ঢাকা   বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৪ আশ্বিন ১৪৩১

গাজায় ইসরাইলের গণহত্যা : মুসলিম বিশ্বের ভূমিকা চরম হতাশাজনক

Daily Inqilab ড. মো. কামরুজ্জামান

২৫ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০৪ এএম | আপডেট: ২৫ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০৪ এএম

ইহুদিদের ধারণা মতে, জেরুজালেমের মসজিদে আকসার অদূরে তাদের একটি উপাসনালয় আছে। এটির পুনঃনির্মাণ করে সেখানে তারা বসতি স্থাপন করতে চায়। এ উপসনালয়কে ঘিরে তারা ফিলিস্তিনে একটি ইহুদি রাষ্ট্র কায়েমের পরিকল্পনা করে। এখানে তারা স্থায়ী হয়ে গোটা পৃথিবীর কর্তৃত্ব করতে চায়। ইহুদিদের কোনো স্থায়ী ভূমি ছিল না। সারা দুনিয়ায় তারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। তথাপিও তাদের এ লক্ষ্য অর্জনে তারা একযোগে কাজ করে যেতে থাকে। আপন অবস্থান থেকে এ মিশন বাস্তবায়নে তারা ধাপে ধাপে অগ্রসর হয়। এ হিসেবে জায়নবাদের ইতিহাস অতি প্রাচীন। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এটি বিভিন্ন নামে বিকশিত হয়েছে। বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের রূপ ধারণ করে তা বিস্তৃত হয়েছে। ইহুদিরা নিজেদের গোপন অভিপ্রায় ও স্বকীয়তা ঠিক রেখে সমাজের সাথে মিশে গিয়েছে। যার যার অবস্থান থেকে সাধ্যমত তাদের কাজ করে গেছে। তাদের কূটকৌশল ইউরোপের বিস্তৃত খ্রিস্টান জগতকে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করেছে। ক্রুসেডে জড়িয়ে সংকটে ফেলে দিয়ে গোটা ইউরোপকে তারা অদৃশ্য নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। দেশে দেশে তারা বিশ^মানের নেতা, সংগঠক ও রাজনীতিক পয়দা করেছে। দেশ-বিদেশে গবেষক, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবী তৈরি করেছে। এক্ষেত্রে তারা ব্যাপকভাবে নারী ও অর্থ বিনিয়োগ করেছে। তাদের কূটকৌশলের মাধ্যমে আধুনিক খ্রিস্টানদের তারা কুপোকাত করেছে। ফলে ইহুদিঘাতক হিসেবে পরিচিত অনেক নামি দামি খ্রিস্টান নেতা ইহুদিদের পক্ষে ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে।

আধুনিক জায়নবাদের উত্থান ঘটে ১৮৮০ সালে। নাকান বেরেনবুয়ান নামে এক অস্ট্রিয়ান ইহুদি ইহুদিজাতিকে জেরুজালেমে ফিরে যাওয়ার জন্য একটি আন্দোলনের প্রস্তাব দেন। অস্ট্রিয়ান আরেক ইহুদির নাম হলো ড. থিওডর হার্জেল, পেশায় সাংবাদিক। ১৮৯৬ সালে তিনি ‘দ্যা জুয়েশ স্টেট’ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। এ বইতে তিনি ইহুদিমুক্তি আন্দোলনের রূপরেখা পেশ করেন। আর তার নেতৃত্বে গঠিত হয় ‘ইন্টারন্যাশনাল জায়োনিস্ট অর্গানাইজেশন’। ইউরোপ, আমেরিকা ও রাশিয়ায় এ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন কাঠামোতে ইহুদিরা নানা সংগঠন গড়ে তোলে। প্রত্যক্ষভাবে তারা গড়ে তোলে আন্তর্জাতিক নানা সংগঠন। ইহুদি কংগ্রেস, আন্তর্জাতিক জায়নিস্ট লীগ, বেরিহাহ মুভমেন্ট, হাগানাহ ইত্যাদি তাদের প্রতিষ্ঠিত প্রত্যক্ষ সংগঠন। আর পরোক্ষভাবে তারা গড়ে তোলে ইন্টারন্যাশনাল মনিটরি ফান্ড, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, ইন্টারন্যাশনাল রেড ক্রস, ইউএনডিপি, ইউনিসেফ, ইউনেস্কো, জুয়েশ ন্যাশনাল ফান্ড ইত্যাদি। ড. থিওডর হার্জেলের নেতৃত্বে ১৮৯৭ সালের আগস্টে সুইজারল্যান্ডে দুদিনব্যাপী এক আনুষ্ঠানিক ইহুদি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। আধুনিক বিশে^ এটাই ছিল ইহুদিদের প্রথম আনুষ্ঠানিক কোনো আন্তর্জাতিক সম্মেলন। এ সম্মেলন থেকেই আন্তর্জাতিকভাবে ইহুদিবাদের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। বিশে^র ৩০টি ইহুদি সংগঠনের ৩০০ জন নেতা ইহুদিবাদকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়। গোটা দুনিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে তারা পরিকল্পনা কষতে থাকে। স্থায়ীভূমি ক্রয় করতে তারা গঠন করে ‘জুয়েশ ন্যাশনাল ফান্ড’। ফিলিস্তিনিদের কাছ থেকে জমি কিনতেই তারা এ ফান্ড ব্যবহার করে। এ সময় থেকে তারা রিফিউজি ও ভিখারি হিসেবে অল্প অল্প করে ফিলিস্তিনে আগমন শুরু করে ও সেখানে বসবাস করতে থাকে।

১৯১৫ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধে দুটি পক্ষে অনেকগুলো রাষ্ট্র ছিল। প্রথম পক্ষে ছিল উসমানীয় সাম্রাজ্য, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি, বুলগেরিয়া ও জার্মানি। দ্বিতীয় পক্ষে ছিল ব্রিটেন, ফ্রান্স, সার্বিয়া, জাপান, ইতালি, রুমানিয়া, রাশিয়া ও আমেরিকা। যুদ্ধে প্রথম পক্ষ হেরে যায়। ফলে উসমানিয় সাম্রাজ্য ভেঙ্গে যায়। উসমানীয় সাম্রাজ্য মানেই মুসলিম বিশ^। বিজয়ী পক্ষ পরাজিত মুসলিম বিশ^কে ভাগ বাটোয়ারা করে নেয়। ফিলিস্তিন চলে যায় ব্রিটিশের ভাগে। ফলে ব্রিটেন ফিলিস্তিনে বসতি স্থাপন শুরু করে। সেখানে ব্রিটেনের রাজত্ব স্থায়ী হয় ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত। এ দীর্ঘ সময়ে ব্রিটেন ফিলিস্তিনের মাটির গভীরে তাদের শিকড় গেড়ে ফেলে। আডলফ হিটলার ছিলেন অস্ট্রীয় বংশোদ্ভূত জার্মান রাজনীতিবিদ। প্রথম বিশ^যুদ্ধে তিনি সৈনিক হিসেবে জার্মনির পক্ষে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তাকে নাৎসিবাদের প্রবক্তা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তিনি ১৯৩৩ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত জার্মানির চ্যান্সেলর ছিলেন। ১৯৪১ সালে জার্মানিতে ঘটে হলোকাস্টের ঘটনা। হলোকাস্ট হলো একটি জেনোসাইড বা গণহত্যা। এর সরল অর্থ ইহুদি নিধন। হিটলারের নেতৃত্বে এ নিধন সংঘটিত হয়। এছাড়া জার্মানির অধিকৃত অন্যান্য দেশেও এ নিধন সংঘটিত হয়। ধারণা করা হয়, এ গণহত্যায় নিহতের সংখ্যা ছিল ৬০ লাখ ইহুদি। এ সময়ে জার্মানির অর্থ মন্ত্রণালয় ইহুদিদের সকল সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে। জার্মান প্রতিষ্ঠানগুলো ইহুদিদের চাকরিচ্যুত করে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ইহুদিছাত্র ভর্তির ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। অধ্যয়নরত ইহুদি ছাত্রদেরকে ডিগ্রি প্রদান বন্ধ করে। চাকরিরত ইহুদি প্রফেসরদের চাকরিচ্যুত করে।

১৯৩০ এর দশক থেকেই ইহুদিদের আইনি, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকার চরমভাবে সীমিত করা হয়। জার্মানি ১৯৪০ সালে নরওয়ে, নেদারল্যান্ড, বেলজিয়াম ও ফ্রান্স দখল করে নেয়। ১৯৪১ সালে দখল করে নেয় যুগোশ্লাভোকিয়া ও গ্রিস। এ সমস্ত দেশেও ইহুদিদের বিরুদ্ধে ব্যাপক পদক্ষেপ নেয়া হয়। এ সময় ইতালি সরকার ইহুদিদের সরকারি চাকরি ও স্কুলে প্রবেশের সুযোগ বন্ধের এক আইন পাশ করে। ইতালীয় লিবিয়ায় মোট জনসংখ্যার ২৫ ভাগ ছিল ইহুদি। সেখানে তাদের ৪৪টি উপসনালয় ছিল। ১৯৪২ সালে নাৎসিরা সেগুলো দখল করে নেয়। তাদেরকে সেখান থেকে উচ্ছেদ করা হয়। তাদের জোর করে বিভিন্ন শ্রমশিবিরে পাঠানো হয়। অধিকাংশ ইহুদি শ্রমশিবিরে রোগে-শোকে ও অনাহারে মৃত্যুবরণ করে। বেঁচে যাওয়া ইহুদিরা ইউরোপের বিভিন্ন রাষ্ট্রে মানবেতর জীবন যাপন করতে থাকে। তারা নিজেদের বড়ো অসহায় জাতি ভাবতে থাকে। তারা উদ্বাস্তু জীবন থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজতে থাকে। তাদের কাছে প্রয়োজন ছিল একটি স্থায়ী স্বাধীন রাষ্ট্র।

ফিলিস্তিন মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশ। এর পূর্বে রয়েছে লেবানন, সিরিয়া, ইরাক, জর্ডান ও সৌদি আরব। এর পশ্চিমে রয়েছে মিসর। উত্তর-পশ্চিমে ভূমধ্যসাগর। এ সাগরের তীরে রয়েছে সাইপ্রাস, তুরস্ক, গ্রিসসহ ইউরোপীয় অন্যান্য দেশ। এক সময় ফিলিস্তিন ছিল শান্তিময় এক মুসলিম আবাসভূমি। ছিল বিশাল এবং বিস্তীর্ণ এক ভূখন্ড। ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনের ভাগ্যাকাশে কালোমেঘ জন্ম নেয়। এ সময়ে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী বিভিন্ন দেশ থেকে ইহুদিরা ফিলিস্তিনে জড়ো হয়। খ্রিস্টানদের হাতে নির্যাতিত ইউরোপীয় ইহুদিরা এখানে উড়ে এসে জুড়ে বসে। ব্রিটেন নিয়ন্ত্রিত ফিলিস্তিনে তখন জনসংখ্যা ছিল ২০ লাখ। যার মধ্যে ইহুদি সংখ্যা দাঁড়ায় ৬ লাখে। জাতিসংঘ সরাসরি ফিলিস্তিনকে ভেঙ্গে দুটি রাষ্ট্রে বিভক্ত করে। ফিলিস্তিনের পেটের মাঝখানে জন্ম দেয় ইসরাইল নামক অবৈধ রাষ্ট্রের। ফিলিস্তিন ভেঙে দুটি অংশ হয়ে যায়। একটার নাম হয় ইসরাইল আর অপরটি ফিলিস্তিন। ফিলিস্তিন অংশে দুটি এলাকা নির্ধারিত হয়। একটা হলো গাজা, আরেকটা হলো পশ্চিম তীর। ফিলিস্তিনের ভৌগোলিক অবস্থান অনেকটা উপমহাদেশের মতো। ধরা যাক, পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশ হলো গাজা। পশ্চিম পাকিস্তান তথা আজকের পাকিস্তান হলো পশ্চিম তীর। আর মাঝখানে বিশাল ভারত হলো অবৈধ ইসরাইল রাষ্ট্র। গাজার আয়তন মাত্র ৩৬০ বর্গ কিলোমিটার। গাজা থেকে পশ্চিম তীরে যেতে হলে ইসরাইল অতিক্রম করেই যেতে হয়। জাতিসংঘের বণ্টিত নিয়মে জেরুজালেম কারো জন্য নির্ধারিত ছিল না। এটি যেহেতু মুসলিম, ইহুদি এবং খ্রিস্টানদের পবিত্র স্থান তাই এটা ছিল একটি আন্তর্জাতিক নগরী। যদিও এ বণ্টন মুসলিমরা মেনে নেয়নি। এ জেরুজালেমেই অবস্থিত মুসলমানদের প্রথম কেবলা মসজিদে আকসা। বর্তমানে এই জেরুজালেম এবং মসজিদে আকসা ইহুদিরা দখল করে নিয়েছে। ফিলিস্তিনে দুটি রাজনৈতিক দল আছে। একটির নাম হামাস, আরেকটির নাম ফাতাহ। হামাস হলো ইসলামপন্থী সবচেয়ে জনপ্রিয় দল। আর ফাতাহ হলো সেকুলারপন্থী দল। হামাস গাজার নেতৃত্ব দেয়, আর ফাতাহ রয়েছে পশ্চিম তীরের নেতৃত্বে। নির্বাচনে হামাস জয়ী হলেও বর্তমানে ফিলিস্তিনের সরকারি ক্ষমতা রয়েছে ফাতাহর হাতেই। ফাতাহ মূলত ইসরাইলের আনুকূল্য নিয়েই বেঁচে আছে। গাজাবাসীর জন্য সাহায্য করতে হলে সেটা সরাসরি তাদের হাতে যায় না। এটা পশ্চিম তীরের সরকার তথা ফাতাহর কাছে যায়, যা গাজাবাসীর কোনো উপকারে আসে না। বরং পশ্চিম তীরের উন্নয়নে ফাতাহ সরকার সেটা ব্যয় করে। গাজা শহরটি পুরোটাই চারদিক থেকে অবরুদ্ধ। গাজার তিনদিকেই ইসরাইল। আর একদিকে ভূমধ্যসাগর, যার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে ইসরাইলের গানশিপ সদস্যরা। গাজার একটু অংশ মিশরের সাথে সংযুক্ত যাকে রাফা সীমান্ত বলা হয়। ড. মুরসি সরকারের সময়ে মিশরের ঐ বর্ডার গাজাবাসীর জন্য খোলা থাকতো। মুরসি সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে মিশরের ক্ষমতায় আসীন হন আব্দুল ফাত্তাহ সিসি। তিনি ক্ষমতায় আসীন হয়ে ওই সীমান্ত বন্ধ করে দেন। ফলে চারদিক থেকে গাজাবাসী অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। ইসরাইলিদের করুণার উপর নির্ভর করেই গাজাবাসীর জীবনটা অতিবাহিত হয়। হামাসের সংগ্রামী চেতনায় ফিলিস্তিনিদের হারিয়ে যাওয়া স্বাধীনতা ফিরে আসার স্বপ্ন আজও বেঁচে আছে। পশ্চিমা মিডিয়া তাদের সম্পর্কে সবসময় নেতিবাচক সংবাদ প্রচার করে। হামাসের সদস্যদেরকে তারা সন্ত্রাসী ও উগ্রপন্থী হিসেবে উপস্থাপন করে থাকে।
মূলত গাজা নিয়ে ইসরাইলের রয়েছে এক মহাপরিকল্পনা। ৭ অক্টোবর ২০২৩-এর সকালে হামাস আকস্মিকভাবে ইসরাইলের অভ্যন্তরে এক হামলা চালায়। সেদিন থেকে ইসরাইল গাজায় হামলা অব্যাহত রেখেছে। এ হামলায় ইসরাইল হামাস যোদ্ধাদের কোনো ক্ষতি করতে পারছে না। হামাসের কৌশলের কাছে ইসরাইল লজ্জাজনক ধরাশয়ী হয়েছে। সুউচ্চ ভবন ধ্বংস আর নিরীহ শিশু ও নারী মারা ছাড়া অন্য কোনো সাফল্য ইহুদিরা পাচ্ছে না। কয়েক সপ্তাহের হামলায় গাজার ৭ লাখ শিশুকে তারা উদ্বাস্ত বানিয়েছে। তারা মূলত গাজা থেকে মুসলিম শূণ্য করতে চায়। তারা শিশু ও নারীদের গাজার উত্তর সীমান্তে যেতে বলে সেই উত্তর সীমান্তেই বিমান হামলা চালাচ্ছে। আবার দক্ষিণ দিকে সরে যেতে বলে দক্ষিণ দিকেই হামলা করছে। এ পর্যন্ত নিহত ফিলিস্তিনিদের দুই তৃতীয়াংশই নারী ও শিশু। শিশু হত্যার উদ্দেশ্য হলো, শিশুরা যাতে যোদ্ধা না হতে পারে। আর নারী হত্যার উদ্দেশ্য হলো, ফিলিস্তিনিরা যাতে নির্বংশ হয়ে যায়। গাজার অধিবাসী সংখ্যা প্রায় ২৫ লাখ। এই ২৫ লাখ মুসলমানকে তারা গাজা থেকে বের করে দিতে চায়। কট্টর এক ইহুদি মন্ত্রী গাজাবাসীকে মিশরের সিনাই উপত্যকায় পাঠিয়ে দেয়ার প্রস্তাব করেছে। অতঃপর মুসলিমশূন্য গাজার জমি ইসরাইলি সেনাদের মধ্যে বণ্টন করার প্রস্তাব করেছে। ইতোমধ্যে মিশরের সিসি সরকারকে ইসরাইল এ প্রস্তাব জানিয়ে দিয়েছে। বিনিময়ে মিশর কর্তৃক বিশ্ব ব্যাংকের কাছ থেকে নেয়া ১৬ হাজার কোটি ডলার মওকুফের টোপ দেয়া হয়েছে। কোনো কোনো ইহুদি নেতা গাজার মুসলিম জনতাকে আয়ারল্যান্ড, স্কটল্যান্ড কিংবা চীনের মরুভূমিতে নির্বাসনের প্রস্তাব করেছে। আবার কারো মতে, ২৫ লাখ সংখ্যাটা খুব বেশি নয়। সুতরাং পারমাণবিক বোমা মেরে এ সংখ্যাটাকে মেরে ফেলার প্রস্তাব করেছে! ইসরাইল সরকার ফিলিস্তিনিদের বিতাড়িত করে সেখানে প্রবল প্রতিপত্তি স্থাপন করতে চায়। সেখানে আমেরিকা ও ইসরাইল যৌথ সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের পরিকল্পনা করেছে। এর মাধ্যমে তারা গোটা বিশ^কে পদানত করতে চায়। আরববিশ^কে তারা হাতের মুঠোয় নিয়ে কৃতদাসে পরিণত করতে চায়। ইসরাইলের এক গোপন নথি ফাঁস হলে বিশ^মিডিয়ায় তাদের এ পরিকল্পনা প্রকাশ পায়। আন্তর্জাতিক মিডিয়া সূত্রে বলা হয়েছে, গাজার তলদেশে তেল ও গ্যাসের মজুদ রয়েছে। ইসরাইলের বারোটা কোম্পানি গাজায় তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানে প্রস্তুত রয়েছে। ইসরাইল বর্তমানে মূলত আরব বিশ্বের তেলের উপর নির্ভরশীল। এমতাবস্থায়, তারা যদি গাজার তলদেশ থেকে তেল ও গ্যাস উত্তোলন করতে পারে তাহলে তারা এক্ষেত্রে স্বনির্ভর হয়ে যাবে। বর্তমানে ইসরাইল আরব বিশ্বের মুখাপেক্ষী হলেও তখন আর মুখাপেক্ষী থাকবে না।

গাজায় প্রতিদিন শতশত নিরীহ মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। গাজার চারিদিকে অসহায় নারী ও শিশুর মরদেহ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। অনেক মরদেহ পচে গলে গন্ধ ছড়ালেও দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করা যাচ্ছে না। দখলদার ইহুদিরা লাশ ও রোগীবাহী অ্যাম্বুলেন্সেও হামলা করছে। শরণার্থী শিবিরেও তারা হামলা চালাচ্ছে। ট্যাংক ও সাজোয়া যান দিয়ে হাসপাতালের পথ বন্ধ করছে। গাজার ৩৬টি হাসপাতালের সবকটিই প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। তাদের হামলা থেকে পানির ট্যাংক ও গ্যাস পাম্পও রক্ষা পাচ্ছে না। হাজার হাজার শিশুর কান, নাক ও গাল ফেটে রক্ত পড়ছে। অগনিত শিশুর দেহ ও মাথা থেতলে যাচ্ছে। তাদের আর্তচিৎকারে আকাশ বাতাস ভারি হয়ে উঠছে। লোমহর্ষক এসব দৃশ্যে খোদ ইসরাইলের অভ্যন্তরে সাধারণ ইহুদিরা প্রতিবাদে রাস্তায় নামছে। যুদ্ধ বন্ধে নেতানিয়াহুর বাড়ি ঘেরাও করছে। ইসরাইলের পশ্চিমা মিত্ররা এ গণত্যার বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠছে। সাধারণ ইহুদিরা নিরাপদ জীবনযাপন করতে সাইপ্রাস পাড়ি জমাচ্ছে। ফিলিস্তিনে হামলা বন্ধে আন্তর্জাতিক বিশ^ ইসরাইলের উপর চাপ প্রয়োগ করছে। ফিলিস্তিনি শিশুদের রক্ত পশ্চিমা বিবেককে জাগিয়ে তুলেছে। কিন্তু আফসোস আরব বিশে^র মুসলিম নেতাদের জন্য! তাদের বিবেক আজও জাগ্রত হলো না! অথচ তারা জাগলেই ইসরাইল থেমে যেতো। তাদের একটি মাত্র উদ্যোগে ফিলিস্তিনি শিশুদের পথচলা সহজ হতো। আর সেটা হলো, ইহুদি দখলদারদের বিরুদ্ধে আরবনেতাদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া এবং ফিলিস্তিনিদের বৈধ স্বাধীকারের প্রতি সমর্থন দেয়া। বৈধ স্বাধীকার অর্জন করতে ফিলিস্তিনিরা দীর্ঘ ৭৪ বছর ধরে তাদের রক্ত ঝরাচ্ছে। কিন্তু আরব নেতাদের নিরবতা ও বিলাসিতার কারণে তারা তাদের বৈধ স্বাধীনতা ফিরে পাচ্ছে না।

গত ১১ নভেম্বরে আরবলীগ ও ওআইসিভুক্ত ৫৭টি মুসলিম দেশের নেতারা করণীয় নির্ধারণে সৌদি আরবে এক বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন। গোটা মুসলিম দুনিয়া অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় ছিল। তারা ভেবেছিল, এই বুঝি মুসলিম নেতাদের সম্বিত ফিরে এসেছে। তারা হয়তো এবার ইসরাইলের গণহত্যার বিরুদ্ধে হুংকার দেবে। কিন্তু না! তাদের ভূমিকায় গোটা মুসলিম উম্মাহ হতাশ হয়েছে। তারা কার্যকর কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেননি। শুধু যুদ্ধ বন্ধে নিন্দা ও কিছু নসিহতপূর্ণ কথা পেশ করেছেন! তাদের এমন নিন্দা ও নসিহত নতুন কিছু নয়। গত ৭৪ বছর ধরেই বিশ^বাসী এমন নিন্দাই প্রকাশ করেছে। কিন্তু এতে ফিলিস্তিনিরা তাদের স্বাধিকার ফিরে পায়নি। আর গণহত্যাও বন্ধ হয়নি।

লেখক: অধ্যাপক, দা›ওয়াহ এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

ইত্তিহাদেই সিটিকে রুখে দিল ইন্টার

ইত্তিহাদেই সিটিকে রুখে দিল ইন্টার

রোনালদোদের নতুন কোচ পিওলি

রোনালদোদের নতুন কোচ পিওলি

দক্ষিণ আফ্রিকাকে গুড়িয়ে আফগানদের ঐতিহাসিক জয়

দক্ষিণ আফ্রিকাকে গুড়িয়ে আফগানদের ঐতিহাসিক জয়

যেই গৌরব কেবল শারজাহ ক্রিকেট স্টেডিয়ামের

যেই গৌরব কেবল শারজাহ ক্রিকেট স্টেডিয়ামের

রিট করে ‘খেলাপি ঋণ স্থগিত’ বন্ধ চান ব্যাংক-মালিকরা

রিট করে ‘খেলাপি ঋণ স্থগিত’ বন্ধ চান ব্যাংক-মালিকরা

বিদেশি ঋণ ফের ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে

বিদেশি ঋণ ফের ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে

টাকা উদ্ধারের নামে ‘ঘুষ’ চাওয়ার অভিযোগ জিএম শাহজাহান চৌধুরীর’র বিরুদ্ধে

টাকা উদ্ধারের নামে ‘ঘুষ’ চাওয়ার অভিযোগ জিএম শাহজাহান চৌধুরীর’র বিরুদ্ধে

জাতীয় ঐক্য বিনষ্টকারী কর্মকান্ড থেকে বিরত থাকতে হবে

জাতীয় ঐক্য বিনষ্টকারী কর্মকান্ড থেকে বিরত থাকতে হবে

৬০ হাজার টন ইউরিয়া সার কিনবে সরকার, ব্যয় ২৩৬ কোটি টাকা

৬০ হাজার টন ইউরিয়া সার কিনবে সরকার, ব্যয় ২৩৬ কোটি টাকা

আইকনিক লিডার তারেক রহমান ও বাংলাদেশের রাজনীতি

আইকনিক লিডার তারেক রহমান ও বাংলাদেশের রাজনীতি

পতিত স্বৈরাচার ও ভারতের চক্রান্ত চলছেই

পতিত স্বৈরাচার ও ভারতের চক্রান্ত চলছেই

তারেক রহমানের রাষ্ট্রনায়কোচিত বক্তব্য ও দিকনির্দেশনা

তারেক রহমানের রাষ্ট্রনায়কোচিত বক্তব্য ও দিকনির্দেশনা

ইসরাইলের দখলদারিত্ব বন্ধের প্রস্তাব বিবেচনা জাতিসংঘের

ইসরাইলের দখলদারিত্ব বন্ধের প্রস্তাব বিবেচনা জাতিসংঘের

উত্তপ্ত মণিপুরে অত্যাধুনিক অস্ত্র দিয়ে নতুন করে গোলাগুলি

উত্তপ্ত মণিপুরে অত্যাধুনিক অস্ত্র দিয়ে নতুন করে গোলাগুলি

২৭ দেশে ছড়িয়ে পড়েছে করোনার নতুন ভ্যারিয়্যান্ট

২৭ দেশে ছড়িয়ে পড়েছে করোনার নতুন ভ্যারিয়্যান্ট

২০০ হাতি নিধনের সিদ্ধান্ত জিম্বাবুয়ের

২০০ হাতি নিধনের সিদ্ধান্ত জিম্বাবুয়ের

কলেরাসহ মারাত্মক রোগের ঝুঁকিতে সুদানের ৩৪ লাখ শিশু

কলেরাসহ মারাত্মক রোগের ঝুঁকিতে সুদানের ৩৪ লাখ শিশু

১১ হাজার ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থীর প্রাণ গেছে

১১ হাজার ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থীর প্রাণ গেছে

বেলারুশে হামলা হলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবে : লুকাশেঙ্কো

বেলারুশে হামলা হলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবে : লুকাশেঙ্কো

তাইওয়ান প্রণালীতে চীনের যুদ্ধবিমান

তাইওয়ান প্রণালীতে চীনের যুদ্ধবিমান