ঢাকা   বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৪ আশ্বিন ১৪৩১

পাট বীজ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতার পথে দেশ

Daily Inqilab রাশেদ খান মিলন

২৬ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০৫ এএম | আপডেট: ২৬ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০৫ এএম

বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ পাট উৎপাদনকারী দেশ। পাট ও পাটজাত পণ্যের বৈশ্বিক রফতানি আয়ের সিংহভাগ তথা প্রায় ৭২ শতাংশ বাংলাদেশের দখলে। ‘সোনালি আঁশ’-এর দেশ হওয়া সত্ত্বেও এ দেশের পাটবীজের আমদানি নির্ভরতা কাটছে না। ২০২২-২৩ উৎপাদন বছরে ৫ হাজার টন পাটবীজ আমদানির অনুমতির বিপরীতে প্রকৃতপক্ষে আমদানি হয়েছিল ৪ হাজার ১৬৬ টন। আমদানি কম হওয়ায় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ২০ শতাংশ কম জমিতে পাট চাষ হয়েছে। ২০২৩-২৪ উৎপাদন বছরে দেশে প্রায় ৭ লাখ ৬৪ হাজার হেক্টর জমিতে পাট, মেস্তা ও কেনাফ চাষ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে বীজের চাহিদা নির্ধারণ করা হয়েছে ৬ হাজার ৩৬৯ টন। ইতোমধ্যে তোষা পাটের বীজ ৪ হাজার ৬০০ টন এবং মেস্তা ও কেনাফের বীজ ৫৭৬ টন আমদানির অনুমতি দেয়া হয়েছে। পাট বীজের চাহিদার অবশিষ্ট ১ হাজার ১৯৩ টন অর্থাৎ ১৯ শতাংশের সরবরাহ আসবে দেশের অভ্যন্তরীণ নানা উৎস থেকে।

প্রকৃতপক্ষে, পাটবীজ উৎপাদনের মৌলিক ধাপ তিনটি। এগুলো হচ্ছে, প্রজনন বীজ, ভিত্তি বীজ ও প্রত্যয়িত বীজ। প্রজননবিদের সরাসরি তত্ত্বাবধানে উৎপাদিত শতভাগ কৌলিত্বাত্তিক দিক থেকে বিশুদ্ধ বীজ প্রজনন বীজ নামে পরিচিত। প্রজনন বীজকে বর্ধিত করে যে বীজ পাওয়া যায় তাকে বলা হয় ভিত্তি বীজ। সরাসরি বা গবেষণা খামারে গবেষক এবং বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সির কর্মকর্তাদের তত্ত্বাবধানে ভিত্তি বীজ উৎপাদন করা হয়। ভিত্তি বীজ বর্ধিত করে যে বীজ পাওয়া যায় তাকে বলা হয় প্রত্যয়িত বীজ। এই বীজই কৃষকদের মাঝে চাষের জন্য বিতরণ করা হয়। বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি এই বীজের সনদ প্রদান করে। দেশে ২০১৭-১৮ উৎপাদন বছরে ৭ দশমিক ৫৮ লাখ হেক্টর জমিতে পাটচাষ করা হয়, যা ছিল গত কয়েক বছরের তুলনায় সর্বোচ্চ। তাই ২০১৭-১৮ সালের জমির পরিমাণকে ভিত্তি ধরে এখন পাটবীজের চাহিদা হিসাব করা হয়। বর্তমানে প্রতি হেক্টরে পাট চাষ করতে ৬ দশমিক ৫ কেজি বীজের প্রয়োজন হয়। এই বিপুল পরিমাণ উন্নত পাট বীজ উৎপাদনে বাংলাদেশকে স্বনির্ভর করতে সরকার ২০২৫ সাল পর্যন্ত একটি রোডম্যাপ তৈরি করেছে। বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিজেআরআই) এ রোডম্যাপ বাস্তবায়নে প্রযুক্তিগত সহায়তা দেবে। এ রোডম্যাপ অনুযায়ী, প্রথম বছর ২০ মেট্রিক টন ভিত্তি বীজ উৎপাদন করা হবে। ভিত্তি বীজ উৎপাদনের জন্য পাট উৎপাদনপ্রবণ এলাকায় ৩০০০টি প্রদর্শনী প্লট স্থাাপন করা হবে। এর জন্য প্রয়োজনীয় প্রজনন বীজ বিজেআরআই সরবরাহ করবে। দ্বিতীয় বছর ৪০ মেট্রিক টন ভিত্তি বীজ উৎপাদন করা হবে, যা দিয়ে ১ হাজার ৪৬৪ মেট্রিক টন প্রত্যয়িত বীজ উৎপাদন করা হবে। দ্বিতীয় বছরেও প্রয়োজনীয় প্রজনন বীজ বিজেআরআই সরবরাহ করবে। পাশাপাশি পাট উৎপাদনপ্রবণ এলাকায় ৩০০০টি প্রদর্শনী প্লট স্থাপন করা হবে এবং উৎপাদিত বীজ বিনামূল্যে পাটচাষিদের মধ্যে বিতরণ করা হবে। তৃতীয় বছর বিজেআরআই এর সরবরাহকৃত প্রজনন বীজ থেকে ৫৯ মেট্রিক টন ভিত্তি বীজ উৎপাদন করা হবে, যা দিয়ে ২ হাজার ৯২৭ মেট্রিক টন প্রত্যয়িত বীজ উৎপাদন করা হবে। একই সাথে ৩ হাজারটি প্রদর্শনী প্লট স্থাাপন করা হবে এবং উৎপাদিত বীজ বিনামূল্যে পাটচাষিদের বিতরণ করা হবে। চতুর্থ বছর একইভাবে বিজেআরআই এর সরবরাহকৃত প্রজনন বীজের মাধ্যমে ৫৯ মেট্রিক টন ভিত্তি বীজ উৎপাদন করা হবে, যা দিয়ে দেশের মোট চাহিদার শতভাগ প্রত্যয়িত বীজ উৎপাদন করা সম্ভব হবে। এই বীজ ভর্তুকি মূল্যে প্রতিকেজি ১০০ টাকা দরে পাটচাষিদের কাছে বিক্রি করা হবে। এ বছরেও ৩০০০টি প্রদর্শনী প্লট স্থাাপন করা হবে।

রোডম্যাপ অনুযায়ী সর্বশেষ পঞ্চম বছরে ৫৯ মেট্রিক টন ভিত্তি বীজ উৎপাদনের মধ্য দিয়ে শতভাগ প্রত্যয়িত বীজ উৎপাদনে দেশের সক্ষমতা নিশ্চিত করা হবে। এ পাটবীজও ভর্তুকি মূল্যে ১০০ টাকা কেজি দরে পাটচাষিদের কাছে বিক্রি করা হবে।

কৃষকের দীর্ঘদিনের চাষাবাদের অভ্যাসের কারণে বর্তমানে বাইরে থেকে যে পাটবীজ আমদানি করা হয় তার বেশির ভাগই তোষা পাট জেআরও-৫২৪ জাতের। বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট ইতোমধ্যে পাটের জীবন রহস্য উম্মোচন করেছে। সেই প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিজেআরআই এর বিজ্ঞানীরা ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে তোষা-৮ (রবি-১) নামে পাটের একটি নতুন জাত অবমুক্ত করেছে। এর ফলন জেআরও-৫২৪ জাতের পাটের চেয়ে ১০-১৫ ভাগ বেশি।

আগে কৃষকরা পাটক্ষেতের কিছু অংশের পাট বীজ উৎপাদনের জন্য রেখে দিত। এই পদ্ধতিতে বীজ সংগ্রহে সময় লাগত ১০-১১ মাস। এ সমস্যা সমাধানে বিজেআরআই নাবি পাট বীজ উৎপাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। এ প্রযুক্তির মাধ্যমে বছরের সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর, এই ৪ মাসে উন্নতমানের বীজ উৎপাদন করা সম্ভব। এ প্রযুক্তিতে তিন পদ্ধতিতে পাট বীজ উৎপাদন করা হয়। এগুলো হলো: ১) সরাসরি বীজ বপণ পদ্ধতি; ২) কাণ্ড ও ডগা রোপণ পদ্ধতি এবং ৩) চারা রোপণ পদ্ধতি।

সরাসরি বীজ বপন পদ্ধতিতে দেশি পাটের বীজ মধ্য জুলাই থেকে মধ্য আগস্ট এবং তোষা পাটের বীজ মধ্য জুলাই থেকে ৩০ আগস্টের মধ্যে বপন করতে হবে। জমিতে সারি করে বপন করলে প্রতি এক শতাংশ জমিতে ১৬-১৭ গ্রাম তোষা এবং ২০ গ্রাম দেশি বীজ বপন করতে হয়। ছিটিয়ে বপন করলে প্রতি এক শতাংশে ২০ গ্রাম তোষা এবং ২৪ গ্রাম দেশি পাটের বীজ বপন করতে হয়।

কৃষকের হাতে বপনের জন্য কোনো বীজ না থাকলে ঐ বছর কাণ্ড ও ডগা রোপণ পদ্ধতিতে বীজ উৎপাদন করা হয়। আঁশ ফসলের জমি থেকে গাছের বয়স ১০০ দিনের মতো হলে সুস্থ সবল গাছ বাছাই করতে হবে। বাছাইকৃত গাছের কাণ্ড ও ডগাগুলো ধারালো চাকু বা ব্লেডের সাহায্যে কাটতে হবে। কাটার সময় লক্ষ রাখতে হবে প্রতিটি টুকরার দৈর্ঘ্য যেন ২০-২৫ সেন্টিমিটার হয় এবং প্রতি টুকরায় কমপক্ষে ২-৩টি গিট থাকে। টুকরাগুলো গোড়ার দিকে বাঁকা করে কাটতে হবে। টুকরার বাঁকা অংশ ডগা সংগ্রহ করার দিনই রোপণ করা উত্তম। এছাড়াও পড়ন্ত রোদে ডগা রোপণ করলে ভালো হয়। সারি থেকে সারি দেড় ফুট দূরত্ব রেখে এবং উত্তর দিকে ৪৫ ডিগ্রি কোণ করে টুকরাগুলো রোপণ করতে হবে।

এছাড়াও চারা রোপণ পদ্ধতিতে প্রথমে বীজতলায় বীজ বপন করে সেখান থেকে চারা উৎপন্ন করা হয়। ৩ মিটার দৈর্ঘ্য ও ১ মিটার প্রস্থ আকারের বীজতলায় মধ্য জুন-মধ্য জুলাই মাসের মধ্যে ৫০-১০০ গ্রাম বীজ বপন করতে হয়। বীজ তলার চারার বয়স ২৫-৪০ দিন হলে চারাগুলো রোপণের জন্য উপযুক্ত হয়। মূল জমিতে বপনের দিন বীজতলা থেকে চারা তুলে নিয়ে প্রথমে ছায়ায় রাখতে হবে। প্রতিটি চারার ডগার ২/৩টি কচিপাতা রেখে অন্যান্য সব পাতার বোটা বাদে বাকি অংশ কাঁচি দিয়ে কেটে দিতে হবে। মূল জমিতে অবশ্যই সারি করে চারা রোপণ করতে হবে। সারি থেকে সারির দূরত্ব হবে ৪০ সেন্টিমিটার এবং চারা থেকে চারার দূরত্ব হবে ১৫ সেন্টিমিটার। মেঘলা দিনে অথবা সন্ধ্যার আগে যখন রোদ থাকে না তখন চারা রোপণ করা ভালো।

এছাড়াও বিজেআরআই উদ্ভাবিত ও উন্নতকৃত অন্যান্য প্রযুক্তিÑ সাথী ফসল বা রিলে ক্রপিং পদ্ধতিতে পাটবীজ উৎপাদন, সরাসরি বীজ বপন পদ্ধতিতে পাটবীজ উৎপাদন, কাণ্ড ও ডগা রোপণ পদ্ধতিতে পাটবীজ উৎপাদন, পাট বীজের সাথে সাথী ফসল হিসেবে সবজি উৎপাদন, পাট বীজ ফসলের সাথে শাকসবজি চাষ পদ্ধতি ইত্যাদি বাংলাদেশের পাটবীজের চাহিদা পূরণ করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। নাবি পাট বীজ উৎপাদন প্রযুক্তিসহ অন্যান্য প্রযুক্তি সঠিকভাবে সম্প্রসারণ করা গেলে কৃষক নিজেই তার প্রয়োজনীয় পাট বীজ উৎপাদন করতে পারবে।

উন্নত পাট বীজ উৎপাদনে স্বনির্ভরতা অর্জনের পথে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। আধুনিক গবেষণাগারসহ এক বা একাধিক বৃহৎ খামার স্থাপন করলে পাটবীজ উৎপাদনে বাংলাদেশ দ্রুত স্বয়ংসম্পূর্ণতার পথে এগিয়ে যাবে। একই সাথে পাট বীজ উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে নতুন নতুন জাত ও প্রযুক্তি উদ্ভাবনে কৃষি বিজ্ঞানীদের চলমান কর্মকাণ্ডও ত্বরান্বিত করতে হবে।

লেখক: বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট।
[email protected]

 


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

ইত্তিহাদেই সিটিকে রুখে দিল ইন্টার

ইত্তিহাদেই সিটিকে রুখে দিল ইন্টার

রোনালদোদের নতুন কোচ পিওলি

রোনালদোদের নতুন কোচ পিওলি

দক্ষিণ আফ্রিকাকে গুড়িয়ে আফগানদের ঐতিহাসিক জয়

দক্ষিণ আফ্রিকাকে গুড়িয়ে আফগানদের ঐতিহাসিক জয়

যেই গৌরব কেবল শারজাহ ক্রিকেট স্টেডিয়ামের

যেই গৌরব কেবল শারজাহ ক্রিকেট স্টেডিয়ামের

রিট করে ‘খেলাপি ঋণ স্থগিত’ বন্ধ চান ব্যাংক-মালিকরা

রিট করে ‘খেলাপি ঋণ স্থগিত’ বন্ধ চান ব্যাংক-মালিকরা

বিদেশি ঋণ ফের ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে

বিদেশি ঋণ ফের ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে

টাকা উদ্ধারের নামে ‘ঘুষ’ চাওয়ার অভিযোগ জিএম শাহজাহান চৌধুরীর’র বিরুদ্ধে

টাকা উদ্ধারের নামে ‘ঘুষ’ চাওয়ার অভিযোগ জিএম শাহজাহান চৌধুরীর’র বিরুদ্ধে

জাতীয় ঐক্য বিনষ্টকারী কর্মকান্ড থেকে বিরত থাকতে হবে

জাতীয় ঐক্য বিনষ্টকারী কর্মকান্ড থেকে বিরত থাকতে হবে

৬০ হাজার টন ইউরিয়া সার কিনবে সরকার, ব্যয় ২৩৬ কোটি টাকা

৬০ হাজার টন ইউরিয়া সার কিনবে সরকার, ব্যয় ২৩৬ কোটি টাকা

আইকনিক লিডার তারেক রহমান ও বাংলাদেশের রাজনীতি

আইকনিক লিডার তারেক রহমান ও বাংলাদেশের রাজনীতি

পতিত স্বৈরাচার ও ভারতের চক্রান্ত চলছেই

পতিত স্বৈরাচার ও ভারতের চক্রান্ত চলছেই

তারেক রহমানের রাষ্ট্রনায়কোচিত বক্তব্য ও দিকনির্দেশনা

তারেক রহমানের রাষ্ট্রনায়কোচিত বক্তব্য ও দিকনির্দেশনা

ইসরাইলের দখলদারিত্ব বন্ধের প্রস্তাব বিবেচনা জাতিসংঘের

ইসরাইলের দখলদারিত্ব বন্ধের প্রস্তাব বিবেচনা জাতিসংঘের

উত্তপ্ত মণিপুরে অত্যাধুনিক অস্ত্র দিয়ে নতুন করে গোলাগুলি

উত্তপ্ত মণিপুরে অত্যাধুনিক অস্ত্র দিয়ে নতুন করে গোলাগুলি

২৭ দেশে ছড়িয়ে পড়েছে করোনার নতুন ভ্যারিয়্যান্ট

২৭ দেশে ছড়িয়ে পড়েছে করোনার নতুন ভ্যারিয়্যান্ট

২০০ হাতি নিধনের সিদ্ধান্ত জিম্বাবুয়ের

২০০ হাতি নিধনের সিদ্ধান্ত জিম্বাবুয়ের

কলেরাসহ মারাত্মক রোগের ঝুঁকিতে সুদানের ৩৪ লাখ শিশু

কলেরাসহ মারাত্মক রোগের ঝুঁকিতে সুদানের ৩৪ লাখ শিশু

১১ হাজার ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থীর প্রাণ গেছে

১১ হাজার ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থীর প্রাণ গেছে

বেলারুশে হামলা হলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবে : লুকাশেঙ্কো

বেলারুশে হামলা হলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবে : লুকাশেঙ্কো

তাইওয়ান প্রণালীতে চীনের যুদ্ধবিমান

তাইওয়ান প্রণালীতে চীনের যুদ্ধবিমান