিল। ইহুদিদের পাশেই ছিল ফিলিস্তিনি আরবদের বসবাস। সেখানে আরবদের কৃষি খামার ছিল। তারা কয়েক শতাব্দী ধরে সেখানে বসবাস করছিল। সে সময় মুসলমান এবং ইহুদিদের মধ্যে সম্পর্ক মোটামুটি বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল। কিন্তু ১৯৩০'র দশকে ফিলিস্তিনিরা বুঝতে পারলো যে, তারা ধীরে-ধীরে জমি হারাচ্ছে। ইহুদিরা দলে-দলে সেখানে আসে এবং জমি ক্রয় করতে থাকে। এ দিকে উসমানীয় শাসনের শেষ দিকে ফিলিস্তিনের অধিকার নিয়ে ইহুদিদের ষড়যন্ত্র চলছিল। ঋণচাপে জর্জরিত উসমানীয় সাম্রাজ্যকে আর্থিক সহযোগিতার বিনিময়ে ফিলিস্তিন ভূখণ্ডের জমি ক্রয় ও ইহুদিদের বসতি গড়ার অনুমোদন নেওয়ার চেষ্টা করেন ইহুদিবাদী সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা থিয়োডর হার্জেল (ঞযবড়ফড়ৎ ঐধৎুষ)। কেননা সে সময় সালতানাতের পক্ষ থেকে ফিলিস্তিনে ইহুদিদের স্থায়ী বসবাস নিষিদ্ধ ছিল। ১৮৯৬ সালের ১৮ জুন হার্জেলের প্রস্তাবের জবাবে উসমানীয় সুলতান দ্বিতীয় আবদুল হামিদ বলেছিলেন, ‘আমি দেশের এক কদমও বিক্রি করতে পারব না। কেননা তা আমার নয়; বরং আমার জাতির। আমার জাতি রক্ত দিয়ে এই ভূখণ্ড অর্জন করেছে এবং রক্ত দিয়ে এর সুরক্ষা করবে। লাখ লাখ ইহুদির সুরক্ষার জন্য আমাদের কাছ থেকে তা আত্মসাৎ করার অনুমোদন পাবে না।’ কিন্তু হার্জেল বারবার একই প্রস্তাব পাঠালে আবদুল হামিদ বলেন, ‘আমরা আমাদের দেশের এক বিঘা পরিমাণ জমি নিয়েও আপস করব না, বরং এসব অর্জনে আগে আমরা যে পরিমাণ রক্ত ব্যয় করেছি, এখন তার চেয়েও বেশি ব্যয় করব। আমি সব নাগরিকের মধ্যে সাম্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে চাই। তবে আমাদের মুসলিম পূর্বপুরুষদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত ফিলিস্তিনে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কখনো হ্যাঁ বলতে পারব না।’ (সুলতান আবদুল হামিদ আল-সানি ওয়া ফিলিস্তিন, রফিক শাকির নাতশা)
বেলফোর ঘোষণার প্রভাব ও তাৎপর্য: ১৯১৭ সালে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার জেমস বেলফোর ইহুদি নেতা ব্যারন রথচাইল্ডের কাছে মাত্র ৬৭ শব্দের একটি সংক্ষিপ্ত চিঠি লেখেন। এর ভাষ্য ছিল, ‘মহামান্য (ব্রিটিশ) সরকার ফিলিস্তিনে ইহুদি জনগণের জন্য জাতীয় আবাসভূমি গড়ে তোলার বিষয়ে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে। আর এই লক্ষ্য অর্জনে তার সর্বোত্তম প্রয়াস প্রয়োগ করা হবে এবং এটাও পরিষ্কার যে, এখানে এমন কিছু করা হবে না, যা ফিলিস্তিনে বিদ্যমান অ-ইহুদি সম্প্রদায়ের নাগরিকদের ধর্মীয় অধিকার কিংবা অন্য কোনো দেশে ইহুদিদের বিরাজমান অধিকার ও রাজনৈতিক অবস্থান ক্ষুণ্ন করতে পারে।’ আকারে ছোট হলেও তাতে ‘ইহুদি জনগোষ্ঠীর জাতীয় ভূমি প্রতিষ্ঠার’ প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। ‘বেলফোর ঘোষণা’ নামে পরিচিত এই চিঠির প্রভাব এতটাই তীব্র ছিল যে ১০০ বছর পরও এর সংকটে ফিলিস্তিনি আরবরা ভুগছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে উসমানীয় সাম্রাজ্য পরাজিত হয়। ৪০০ বছরের বেশি সময় উসমানীয়দের শাসনাধীন থাকার পর ব্রিটিশরা ফিলিস্তিনের নিয়ন্ত্রণ নেয় এবং এর নাম রাখে ‘ম্যান্ডেটরি প্যালেস্টাইন’। মূলত ১৯১৮ সাল থেকে ৩০ বছর ব্রিটিশের অধীনে থাকাকালে ফিলিস্তিনে ইউরোপ থেকে প্রায় চার লাখ ইহুদির আগমন ঘটে। পাশাপাশি হাগানাহসহ বিভিন্ন ইহুদি মিলিশিয়া গোষ্ঠীর মাধ্যমে আরব ফিলিস্তিনিদের নিজ বসতি থেকে উচ্ছেদ করা হয়। বেলফোর ঘোষণার তাৎপর্য বেড়ে যায় এ জন্য যে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষদিকে উসমানী সালতানাতের কাছ থেকে ফিলিস্তিন ভূখণ্ড ব্রিটিশদের অধীনে চলে যায়। ১৯২০ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রিটিশরাজ ম্যানডেটরি প্যালেস্টাইনের শাসনভার গ্রহণ করে, যা চলে ১৯৪৮ সালের মে মাস পর্যন্ত। ব্রিটিশরা ফিলিস্তিনের শাসনভার গ্রহণ করার পর থেকেই সেখানকার ৯০ শতাংশ বা তারও বেশি আরব অধিবাসীর সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ ও দমননীতি শুরু করে। দীর্ঘ মেয়াদে ইহুদিদের জন্য ঈশ্বর ‘প্রতিশ্রুত ভূমি’ (প্রমিজড ল্যান্ড) তাদের হাতে ফিরিয়ে দেওয়ার কৌশল হিসেবে ইহুদি সেটেলারদের বিভিন্নভাবে অগ্রাধিকার সুবিধা দিতে থাকে। দলে দলে ইহুদিরা ইউরোপ ও অন্য আরব দেশ থেকে ফিলিস্তিনে পাড়ি জমায়। ব্রিটিশদের প্রত্যক্ষ মদদেই অভিবাসী ইহুদিদের নিয়ে ১৯২১ সালেই গঠন করা হয় হাগানাহ নামের আধা সামরিক বাহিনী। এরপর আরও দুটি জায়নবাদী সন্ত্রাসী সংগঠন ইরগুন ও স্টার্ন গ্যাং গড়ে ওঠে।
ইসরাইল রাষ্ট্রের জন্মই হয়েছে সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ‘ফিলিস্তিনিরা সন্ত্রাসবাদী’ এ কথা বলে ইসরাইল ও পশ্চিমা বিশ্ব দশকের পর দশক ধরে প্রচারণা চালিয়ে তাদের ওপর ইসরাইলের সামরিক অভিযান ও হত্যাযজ্ঞকে বৈধতা দিচ্ছে, অথচ ইসরাইল রাষ্ট্রের জন্মই হয়েছে সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে। ১৯৪৮ সালের ১৪ মে ইসরাইল রাষ্ট্র ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে হাগানাহ, ইরগুন ও স্টার্ন গ্যাং একীভূত হয়ে ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনীতে রূপান্তরিত হয়। ১৯৩৯-৪৫ কালপর্বে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোল আর জার্মানিতে হিটলারের চরম ইহুদিবিদ্বেষ জায়নবাদীদের জন্য বিরাট সুযোগ এনে দেয়। বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ইউরোপে কমবেশি ৬০ লাখ ইহুদিকে নিধন করা হয়, যা ইতিহাসে হলোকাস্ট হিসেবে স্বীকৃত। যুদ্ধ শেষে এই হলোকাস্টই ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে ইহুদিদের স্বতন্ত্র আবাসভূমি স্থাপনের সবচেয়ে বড় যৌক্তিকতা হিসেবে তুলে ধরা হয়। ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে জায়নবাদীরা যে পাপের সূচনা ঘটিয়েছে, তা একাধারে অপরাধ ও দখলদারির মধ্য দিয়ে দশকের পর দশক ধরে বিস্তৃত হয়ে আসছে। এ জন্য জায়নবাদীরা প্রকৃত ইতিহাসের বিকৃতিই শুধু ঘটায়নি, বরং বাছাই করা সত্য ও সযত্নে তৈরি মিথ্যার সুদক্ষ মিশেলে নিজেদের অপকর্মের বৈধতার জন্য বিভ্রান্তিকর ভাষ্য তৈরি করেছে এবং এখনো করে যাচ্ছে। পশ্চিমা বিশ্ব বেমালুম এটা ভুলে যায় যে, ইহুদি গণহত্যার দায় ইউরোপের, অথচ ক্ষতিপূরণের জন্য মূল্য গুনতে হচ্ছে আরবদের, বিশেষত ফিলিস্তিনিদের। ১৯৪৭ সালের ২৯ নভেম্বর সদ্য গঠিত জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ফিলিস্তিন ভূখণ্ডকে ইহুদি ও আরবদের মধ্যে দুই ভাগ করার প্রস্তাব অনুমোদনের মধ্য দিয়ে কফিনের শেষ পেরেকটি পুঁতে দেওয়া হয়। এদিকে জায়নবাদীরা নিজ ভূখণ্ড থেকে ফিলিস্তিনিদের তাড়িয়ে দেওয়ার ছক কেটে ফেলে। প্ল্যান দালেত বা প্ল্যান ডি নামে এই পরিকল্পনার নেতৃত্বে ছিলেন ইসরাইলের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন গুরিয়ান। পোল্যান্ডে জন্মগ্রহণকারী বেন গুরিয়ান ১৯০৬ সালে অটোমান ফিলিস্তিনে অভিবাসী হয়ে আসেন এবং কট্টর জায়নবাদী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন। প্ল্যান ডি ছিল হত্যা-ধর্ষণ-লুটতরাজ-সন্ত্রাসের মাধ্যমে ফিলিস্তিনি আরবদের নিজ ভূমি থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার মহাপরিকল্পনা। ১৯৪৮ সালের ১০ মার্চ এই পরিকল্পনা চূড়ান্ত হলে ইসরাইলি সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলো তা বাস্তবায়নে পুরোদমে নেমে যায়। তখন পর্যন্ত ব্রিটিশদের শাসনাধীনে থাকা সত্ত্বেও ব্রিটিশ বাহিনীকে পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়, যাতে নিরস্ত্র ও অপ্রস্তুত আরবেরা সুরক্ষা না পায়।
ফিলিস্তিন বিভক্তির প্রস্তাব জাতিসংঘে : ১৯৪৭ সালের ২৯ নভেম্বর জাতিসংঘ ব্রিটিশ ম্যান্ডেট শেষ হওয়ার পর তা দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভক্ত করার প্রস্তাব উত্থাপন করে। ১৮১(২) প্রস্তাব নামে পরিচিত এই প্রস্তাবে স্বাধীন আরব ও ইহুদি রাষ্ট্র তৈরি এবং জেরুজালেম শহরের জন্য বিশেষ আন্তর্জাতিক শাসন চালুর সুপারিশ করা হয়। এতে ফিলিস্তিনের ৬ শতাংশ ভূমি ৩৩ শতাংশ ইহুদিদের দেওয়া হয় এবং ৯৪ শতাংশ জমি ৬৭ শতাংশ ফিলিস্তিনিদের দেওয়া হয়। তা ইহুদিদের কাছে গৃহীত হলেও আরব নেতারা তা প্রত্যাখ্যান করেন। ফলে জাতিসংঘের এই পরিকল্পনা কখনোই বাস্তবায়িত হয়নি। ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশরা এই সমস্যার সমাধানে ব্যর্থ হয়ে ফিলিস্তিন ছাড়ার পর ১৪ মে ইহুদি নেতারা ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয় এবং ডেভিড বেন গুরিয়ন প্রথম প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান সঙ্গে সঙ্গে ইসরাইলকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি দেন। আর ফিলিস্তিনিদের ওপর নেমে আসে আল নাকবা বা মহাবিপর্যয়। নিজ ঘরবাড়ি ছেড়ে নিঃস্ব অবস্থায় রাতারাতি লাখ লাখ ফিলিস্তিনি প্রাণ রক্ষায় ছুটে পালাতে থাকে। তাই ১৫ মে আল নাকবা (মহাবিপর্যয়) দিবস বিবেচিত হয়। ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে ইসরাইলের যুদ্ধ শুরু হয়। পরদিনই প্রতিবেশী আরবদেশও এতে অংশ নেয়। তখন ইহুদিরা ফিলিস্তিনের ৭৮ শতাংশ দখল করে। ১৯৪৮ সালের ডিসেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ১৯৪ রেজল্যুশন পাস হয়, যাতে শরণার্থী ফেরার অধিকার বিষয়ে আহ্বান জানানো হয়। পরের বছর মিসর, লেবানন, জর্দান ও সিরিয়া যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়। (চলবে)
লেখক: ইমাম ও খতীব, মসজিদুল আমান, গাঙ্গিনার পাড়, মোমেনশাহী।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
বিদেশে সাবেক ভুমিমন্ত্রীর আট হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি
ইউনূস গুড উইলের প্রতিফলন দেখতে চায় জনগণ: রিজভী
সময় থাকতে হাসিনাকে ফেরত পাঠান : ভারতকে দুদু
রুশ সেনা কুরস্কের দুটি শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে
বিমানবন্দর এলাকা হবে শব্দদূষণ মুক্ত
যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ওসি আবুল হাসান ৭ দিনের রিমান্ডে
বিচার শুরু হলে হাসিনাকে ফেরত চাওয়া হবে : আইন উপদেষ্টা
লোহাগড়ায় দিনে-দুপুরে বসতবাড়ি পুড়ে ছাই
রাষ্ট্রীয় কল্যাণে অবদান রাখার সুযোগ দিন আলেমদেরকে
দুই মেডিকেল টেকনোলজিস্টের ওপর হামলার ঘটনায় বিএমটিএর নিন্দা
জিএম কাদের ও মজিবুল হক চুন্নুকে অবিলম্বে আটক করতে হবে : আবু হানিফ
উপদেষ্টাদের আয় ও সম্পদ বিবরণী প্রকাশের নীতিমালা অনুমোদন
সাবেক মন্ত্রী শ ম রেজাউল-এমপি হেনরিসহ ৩ জনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা
পটুয়াখালী মেডিক্যাল কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতিকে একবছর ,সাধারন সম্পাদককে দুই বছর একাডেমীক কার্যক্রম থেকে বহিস্কারসহ উভয়কে হোস্টেল থেকে আজীবন বহিস্কার।
ঢাবিতে যুবককে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগে ৫ শিক্ষার্থী গ্রেফতার
রাজউক চেয়ারম্যানের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল
‘স্পেন্ড অ্যান্ড উইন’ ক্যাম্পেইনের বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করেছে মাস্টারকার্ড
সিটি ব্যাংক আনল অভূতপূর্ব ভিসা ইনফিনিট ক্রেডিট কার্ড
শেখ হাসিনার কোনো ক্ষমা নেই, জবাব তাকে দিতেই হবে : মির্জা ফখরুল
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে খুনিদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনতে হবে