মিধিলি’র আঘাত : ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের পাশে দাঁড়াতে হবে
১৯ নভেম্বর ২০২৩, ১২:১৩ এএম | আপডেট: ১৯ নভেম্বর ২০২৩, ১২:১৩ এএম
বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় মিধিলি গত শুক্রবার দুপুরে বাংলাদেশের উপকূলে আঘাত হানে। ঝড়ের অগ্রভাগ দুপুর ১২টার দিকে বরিশালের খেপুপাড়ার কাছ দিয়ে মোংলা-পায়রা উপকূল অতিক্রম করে তিনটার দিকে দুর্বল হয়ে পড়ে। ঘূর্ণিঝড়টির প্রভাবে বৃহস্পতিবার রাত থেকেই উপকূলীয় এলাকায় মাঝারি ও ভারি বৃষ্টিপাত শুরু হয়, যা শুক্রবার খুলনা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত পুরো উপকূল ভাগ ও সন্নিহিত এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। এতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। দেয়াল চাপা পড়ে ও গাছের ডাল ভেঙ্গে সাতজনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গেছে। অসংখ্য গাছপালা উপড়ে বা ভেঙ্গে গেছে। এতে অনেক স্থানে সড়ক যোগাযোগ ব্যাহত হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে উঠতি আমন ধানের। বোরোর বীজতলা পানিতে ডুবে বিনষ্ট হয়েছে। শীতের সবজি ও অন্যান্য ফসলেরও ক্ষতি হয়েছে। বিদ্যুতের তার ছিড়ে বহু এলাকা অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়েছে। কাঁচা বাড়িঘর ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। ট্রলারসহ কয়েকশ’ জেলে নিখোঁজ হয়েছে। গত ২৪ অক্টোবর ঘূর্ণিঝড় হামুন আঘাত হেনেছিল প্রধানত চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে। তাতে তিনজনের প্রাণহানি ছাড়াও কয়েক লাখ মানুষ ক্ষতির শিকার হয়েছিল। কক্সবাজারের প্রায় সমুদয় মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। তাদের ঘরবাড়ি, ফসলাদি বিনষ্ট হয়েছিল। হামুনের ক্ষয়ক্ষতির রেশ থাকতে থাকতেই মিধিলির আঘাত ও অধিকতর ক্ষয়ক্ষতি অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়। দু’ দুবার আমন ধান, অন্যান্য ফসল ও শাক-সবজির ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া কঠিন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সূত্র মতে, এবার সারাদেশে ৫৮ লাখ ৭৪ হাজার হেক্টর জমিতে আমন ধানের আবাদ হয়েছে। চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়েছে এক কোটি ৭১ লাখ টন। এর মধ্যে প্রায় নয় লাখ হেক্টরের ধান কাটা হয়েছে। আর ১০-১৫ দিনের মধ্যে সব আমন ধানই কাটার যোগ্য হতো। এর মধ্যে নেমে এসেছে ব্যাপক বিনষ্টি। কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, পটুয়াখালীতে আমনের ৭৫ শতাংশ কোনো না কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফেনীতে কয়েক হাজার হেক্টর জমির আমন ধান জমিতে শুয়ে পড়েছে। উপকূলীয় অন্যান্য জেলাতেও অনুরূপ ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। আমনের পর দেশে বোরোর আবাদই বেশি হয়। আসন্ন মওসুমে ৫০ লাখ ৪০ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ প্রেক্ষিতে বীজতলা তৈরি হচ্ছে দেশের সর্বত্র। মিধিলির প্রভাবে উপকূলীয় এলাকায় বীজতলা তলিয়ে যাওয়ায় বোরো আবাদ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এখন শীতকালীন শাক-সবজির মওসুম। ইতোমধ্যে বাজারে আসতে শুরু করেছে বিভিন্ন রকম শাক-সবজির। ঘূর্ণিঝড়ে উঠতি শাক-সবজির যে ক্ষতি করেছে তা পূরণ হবে কিনা, সেটাও এড়িয়ে যাওয়া যায় না।
ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বাণবন্যা, খরা, অনাবৃষ্টি ইত্যাদি আমাদের দেশে নতুন কোনো ঘটনা নয়। বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বিপর্যয়ে প্রাণহানি ছাড়াও ঘরবাড়ি, গাছপালা, ফল-ফসল প্রভৃতির বেশুমার ক্ষতি হয়। আবাদকারী কৃষক নিঃস্ব ও নিঃসম্বল হয়ে পড়ে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বিপর্যয় আগের তুলনায় এখন অনেক বেড়ে গেছে। জলবায়ুর পরিবর্তনই এর প্রধান কারণ। আমাদের দেশ জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় শিকার। এখন বন্যা বছরে একবার নয়, বার বার হয়। ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস হয় সময়ে-অসময়ে। বর্ষায় বৃষ্টি হয় না, অন্য সময়ে বন্যা দেখা দেয়। খরা-অনাবৃষ্টির সময়েরও পরিবর্তন হয়েছে। শীতও অপরিবর্তনীয় নেই। জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় ঝুঁকিতে আছে এদেশের মানুষ। উপকূলীয় এলাকার অন্তত দেড় কোটি মানুষ উদ্বাস্তুতে পরিণত হতে পারে, এমন আশঙ্কা প্রবল। অন্যদিকে যখন তখন কৃষিতে ক্ষয়ক্ষতি ঘটছে। এতে খাদ্য সংস্থান ও খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির বাইরে আসতে পারছে না। সরকারিভাবে বলা হয়ে থাকে, দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। আসলে তা সত্য ভাষণ নয়। যদি তাই হতো, তবে প্রতিবছর লাখ লাখ টন খাদ্যশস্য আমদানি করতে হয় কেন? দেশে আগের মতো খাদ্যাভাব নেই বটে, তবে খাদ্যমূল্য অধিকাংশ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি এখন সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ। খাদ্যপণ্যসহ এমন কোনো পণ্য নেই, যার দাম হু হু করে না বাড়ছে। সরকার মূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। ব্যবসায়ীদের হাতেই পণ্যের বাজার ছেড়ে দিয়েছে। মানুষের আয় বাড়েনি, ক্রয়ক্ষমতাও বাড়েনি; বরং কমেছে। এমতাবস্থায়, উচ্চবিত্তের স্বল্প সংখ্যক বাদে সব মানুষের জীবনযাপনই দুর্বহ হয়ে উঠেছে। খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি কেবল শহরে নয়, গ্রামেও প্রায় সমান সমান। শহর-গ্রামের অতি দরিদ্র ও দরিদ্র মানুষ কীভাবে বেঁচে আছে, সেটাই প্রশ্ন।
খাদ্য নিরাপত্তা যেকোনো দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শুধু মানুষ কেন সমস্ত প্রাণীর জন্যই খাদ্য অপরিহার্য। খাদ্য ছাড়া কারো পক্ষে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। আমাদের দেশে খাদ্যোৎপাদন অনেক বাড়লেও প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট নয়। এক বিঘা জমিতে এক সময় তিন-চার মণের বেশি ধান হতো না। এখন সেখানে ৩০-৩৫ মণও হচ্ছে। তারপরও চাল আমদানি করতে হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতিবছর যে পরিমাণ ধান বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে নষ্ট হয়, নানা কারণে অপচয় বা বিনষ্ট হয়, তা না হলে খাদ্য আমদানির হয়তো প্রয়োজন হতো না। বলা বাহুল্য, খাদ্যোৎপাদন বাড়ানোর বিকল্প নেই। এ জন্য কৃষিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। কৃষকের সহযোগিতা ও স্বার্থ সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য দিতে হবে এবং কৃষক যাতে তা পায় তার ব্যবস্থা করতে হবে। মধ্যসত্ত্বভোগীদের হটিয়ে দিতে হবে। সিন্ডিকেটবাজদের প্রতিহত করতে হবে। কৃষি বিভাগের পক্ষেও মিধিলির আঘাতে ধান ও ফসলাদির কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, এখন বলা সম্ভব নয়। ক্ষয়ক্ষতির দ্রুত নিরূপণ করা দরকার। আমনের ক্ষতি বোরো দিয়ে পূরণ করা সম্ভব। বোরোর বীজতলার যে ক্ষতি হয়েছে, পুনরায় বীজতলা তৈরি করে তা পূরণ করা যেতে পারে। শাক-সবজির জমিতে অন্য ফসলের আবাদ গড়ে তোলা যায়। এর জন্য আর্থিক ও অন্যান্য সহযোগিতা প্রয়োজন। সরকারকে এই প্রয়োজন পূরণে এগিয়ে আসতে হবে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের পাশে দাঁড়াতে হবে, যাতে তারা আবার ফসলাদির উৎপাদনে নিজেদের নিয়োজিত করতে পারে।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
ইসলামি দেশগুলোর মধ্যে জ্ঞানীয় বিজ্ঞানে শীর্ষ দুয়ে ইরান
জাইসের লেন্সের জয়জয়কার, স্মার্টফোনেও দুর্দান্ত
সাগর-রুনি হত্যার বিচারের প্রাথমিক স্তর পরিষ্কার করা দরকার : শামসুজ্জামান দুদু
আন্দোলন সংগ্রামে থাকা নেতাকর্মীদের পিছনে রাখার সুযোগ নেই : আমিনুল হক
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টার সাথে বিশ্ব ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্টের বৈঠক
যশোরে সাবেক এমপি, এসপিসহ ১৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা
এস আলম গ্রুপের সম্পত্তি স্থানান্তরে নিষেধাজ্ঞা চাওয়া রিটের আদেশ আগামী রোববার
গণহত্যাকারী আ.লীগের সঙ্গে আলোচনা নয় : আসিফ নজরুল
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ডিএনসিসি’র সপ্তাহব্যাপী কর্মসূচি শুরু
প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ তহবিলে নোবিপ্রবি শিক্ষক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একদিনের বেতন প্রদান
সিল্ক রোড উৎসবে ইরানের ‘মেলোডি’
বেনজির ও আজিজসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের
৬ ব্যাংকের এমডি নিয়োগ বাতিল
১৪৩ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এলো সেপ্টেম্বরের ১৭ দিনে
ইউনূস গুড উইলের প্রতিফলন দেখতে চায় জনগণ: রিজভী
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ প্রফেসর আমীর আলী চৌধুরীর ইন্তেকাল
ভারতের কাছ থেকে শেখ হাসিনাকে ফেরত চাওয়া হবে: আইন উপদেষ্টা
মেজর জে. অব. তারেক সিদ্দিকসহ ১০ জনের নামে মামলা
বহিঃশক্তি শকুনের মত শিল্প কলকারখানায় থাবা দেয়ার চেষ্টা করছে : শিমুল বিশ্বাস
বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বরদাশত করা হবে না: আইন উপদেষ্টা