ঢাকা   বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৪ আশ্বিন ১৪৩১

ওসামা বিন লাদেনের চিঠি এবং নিপীড়িত মানুষের বিজয়ের বার্তা

Daily Inqilab জামালউদ্দিন বারী

২২ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০৫ এএম | আপডেট: ২২ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০৫ এএম

বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী মানুষ এক চরম সংকটকাল অতিক্রম করছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বাংলাদেশের শতকরা ৯০ ভাগ মুসলমানের বোধের জগতকে বেদনা-বিধুর ও হতাশায় আচ্ছন্ন করে তুলেছে। একদিকে বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে বড় ধরণের রাজনৈতিক সংকট, অনিশ্চয়তা এবং আরেকটি একতরফা নির্বাচনের তফসিল যেমন দেশের বেশিরভাগ মানুষকে সংক্ষুব্ধ ও হতাশ করছে, অন্যদিকে ফিলিস্তিনের গাজা ও পশ্চিমতীরে দখলদার ইসরাইলী বাহিনীর নজিরবিহীন ধ্বংসযজ্ঞের তাণ্ডব ও গণহত্যার পৈশাচিক উন্মত্ততা বিশ্ববিবেককে নাড়িয়ে দিয়েছে। ফিলিস্তিনে ইসরাইলী জায়নবাদীদের হাতে নির্বিচার ও বেপরোয়া শিশু হত্যার এমন বিভৎস দৃশ্য বিগত কোনো মহাযুদ্ধেও ঘটেনি। প্রথমত মানুষ হিসেবে এবং মুসলমান আত্মপরিচয় ও উম্মাহ চেতনার এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মধ্যে এক প্রবল অভিঘাত সৃষ্টি করছে। সেই সাথে লাখো মানুষের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশে নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক সমঝোতা ও গণআকাক্সক্ষার সুপ্রতিষ্ঠিত প্রতিশ্রুতি ভেঙ্গে দিয়ে দলীয় সরকারের অধীনে বিগত দুইটি একতরফা জাতীয় নির্বাচনে মানুষের ভোট দিতে না পারার গ্লানী এবং কোনো রকম রাজনৈতিক সমঝোতা ছাড়াই বিদ্যমান অস্বাভাবিক-অগণতান্ত্রিক বাস্তবতায় দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার মধ্য দিয়ে দেশের জনপ্রতিনিধিত্বশীল বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল ও সাধারণ মানুষকে আরো সংক্ষুব্ধ ও উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে যাচ্ছেতাইভাবে সংবিধান পরিবর্তন করে সংবিধানের দোহাই দিয়ে ক্ষমতাসীনদের এসব বেপরোয়া কর্মকাণ্ড চলছে। গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রশ্নে দেশি-বিদেশি সব পক্ষের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা ও দাবি-দাওয়াকে অগ্রাহ্য করে, আইনের শাসন, বহু মতের সহাবস্থানের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পরিবেশ, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতাকে বড় হুমকির মুখে ঠেলে দিয়ে ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করার বেপরোয়া পদক্ষেপ দেশকে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিকভাবে চরম সংকটের মুখে ঠেলে দিতে শুরু করেছে।

তথ্যপ্রযুক্তি ও বাণিজ্যের এই বিশ্বায়নের যুগে কোনো পরাশক্তির পক্ষেও জনসম্পৃক্ত কোনো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য লুকিয়ে রাখা বা ধামাচাপা দেয়া সম্ভব নয়। বাংলাদেশের বিগত তিনটি জাতীয় নির্বাচনের সাথে পশ্চিমা পরাশক্তি ও আঞ্চলিক আধিপত্যবাদী শক্তির নানাবিধ কূটচাল, বোঝাপড়া এবং বিরোধীদল ও মত দমনে ক্ষমতাসীন সরকারের চরমপন্থী কার্যক্রমের কোনো কিছুই শেষ পর্যন্ত গোপণ বা অজ্ঞাত থাকেনি। ‘বোয়ালের আন্ডা বোয়ালেই’ ভেঙ্গে দিতে দেখা গেছে। বিগত তিনটি নির্বাচনের মধ্যে সেনা সমর্থিত এক-এগারোর জরুরি সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় নির্বাচনকে সুষ্ঠু, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক বলে আখ্যায়িত করা হলেও ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ফরেন সেক্রেটারি হিলারি ক্লিন্টনসহ বিভিন্ন জনের লেখা ও উইকিলিকস থেকে ফাঁস হওয়া গণমাধ্যমের তথ্যে সে নির্বাচনের কারসাজি অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে গেছে। ইতিমধ্যে আঞ্চলিক প্রেক্ষাপটে বিশ্বরাজনীতিতে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটে গেছে। বিশেষত ওয়ার অন টেররিজম এবং ইসলামোফোবিক এজেন্ডাকে সামনে রেখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়া নীতির ইতিবাচক পরিবর্তনের নিয়ামক হিসেবে বাংলাদেশে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও আইনের শাসনের মত গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক ইস্যুগুলোর সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাবিশ্বের জোরালো অবস্থান ও ভূমিকাকে বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী মানুষ ও নিবর্তনের শিকার বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো স্বাগত জানিয়েছে। কোনো স্বাধীন রাষ্ট্রের গণতন্ত্রকামী মানুষ নিজদেশের আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিষয়ে কোনো প্রতিবেশী বা আন্তর্জাতিক পরাশক্তির অযাচিত হস্তক্ষেপকে স্বাগত জানাতে পারেনা। কিন্তু দেশের শাসকরা যখন অব্যাহত মানবাধিকার লঙ্ঘনের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক রীতিনীতি, আইনের শাসন ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের প্রত্যাশিত পরিবেশ নস্যাৎ করার পাশাপাশি রাজনৈতিক সংলাপ-সমঝোতার সব পথকে রুদ্ধ করে একদলীয় শাসনকে চিরস্থায়ী করতে সংকল্প প্রকাশ করতে থাকে, তখন গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রশ্নে পরাশক্তি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের হস্তক্ষেপকে সাধারণ মানুষ এবং গণতন্ত্রকামী সব রাজনৈতিকদল সাধুবাদ জানাতে বাধ্য হয়।

দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহনমূলক করার অভিপ্রায়কে সামনে রেখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৎপরতা হঠাৎ করেই শুরু হয়নি। সেই ২০২১ সালে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও গুম-খুনের অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের দাবি রেখে এলিট ফোর্স র‌্যাব ও পুলিশের ৭ শীর্ষ কর্মকর্তার উপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্যাংশানকে আমাদের সরকার যথাযথ গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করেনি। তারা এ নিয়ে নানাভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে লবিং করার চেষ্টা করলেও গুম-খুনের অস্বাভাবিক ঘটনাগুলো স্বীকার করে নিয়ে তার সুষ্ঠু তদন্তসাপেক্ষে দোষীদের বিচার নিশ্চিত করার সাথে সাথে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে বলপূর্বক নিখোঁজ ব্যক্তিদের সম্পর্কে স্বচ্ছ তথ্য ও পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেনি সরকার। তবে র‌্যাবের উপর স্যাংশান দেয়ার পর এই বাহিনীর হাতে গুম-খুন ও মানবাধিকার লঙ্ঘণের ঘটনা অনেকটা কমে আসায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের তরফ থেকে সন্তোষ প্রকাশ করতে শোনা গেছে। তবে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উত্তরণের প্রশ্নে রাজনৈতিক সংলাপ-সমঝোতা এবং দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করতে সরকারের অনীহার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠার কারণে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের উপর মার্কিন ভিসানীতির মতো কঠোর পদক্ষেপের ঘোষণা দিয়েছে। বিরোধিদলের শান্তিপূর্ণ ধারাবাহিত রাজনৈতিক কর্মসূচির শেষ ধাপে এসে গত ২৮ অক্টোবর ঢাকার মহাসমাবেশে কথিত বিশৃঙ্খলার অজুহাতে মাত্রাতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ করে, শত শত টিয়ার সেল, সাউন্ড গ্রেনেড ও গোলাগুলি করে লাখ লাখ মানুষের মহাসমাবেশ পন্ড করে দেয়ার পর থেকে বিএনপি’র উপর ক্র্যাকডাউন, দলের প্রধান কার্যালয় অবরুদ্ধ করে রাখা, হাজার হাজার নেতাকর্মী গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের সব সম্ভাবনা রুদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। বিএনপি মহাসচিবসহ কেন্দ্রীয় নেতাদের মুক্তির দাবি ছাড়াই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শর্তহীন সংলাপের আহ্বান জানিয়েছিল। সেই আহ্বানকে পাত্তা না দেয়া এবং মাত্রাতিরিক্ত বলপ্রয়োগের মাধ্যমে শ্রমিক আন্দোলন দমনের কারণে আরেকটি একতরফা নির্বাচনের তফসিল শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের তৈরী পোশাক শিল্প পশ্চিমা বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন হলে তা দেশের জন্য বড় ধরণের বিপর্যয় সৃষ্টি করবে। এমন একটি ঝুঁকি নিয়ে সরকারের একতরফা নির্বাচনের পেছনে দেশের মানুষের কোনো সমর্থন কিংবা ন্যুনতম কল্যাণ চিন্তার যোগসুত্র নেই। এরই মধ্যে দেশে একটি অচলাবস্থা ও গৃহযুদ্ধ পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে। এমনিতে চলতে থাকা অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে বিরোধীদলের ধারাবাহিক হরতাল-অবরোধে দেশের যোগাযোগ, উৎপাদন ব্যবস্থা ও অর্থনীতির গতিশীলতা থমকে দাঁড়িয়েছে। নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন ছাড়া এ থেকে উত্তরণের আর কোনো পথ নেই।

জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতায় আমাদের জনমানস এক বিরূপ পরিস্থিতির সম্মুখীন। গাজায় ইসরাইলের বর্বর গণহত্যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের অকুণ্ঠ সমর্থন ও সামরিক সহায়তা আমাদের অন্তরে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে চরম বিদ্বেষি মনোভাব সৃষ্টি করেছে। দেশের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে মানুষের ভোটাধিকার হরণ, মানবাধিকার লঙ্ঘন, দেশ থেকে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা পাচারের মধ্য দিয়ে দেশকে দেউলিয়াত্বের দিকে ঠেলে দেয়ার কারণে অস্বাভাবিক মূল্যস্ফীতিসহ জীবনযাত্রায় নানাবিধ সংকটের মুখে পড়েছে দেশের মানুষ। গত ১৭ বছরে অনেকটা ফ্যাসিবাদী কায়দায় রাষ্ট্রশক্তি ব্যবহার করে বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিকে দুর্বল ও অকার্যকর করে দেয়ার ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার মধ্যেও নিবর্তনমূলক-কর্তৃত্ববাদী আচরণে সাধারণ মানুষের সমর্থন হারিয়েছে সরকার। বিএনপির শীর্ষনেতা বেগম খালেদা জিয়া, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক জিয়া, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বিরোধিদলের শীর্ষ নেতা এবং হাজার হাজার রাজনৈতিক নেতার উপর গ্রেফতার-নির্যাতন ও হামলা-মামলায় ভীতিকর পরিস্থিতিতে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো যেন বাংলাদেশে গণতন্ত্রের জন্য ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডা, অষ্ট্রেলিয়ার মত পশ্চিমা উন্নয়ন সহযোগিরা যখন বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের কথা বলছে, তখন এরাই ফিলিস্তিনে ইসরাইলী দখলদার বাহিনীর বেপরোয়া বোমা হামলায় নৃশংস গণহত্যা, শিশুহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের পক্ষে সাফাই গাচ্ছে! প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে চীন-ভারত ও রাশিয়ার সমর্থন পাওয়া কর্তৃত্ববাদী সরকারের নিবর্তনমূলক ভূমিকার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক শক্তির দুর্বলতার কারণে পশ্চিমাদের হস্তক্ষেপকে বিরোধী রাজনৈতিক দল ও সাধারণ মানুষ সমর্থণের আড়ালে গাজার মুসলমানদের উপর ইসরাইলের জাতিগত নির্মূল অভিযানের বিরুদ্ধে ঢাকায় কার্যত তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে না। তবে খোদ ইসরাইল থেকে শুরু করে লন্ডন, প্যারিস, ওয়াশিংটন-নিউইয়র্কসহ পশ্চিমা বিশ্বের সর্বত্র সাধারণ মানুষ ইসরাইলী বর্বরতার নিন্দা-প্রতিবাদে ফেটে পড়েছে। অদ্ভুত এক রাজনৈতিক বাস্তবতায় আমাদের কোটি কোটি ধর্মপ্রাণ মুসলমান জায়নবাদী-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে নীলকণ্ঠ নিরবতা গ্রহণ করতে বাধ্য হচ্ছে। সব যুগে সব দেশে আঞ্চলিক-আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদী নিবর্তনের রূপরেখা, গতিপথ ও পরিনতি অভিন্ন। মনবাধিকার, শান্তি ও সৌহার্দ্য বিনষ্টকারী কোনো কর্তৃত্ববাদী শাসকের ক্ষমতার কর্তৃত্ব চিরস্থায়ী নয়। ক্ষমতাদর্পী, অত্যাচারী শাসকরা নিজেরাই ক্রমাগত নিজেদের পতনের খাদ খনন করে চলে। সব হারানোর পর মানুষের আর কোনো ভয় কিংবা সংশয় থাকে না। ইসরাইলের ৭৫ বছরের নিবর্তনের মধ্যেও অবরুদ্ধ গাজায় হামাস-হিজবুল্লাহর মত অসম সাহসী মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পরাক্রমশালী শক্তিকে নাস্তানাবুদ হতে হয়। প্রযুক্তি, অর্থনীতি ও বিশ্বব্যবস্থার উপর পশ্চিমা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে যেসব রাজনৈতিক বয়ান ও প্রোপাগান্ডা বিশ্বের মানুষের মগজ ধোলাইয়ের জন্য ব্যবহার করা হয়, তার ভিত্তিতে কোনো কিছুর স্বচ্ছ উপসংহার টানা সম্ভব নয়। আফগান তালেবান, আল-কায়েদা, আইএস কিংবা হামাসের সাথে মোসাদ ও সিআইএর সম্পৃক্ততার অনেক তথ্যপ্রমান পাওয়া যায়। পরিবেশ পরিস্থিতি পাল্টে যাওয়ার সাথে সাথে বন্দুকের নল ঘুরে যেতে পারে। নিজের নির্মিত দানবীয় যন্ত্র ফ্রাঙ্কেনস্টাইনে পরিনত হওয়ার গল্প শুধু কল্পকাহিনীতেই সীমাবদ্ধ নয়। বাস্তব ইতিহাসে এর ভুরি ভুরি প্রমান রয়েছে। ওসামা বিন লাদেন পরিবারের সাথে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের পরিবারের যৌথ অংশীদারি বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল। আফগানিস্তানকে সোভিয়েত সামরিক বাহিনীর দখলদারিত্ব থেকে মুক্ত করতে তালেবান ও আল কায়েদার মত প্রতিরোধ যোদ্ধাদের সংঘটিত ও শক্তিশালী করতে পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ব্যাপক ভূমিকা ছিল।

‘তোমারে বধিবে যে, গোকূলে বাড়িছে সে’ মহাভারতের সেই কংস রাজার কাহিনী যুগে যুগে পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। ফেরাউনের ঘরেই অলৌকিকভাবে মূসা (আ.) নবী বেড়ে উঠেছিলেন, অত:পর তার পদাঙ্কেই নীলনদের পানিতে ডুবে পরাক্রমশালী অত্যাচারি শাসকের পতন ঘটেছিল। গাজায় হামাস-ইসরাইল অসম যুদ্ধে ইসরাইলী বাহিনীর নৈতিক ও কৌশলগত পরাজয় ঘটে গেছে। হাজার হাজার টন বোমা ফেলে গাজাকে ধ্বংসস্তুপে পরিনত করেও হামাসের সক্ষমতায় চিড় ধরাতে কিংবা গত দেড়মাসে হামাসের হাতে জিম্মি একজন বন্দিকেও মুক্ত করতে পারেনি ইসরাইলের গণহন্তারক বাহিনী। দেশে দেশে কোটি কোটি সমাধারণ মানুষের পাশাপাশি ইহুদি সম্প্রদায়ের হাজার হাজার মানুষও গাজায় ইসরাইলী গণহত্যা বন্ধ ও ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার দাবিতে রাজপথে নামতে দেখা যাচ্ছে। পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী পরাশক্তির সমর্থনপুষ্ট ইসরাইলীরা তাদের প্রতিবেশী এবং বিশ্বসম্প্রদায় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ক্রমশ পরাজয়ের দিকে ধাবিত হচ্ছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর ইসরাইল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার পর থেকে মধ্যপ্রাচ্যের ভৌগলিক মানচিত্র, যুদ্ধ-বিগ্রহ ও রাজনৈতিক ঘটনাক্রমের সাথে জায়নবাদী ইসরাইলের যোগসাজশ স্পষ্ট। ইরাকে মার্কিন হামলা ও দখলদারিত্ব কায়েমের আগে প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের গণবিদ্ধংসী সমরাস্ত্রের বিশাল মজুদ থাকার মিথ্যা প্রোপাগান্ডা ছড়িয়েছিল জায়নবাদিদের নিয়ন্ত্রিত মিডিয়াগুলো। তবে আগ্রাসি শক্তি কোথাও সামরিক-রাজনৈতিক বিজয় হয়নি। ইতিহাসের কোনো ঘটনাই পরস্পর বিচ্ছিন্ন নয়। হামাস-ইসরাইলের অসম যুদ্ধের এই সময় বিশ বছর আগে মার্কিন জনগণের উদ্দেশ্যে লেখা ওসামা বিন লাদেনের একটি চিঠি নেট দুনিয়ায় ভাইরাল হয়েছে। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী বিমান হামলার ঘটনার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডাব্লিউ বুশ এর জন্য আল কায়েদার উপর দোষ চাপিয়ে মূলত মধ্যপ্রাচ্যের মুসলমানদের বিরুদ্ধে ‘ক্রুসেড’ ঘোষণা করেন। এরপর সামরিক-অর্থনৈতিকভাবে বিশ্বের সবচেয়ে দুর্বল দেশটির বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ ন্যাটো বাহিনী সম্মিলিত শক্তি নিয়ে হামলে পড়ে। কয়েক ট্রিলিয়ন ডলারের সামরিক বাজেট খরচ করে দুই দশক যুদ্ধ করার পর মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনী আফগানিস্তান থেকে পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে তালেবানদের হাতে ক্ষমতা দিয়ে ফিরে যেতে বাধ্য হয়। মার্কিনীদের উদ্দেশ্যে আল কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনের লেখা চিঠিটি ২০০২ সালের ২৪ নভেম্বর মার্কিন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। সুদীর্ঘ ও সুলিখিত চিঠির শুরুতেই আল কোরআনের সূরা হাজ্বের ৩৯ নাম্বার আয়াত এবং সুরা আন নিসার ৭৬ নাম্বার আয়াতের উদ্ধৃতি তুলে ধরেছেন। সেখানে বলা হয়েছে, তাদেরকে যুদ্ধের জন্য অনুমতি দেয়া হল, কেননা তারা অত্যাচারিত হয়েছে, আর আল্লাহ অবিশ্বাসীদের উপর বিশ্বাসীদের বিজয়ী করতে সক্ষম (সুরা২২:৩৯)। অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, যারা বিশ্বাসী তারা আল্লাহর পথে জিহাদ করে আর অবিশ্বাসীরা শয়তানের দেখানো পথে যুদ্ধ করে, শয়তানের কৌশল খুবই দুর্বল। আমেরিকা ও পশ্চিমা বিশ্বের বিরুদ্ধে মুসলমানদের বিদ্বেষ পোষণের কারণ হিসেবে অনেকগুলো বিষয়ের অবতারণা করে বিন লাদেন যে দুটি প্রধান কারণকে তুলে ধরেছেন তার প্রথমটি হচ্ছে- মুসলমানদের উপর পশ্চিমাদের অব্যাহত ও ক্রমবর্ধমান আক্রমণ। দ্বিতীয় হচ্ছে- ফিলিস্তিনিদের উপর জায়নবাদীদের দখলদারিত্ব ও গণহত্যায় মার্কিনীদের সমর্থন। বিন লাদেন ফিলিস্তিনের হাজার হাজার বছরের ক্রমবিবর্তনের ঐতিহাসিক ধারাক্রম তুলে ধরেছেন। প্রায় ৪ হাজার শব্দের এই চিঠিটি প্রত্যেক মুসলমান ও সব ধর্মের সচেতন নাগরিকদের পড়া উচিৎ। বিন লাদেন গাজায় জায়নবাদী ইসরাইলের শিশু হত্যার নারকীয় তাণ্ডব দেখে যাননি, তবে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে লাখ লাখ ইরাকি শিশুর মৃত্যু ও ইরাক-আফগানিস্তানে ধ্বংসযজ্ঞ ও দখলদারিত্ব দেখেছেন। বিন লাদেন আফগানিস্তানে মার্কিনীদের পরাজয় দেখে যেতে পারেননি। তাঁর চিঠিতে তিনি অনেক উদাহরণ তুলে ধরে নিপীড়িত ও প্রতিরোধ-সংগ্রামী মুসলমানদের বিজয়ের লক্ষ্যে আল্লাহর প্রতিশ্রুতির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। দেশে দেশে নিপীড়িত সংগ্রামী মানুষের বিজয় সুনিশ্চিত।

[email protected]


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

ইসলামি দেশগুলোর মধ্যে জ্ঞানীয় বিজ্ঞানে শীর্ষ দুয়ে ইরান

ইসলামি দেশগুলোর মধ্যে জ্ঞানীয় বিজ্ঞানে শীর্ষ দুয়ে ইরান

জাইসের লেন্সের জয়জয়কার, স্মার্টফোনেও দুর্দান্ত

জাইসের লেন্সের জয়জয়কার, স্মার্টফোনেও দুর্দান্ত

সাগর-রুনি হত্যার বিচারের প্রাথমিক স্তর পরিষ্কার করা দরকার : শামসুজ্জামান দুদু

সাগর-রুনি হত্যার বিচারের প্রাথমিক স্তর পরিষ্কার করা দরকার : শামসুজ্জামান দুদু

আন্দোলন সংগ্রামে থাকা নেতাকর্মীদের পিছনে রাখার সুযোগ নেই : আমিনুল হক

আন্দোলন সংগ্রামে থাকা নেতাকর্মীদের পিছনে রাখার সুযোগ নেই : আমিনুল হক

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টার সাথে বিশ্ব ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্টের বৈঠক

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টার সাথে বিশ্ব ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্টের বৈঠক

যশোরে সাবেক এমপি, এসপিসহ ১৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা

যশোরে সাবেক এমপি, এসপিসহ ১৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা

এস আলম গ্রুপের সম্পত্তি স্থানান্তরে নিষেধাজ্ঞা চাওয়া রিটের আদেশ আগামী রোববার

এস আলম গ্রুপের সম্পত্তি স্থানান্তরে নিষেধাজ্ঞা চাওয়া রিটের আদেশ আগামী রোববার

গণহত্যাকারী আ.লীগের সঙ্গে আলোচনা নয় : আসিফ নজরুল

গণহত্যাকারী আ.লীগের সঙ্গে আলোচনা নয় : আসিফ নজরুল

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ডিএনসিসি’র সপ্তাহব্যাপী কর্মসূচি শুরু

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ডিএনসিসি’র সপ্তাহব্যাপী কর্মসূচি শুরু

প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ তহবিলে নোবিপ্রবি শিক্ষক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একদিনের বেতন প্রদান

প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ তহবিলে নোবিপ্রবি শিক্ষক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একদিনের বেতন প্রদান

সিল্ক রোড উৎসবে ইরানের ‘মেলোডি’

সিল্ক রোড উৎসবে ইরানের ‘মেলোডি’

বেনজির ও আজিজসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের

বেনজির ও আজিজসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের

৬ ব্যাংকের এমডি নিয়োগ বাতিল

৬ ব্যাংকের এমডি নিয়োগ বাতিল

১৪৩ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এলো সেপ্টেম্বরের ১৭ দিনে

১৪৩ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এলো সেপ্টেম্বরের ১৭ দিনে

ইউনূস গুড উইলের প্রতিফলন দেখতে চায় জনগণ: রিজভী

ইউনূস গুড উইলের প্রতিফলন দেখতে চায় জনগণ: রিজভী

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ প্রফেসর আমীর আলী চৌধুরীর ইন্তেকাল

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ প্রফেসর আমীর আলী চৌধুরীর ইন্তেকাল

ভারতের কাছ থেকে শেখ হাসিনাকে ফেরত চাওয়া হবে: আইন উপদেষ্টা

ভারতের কাছ থেকে শেখ হাসিনাকে ফেরত চাওয়া হবে: আইন উপদেষ্টা

মেজর জে. অব. তারেক সিদ্দিকসহ ১০ জনের নামে মামলা

মেজর জে. অব. তারেক সিদ্দিকসহ ১০ জনের নামে মামলা

বহিঃশক্তি শকুনের মত শিল্প কলকারখানায় থাবা দেয়ার চেষ্টা করছে : শিমুল বিশ্বাস

বহিঃশক্তি শকুনের মত শিল্প কলকারখানায় থাবা দেয়ার চেষ্টা করছে : শিমুল বিশ্বাস

বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বরদাশত করা হবে না: আইন উপদেষ্টা

বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বরদাশত করা হবে না: আইন উপদেষ্টা