নতুন প্রজন্মের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে
১৯ নভেম্বর ২০২৩, ১২:১৩ এএম | আপডেট: ১৯ নভেম্বর ২০২৩, ১২:১৩ এএম

সমস্যার শেষ নেই। নানা রকমের সমস্যা দেশের মানুষের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। কেড়ে নিয়েছে জীবনের সুখ-শান্তি, আনন্দ-ভালবাসা। প্রতিদিন পথচারী যন্ত্রদানবের চাকায় পিষ্ট হচ্ছে। ক্রন্দনের রোল আকাশ-বাতাসকে পরিব্যাপ্ত করছে। মানুষ দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে অসহায় চোখে শূন্যের দিকে তাকিয়ে আছে, কোনও ভরসা নেই। এ ভয়ঙ্কর সমস্যার মধ্যে আরও একটি বড় সমস্যা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। এ সাংঘাতিক সমস্যাটি এসেছে মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত এবং বস্তি ও শিল্পাঞ্চলের সমাজ থেকে। এ ভয়ঙ্কর সমস্যার শিকার ছাত্র-ছাত্রী, কিশোর-কিশোরী, যাদের বয়স চৌদ্দ থেকে কুড়ির মধ্যে।
চৌদ্দ বছরের কিশোর-কিশোরীও আজ অপরাধ জগতের চরিত্র। যাদের বয়স পনেরো, ষোল, সতেরো, আঠারো, উনিশ বা কুড়ি, তাদের অনেকেই অপরাধ জগতের নারকীয় কর্মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে, যার পরিণতি ভয়ঙ্কর। নিরপরাধ কিশোর-কিশোরী অজ্ঞাতসারে কামনার আকর্ষণে দেহভোগের ভিতর দিয়ে বীভৎস পাপের জগতে ডুবে যাচ্ছে, সেখান থেকে উঠে আসা সম্ভব হচ্ছে না। মধ্যবিত্তের বাবা-মার চোখ নিদ্রাহীন। চৌদ্দ থেকে কুড়ি বছরের ছেলে-মেয়েরা কেন সমাজের বড় সমস্যা, সে আলোচনাই এখন করার প্রয়াস।
একটি বড় সংখ্যার কিশোর-যুবক এবং কিশোরী-যুবতী অপরাধ জগতের শিকার হচ্ছে। মনস্তত্ত্ব সম্মত বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখতে পাই যে, এ বয়সটি জীবনের একটি গুত্বপূর্ণ স্তর। ঠিক এ জায়গা থেকে যাত্রা শুরু করে অন্য একটি স্তরে পৌঁছানো খুব কঠিন। অর্থাৎ চৌদ্দ-স্তর থেকে যাত্রা শুরু করে কুড়ি-স্তর অতিক্রম করে একুশের স্তরে পৌঁছানো ভীষণ কঠিন। এটি একটি পিচ্ছিল এবং বিপদসঙ্কুল পথ। এ বয়সে যেসব লক্ষণ দেখতে পাই সে সবের মধ্যে দুটি প্রধান হচ্ছে, তীব্র কৌতূহলের সঙ্গে একটি অনুসন্ধিৎসু মন এবং কল্পনাকে বাস্তবে রূপ দিতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো।
মনোবিজ্ঞান বলে থাকে, মানুষ মাত্রই কৌতূহলী। বয়স বৃদ্ধি এবং অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের সঙ্গে সঙ্গে কৌতূহলী মনকে সংযমে রাখার প্রচেষ্টা থাকে। এ সংযমী হওয়ার ইচ্ছাকে কার্যকর রাখতে বুদ্ধির একটি বড় ভূমিকা আছে। কিশোর-যুবক এবং কিশোরী-যুবতীর মধ্যে সংযমশক্তির ভীষণ অভাব। এদের মধ্যে বুদ্ধি সংযমের লাগাম টেনে ধরে রাখতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হয়। এ বয়সের মনকে বিশ্লেষণ করলে আরও অদ্ভুত ধর্মের সন্ধান মেলে। এসব অদ্ভুত ধর্ম যেমন বুদ্ধির দ্বারা পরিচালিত হয় না, আবার এসব ধর্মকে বাস্তবে রূপ দিতে বুদ্ধির সাহায্যও দরকার। তার মানে বুদ্ধির ভূমিকা আছে। সে বুদ্ধিকে এ বয়সের ছেলে-মেয়েরা পরীক্ষামূলক কাজে ব্যয়িত করছে।
আমার মনে হয়, মানসিকতার বিচারে সেকাল এবং একালের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। সে সময়ে কিশোর-যুবককে উদ্দীপিত করার পরিবেশের অভাব ছিল। শিক্ষার বাতাবরণ ছিল, নিয়মের প্রাচীর ছিল, চলচ্চিত্রের আনন্দ পাওয়ার অধিকার সীমিত ছিল, টিভি, স্যাটেলাইট আবিষ্কার হয়নি। এসব ভালো প্রতিবন্ধকতা থাকায় সেকালের কিশোর-যুবক এবং কিশোর-যুবতী যৌনঘটিত অপরাধ কম করত। সামাজিক পারিপার্শ্বিক প্রতিবন্ধকতা সেকালের কিশোর-যুবক এবং কিশোরী-যুবতীদের বিপদসঙ্কুল পথ অতিক্রম করতে সাহায্য করত।
প্রাকৃতিক নিয়মের ভিতর দিয়েই ছেলে এবং মেয়েরা বেড়ে উঠে। বেড়ে উঠার সঙ্গে সঙ্গে তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বিকাশও ঘটে। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বিকাশের সঙ্গে মানসিক অনুভূতিরও প্রকাশ ঘটে। এভাবে পূর্ণতার দিকে দেহ-মন যদি এগুতে পারত এবং কোনও বাধা না পেত তবে অপরাধের জš§ই হতো না, কিন্তু এরা বর্তমান সমাজে এ বয়সেই ভোগের দিকে ছুটে চলেছে।
এবার প্রশ্ন, এরা কেন ভয়ঙ্কর অপরাধ করে? অথবা এ ভয়ঙ্কর অপরাধ করার উদ্দীপক কারণগুলো কী? এখন পর্যালোচনা করে দেখি, এসব পবিত্র বা সোনার টুকরো ছেলে-মেয়ে কেন এ পাপ কাজের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, কিসের হাতছানি এদের বিপথগামী করছে? যে বয়স থেকে সংযম গড়ে উঠে, সংযমী হওয়ার অভ্যাস প্রতিদিন করতে হয়, ঠিক সে বয়সেই এদের কাছে উত্তেজক আহার সমাজ প্রতিনিয়ত যোগান দিচ্ছে, তারা দিশেহারা হয়ে যাচ্ছে, হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে পাপে ডুবে যাচ্ছে।
এ উদ্দীপক উপাদানগুলো কী? কোথা থেকে আসছে, সেটাই দেখা যাক। বিভিন্ন টিভি, আকাশ সংস্কৃতি, দূরদর্শন এ উপলক্ষে একটি ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক মাধ্যম। দূরদর্শন উদ্দীপক উপাদানের একটি জলন্ত যন্ত্র। সংখ্যাতত্ত্বের বিচারে একটি, কিন্তু ক্ষতির পরিমাপকে বিচার করলে হাজারটি ক্ষতিকারক মাধ্যমের ভূমিকা একটি মাধ্যমের মধ্য দিয়েই প্রতিফলিত হচ্ছে। ভারতীয় হিন্দী ছবিতে যে সব ধারাবহিক দূরদর্শনে দেখানো হয় তার ভিতর থেকে উগ্র যৌনতাকে ছেলেমেয়েরা গ্রহণ করে। আর এখন উন্মুক্ত ইন্টারনেটের কারণে পরিস্থিতি আরো ভয়ানক হয়ে উঠেছে।
প্রত্যেকদিন যদি কিশোর-যুবক এবং কিশোরী-যুবতী পর্দায় দেখে নায়ক-নায়িকাকে চুম্বন করছে, কিংবা অর্ধ-উলঙ্গ দেহে বার বা হোটেলে নাচ করছে কিংবা খলনায়ক কোনও নারীকে জোর করে ধর্ষণ করছে তখন ওই ছেলে-মেয়ের মধ্যে কি প্রতিক্রিয়া হবে? আমরা সহজেই অনুমান করতে পারি, ওই একই দৃশ্য তাদের মনের কামনাকে প্রজ্বলিত করবে। তারা অস্থির হয়ে উঠবে এবং সুযোগ তৈরি করে পাপ কাজ করবে এবং করছেও। টেলিভিশনে যেসব নগ্ন বিজ্ঞাপন দেখানো হয় তা শুধুমাত্র কিশোর-যুবক এবং কিশোরী-যুবতীদের ক্ষতি করছে না, ক্ষতি করছে শিশুদেরও। ছবিগুলো শিশুর অবচেতন মনে জমে থাকছে, পরবর্তীতে শিশু সে জমাকৃত ছবি বাস্তবের সংঘাতে চেতন মনে উঠে আসবে, যা জীবনের পক্ষে প্রচন্ড ক্ষতিকারক।
সরকারি ছাড়াও বেসরকারি চ্যানেল রয়েছে। অসংখ্য চ্যানেল। দিন এবং রাতে এসব চ্যানেলে যা দেখানো হয় তা দুশো কিলোমিটার বেগের ঝড়ের থেকেও ভয়ঙ্কর এবং ক্ষতিকারক। রাতভর ওইসব চ্যানেল চলে অর্ধ উলঙ্গ নৃত্য, ব্যভিচারের নানা দৃশ্য, যা কিশোর-যুবক এবং কিশোরী-যুবতীকে বিকৃত যৌন চেতনার মধ্যে ঠেলে দেয়। আর এখন যাদের কাছে একটি অ্যান্ড্রয়েড ফোন এবং ইন্টারনেট সংযোগ আছে তাদের নরক উদ্যানে যাওয়ার পথ তো আরো উš§ুক্ত।
এ তো গেল দেহকেন্দ্রিক পাপ বা অপরাধ। দেহগত পাপের পাশাপাশি ছেলে-মেয়েদের মধ্যে খুন বা হত্যা করার প্রবণতা ও তৈরি হয়ে যায়। আমি আলোচনার প্রারম্ভেই বলেছি যে, কল্পনাকে বাস্তবায়িত করতে এ সব ছেলে-মেয়েরা রীতিমত পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালায়। রূপালী পর্দায় যে কাল্পনিক খুনের দৃশ্য দেখানো হয়, যাকে সাধারণ ভাবে বাস্তবায়িত করা অসম্ভব, সে অসম্ভবকে এসব ছেলে-মেয়েরা করে সম্ভব। ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পিতভাবে এরা খুন করে। এ খুন করার মানসিকতার জš§দাতা ওই রঙিন পর্দায় দেখা দৃশ্যকল্প। এ কারণেই খুনের সংখ্যা এবং দেহগত পাপের পরিমাণ ভীষণভাবে বেড়ে চলেছে। এভাবে চলতে থাকলে সমাজ পাপে তলিয়ে যাবে।
যে কারণগুলোর কথা আলোচনা করলাম, সেসব কারণ ছাড়া অন্য কারণও আছে। অন্যান্য কারণগুলো সংক্ষেপে বিবৃত করছি। বেশ ক’বছর আগেও ছাত্র-শিক্ষকের সম্বন্ধ গুরু-শিষ্যের মতই ছিল। ছাত্র-ছাত্রী শিক্ষক-শিক্ষিকাকে অত্যন্ত সমীহ করত এবং সঙ্গে থাকত ভক্তি মিশ্রিত শ্রদ্ধা। আজকাল আগেকার দিনের মতো আদর্শবান শিক্ষকের বড় অভাব, অভাব আদর্শবতী শিক্ষয়িত্রীর। নিয়ম ও শৃঙ্খলাপরায়ন বিদ্যালয়েরও অভাব। অভাব আদর্শ পিতা-মাতার, অভাব ব্যক্তিত্বপূর্ণ অভিভাবকের। এখন দেখি শিক্ষকরা ভাই হয়ে গেছে। ভাইয়েরা যত্রতত্র কোচিং খুলে বসে আছে। ওমুক ভাইয়ের কোচিং-এ না পড়লে সব বিষয়ে ভালো নম্বর পাওয়া যাবে না, সে জন্য চল ওমুক ভাইদের কোচিংয়ে। নিয়ম-শৃঙ্খলার বালাই নেই। কোচিংয়ে যাওয়ার বাহানা করে ছেলে-মেয়েরা অকালে-অসময়ে পাপের ঘরে প্রবেশ করছে এমনও দেখা যায়।
সরকারি শিক্ষা নীতি চালু থাকলেও ব্যবস্থার প্রতি উদাসীন। একজোট হয়ে শিক্ষা ক্ষেত্রে বিশৃংখলা নৈরাজ্য সৃষ্টি করা হচ্ছে। তারা সরল কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতীদের নিয়ে রাজনৈতিক মিছিল করছে, আন্দোলন করছে, যার পরিণতি ছাত্র সমাজের অধঃপতন। এ কারণেই নিয়ম-শৃঙ্খলা এবং মূল্যবোধের নিম্নগামী যাত্রা শুরু হলো, আজ মূল্যবোধ বইয়ের মধ্যে একটি ‘শব্দ’ হয়ে বেঁচে আছে। শুধুমাত্র কোনও একটি কারণের জন্য কিশোর-যুবক এবং কিশোরী-যুবতী অপরাধ জগতের বাসিন্দা হচ্ছে না, যৌথ কারণের জন্যই তারা অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে। এর প্রতিকারের কথা সুধী সমাজ নিশ্চয়ই ভাবছেন, ভাবছেন শিক্ষাবিদ এবং সমাজ-বিজ্ঞানীরা, ভাবছেন রাষ্ট্রনায়কগণ। প্রতিবেদনটি শেষ করার আগে পিতামাতা, অভিভাবক এবং কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বে যাঁরা আছেন তাঁদের একটি বিষয় স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, সেটি হলো, আবাসিক বিদ্যালয় ও হলসমূহ। এসব বিদ্যালয় বা হলে পড়াশুনা এবং মানুষ হওয়ার সুন্দর বাতাবরণ যদি তৈরি করা যায়, যদি প্রতিনিয়ত ছাত্র-ছাত্রীদের ভালোর দিকে চলার দিক নির্দেশনা থাকে, চরিত্র গঠনের পরিবেশ থাকে তাহলে, কোন ছেলে-মেয়েই পিচ্ছিল পথে যাবে না, সব ছেলে-মেয়ে মানুষের মতো মানুষ হয়ে উঠবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
টেন্ডুলকারের রেকর্ড ভাঙতে পারবেন না কোহলি: লারা

আসাদুজ্জামানের নেতৃত্বে ধানম-িতে ছাত্রদলের বিক্ষোভ মিছিল

চকরিয়ায় বেপরোয়া শ্যামলী বাসে পৃষ্ঠ হয়ে প্রাণ হারালো দুই সহোদর

রাজবাড়ীতে অরক্ষিত রেল ক্রসিংয়ে এক বছরে ট্রেনে কাটা পড়ে ১২ জনের মৃত্যু

অবরোধের সমর্থনে তিতুমীর কলেজ ছাত্রদলের বিক্ষোভ মিছিল ও পিকেটিং

পূর্ব শত্রুতার জের ডাসারে ঘেরে বিষ দিয়ে মাছ নিধনের অভিযোগ

প্রেসিডেন্টের কাছে চার দেশের রাষ্ট্রদূতের পরিচয়পত্র পেশ
আইসিসির মাসসেরার দৌড়ে নাহিদা ও ফারজানা

এবার ইসির অনুমোদন পেলো ১১০ ইউএনও বদলির প্রস্তাব

রায়গঞ্জে নবাগত ইউএনওর যোগদান

যোগ্যদের ছাড় দেবে আওয়ামী লীগ : তথ্যমন্ত্রী

রাজবাড়ীতে অরক্ষিত রেল ক্রসিংয়ে এক বছরে ট্রেনে কাটা পড়ে ১২ জনের মৃত্যু

নির্বাচনী হলফনামায় দুদকের কঠোর নজরদারি

গাজায় যুদ্ধ বন্ধে নিজের সর্বোচ্চ ক্ষমতা প্রয়োগ করলেন জাতিসংঘ মহাসচিব

মেরামত কাজ না হওয়ায় বিশ্বনাথে-রামপাশা-লামাকাজি সড়ক এখন মরন ফাঁদ

সড়ক দুর্ঘটনায় ইউনিক গ্রুপের এমডির মেয়ের মৃত্যু

দৌলতখানে গভীর রাতে মাইক্রোবাসে আগুন

এবার ১১০ ইউএনও বদলির প্রস্তাব অনুমোদন ইসির

বাগেরহাটে হত্যা মামলার যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামী গ্রেফতার

বৃষ্টির মধ্যেই শাহবাগে বাসে আগুন